বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
প্রকৃতির মার বড় তীব্র, বড় আকস্মিক। প্রস্তুতির সময়টুকুও কখনও কখনও মেলে না। নিমেষে তছনছ হয় জীবন-জীবিকা। হাজার হাজার মানুষ, গবাদি পশুর ঠাঁই হয় ত্রাণশিবিরে। সে তো বিপর্যয়। কিন্তু যে বিপদের চরিত্র জানা, আগমনের সময় মোটামুটি নির্দিষ্ট, এবং যোঝার পথটিও এত দিনের অভিজ্ঞতা শিখিয়ে দেয়, সেই বিপদও কি নিশ্চিন্ত থাকতে দেয়?
অসমের ধেমাজি এবং মাজুলি অঞ্চল ভারতের অন্যতম বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে, এখানে জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চলে বন্যার পর্ব। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এই অঞ্চলে বন্যার প্রাবল্য বেশি। অরুণাচলের পাহাড়ের নীচে অবস্থিত হওয়ায় পাহাড় বেয়ে নেমে আসা অতিরিক্ত বৃষ্টির জল প্রতি বছর এই সময়কালের মধ্যে ভাসিয়ে দেয় ধেমাজিকে। ভাসে খেত, গবাদি পশু, ভাসে জনজীবনও। সেই বন্যাপর্বের সঙ্গে এখানকার মিসিং, হাজং জনজাতির মানুষদের পরিচিতি বহু কালের।
সম্প্রতি ধেমাজির মানুষের জীবনসংগ্রাম সরেজমিনে দেখতে সেখানে গিয়েছিল ভারতের নানা রাজ্যের মহিলা সাংবাদিকদের একটি দল। দেখা গেল, বন্যার সঙ্গে দীর্ঘ পরিচয়ের জন্য এলাকার মানুষের প্রস্তুতিও অনুরূপ। গ্রামাঞ্চলে তৈরি থাকে সাংঘর। সাংঘর, অর্থাৎ যে বাসস্থান গড়ে ওঠে মাচার উপরে। মাচার নীচের চার দিক খোলা জায়গায় বাঁধা থাকে গবাদি পশু, অনেকে আবারওই এক ফালি জায়গাটুকুকেই ব্যবহার করেন ভাঁড়ার ঘর হিসাবে। বন্যার জল যখন গ্রামে ঢোকে, তখন মাচার উপরের বাসস্থানটুকু অন্তত যেন নিরাপদ থাকে— এমনই ছিল ভাবনা। গবাদি পশুদের রেখে আসা হয় অপেক্ষাকৃত উঁচু নিরাপদ জায়গায়। আর সম্বৎসরের শস্যটুকু সাংঘরের উপরের অংশে তুলে গৃহস্থরা বন্যার সময়টুকু পার করে দেন।
কিন্তু বন্যা এবং তার সঙ্গে লড়াইয়ের এই চেনা চিত্র আশির দশকের শেষের দিক থেকে ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কল্যাণে। তীব্রতা বাড়ছে বন্যার। বদলাচ্ছে সময়ও। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে যে বন্যার সূচনা হতো জুন-জুলাইয়ে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা ক্রমশ এগিয়ে এপ্রিল-মে মাসেও আঘাত হানছে। জলের উচ্চতা বাড়ছে প্রায় প্রতি বার। ফলে, প্রস্তুতির সময় মিলছে না। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকছে পড়ুয়াদের পড়াশোনা। কূপ-নলকূপ-জলের পাইপ বন্যার জলে ডুবে থাকায় পানীয় জলের তীব্র হাহাকার তৈরি হচ্ছে গ্রামের পর গ্রামে, শৌচালয় ডুবে থাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। এবং মূলত চাষবাসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষদের জমিটুকুর মধ্য়ে বালি ঢেলে নদী ফিরে যাচ্ছে নিজ জায়গায়। বন্যার জলেই ভেসে যাচ্ছে সারা বছর ভাল ভাবে গৃহস্থের বেঁচে থাকার আশাটুকুও।
এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় ধেমাজিতে একযোগে কাজ করছে ইউনিসেফ এবং রুরাল ভলান্টিয়ার সেন্টার নামের অসরকারি প্রতিষ্ঠান। সাহায্য করছে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতও। বছরে ছ’মাস বন্যার জলের তলায় গ্রাম ডুবে থাকার কারণে উদ্ভুত বিভিন্ন সমস্যাগুলির নিরসনে তারা বিভিন্ন গ্রামে তৈরি করেছে ‘রেইজ়ড প্ল্যাটফর্ম’। গ্রামেরই একটা অংশকে বেছে নিয়ে মাটি ফেলে তার উচ্চতা অনেকটা বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। এই অংশের এক পাশে স্থায়ী ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকি অংশ খোলা, যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী অস্থায়ী ছাউনি দিয়ে অনেকের এক সঙ্গে থাকার বন্দোবস্ত করা যায়। সর্বোপরি, এই উঁচু জায়গাতেই বসানো হয়েছে নলকূপ আর তৈরি হয়েছে শৌচালয়, বন্যার জলে যে দু’টির সমস্যা সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করে।
এই প্রকল্প নিঃসন্দেহে খুবই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। শুধুমাত্র যে এখানে থাকা, খাওয়া আর জলের ব্যবস্থার মতো প্রয়োজনগুলির দিকে দৃষ্টি রাখা হয়েছে, তা নয়। মেয়ে এবং শিশুদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে যথাসাধ্য তা সমাধানের চেষ্টাও চলছে। যেমন, বন্যার সময় স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। সেই সমস্যা সমাধানে রেইজ়ড প্ল্যাটফর্মেই শিক্ষকরা বন্যার সময়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অসম সরকার বর্তমানে নিয়ম করেছে প্রতিটি ত্রাণ শিবিরের সঙ্গে বিদ্যালয় থাকতে হবে, তৈরি করতে হবে ‘চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেস’। যদিও, স্থানীয় মানুষদের দাবি, সরকারি ঘোষণার বহু আগে থেকেই ধেমাজি ও মাজুলিতে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার প্রকল্প শুরু হয়ে গিয়েছে ইউনিসেফ এবং আরভিসি-র হাত ধরে। এর পাশাপাশি কাজ করেন আশা এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও। ফলে প্রসূতি ও শিশুর যত্ন, তাদের টিকাকরণ, পুষ্টিকর খাবার প্রদানের কাজটিও চালিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা জারি থাকে। শিশুদের লেখাপড়ার পাঠও মেলে। এক কথায়, বন্যার জলে পরিবৃত হয়ে থেকেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালানোর একটা অভ্যাস তৈরি করেছেন স্থানীয় মানুষ।
তাই কিছুটা হলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জোর পাচ্ছেন ধেমাজির গ্রামবাসীরা। সমস্যা এখনও পুরোপুরি মেটেনি। জীবিকার অভাব তীব্র, বিশেষত কৃষির ক্ষতি তাঁদের বিপন্ন করেছে। এবং বছরে ছ’মাস জলের সঙ্গে যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে নবীন প্রজন্ম অন্য রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনসমাজের বয়সানুপাতিক গঠন, বা ‘ডেমোগ্রাফি’। আবার জনস্বাস্থ্যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। গ্রামগুলিতে হ্যান্ড পাম্পের সাহায্যে জল পাওয়া গেলেও তাতে আয়রনের ভাগ প্রচুর। ফলে, পাত্রের মধ্যে বালি, পাথর, ছাঁকনি বসিয়ে জল পরিশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামবাসীরা। অন্য দিকে, বন্যার সময় দীর্ঘ দিন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে গাদাগাদি করে বাস করায় রোগ সংক্রমণ সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন গর্ভবতী এবং সদ্য প্রসূতিরা। তাই দাবি উঠেছে, তাঁদের জন্য উঁচু চাতাল বা ‘রেইজ়ড প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করে, সেখানে পৃথক ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়ার, যাতে প্রসূতিদের প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা এবং শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর কাজটি নির্বিঘ্নে করা যায়।
তাই সমস্যা রয়েই গিয়েছে। আছে সেই সমস্যাকে কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টাও। জলবায়ু পরিবর্তনের কোপের সঙ্গে লড়ছে ধেমাজি, সীমিত পরিকাঠামো নিয়েও। সেই লড়াইকে কুর্নিশ।