বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

কুম্ভমেলা: ধর্ম যখন শাসকের হাতিয়ার

কুম্ভমেলা: ধর্ম যখন শাসকের হাতিয়ার

কমল দাশ

photo

৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ। হিউয়েন সাঙ এলেন প্রয়াগের কুম্ভমেলায়। তিনি দেখলেন স্বয়ং রাজা হর্ষবর্ধন স্বহস্তে দরিদ্র প্রজাদের দান করছেন। হিন্দু, বৌদ্ধসহ সব ধর্মের মানুষ সেই দান সানন্দে গ্রহণ করছে। তখন কুম্ভমেলা ছিল দানক্ষেত্র। হিউয়েন সাঙ আরো লিখছেন হিন্দুরা কুম্ভমেলায় দান গ্রহণের পাশাপাশি পুণ্যলাভের আশায় গঙ্গায় স্নান করতেন। ধর্ম ছিল নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়। তার আগে গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের লেখাতেও কুম্ভমেলার অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। এর প্রায় দু’শো বছর পর শঙ্করাচার্য নতুনভাবে কুম্ভমেলার সূচনা করলেন। তখন বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের দাপটে হিন্দু ধর্ম কোনঠাসা। বিপন্ন হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের ডাক দিলেন আচার্য শঙ্কর। বেদান্তের নতুন ভাষ্য রচনা করলেন তিনি। সারা দেশ জুড়ে শুরু হল হিন্দু ধর্মের নবজাগরণ। হিন্দু ধর্মের সমস্ত সাধু সন্তদের একত্রিত করার জন্য প্রয়াগেই মহাকুম্ভের আয়োজন করলেন আচার্য শঙ্কর। তিনি চেয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের সব সম্প্রদায়ের মানুষ কুম্ভমেলায় মিলিত হোক। সাধু সন্তদের উপদেশ এবং সান্নিধ্যে সাধারণ মানুষের জীবন সমৃদ্ধ হোক। তখন বিদ্বেষ ছিল না। নদীতে স্নান, সাধু দর্শন এবং তাদের উপদেশ শোনাই ছিল কুম্ভমেলার উদ্দেশ্য। এরপর গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। প্রকার এবং প্রকরণে কুম্ভমেলার চরিত্র গেছে আমূল পাল্টে।
বর্তমান কুম্ভমেলার সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এবারের মহাকুম্ভ পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদের প্রচার মঞ্চ হয় উঠেছে। দশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট এই মেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং যোগী আদিত্যনাথের ছবি পোস্টারে জ্বলজ্বল করছে “Sound of Oneness” স্লোগান। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় সামগ্রিক সংযুক্তি — একদেশ এক ধর্ম। বিভিন্ন আশ্রমের মহারাজরা সান্ধ্যকালীন যে ধর্মকথা সাধারণ মানুষকে বিতরণ করছেন তার সারমর্ম হিন্দুত্ববাদ এবং হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে একটি ধর্ম সম্মেলনকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক মুনাফা ঘরে তোলার এমন মহা আয়োজন সাম্প্রতিক অতীতে মানুষ দেখেনি। অথচ কোটি মানুষের জীবনের সুরক্ষা দিতে যে পরিকল্পনা আবশ্যিক তা ছিল অবহেলিত। মানুষের জীবন রক্ষায় যোগী সরকারের উদাসীনতা নজিরবিহীন।
২৯ জানুয়ারি। রাত সাড়ে বারোটা একটা হবে। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমস্থল লোকে লোকারণ্য। কাঁধে পিঠে ব্যাগ নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ গঙ্গায় ডুব দেওয়ার জন্য অপেক্ষায়। অধিকাংশ নিতান্ত সাধারণ গরীবগুর্বো দেহাতি মানুষ। হয়ত প্রথম বার বাড়ির বাইরে পা রেখেছেন। অনেকেই খালি পায়ে। শীতবস্ত্র যৎসামান্য। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, খিদে তেষ্টা ভুলে, মাঘের কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে গঙ্গার তীরে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে অনেকেই আবার গঙ্গার তীরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। নাগা সন্ন্যাসীদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যাবে এই আশায়। তারপর মৌনী অমাবস্যার ব্রাহ্ম মুহূর্তে গঙ্গায় ডুব দিয়ে আজন্মের পাপ ধূয়ে ফেলবে, এই আশায়। কিন্তু ঘুম তাদের আর ভাঙল না। ঘুমের ঘোরে সন্ন্যাসী আর পুর্ণ্যার্থীদের পায়ের তলায় হয়ে পিষ্ট হয়ে লাশ হয়ে গেল অনেকে। কথাগুলো বলছিলেন মৌনী অমাবস্যার ব্রহ্ম মুহূর্তে ত্রিবেণী সঙ্গমে ডুব দিতে যাওয়া একজন পুর্ণ্যার্থী।
সরকার বলছে ৩০ জন। বিরোধীরা বলছে আরো অনেক। সংখ্যাটা এক-দেড় হাজার হতে পারে। পরের দিন মেলার এক আশ্রমের মহারাজ বলছিলেন, সঙ্গম ঘাটে তখন থিক থিক করছে ভিড়। পা ফেলার জায়গা নেই। এরকম জায়গায় দুর্ঘটনা হলে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা। আসলে যাদের গলায় পরিচয়পত্র ছিল এবং যারা সম্পন্ন ব্যক্তি সরকার তাদের তালিকা দিচ্ছে, অন্যদের নাম গোপন করছে। তাদের লাশ হয় গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে। নতুবা অন্য জায়গায় পাচার করে দিয়েছে। আর একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলছিলেন, স্নান সেরে ফেরার পথে দেখলাম অন্ধকারজড়ানো তটভূমি যেন প্রেতপুরী। কয়েক ঘন্টা আগের ভিড়েঠাসা জায়গাটি ফাঁকা ফাঁকা। পুলিশের আনাগোনা। অ্যাম্বুলেন্সের সুতীব্র সাইরেন। ভোরের আলোয় দেখতে পেলাম চারিদিকে হাজার হাজার ব্যাগ, কম্বল, চাদর, জুতো ইতস্তত ছড়িয়ে। আর স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদে প্রয়াগের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।
১৬ জানুয়ারি। নিউ দিল্লি স্টেশন। মধ্য রাত। কুম্ভমেলায় যাওয়ার জন্য এলাহাবাদের ট্রেন ধরতে মানুষের ঢল নেমেছে। ভিড়ে থিক থিক করছে রাজধানীর অতিব্যস্ত রেল স্টেশন। প্ল্যাটফর্মে তিল ধারণের জায়গা নেই। স্টেশনের মাইকে প্রয়াগরাজ যাওয়ার ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম বদলের ঘোষণা হল। হাজার হাজার মানুষ সবাই সবার আগে প্ল্যাটফর্ম বদল করতে গিয়ে বিপত্তি। পদপিষ্ট হয়ে মারা গেল ২০ জন। আহত হল অসংখ্য মানুষ। আসানসোল এবং উত্তর-মধ্য ভারতের বিভিন্ন স্টেশনে লাগামছাড়া ভিড়ে কোনওক্রমে ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন পুর্ণ্যার্থীরা।
মহাকুম্ভের প্রস্তুতি চলছে বছর খানিক ধরে। ডবল ইঞ্জিন সরকার মহাকুম্ভকে হিন্দুত্ববাদের মহা সম্মেলন করার সব রকম চেষ্টা করেছে। সরকারি-বেসরকারি সমস্ত প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কুম্ভমেলা নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করেছে দুই সরকার। ধর্মীয় ভাবাবেগকে উসকে দিয়ে কোটি কোটি ভারতবাসীকে কুম্ভমেলায় সমবেত করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও তাদের সুরক্ষা করার যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয়নি। মৌনী অমাবস্যার ব্রাহ্ম মুহূর্তে সঙ্গম ঘাটে বিপুল সমাগমের আগাম সংবাদ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন সতর্কতা নেয়নি। ফলে অমৃতের সন্ধানে এসে অসংখ্য মানুষ লাশ হয়ে লেগ। একই ঘটনা ঘটল নিউ দিল্লি স্টেশনে।
প্রতিটি মেলার মতো এবারের কুম্ভমেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ মহিলা। কেউ মেলার মাঠে প্লাস্টিক বিছিয়ে গয়না বিক্রি করছেন। কেউ জড়িবুটির দোকান সাজিয়ে বসেছেন। কেউ শীতবস্ত্র বিক্রি করছেন মাটিতে বিছিয়ে। কেউ আবার বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে বসেছেন। ফুল বিক্রি করছেন অনেকেই। বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে জিনিস ফেরি করাই এদের পেশা। এদের নির্দিষ্ট কোনও থাকার জায়গা নেই। রাস্তার ধারে প্লাস্টিক ঝুপড়িতে বাচ্ছা নিয়ে তাদের বাস। সকাল ন’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ঠায় দোকানদারি করে দু’শো-তিনশোর বেশি বেচাকেনা হয় না। মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার চোলমুখ গ্রাম থেকে আসা এক গয়না বিক্রেতা বলছিলেন ধোঁয়া ধূলোতে সারাদিন কাজ করে যা পাই, তা দিয়ে পেট চলে না। পুলিশের জুলুম তো আছেই, তার উপর নাগা সন্ন্যাসীরা হুটহাট এসে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে যায়। কিছু বলতে গেলেই কপালে জোটে ত্রিশূলের গুতো বা লাঠির বাড়ি।
দূষণ সৃষ্টিতে কুম্ভমেলার বিকল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বায়ু দূষণ এতো তীব্র যে মেলা প্রাঙ্গণে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলে চোখে জ্বালা করে। জল পড়ে। রাতদিন জ্বলতে থাকা নাগা সন্ন্যাসীদের যজ্ঞের ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে তোলে। এক আশ্রমের মহারাজ বলছিলেন, এই কাঠের ধোঁয়ার মধ্যে থাকতে থাকতে কাশির রোগ ধরে যায়। নিজের আস্তানায় ফেরার পর এই কাশি সারাতে দীর্ঘদিন লেগে যায়।
অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষের মলমূত্রের থেকে ত্রিবেনী সঙ্গমের জলে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট অনুয়ায়ী নদীর জলের গুণমান জৈব রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা (BOD) মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে গ্রীন ট্রাইবুনাল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তবুও কোটি কোটি মানুষ কুম্ভে আসে। মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটে। খাওয়া ঘুমের তোয়াক্কা করে না। মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে। সবকিছু পেছনে ফেলে কিসের নেশায় মানুষ চলেছে! পৃথিবী বিখ্যাত গণিতবিদ পল এড্রিয়ান মরিস ডিরাক আড্ডার মেজাজে হাইসেনবার্গকে বলেছিলেন: আজও যে ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়, তার কারণ এ নয় যে ধর্মভাবনা আমাদের মনে এখনও প্রত্যয় জাগায়; তার সোজাসাপটা কারণ হল, আমরা অনেকেই সমাজের নিন্ম শ্রেণীর লোকদের ভুলিয়ে শান্ত রাখতে চাই। যারা গলা ফাটিয়ে বিক্ষোভ জানায়, তাদের তুলনায় শান্ত লোকদের শাসন ও শোষণ করা অনেক সহজ। ধর্ম এক ধরনের আফিম, যা একটা জাতিকে স্বপ্নকল্পনায় বুঁদ করে রেখে মানুষের প্রতি অবিচারের কথা ভুলিয়ে রাখা যায়। সেই কারণেই রাষ্ট্র আর চার্চ এই দুই বিশাল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে এত গলাগলি।
মার্কসবাদী না হয়েও ডিরাকের ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনার প্রসঙ্গে মার্কসের কথা মনে পড়িয়ে দেয়: ধর্ম হল নিপীড়িত জীবিতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন এই জগতের হৃদয়, আত্মাহীন পরিস্থিতির আত্মা। মার্কস লিখেছিলেন, মানুষের প্রার্থিব জীবনের বঞ্চনা, শোষণ, লাঞ্ছনার অবসান না হলে ঈশ্বর বিশ্বাস থাকবে।
ডিরাকের চার বছর আগে কবিগুরু রক্তকরবী নাটকে বিশু পাগল (প্রাক্তন শ্রমিক) নামক চরিত্রের মুখ দিয়ে আমাদের জানিয়েছেন: আমাদের না আছে আকাশ, না আছে অবকাশ; তাই বারো ঘন্টার সমস্ত হাসি গান সূর্যের আলো কড়া করে চুঁইয়ে নিয়েছি একচুমুকের তরল আগুনে। যেমন ঠাস দাসত্ব তেমনি নিবিড় ছুটি। কাঠখোট্টা শ্রমিক ফাগুলাল বলেছিল: দেখ নি ওদের মদের ভঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির একেবারে গায়ে গায়ে?"
ঈশ্বরবিশ্বাসী অ-মার্কসবাদী রবীন্দ্রনাথ এইভাবে রক্তকরবী নাটকে শোষণ, বলপ্রয়োগ, ধর্মের সমীকরণ জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.