বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১— মহাত্মা সম্পর্কে আমি এতই কম জানি যে, তাঁকে নিয়ে একটা গোটা বক্তৃতা করার মতো অসম্ভব প্রস্তাবে রাজি হওয়ার মধ্যে কতটা মূঢ়তা আছে আর কতটা দুঃসাহস তা বলা কঠিন। তাই অজ্ঞানতাকেই সম্বল করে কিছু কথা বলব। মহাত্মার মাপ বিরাট, বিপুল তাঁর কর্মকাণ্ড, সে-কারণে, যে কোনো বৃহৎ মানুষের মতোই, মহাত্মাও ভিন্ন ভিন্ন লোকের চোখে আলাদা আলাদা ভাবে ধরা দেন। মানুষ তাঁকে খণ্ড খণ্ড ভাবেই পায় – অন্তত আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাদের মনে মহাত্মার কোনো অখণ্ড স্বরূপ ছায়া ফেলে বলে মনে হয় না। এটাই হয়তো তাঁর মাহাত্ম্য – অনেকের ভাবনায় অনেক মহাত্মা মিলে এক বড় মহাত্মা গড়ে ওঠেন। মহাত্মার সঙ্গে বহুল মানুষের এই বহুল সম্পর্ক নিয়েই আজ কিছু কথা বলব।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তাঁর মহাত্মা নামটি পেয়েছিলেন এই বাংলায় – রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। তাঁর জীবনের বড় ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই প্রদেশ – বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ তথা অখণ্ড বাংলা। বিশেষত ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে সৃষ্ট দাঙ্গা নিবারণে বাংলায় তাঁর কর্মকাণ্ড যে বিস্মৃত হয় তার বড় মহাপাতক আর কেউ নেই। তা সত্ত্বেও, স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর আমাদের রাজ্যে মহাত্মার ছবিটা ক্রমশ ফিকে। আমরা যতদিনে স্কুলে পড়তে যাচ্ছি, স্বাধীনতার দেড়-দুই দশক পর ততদিনে এ রাজ্যে মহাত্মা আর নায়ক নন। আমরা তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ পাইনি। যদিও তাঁর রচনাবলী বাংলায় প্রকাশিত, অসামান্য তর্জমা করেছিলেন সতীশ দাশগুপ্ত – সে সব পড়বার প্রয়াস পাই যৌবন অতিক্রান্ত হবার পর। আমরা বড় হয়ে উঠেছি বামপন্থী পরিমণ্ডলে, সেই আবহে মহাত্মাকে নিয়ে চর্চার ব্যাপকতা ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে যে পরিচয় ঘটল, সেটা কতকগুলো ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে।
দীর্ঘ দিন পাটনায় থেকেছি। সেখানে গান্ধী সংগ্রহালয়ে বামপন্থী, বিশেষত নকশালপন্থীদের অনেক মিটিং হতো। রজি আহমদ ছিলেন তার পরিচালক। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা আপনিতো অহিংস, তা সহিংস রাজনীতির লোকেদের মিটিং করতে দেন কেন? রজি ভাই একটু তাকিয়ে বললেন, আমার গান্ধী আমাকে এরকমটা শিখিয়েছেন – কারো পথে বাধা হবার দরকার নেই, তুমি শুধু তোমার পথটা থেকে বিচ্যুত হয়ো না। আর একবার দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয় আদ্যন্ত গান্ধীবাদী শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে– বর্ধমানের কলা নবগ্রামে। ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আচ্ছা আপনিতো গান্ধীবাদী, তা আপনার “জিন্না, পাকিস্তান/নতুন ভাবনা” বইতে আপনি জিন্না সম্পর্কে এত সপ্রশংস হলেন কী করে? উত্তরে বলেছিলেন, আমার গান্ধী আমাকে এমনটাই শিখিয়েছেন: যাকে সত্য মনে করবে সেটাই বলবে।
আবার ভারতের স্বাস্থ্য আন্দোলনে, নতুন পথের এক অন্যতম দিশারী ডাক্তার অভয় বাং-এর লেখায় পড়ছি, তিনি তাঁর গান্ধীকে পেয়েছিলেন, কীভাবে সবচেয়ে দুঃখী মানুষটির মুখ স্মরণে এনে বাধার পাহাড় ডিঙ্গোতে হয়। সব পরীক্ষাতেই যিনি প্রথম হয়েছিলেন, যিনি বিশ্বের তথাকথিত আকর্ষক হাসপাতালগুলোতে বা কোন প্রশাসনিক ক্ষমতাকেন্দ্রে সহজেই অধিষ্ঠিত হতে পারতেন, সেই মানুষটি কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন, দরিদ্র, সুযোগবঞ্চিত আদিবাসী অধ্যুষিত গড়চিরৌলিকে। তাঁর গান্ধী তাঁকে এমনটাই বেছে নিতে শিখিয়েছিলেন।
“আমার গান্ধী” কথাটা আমার মনে গেঁথে গেল। তার মানে মহাত্মা আলাদা আলাদা লোকের নিজস্ব ব্যাপার? এই সময়েই, আশ্চর্য সমাপতন, হাওড়া স্টেশনে সর্বোদয় বুক স্টলে মহাত্মার জীবনীলেখক ডি জি টেণ্ডুলকরের লেখা একটা বই পেলাম – “গান্ধী ইন চম্পারন”। সেই বই থেকেই আপনাদের কাছে অনেকখানি বলব। কারণ, এতদিনে, বামপন্থী রাজনীতির সংকটের কারণ ও তা থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে গিয়ে আমিও একরকম করে আমার গান্ধীকে পেয়েছি।
“উইক” পত্রিকার ২০১৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় অমর্ত্য সেন একটা ছোট প্রবন্ধ লিখেছিলেন: “চেরি পিকিং গান্ধী” শিরোনামে। সেখানে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, সবার কাছ থেকে সব কিছু নিতে হবে – তা নয়। যার কাছ থেকে যা নেবার ততটুকুই নেব, কিন্তু তাঁর বক্তব্যে ভুল কিছু আছে বলে তাঁকে পুরোটা ফেলে দেব না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, প্রাচীন গ্রিসে শিশুদের মানুষ করতে পারবে না এমন মা-বাবাদেরকে তাদের সন্তানদের নগরের বাইরে ফেলে দিতে হত, কিন্তু অ্যারিস্টটল এই প্রথার বিরোধিতা করেননি। আবার হিউম মনে করতেন, আফ্রিকীয়রা কম বুদ্ধির অধিকারী। তা বলে মানব সভ্যতার বিকশে এঁদের অবদানগুলোকে বিসর্জন দিতে পারি না। গান্ধী সম্পর্কেও তাঁর সেই মত। তিনি নিখুঁত নন বলে তাঁর কাছ থেকে আমরা যা পেতে পারি তা নিতে অস্বীকার করা একটি ভ্রান্তি। “গান্ধী ইন চম্পারন” বই থেকে আমিও আমার গান্ধীকে নিলাম। কীভাবে নিলাম, সেটা অন্যত্র লিখেছি, কিন্তু এখানে আবার বলা দরকার।
এক শতাব্দী আগে হাওড়া স্টেশন থেকে পটনার ট্রেনে উঠলেন রাজকুমার শুক্লা। সঙ্গে তাঁরই মতো গেঁয়ো চেহারার, খাটো ধুতি পরা, ইন্দ্রলুপ্ত, পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক পুরুষ। লোকটাকে ধরবার জন্য কত চেষ্টাই না করেছেন রাজকুমার। এ চেষ্টা যতখানি বিহারি কৃষকের অদম্য জেদের ফল, তার চেয়ে বেশি বোধ হয় জন্ম-জন্ম ধরে অর্জিত লোকপ্রজ্ঞায় এই ‘লোকটিই ঠিক লোক’ বোধে উপনীত হওয়ার পরিণতি। ভরসা খুঁজে ফেরা রাজকুমার মানুষটিকে দেখে ভরসা পেয়েছেন।
বিহারের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে নেপাল সীমান্তবর্তী জেলা চম্পারণ, সেখানকার নরকটিয়াগঞ্জ স্টেশন থেকে সাত মাইল পথ হাঁটলে তাঁর গ্রাম মুরলি ভারওয়া। গ্রাম থেকে গেছেন লখনউ; কংগ্রেস অধিবেশনে, চম্পারণে রায়তদের উপর নীলকরদের ভয়াবহ অত্যাচারের সুরাহা খুঁজতে। তৎকালীন কংগ্রেসের দিকপাল সব নেতা, লোকমান্য টিলক, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য-র কাছে সবিনয় নিবেদন, চম্পারণের রায়তদের জন্য কিছু করুন। ‘আগে দেশের স্বাধীনতা, তার পর অন্য সমস্যার সমাধান, এখন এ সব শোনার সময় কোথায়?’ রাজকুমারের হতাশা শেষ সীমায় পৌঁছনোর আগে আগেই লোকটিকে দেখলেন। এঁর কথা খানিক শুনেছেন, গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। কিন্তু, শীর্ণ, দেহাতি চেহারার, সাধারণের মধ্যে মিশে থাকার অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল মানুষটিকে নিজের চোখে দেখার পর রাজকুমার নিশ্চিত হন, ‘এঁকেই দরকার’। সরাসরি সনির্বন্ধ অনুরোধ: চম্পারণের নীলচাষিদের দুর্দশার কথাটা আপনি জনসমক্ষে তুলে ধরুন। প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন, ‘নিজের চোখে না দেখে আমি কোনও কথা বলব না।’ ‘তা হলে নিজের চোখে দেখে আসবেন, চলুন।’ তিনি কথা দিলেন পরের বছর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ চম্পারণ যাবেন। কিন্তু রাজকুমারের তর সয় না, তাঁর পিছু ধরে চললেন কানপুর, সেখান থেকে আমদাবাদ, অবশেষে কলকাতা থেকে তাঁকে সঙ্গে করে চলা। সে যাত্রা শুরু হল ৭ এপ্রিল ১৯১৭।
পটনায় উঠলেন বিখ্যাত উকিল ও কংগ্রেস নেতা রাজেন্দ্র প্রসাদের প্রাসাদোপম বাড়িতে। রাজকুমার ভেবেছিলেন, সেখানে তাঁদের আতিথ্য জুটবে, জুটেও ছিল, রাজেন্দ্র প্রসাদ বাড়িতে ছিলেন না যদিও। কিন্তু সেই আতিথ্যের সঙ্গে মিশে ছিল জাতপাত, শ্রেণী এবং পদমর্যাদাজনিত বিভাজনের অমানবিকতা। রাজকুমারের সঙ্গীর কাছে এগুলো নতুন নয়, গায়ে মাখেননি। তাঁর দরকার ছিল স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ। রাজকুমারের ইচ্ছাশক্তি প্রবল, কিন্তু তাঁকে কেউ পাত্তা দেয় না— একে চাষি তায় আবার নেপাল সীমান্তের কোন এঁদো গাঁয়ের বাসিন্দা! অতএব ‘যা করার নিজেকেই করতে হবে’ বলে ধর্মাচরণে গোঁড়া হিন্দু মানুষটি আতিথ্য নিলেন বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা মজহারুল হকের। ধর্মাচরণ ব্যক্তিগত ব্যাপার, সামাজিক পরিসরে তার অনুপ্রবেশ তাঁর কাছে অনাকাঙ্ক্ষিতই শুধু নয়, প্রতিরোধ্য একটা ব্যাপার। এই বোধেই অল্প কিছু দিন পর যখন চম্পারণে নীলচাষিদের কথা শোনা হচ্ছে, তখন সেখানে তিনি কংগ্রেস নেতাদের আলাদা আলাদা রান্নার ব্যবস্থা তুলে দিচ্ছেন: তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক কংগ্রেস নেতা-কর্মী হাজির হন চম্পারণে, কিন্তু তাঁদের অনেকেই সঙ্গে রান্নার ঠাকুর নিয়ে গিয়েছেন! জাতপাতের ভিন্নতাকে ভেঙে তিনি চালু করলেন এক হাঁড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা।
কিন্তু তিনি তো কেবল সমাজ সংস্কারক নন, আদ্যন্ত রাজনীতিকার। এবং রাজনীতিবিদ বা রাজনীতিজ্ঞই নন শুধু, ব্যবহারিক রাজনীতিই তাঁর জীবন। সে রাজনীতিকে তিনি উত্তীর্ণ করলেন প্রকৃতই লোক-রাজনীতির চূড়ায়। যে কালে বাগ্মিতাই জননেতা হওয়ার পূর্ব শর্ত, যিনি যত প্রলম্বিত/উত্তেজক/আবেগঘন ভাষণ দিতে পারেন, তিনি তত বড় নেতা, সেই সময়কে বিভাজিত করলেন এই আপাত-বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার মানুষটি: তাঁর রাজনীতি আশ্রিত হল, বলা নয়, শোনার ওপর। ‘লোকেদের কথা শুনতে হবে, সে কথা যতই অগোছালো, পুনরাবৃত্তি বা অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট হোক না কেন।’ কথা শোনাটাই হয়ে উঠল একটা মস্ত অঙ্গীকার। জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা, সুখ-আনন্দের অংশীদারির ভিতর দিয়ে তাঁদের দিশারি হয়ে ওঠার আত্মপ্রতিশ্রুতি। শ্রবণ একটি গুণমাত্র নয়, তা একটি শর্ত: দেশ-জাতির উন্নতি ঘটানো যদি রাজনীতির উদ্দেশ্য হয়, তা হলে দেশবাসীর কথা শুনতেই হবে। দেশ তো কোনও বিচ্ছিন্ন, বিমূর্ত সত্তা নয়, লক্ষ কোটি নিরন্ন, অবদমিত, প্রথা-শৃঙ্খলিত মানুষকে নিয়েই দেশ। সে দেশের স্বাধীনতা তো কেবল ক্ষমতার হস্তান্তর নয়, আসলে তো তা জনসাধারণের শৃঙ্খলমুক্তি। সে উদ্দেশ্য সাধনে, কান পেতে, মনোযোগ দিয়ে শোনার ভূমিকা যে কতটা নির্বিকল্প, তার ফলিত রূপ দেখা গেল ১৯১৭-র গ্রীষ্মে— চম্পারণে।
রাজকুমার শুক্লার সঙ্গীটি সে দিন বিখ্যাত কেউ নন, কিন্তু শুক্লা তাঁকে যে ভাবে চিনে নিয়েছিলেন, সে ভাবেই তাঁকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল তিরহুত-এর জনতা। পটনা থেকে ট্রেনে মুজফ্ফরপুর নামামাত্রই জনতা হয়ে উঠল তাঁর সঙ্গী। সেখান থেকে মোতিহারি, তৎকালীন চম্পারণ জেলা সদর, অধুনা পূর্ব চম্পারণ জেলার মুখ্যালয়। দলে দলে রায়তদের আগমন, সারা দিন ধরে চলছে তাঁদের কথা শোনার কাজ, প্রায় সারা রাত ধরে চলছে সেই সব কথার পরীক্ষানিরীক্ষা, বিশ্লেষণ। বড় বড় উকিল, কংগ্রেস নেতা এবং অধ্যাপকরাও তাঁর সঙ্গী, স্বেচ্ছাসেবী। এ রাজনীতি শাসকের অজানা, এবং ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। এ রাজনীতি আপাত-নিষ্ক্রিয়, এতে সরকার বিরোধিতার কোনও উচ্চরব রণধ্বনি নেই, নেই সমালোচনায় বিদ্ধ করার প্রকরণ।
অজ্ঞাতপূর্ব এই অনুশীলনের প্রক্রিয়া, শুধু শুনে যাওয়া। অজানা বলেই শাসকের আতংক দ্বিগুণ হল, এবং অচিরে ঘোষণা করা হল, ‘লোকটাকে চম্পারণ ছাড়তে হবে, ওর এখানে থাকাটা বিপজ্জনক, যে কোনও সময় প্রজাবিদ্রোহ হতে পারে।’ এক পুলিশকর্তা তো বলেই বসলেন, ‘এই কথা-শোনার প্রক্রিয়া ‘শ্রেণীযুদ্ধের সূচনা করবে।’ আদালতে হাজিরা দিয়ে লোকটি শান্তকণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, ‘আইন মেনে চলা নাগরিক হিসেবে আমার প্রথম বোধটা হচ্ছে, আমাকে সরকারি হুকুম মানতে হবে। কিন্তু এ কাজ করতে হলে আমি যাঁদের জন্য এসেছি তাঁদের প্রতি কর্তব্যবোধের বিরুদ্ধেই হিংসার প্রয়োগ ঘটাতে হবে।’ এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না নীলচাষিদের অবস্থা বিষয়ে তাঁর তদন্ত শেষ হচ্ছে, তিনি চম্পারণ ছেড়ে নড়বেন না। এটা যদি আইন ভাঙা হয়, সরকার তাঁকে জেলে পুরুক, তিনি প্রস্তুত।
সে যাত্রায় সরকার পিছু হটে, তাঁকে গ্রেফতার করে না। গ্রেফতার করা কঠিন ছিল, কথা শোনাটাকে অপরাধ হিসেবে দেখানো সহজ ছিল না। অবশ্য যতক্ষণ তিনি কথা শুনছেন, ততক্ষণ সেখানে পুলিশের লোক উপস্থিত থেকেছে। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না, তিনি তো গোপনে কিছু করতে চাননি, বস্তুত রাজনীতির প্রকাশ্যকরণই তাঁর রাজনৈতিক শক্তি। পুলিশ যদি সেই প্রক্রিয়ার সাক্ষী থাকতে চায় থাক, তাতে তাঁর কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যায় পড়ল রাষ্ট্র, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, সচিব— কেউই বুঝতে পারছে না এ লোকটাকে নিয়ে কী করা— সে নিজে তো কিছু বলছে না, কেবল শুনছে। এক বেতিয়াতেই পঁচিশ হাজার রায়তের বয়ান নথিভুক্ত হয়: দশ হাজারের সম্পূর্ণ, বাকিদের আংশিক। শুধু শিবিরে বসে নয়, শোনা হচ্ছে গ্রামে গ্রামান্তরে হেঁটে হেঁটে। বিহারের বৈশাখ মানে বাতাসে আগুন, সেই তাপপ্রবাহের ভিতর দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন মাইলের পর মাইল, আর যেখানেই যাচ্ছেন, উতরোল হয়ে উঠছে জনতা, শুধুমাত্র তাঁকে এক বার চোখের দেখা দেখার জন্য। তত দিনে লোকে জেনেছেন, তাঁদের কথা শোনারও কেউ আছেন। এই প্রতীতিতে তাঁদের শত শত বছর ধরে জমে থাকা শাসক-ভীতি মুহূর্তে অবলুপ্ত। পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা গলা খুলে বলে যাচ্ছেন নীলকরদের অত্যাচারের কথা, এমনকী নীলকর সাহেবের সামনেও।
শুনতে শুনতে তিনি শেখাচ্ছেনও, কী ভাবে শুনতে হয়। এক নীলকর ভেবেছিল রায়তরা তার সামনে অন্তত কোনও অভিযোগ আনবে না, এবং আরও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য অসদুপায়ে কয়েক জনকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে প্রলুব্ধ করেছিল। সে ডাকে, ‘আসুন, নিজের কানে শুনে যান, আমি রায়তদের জন্য কত ভাল ভাল কাজ করেছি।’ আমন্ত্রণ গৃহীত হল। কথা শুরু হল স্তাবকতা দিয়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে জনতা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘মিথ্যা বলছে, ও যা বলছে তার মধ্যে এক ফোঁটাও সত্যি নেই।’ করজোড়ে জনতাকে থামালেন, ‘ওঁকে বলতে দিন। সকলেরই কথা বলার হক আছে। ওঁর কথা শোনার পরে আপনারা আপনাদের কথা বলবেন।’
শোনার পর্ব চলতে থাকল। যিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, চম্পারণে কয়েকটা দিন মাত্র কাটাবেন, সেখানেই তাঁকে ভ্রাম্যমাণ ডেরা গড়তে হল কয়েক মাসের জন্য। ভারতবর্ষের রাজনীতি সাবালক হয়ে উঠল এই কথানুশীলনের প্রক্রিয়ায়।
আর গেঁয়ো চেহারার লোকটি হয়ে উঠলেন লোকনেতৃত্বের প্রতীক। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী থেকে ‘গাঁধীজি’তে পরিণত হওয়াটা বাস্তবিক তাঁর নয়, ভারতবর্ষের উত্তরণ। একশো বছর পরেও তাই চম্পারণ আন্দোলন সমান বা বেশি প্রাসঙ্গিক। আজ কথা শোনার অভ্যাসটাই যেহেতু ভয়ানক ভাবে আক্রান্ত, সেই প্রক্রিয়াটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়টাও অত্যন্ত বেশি। তেমনই জরুরি, মোহনদাসের ‘গাঁধীজি’ হয়ে ওঠার পিছনে রাজকুমার শুক্লার মতো বিহারি কৃষকদের ভূমিকা স্মরণ করা। সেই কৃষককে ঠিক মতো চিনে নেওয়ার ক্ষমতা, তাঁর কথার ভিতর দিয়ে, আচরণের মধ্য থেকে জনসাধারণের অন্তর্বেদনাকে বুঝে নিয়ে রাজনীতির পথ ঠিক করতে পারার ক্ষমতায় যদি গাঁধীজি লোকনেতা হয়ে থাকেন, তবে তাঁকে ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে চিনে নেওয়ার কৃতিত্বটাও রাজকুমার শুক্লার প্রাপ্য। আমার গান্ধী হলেন এই রাজকুমার শুক্লার গান্ধী – পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। আমার গান্ধীকে রাজকুমার শুক্লার থেকে আলাদা করা যাবে না। আমার কাছে আজকের দুর্দিনে এটাই সব চেয়ে বড় শিক্ষা।
আজকের দুঃসময়ে, যখন ভারতবর্ষকে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার মাইল পিছনে, যেখানে বহু ঘামে-রক্তে অর্জিত মানুষের বেঁচে থাকার, কথা বলতে পারার, স্বাধীনতা, নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মাচরণ করার বা না করার স্বাধিকার, নিজের ইচ্ছামতো জীবন ও জীবন চর্যা বেছে নেবার– তা যতই সীমাবদ্ধ হোক না কেন – অধিকার বিপন্ন, তখন যে মানুষটি আমাদের হাত ধরেন, তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। মানুষ যা হতে চায় এবং সেই চাওয়াকে পাওয়াতে পরিণতি দিতে নিজেই নিজেরমতো কর্মোদ্যোগ নিতে পারে – এমন এক স্ব-ক্ষম মানব সমাজ গড়ে তোলা, সবাই জানে, সহজ নয়। শ্রেণী-বিভাজন, নৃগোষ্ঠীভিত্তিক ক্ষমতা-পার্থক্য, লিঙ্গ-বৈষম্য, অঞ্চল-ভাষা-শিক্ষাগত যোগ্যতা-পুষ্টির মান ও পরিমাণ – রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার কাঠামোগত বিন্যাসের অ-সমতা থেকে উদ্ভুত নানা কিছুর বিরুদ্ধে মানুষের যে সংগ্রাম তার অগ্রগতি অনেকখানি নির্ভর করে মানুষের নেতিবাচক স্বাধীনতার প্রসারের ওপর। নেতিবাচক স্বাধীনতা বলতে আমরা বুঝি অন্যের দ্বারা নিহত বা অত্যাচারিত না হওয়ার স্বাধীনতা, নিজের মতপ্রকাশে বাধা না পাওয়ার স্বাধীনতা, সভা-সমিতি সংগঠনে হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকার সাধীনতা, ইত্যাদি। এই স্বাধীনতাগুলি ছাড়া, মানুষের শিক্ষিত হবার, স্বাস্থ্যবান হবার, কর্মে নিয়োজিত হবার, নিজেকে বিকশিত করার মতো ইতিবাচক স্বাধীনতাগুলোর সংগ্রামে অগ্রসর হওয়ার কথা আমরা কীভাবে ভাবতে পারি? তার খণ্ডিত অবয়ব নিয়েও ইংরাজের হাত থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আমাদের যে সীমায়িত গণতন্ত্র দিয়েছিল, যে সংবিধান আমরা র করেছিলাম, যে-সব লোক-প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলতে পেরেছিলাম – সে-সবই আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। জোর করে লোককে “জয় শ্রীরাম”, “ভারত-মাতা-কী-জয়” বলানো, মানুষের খাদ্যাভ্যাস্কে জোর কবলে দেওয়া, স্বাধীন মতপ্রকাশের “অপরাধে” খুন করা, কারারুদ্ধ করা-র যে রীতি গত অর্ধ-দশক জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তা থেকে মুক্তি না পেয়ে মনুষ্যত্ব কীভাবে তার সংজ্ঞা নির্মাণ করতে পারে? আজ যখন মানুষের মৌলিক সত্ত্বাটাই এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে, বাঁ হাত টাকা নেয় আর ডান হাত ঘুষি মারে, কথা বলাটা অপরাধ, কথা শোনাটা বিলাসিতা, মেরে কাজ হাসিল করাটা রাজধর্ম, তখন আমাদের সামনে যে মানুষটি এসে দাঁড়ান তিনি আমাদের মহাত্মা।
তাঁর কিছু বিশ্বাস হয়ে ওঠে আমাদের পাথেয়। যেমন, “ আমি এমন কোনো ভারত চাই না, যেটা হবে একান্তভাবে হন্দু বা খ্রিস্টান বা মুসলমান। আমি সেই ভারত চাই যে ভারত হবে সহিষ্ণু, যেখানে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস পাশাপাশি চলতে পারবে।“ অথবা, “আমি আমার ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে শপথ নিতে পারি। আমি এর জন্য প্রাণ দিতে পারি। কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কিছু করণীয় নেই। ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণ যাতে বজায় থাকে রাষ্ট্র সেটাই নিশ্চিত করবে, তোমার বা আমার ধর্মের প্রতিপালন তার কাজ নয়। এটা প্রত্যেকের এজান্ত নিজস্ব ব্যাপার।”
তাঁর সব কথা আমাদের মেনে নিতে হবে তার কোনো মানে নেই। তিনি নিজেই বলে গেছেন, “আমার পাঠক ও অন্যান্য যাঁরা আম্মার লেখা নিয়ে আগ্রহী তাঁদের আমি বলতে চাই যে, আমার লেখায় পূর্বাপর সামঞ্জস্য দেখানো নিয়ে আমি আদৌ চিন্তিত নই। সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে আমি অনেক ধারণা বর্জন করেছি, আবার অনেক নতুন জিনিস গ্রহণ করেছি। আমার বয়স হয়েছে বটে, তা বলে আমি এমন করি না যে আমার অন্তরের বৃদ্ধি থেমে গেছে, বা দেহের বিলয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের বৃদ্ধিও স্তব্ধ হয়ে যাবে। আমি যা নিয়ে চিন্তিত তা হল মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে সত্যের আহ্বানকে, আমার ঈশ্বরের আহ্বানকে পালন করা। তাই যদি কেউ আমার দুটি লেখার মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখতে পান, এবং তিনি আমার পবিত্রতার ওপর বিশ্বাস রাখেন, তাহলে তিনি যেন একই বিষয়ে বলা পরের বক্তব্যটাকেই গ্রহণ করেন।” এমন অনেক কথা তিনি বলেছেন, যা আদপেই গ্রহণ করা চলে না। যেমন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক। গান্ধী মনে করেছিলেন, “আমার মতো একজন লোক এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, এই ভূমিকম আমাদের পাপের শাস্তি হিসেবে ভগবান কর্তৃক আনীত হয়েছে, বিশেষত অস্পৃশ্যতার যে পাপ তার ফল হিসেবে। বিহারের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে অভিযানের মধ্যে প্রগাঢ় সম্বন্ধ আছে।“ রবীন্দ্রনাথের কাছে এ চিন্তা উদ্ভট। তিনি লিখলেন, “এটা অধিকতর দুর্ভাগ্যজনক এই কারণে যে, আমাদেরই দেশবাসীর এক বৃহৎ অংশ অত্যন্ত সহজেই প্রাকৃতিক ঘটনার এই ধরণের অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেনে নেয়।“ আবার গান্ধী বলছেন, “গান্ধী: না ভেবেচিন্তে কোনো প্রতিজ্ঞা কোরোনা, আর একবার যদি প্রতিজ্ঞা কর, প্রাণ দিয়েও তা রক্ষা কোরো। “ রবীন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল: যদি দেখ প্রতিজ্ঞাটা ভুল, তাহলে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
মহাত্মার চিন্তায় বিপুল স্ব-বিরোধ। অনেক সময়ই তিনি এক পশ্চাদমুখী মতের প্রবক্তা। অনেক সময়ই তিনি অহিংসার সাহায্য নিয়ে বলপ্রয়োগ করছেন।আবার তাঁর সমাজচিন্তায় শ্রেণীবিভাজন গুরুত্ব পায় না, ধনিক শ্রেণীর সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল তাঁর দুঃখীর দুঃখমোচনের স্বপ্ন। জাতি প্রশ্নেও তাই – অস্পৃশ্যতা তাঁর কাছে অসহনীয়, কিন্তু জাতি জাতিবিভাজন তিনি যথাবিধি মেনে চলার পক্ষপাতী। কিন্তু, মানুষকে স্পর্শ করে, তাকে আপন সত্ত্বার অংশ করে নিয়ে, অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে সরব হবার যে শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন, তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর তার সঙ্গে আছে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে নিজেকে মানুষের মনে রেখে যাওয়ার যে নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন – এ শিক্ষা অমূল্য। মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তিনি প্রাণ দিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব, কর্তব্য, তাদের সহ-নাগরিক করে তোলার মধ্যে দিয়েই দেশের নির্মাণের নিশ্চয়তা। মানুষের এই মহাত্মাকেই আমাদের সযত্নে রক্ষা করতে হবে।
মহাত্মার তাঁর মতো হতে পারার কেউ আছেন কি না জানা নেই, কিন্তু রাজকুমার শুক্লারা তো আছেন। কথা শোনার রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই হয়তো আমরা গান্ধীজীর সাধনার ধন, ভারতের বহুত্ববাদী স্বরূপ, তার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, তার সহিষ্ণুতার ধারা, যাকে রক্ষা করার জন্য গান্ধীজী বারংবার অসহি হয়েছেন – তার অন্তরাত্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব। আমাদের সকলকেই হয়ে উঠতে হবে রাজকুমার শুক্লা। কথা শোনার ভিতর দিয়ে গড়ে তোলা যে সভ্যতায় গান্ধীজী জীবন দিয়েছেন, তার পুনরাধিষ্ঠানে রাজকুমার শুক্লার উত্তরাধিকারই ভারতবর্ষের জিয়নকাঠি। গান্ধীজীকে - এক লোক-সামূহিক মহাত্মাকে - পাবার জন্যই আমাদের রাজকুমার শুক্লা হয়ে উঠতে হবে।
২রা অক্টোবর ২০২১ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের আমন্ত্রণে দেওয়া বক্তৃতা