বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

আন্দোলনের উদযাপন, সন্দেহের উদযাপন

আন্দোলনের উদযাপন, সন্দেহের উদযাপন

কুমার রাণা

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১— উদযাপনের কারণ আছে, সন্দেহেরও। উদযাপনের বাহ্য কারণ, আন্দোলনকারী কৃষকদের দাবি অংশত মেনে নিয়ে কৃষি-বিষয়ক তিনটি আইন প্রত্যাহার করার ঘোষণা। দেশের অন্তত তিনটি রাজ্যের অনেক লোক এই আইনগুলোর বিরুদ্ধে ছিলেন। সে মানুষদের বড় অংশ সম্পন্ন কৃষক বলেই, এবং দেশের অন্য প্রান্তগুলোতে যাঁরা কৃষক বলে পরিচিত তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনের মূল সমর্থনভিত্তিটা আলাদা বলেই তাঁদের অসন্তুষ্টি ও বিরোধিতাগুলো অবৈধ হয়ে যায় না। তাঁদের বর্ষকাল ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাবার মতো, সরকারের পাতা নানা ফাঁদ ও যাবতীয় অত্যাচার সামলে আন্দোলন টিকিয়ে রাখা এবং তাকে উত্তরোত্তর বলবান করে তোলার মতো রসদ ছিল বলেই তাঁদের আন্দোলনের গুরুত্ব বিন্দুমাত্র খাটো হয়ে যায় না। বরং তাঁদের এই আন্দোলন ভারতীয় সমাজের একটা অন্যতর স্বরূপকে তুলে আনল: সমাজের তুলনামূলকভাবে সুবিধজনক আর্থিক-সামাজিক অবস্থানে থাকা অংশের মানুষদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের ওপর বিজেপি সরকারের ভয়াবহ অপশাসন আটকানোর জন্য অনেকটা জমি প্রস্তুত করে দিল।
উদযাপনের এটা হল আন্তরিক কারণ: ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করতে পারার সম্ভবপরতার দিকটি উঠে আসা। (ফ্যাসিবাদ শব্দটা নিয়ে কারো কারো দ্বিমত আছে; ভারতে এখন যেটা চলছে তাকে রাজনৈতিক ব্যাকরণ বই অনুযায়ী ফ্যাসিবাদী বলা যাবে কি না, অনেকে সেই তর্কটাকেই অধিক জরুরি মনে করেন; অবশ্য সে-কারণে ফ্যাসিবাদ তাঁদেরও কোনও ছাড় দিতে স্বাভাবিকভাবেই নারাজ।) বিজেপি-র ভাবাদর্শেই গণতন্ত্রের স্থান নেই। ভারতবর্ষকে একটি কল্পিত হিন্দু রাজতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষে যেমন অগণতন্ত্রই হাতিয়ার, তেমনি, এবং সেই লক্ষ্যের পরিপূরক হিসেবেই মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির কাছে সারা দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেওয়ার জন্যও গণতন্ত্রের হত্যাই হচ্ছে একমাত্র পথ। এই দ্বিবিধ আক্রমণে ভারতবর্ষের মুসলমান, দলিত, আদিবাসী, শ্রমজীবী মানুষ, এবং তাঁদের হয়ে কথা বলা, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো যাবৎ চিন্তাশক্তিসম্পন্ন লোকেদের বিরুদ্ধে বিজেপির সর্বৈব আক্রমণের কালে যখন সারা দেশ চোখে অন্ধকার দেখছে, ঠিক সেই সময় কৃষকদের এই আন্দোলন একটা বিশেষ তাৎপর্যকে তুলে ধরেছে: সেটা হল সম্ভাবনার। যে-কোনও সংকট থেকেই কিছু সম্ভাবনা উঠে আসে, এক্ষেত্রে কৃষক আন্দোলন দেশের সামনে একটা প্রতিরোধের সম্ভাবনাকে প্রশস্ততর করে তুলেছে।
সাধারণ পরম্পরা থেকে আলাদা, কোনও বিশেষ সাংগঠনিক-মতাদর্শগত দল বা গোষ্ঠীর বাইরে থেকে একটা ভিন্নতর সাংগঠনিক, এবং মতাদর্শগতও বটে, প্রতিরোধের নির্মাণটা কৃষক আন্দোলন উদযাপনের আন্তরিক কারণটাকে আরো জোরালো করে তোলে। সময়টা গুরুত্বপূর্ণ: এই আন্দোলন এমন সময়ে উঠে এল, যখন দক্ষিণপন্থী-বামপন্থী, দুর্বল মতাদর্শের আঞ্চলিক ও ব্যক্তিনির্ভর দলগুলো ফ্যাসিবাদী কর্মসুচিটাকে আটকানোর কোনও উপায় বের করতে অপারগ হল; প্রতিরোধের প্রয়োজনটা ছিল তীব্র, এবং ভারতের অন্তরে বহমান প্রতিবাদী ধারা এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উন্মুখ ছিল। অথচ, এককভাবে এই শক্তির মোকাবিলা করা সম্ভব নয় জেনেও দেশজোড়া কোনো সমন্বয়মঞ্চ গড়ে তোলার ব্যাপারে এই দলগুলো উদ্যোগী হতে পারল না। একের পর এক শ্রমিক-বিরোধী আইন, পরিবেশ-বিরোধী কার্যকলাপ, মুসলমান ও দলিতবিদ্বেষী আক্রমণ, আদিবাসীদের অস্তিত্ব-বিপন্নকারী পদক্ষেপ, বুদ্ধিচর্চাকে কারারুদ্ধ করা, ইত্যাদির প্রতিরোধে বাক্যস্ফুরণ করার সাহসটুকুও দেখাতে পারল না। উত্তর ভারতের কৃষকদের দাবির মধ্যে দিয়ে ভারতের এই মুহূর্তের গণতান্ত্রিক প্রয়োজনটাও একটা রূপ পেল। এটা ভারতবর্ষের একান্ত সমস্যা নয়: পৃথিবীর নানা প্রান্তে পরম্পরাগত রাজনীতিতে নিরান্দোলনের স্বাচ্ছন্দ্যে এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে বলেই ঘোর মানবতাবিরোধী অতি-দক্ষিণপন্থার শিকড় গভীরতর হবার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু, মানব-প্রকৃতির মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিকশিত হওয়া চিন্তা দৃশ্যমান এই রাজনীতির পরম্পরাকে অস্বীকার করে এগিয়ে যাবার পথ খুঁজে নেয়। নিচ্ছেও। সিঙ্ঘু সীমান্তের প্রতিরোধ এই প্রতিবাদী মানব-প্রকৃতিরই একটা প্রকাশ।
উদযাপনের পাশাপাশি সন্দেহের কারণগুলোও গুরুত্ব দাবি করে। ইতিমধ্যেই অনেকেই খুব সঙ্গতভাবেই সন্দেহের কিছু কারণকে তুলে ধরেছেন। নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীর কাছে মার্জনা চেয়েছেন, কিন্তু তার কারণটা নয় যে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে কৃষি আইনগুলো ভুল ছিল, কারণটা এই যে, তিনি কৃষকদের এই সব আইনের সুফল বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অস্যার্থ, ব্যর্থতাটা তাঁর নয়, কৃষকদের; তাঁরা আইনের সম্ভাব্য সুফলগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। যিনি বিজেপি-র অগণতন্ত্রে লালিত, যিনি গুজরাটে নিহত মুসলমানদের জন্য শোকপ্রকাশটাকে কুকুর বিড়ালের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশে নামিয়ে আনতে লজ্জা পান না, আন্দোলনের সমর্থনকারীদের আন্দোলনজীবী বলে ব্যঙ্গ করতে অকুন্ঠ, তিনি তো কেবল লোকমাত্র নন – একটা ব্যবস্থা, ঘোর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, সত্যবচনের সঙ্গে যে ব্যবস্থার আজন্ম বৈরিতা, মিথ্যা যার সহজাত, আর মানুষকে কীটপতঙ্গের মতো মেরে ফেলাটা যার কাছে একটা খেলা মাত্র। সুতরাং, সন্দেহ থেকেই যায় যে, এই ব্যবস্থা অচিরেই একটা আরো নিপীড়নমূলক, আরো মানব-বিদ্বেষী, আরো সভ্যতা-বহির্ভুত পদক্ষেপ নেবে। হয়তো বা কৃষি আইন প্রত্যাহার আসলে প্রতিবাদী কৃষকদের তাঁদের সহনাগরিকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবার একটা কৌশলমাত্র। এ ব্যবস্থা জানে, আন্দোলন চালিয়ে যাবার মতো জোর সব গোষ্ঠীর নেই, বিপুল শ্রমজীবী জনতার পক্ষে লাগাতার আন্দোলন জারি রাখাটা কঠিন, সুতরাং যে কৃষক আন্দোলন সারা দেশের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে সিঙ্ঘু সীমান্ত বরাবর জড়ো করে ফেলেছিল, সেই আন্দোলনের একটা কৌশলী পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারলে, আসন্ন নির্বাচনগুলো শুধু নয়, পুঁজিবাদী হিন্দু ভারতের লক্ষে আরো কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়া যাবে। যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন দিয়ে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ দখল করে, কৃষক আন্দোলন সেই বিভাজনের সুযোগকে সংকীর্ণ করে দিতে পেরেছিল, কিন্তু, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির মুখ যোগী আদিত্যনাথের চেষ্টায় কসুর নেই। কৃষক আন্দোলন প্রত্যাহার করাতে পারলে সেই চেষ্টা আরো জোর পাবে। এছাড়াও অনেক কূটকৌশল ও ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার আশঙ্কা থেকেই যায়।
সুতরাং সন্দেহ থাকবেই, এবং সেটাকে জোর করে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। সেগুলোকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্লেষণ করতে হবে, এবং কৃষক আন্দোলন যে ভারতীয় গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে তাকে কাজে লাগাতে হবে। সন্দেহ আমাদের সমস্যাগুলোকে দেখতে শেখায়, পুংখানুপুংখরূপে বিচার করতে শেখায়। সেই বিবেচনা থেকেই একদিকে যেমন বিজেপি ফ্যাসিবাদী চরিত্রটা স্পষ্ট হয়, তেমনি আবার স্পষ্ট হয় দেশের দলীয় রাজনীতির মতাদর্শগত দেউলিয়া দশাটাও। যার কারণে একদিকে ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রভাবটা বিভিন্ন আঞ্চলিক ক্ষত্রপদের মধ্যে প্রকটতর হয়ে উঠছে। বিহারে নীতিশকুমার, অন্ধ্রে জগন রেড্ডি, তেলেঙ্গানায় চন্দ্রশেখর রাও, পশ্চিমবাংলায় মমতা ব্যানার্জি, উড়িষ্যায় নবীন পটনায়েকের মধ্যে দিয়ে ভারতে আঞ্চলিক শাসনের যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রূপটা উঠে এসেছে তা কার্যত বিজেপির ফ্যাসিবাদী ভাবাদর্শকেই মদত যোগায় – যতই কেন না তাদের মধ্যে মমতা ব্যানার্জির মতো কেউ কেউ বিজেপি বিরোধিতায় সরব হোন না কেন।
বিজেপি দ্রুত শেখে। যে হাতিয়ার মমতা পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনে কুন্ঠাহীনভাবে ব্যবহার করেছিলেন, বিজেপি তার অন্যান্য, এবং প্রচণ্ড রকমের বিধ্বংসী, হাতিয়ারগুলোর সঙ্গে এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের হাতিয়ারটাকেও ত্রিপুরায় কাজে লাগাচ্ছে। অন্যান্য ক্ষত্রপরা আবার ভিন্ন কৌশল নিয়ে চলেছে, হয় বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার কৌশল, অন্ততপক্ষে বিজেপি-বিরোধিতায় শামিল না হওয়া। অন্যদিকে কংগ্রেস দল কখনো উগ্র জাতীয়তাবাদ, কখনো ব্রাহ্মণ্যবাদের শরণ নিয়ে, এবং সংগঠনকে কার্যত টুইটারের হাতে সঁপে দিয়ে, নিজের এবং দেশের ভবিষ্যতকে সমস্যা সংকুল করে তুলছে। একদা তারা ঘোড়া কেনাবেচাকে যে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, আজ সেই শিল্পকর্মই বিজেপি এসে টাঙ্গিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাদের দেওয়ালে। বামপন্থীদের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। সিঙ্ঘু সীমান্তে তাঁদের সক্রিয়তা লক্ষণীয়, এই স্বীকৃতিটির সঙ্গে সঙ্গে এটাও চোখ এড়িয়ে যায় না যে, বিজেপি-বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামে তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার যে প্রয়োজন ছিল, তাঁরা সেই প্রয়োজনটাকে যথাযথ সম্মান দিতে পারেননি। মতাদর্শহীন ক্ষত্রপদের নৈতিকতাবর্জিত রাজনীতির সামনে তাঁরা কেন একটা সুনীতির বার্তা তুলে ধরতে পারলেন না, সেটা তাঁরা কতটা ভেবে উঠতে পারবেন, সেটাই একটা ভাবনার বিষয়। আশার কথা, সারা পৃথিবী জুড়ে একটা ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই জোরালোভাবে উঠে এসেছে। লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপ এখন নতুন নতুন সংগ্রামের নির্মাণভূমি। খোদ আমেরিকার শ্রমজীবীরা নেমে পড়েছে হাজার হাজার ধর্মঘট ও প্রতিরোধে। বিশ্ব আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে।
ভারতকে সেই বিশ্বের কাছে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের সন্দেহকে উদযাপন করতে হবে। কৃষক আন্দোলনের উদযাপন মানে সন্দেহেরও উদযাপন, ভবিষ্যৎ পথ খোঁজার এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতির উদযাপন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.