বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

বৈষম্যের বিস্তার ও শ্রমজীবী মানুষ

বৈষম্যের বিস্তার ও শ্রমজীবী মানুষ

কবিতা রায়চৌধুরী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১— বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের অনুসন্ধান আমাদের ঐতিহ্য। কবিও বলে গেছেন ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল এটাই যে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের যে দিকেই তাকাই না কেন বৈষম্যের প্রবল বিস্তার নজরে আসবেই। তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং নানাবিধ সামাজিক বৈষম্য আজকের ভারতবর্ষকে খণ্ড-বিখণ্ড টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। একতার কথা, পারস্পরিক সৌহার্দ্যের বাতাবরণ, জোটবদ্ধভাবে কোনও একটি সমস্যার মোকাবিলা করা ক্রমশই যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। ‘আমিই ঠিক’ বা ‘আমার পথটিই সঠিক পথ’ – বুক বাজিয়ে এই কথা বলে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চলেছেন মানুষ। আমিত্বের ঘনঘটায় চাপা পড়ে যাচ্ছে বহুত্বের কণ্ঠস্বর। দেশটা কারও একার নয়, জাতীয় সম্পত্তিগুলিও প্রত্যেকটি দেশবাসীর কাছে সমানভাবে ভোগ্য, সমাজের সর্বস্তরে সুযোগসাম্যের প্রতিষ্ঠা হওয়া প্রয়োজন, গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নীতি নির্ধারিত হওয়া উচিত সমগ্র জনসাধারণের কথা ভেবেই— কোনও বিশেষ শ্রেণী, ধর্ম বা গোষ্ঠীর জন্য নয়— এই সকল কথাগুলো আলোচিত-পর্যালোচিত হচ্ছে বটে কিন্তু বিশেষ কার্যকরী হচ্ছে না, প্রয়োগ হচ্ছে না সমাজের সর্বস্তরে। বিভেদ-বৈষম্যগুলো বাঁচিয়ে রাখলে দেশ শাসনে বিশেষ সুবিধা হয়- এই সত্য ক্ষমতাসীন সরকার স্পষ্টভাবে বুঝে গেছেন। বিভেদ জিইয়ে রাখার এই রাজনীতি জন্ম দিচ্ছে প্রগাঢ় অসহিষ্ণুতার, পারস্পরিক হিংসার বাতাবরণে রক্তাক্ত হচ্ছেন মানুষ। সবলের হাতে দুর্বলের পীড়ন-শোষণ অব্যাহত গতিতে বেড়ে চলেছে। সকল বিষয়ে উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ ক্লেদাক্ত করছে সামগ্রিক পরিস্থিতি।

২০১৯ সালের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, দেশের সর্ব্বোচ্চ আয়কারীর এক শতাংশের আয় সমগ্র দেশের আয়ের ২১ শতাংশ। এই অঙ্কটি ১৯৯০ সালে ছিল ১১ শতাংশ। সর্ব্বোচ্চ আয়কারী ১০ শতাংশ মানুষের আয় সমগ্র দেশের আয়ের ৫৬ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন আয়কারীর ১০ শতাংশের আয় সামগ্রিক আয়ের মাত্র ৩.৫ শতাংশ। আয়ের এই বিরাট বৈষম্যই যে ভারতবর্ষের উন্নয়নের পথে সর্ববৃহৎ প্রতিবন্ধক সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। আম্বানি, আদানি প্রভৃতি বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠী এবং নিম্নবিত্ত, দরিদ্র ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারি অসংখ্য মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে প্রকট করে তুলছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত, তাঁদের হাতে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করবার মতো পয়সা নেই। বে-রোজগারী, বেকারত্ব এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে এক বৃহদংশের মানুষ ধুঁকছে। কাজের খোঁজে শ্রমিকেরা নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। কর্পোরেটদের দৌরাত্ম্য এবং সরকারের পরিকল্পনাহীনতা এই অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলছে। অতিমারির সময়ে গত দেড় বছরে দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে, কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। দিন-আনি দিন-খাই-এর ধরাবাঁধা জীবনে অভ্যস্ত শ্রমিক, খেতমজুর, হকার, মজদুর, ছোট ব্যবসায়ীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের রুজি-রোজগার প্রায় বন্ধ। তাঁদের শূন্য হাতে কোনও আর্থিক সহায়তা বা অনুদানের ব্যবস্থা করতে পারেননি বা চাননি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। অন্যদিকে আম্বানিদের খুচরো ব্যবসা অতিমারির মধ্যে এই আর্থিক বছরের প্রথম তিনমাসে ৯৬২ কোটি টাকা নীট লাভ করেছে যেখানে গত বছরের প্রথম তিনমাসে এই লাভ ছিল অনেক কম, ৪৩১ কোটি টাকা। তাই বাড়ছে ক্ষোভ, অসন্তোষ, অসহিষ্ণুতা। একথা মানতেই হবে যে মানুষের সঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবধান এক দুর্লঙ্ঘ্য সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে চলেছে।

অর্থনৈতিক অসাম্য ভারতীয় সমাজে যে সংকটের সৃষ্টি করেছে তা ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে বহুমাত্রিক সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে। যেমন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় লিঙ্গবৈষম্য একটি জ্বলন্ত সমস্যা। ভারতীয় সমাজে নারীর অবদমন-শোষণ একটি বহুপ্রাচীন কাল থেকে ঘটমান বিষয়। বৈদিক যুগে নারীকে ‘পাপযোনি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, আজকের আধুনিক ভারতে নারী দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই গণ্য। সমাজে নারীর অধিকার খর্বিত-খণ্ডিত। সমানাধিকারের দাবি, সমকাজে সমবেতন বা সমমজুরির দাবি, সমযোগ্যতায় সমান পদাধিকারের দাবি, শিশুপুত্রের সঙ্গে শিশুকন্যার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সমসুযোগের দাবি সমস্তই আজও সোচ্চারে উচ্চারিত। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সমানাধিকারের দাবি আদায়ে ভারতীয় নারী যতদূর অগ্রসর হয়েছিল তাকে আবার পশ্চাদপসরণের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করে। গৃহাভ্যন্তরই নারীর যথাযোগ্য স্থান, বাইরের জগতে নিরাপত্তার অভাব, খুন-ধর্ষণ-বলাৎকারের এক ভয়ঙ্কর পরিমণ্ডল নারীনিগ্রহের জন্য সদাপ্রস্তুত, তাই ‘সুখী গৃহকোণে’-র আশ্রয়ই নারীর কাম্য— জনমানসে এমনই একটা কথা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে ভারতবর্ষের ক্ষমতাসীন প্রধান রাজনৈতিক দল। কন্যাভ্রূণহত্যা নামক অনৈতিক এবং পাশবিক প্রবৃত্তির মাধ্যমে নারীসত্ত্বার প্রতি বৈরীতার সূত্রপাত; যৌনহেনস্থা, ধর্ষণ বা বধূহত্যার ঘটনা লিঙ্গবৈষম্যকেই প্রতিষ্ঠা দেয়, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যানে এইসব ঘটনার ক্রমবর্ধমান হিসেব প্রকাশিত হচ্ছে। শিক্ষিত কি নিরক্ষর, গ্রাম্য কি শহুরে সমস্ত নারীই এই বৈষম্যের শিকার হলেও শ্রমজীবী মহিলারা বিশেষত যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন তাঁরাই এই বৈষম্যব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বর্তমানের অতিমারির আবহাওয়ায় কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা, গৃহ-পরিচারিকা, খেতমজুর, ছোট দোকানদার ও হকার মহিলারাও। কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার কোনও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাঁদের ন্যূনতম অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা এখনও করতে পারেন নি।

লিঙ্গবৈষম্যের মতো সমস্যাগুলিকে ঘনীভূত করেছে বহুমাত্রিক সামাজিক বৈষম্যের অপরাপর বিভাজনগুলি। যে নারী লিঙ্গবৈষম্যের শিকার সে সমানভাবেই বর্গ বা বর্ণবৈষম্য, শ্রেণীবৈষম্য বা জাতিবৈষম্যের কুফল ভোগ করে। বহুযুগ ধরেই ভারতবর্ষে নারী ও শূদ্রকে সমাজে হীন প্রতিপন্ন করা হয়েছে। চতুর্বর্ণ বিভাজন ভারতবর্ষে এক অভিশাপ। প্রাথমিকভাবে কাজের ভিত্তিতে যে বিভাজন হয়েছিল, সমাজে উচ্চ-নীচ অবস্থানের নিরিখে তা পরিবর্তিত হয়েছে। আজও ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থা অর্থাৎ ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব সমাজে স্বীকৃত। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র— চতুর্বর্ণের অন্য তিন বর্ণের অবস্থান তার পরে। বেদ-পুরাণে শূদ্রকে অন্য তিন বর্ণের সেবক হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে, আজও তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের নিতান্তই প্রান্তিক করে রাখা হয়। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমাজ এই শূদ্ররাই গড়ে তুলেছেন। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি এবং সমাজের মূলস্রোতে প্রবেশের সুযোগের অভাবে দেশের এই বৃহদংশের মানুষ নিপীড়িত-শোষিত-অবহেলিত। কৃষক ফসলের দাম পান না, মজুর তাঁর ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, শ্রমিক কর্মসংস্থানের অভাবে নিজ রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে পাড়ি দেন, অর্থনৈতিক মন্দা গ্রাস করে ছোট ব্যবসায়ীর সামান্য পুঁজি। এভাবেই নানাবিধ অসাম্য-বৈষম্যের মধ্য দিয়ে প্রকটিত জনবহুল এই দেশের বিভেদ কণ্টকিত সমাজবিন্যাস।

বিভেদের যে সর্ববৃহৎ প্রকাশ আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষকে ধ্বস্ত করে চলেছে, দেশের কোনায় কোনায় জ্বালিয়ে দিচ্ছে ধিকিধিকি আগুন তা হল ধর্ম-সম্প্রদায়গত বিভেদ। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে ধর্মের নামে পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল ভারতবর্ষ। ১৯৫০ সালে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে রচিত হল স্বাধীন ভারতের সংবিধান। সংবিধানে স্বীকৃত হল সব মানুষের সমানাধিকার। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন ইংরেজ সরকার সে আগুন নিভল না। স্বাধীনতা উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেই চলল। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বা পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শ প্রাণিত করল না স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে। বর্তমান ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যূত হয়েছে রাষ্ট্রব্যবস্থা। উগ্র-হিন্দুত্বকে লক্ষ্যে রেখে দেশ শাসনের নামে সাম্প্রদায়িকতাকে গভীরভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে নামিয়ে আনা হচ্ছে অত্যাচারের খাঁড়া। সাধারণ মানুষের পোষাক-আশাক, খাদ্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব যেন রাষ্ট্রের উপর বর্তেছে। ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রের অহেতুক নজরদারি জনমানসে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার করছে। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদের মাত্রা— ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে সমাজের মূলস্রোতের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এক বৃহদংশের মানুষকে। ভারতবাসীর একক পরিচিতি বিভক্ত হয়ে পড়ছে হিন্দু-মুসলমান, দলিত-আদিবাসি-অন্ত্যজ শ্রেণীর পরিচয়ে। হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করার কূট প্রকৌশল ক্রমশ প্রান্তিক করে তুলছে অ-হিন্দু, সংখ্যালঘু এবং দলিত-আদিবাসি জনগোষ্ঠীগুলিকে; দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সমস্ত পরিষেবা ও সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক অসাম্যের জাঁতাকলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারী-পুরুষনির্বিশেষে দেশের কোটি কোটি দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ— তাঁদের জন্য ন্যূনতম দৈনিক মজুরি, একশ দিনের কাজের সংস্থান বা ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাও রাষ্ট্র করতে পারছে না।

স্বাধীনতার পরে পরে ১৯৫০ সাল থেকে দেশে যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক কাঠামো অনুসারী সেই পরিকল্পনাগুলো ছিল জনকল্যাণমুখী। আপামর জনসাধারণ উপকৃত হবেন, দেশের কৃষিব্যবস্থা, ক্ষুদ্র ও কুটীরশিল্পের সঙ্গে সঙ্গে ভারী শিল্পগুলিও প্রসারিত হবে, প্রসারিত হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলি, উৎপাদিত পণ্যের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য এবং অন্যান্য পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে, জাতীয় আয় একটি স্থির গতিতে ঊর্ধ্বমুখী হবে, ‘গরীবী হটাও’ শ্লোগান বাস্তবায়িত হয়ে উঠবে এমনই ভাবনা সঞ্চারিত ছিল পরিকল্পনাকারী তৎকালীন সরকারের মনে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা রাজনৈতিক আবর্তের চাপে পরিকল্পনাগুলো দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। ১৯৯০-৯১ সালে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি প্রণয়নের ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসে- লিবারালাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন এবং গ্লোবালাইজেশন (LPG)-এর নামে তা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলোকে সম্পূর্ণ গতিহীন করে দেয় এবং এই সময় থেকেই জনসাধারণের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে পেতে রীতিমত আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে— ধনী আরও ধনী হয়, গরীব হয় দরিদ্রতর। কর্পোরেট এবং বৃহৎ পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে দেশের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থা, উন্নয়নের ভরকেন্দ্র থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগারের ভাবনা। ভারতবর্ষের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার উন্নয়নের যে পথ রচনা করে চলেছেন সেখানে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য কোনও প্রকৃত উদ্যোগ নেই, কৃষিব্যবস্থা অবহেলিত, শিল্পোৎপাদনে মন্দা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক-বীমা যা সাধারণ মানুষের অর্থসঞ্চয় এবং লগ্নির সর্ববৃহৎ পরিকাঠামো, সেখানেও শুরু হয়ে গেছে বিরাষ্ট্রীয়করণের ষড়যন্ত্র। দেশকে অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা যে সব সুপরামর্শ দিচ্ছেন তা-ও গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। একদিকে সংবিধানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা এবং অন্যদিকে কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজিপতিদের অঙুলিহেলনে দেশের অর্থনীতিকে চালিত করা, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের এই দ্বিবিধ নীতি দেশের অসাম্য-বৈষম্যের বিস্তার ঘটাচ্ছে, বিভেদের চোরাবালিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছ সমগ্র দেশবাসীকে। জনমানসে ঘনিয়ে ওঠা তীব্র অসন্তোষ ও বিক্ষোভ অচিরেই গণআন্দোলনের রূপ নেবে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সারা দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলন সেই দিকেই অঙ্গুলিসংকেত করছে। এরকমটা বেশিদিন চলতে পারে না। মানুষ জাগবেই। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে সামিল হবেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.