বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

মজুর বনাম মোদি: শ্রম আন্দোলনের এক দশক

মজুর বনাম মোদি: শ্রম আন্দোলনের এক দশক

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

কুণাল কামরা তাঁর একটি ব্যঙ্গ-কৌতুক নকশায় একবার বলেছিলেন, “আমার আর অম্বানির মাঝে মোদিজি কী করছেন বলতে পারেন? আমি সোজাসুজি অম্বানিকে ভোট দিতে পারি না কেন?” কুণালের যুক্তি, অম্বানি প্রধানমন্ত্রী হলে দুর্নীতি ঘুচে যাবে। কারণ টেন্ডার পাওয়ার জন্য চার কোটি টাকার সুটকেস হাতে অম্বানির বাড়ি যাওয়ার সাহস কার হবে? চার হাজার কোটি টাকা তো তার দারোয়ানের পকেটেই রয়েছে। এমন ভঙ্গীতে এই জনপ্রিয় ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান’ এ কথাগুলো বলেছিলেন, যে যতবারই ইউটিউবে ভিডিও দেখুন না কেন, হাসতে হাসতে চোখে জল এসে যাবে।

বিজেপি-র এবারের ইস্তেহার পড়লে চোখে জল আসতে আসতে ফিক করে চলে আসে হাসি। ‘মোদি কা গ্যারান্টি ফর শ্রমিক সম্মান’ পড়ে মনে হয়, এ কি মোদির লেখা, নাকি অম্বানি বা আদানির? মজুরির গ্যারান্টি নেই, ছাঁটাই রোখার আশ্বাস নেই, সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই — এ তো শিল্পপতির ‘ড্রিম ম্যানিফেস্টো!’ তবে হ্যাঁ, ব্যাকরণে দখলটা পাক্কা রাজনীতির। বিজেপির অভিধানে কী এক আজব উপায়ে ‘সম্মান’ হয়েছে ‘অধিকার’-এর বিপরীতার্থক শব্দ। যা ন্যায্যত, আইনত, শ্রমিকের প্রাপ্য, এমনকি যা সে এত বছর পেয়ে আসছে, তার একেবারে উলটো দিকে দাঁড় করানো হয়েছে ‘সম্মান’ কথাটাকে। মজুরি আর হকের পাওনা নয়, মালিক-নির্ধারিত সাম্মানিক। সোজা কথায়, সম্মান মানে অসম্মান। এমন উলটো বোঝানোর খেলাটির জন্য মোদিকে চাই।

মোদির প্রথম গ্যারান্টি — মাঝে মাঝে ন্যূনতম মজুরি (‘ন্যাশনাল ফ্লোর ওয়েজেস’) পুনর্বিবেচনা করা হবে। কিন্তু কবে টাকা বাড়বে, কতটা? উল্লেখ নেই। ২০১৯ সালে কেন্দ্র-নিযুক্ত অনুপ শতপথী কমিটি সুপারিশ করেছিল, দৈনিক ৩৭৫ টাকা। তৎকালীন শ্রম মন্ত্রকের রাষ্ট্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার তাকে ‘অবাস্তব’ বলে খারিজ করেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে মাত্র দু’টাকা বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছিলেন ১৭৮ টাকা।

২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে সংবাদে ভাসছিল, এ বার মজুরি বাড়বে। পাঁচ বছরে মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে, মজুরি বাড়বে না? বাড়েনি। ইস্তেহারে শ্রমিকদের জন্য মোদির মোট ন’টি ‘গ্যারান্টি’-র বাকি আটটি প্রধানত এই যে, যে সব সুযোগ-সুবিধে কেন্দ্র দিচ্ছে, সেগুলি আরও সহজে (ডাকঘরে, ডিজিট্যাল উপায়ে) নাগালে আসবে শ্রমিকদের।

কিন্তু ন্যায্য মজুরির কী হবে? সম্প্রতি ‘বহুত্ব কর্ণাটক’ নামে একটি অসরকারি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, অন্তত ৩০ কোটি ভারতীয় ওই ন্যূনতম মজুরি, অর্থাৎ দৈনিক ১৭৮ টাকার চাইতেও কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। নানা সমীক্ষা দেখিয়েছে, গ্রামীণ পরিবারগুলি অত্যাবশ্যক সামগ্রী কেনার জন্য খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে, তাদের সঞ্চয়ও কমেছে। বিরোধীরা তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিদ্ধ করার সুযোগ ছাড়েনি। সম্প্রতি কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ সাংবাদিক বৈঠকে মনে করিয়েছেন যে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকৃত মজুরি (মূল্যস্ফীতি অনুপাতে মজুরি) বাড়েনি, বরং মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফায় তা কমেছে। গত সাত-আট বছরে গড় মজুরি বাড়েনি কোনও কর্মীর — না নিয়মিত বেতনের চাকুরে, না চুক্তিকর্মী, না স্বনিযুক্ত কর্মী।

কংগ্রেস ইস্তেহারে বলেছে, ন্যূনতম মজুরি করা হবে চারশো টাকা। উত্তম প্রস্তাব। কিন্ত ৩৫০ টাকা বা ৪৫০ টাকা নয় কেন? কার্পণ্যের চাইতেও বড় ভয়, অস্বচ্ছতা। কীসের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের মজুরি (১৭৬ টাকা) থেকে ২০১৯ সালে দু’টাকাই বাড়ানো হল, ১ টাকা ২০ পয়সা নয়, কিংবা ২০১ টাকা নয়? কী করেই বা ধার্য হচ্ছে মনরেগার মজুরি (সাম্প্রতিকতম বৃদ্ধি রাজ্যভেদে ৭ টাকা থেকে ৩২ টাকা), যেখানে বহু রাজ্যে বর্ধিত মজুরি সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির চাইতেও কম? এই প্রশ্নটা বিরোধী দলও এড়াতে পারে না। কারণ, মজুরি বৃদ্ধির ফর্মুলা নির্দিষ্ট করা মানে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত করা। ১৯৫৭ সালে ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্স ন্যূনতম মজুরি স্থির করার শর্তগুলি বেঁধে দেয়, ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেই ফর্মুলাকে আরও বিশদ করে। এমন নির্দিষ্ট পরিমাপ থাকলে মজুরি কত বাড়ার কথা ছিল, তা মজুর নিজেই স্থির করতে পারে, এবং তা দাবি করতে পারে। এর ফলে সরকার, অথবা শিল্পপতির উপর যে দায় এসে পড়ে, তা এড়ানোর পথ খুঁজছে নানা রাজনৈতিক দল। সেই জন্যই মজুরি দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ, বৃদ্ধির ফর্মুলা ঘোষণা সমস্যার।

প্রায় একই সুরে, অঙ্গনওয়াড়ি, আশা প্রভৃতি স্কিমকর্মীদের জন্য কেন্দ্রের প্রদেয় টাকা দ্বিগুণ হবে, বলছে কংগ্রেস ইস্তেহার। এ-ও ‘সম্মান’, অধিকার নয়। ওই মহিলা কর্মীরা সরকারি কর্মীর মর্যাদা চেয়ে দেশজুড়ে আন্দোলন করছেন। এই স্বীকৃতির দাবিকে আরও দুটি বেশি টাকার দাবিতে পর্যবসিত করা যায় না। সিপিআইএম অবশ্য ইস্তেহারে তাঁদের সরকারি কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছে।

অনেকে বলতে পারেন, ইস্তেহারে কোন দল কী বলল, তাতে কী-ই বা এসে গেল? দলের প্রার্থী বা কর্মীরাই ইস্তেহারটা পড়ে কি? ভোট পেতে সকলেই যে যার মতো প্রতিশ্রুতি দেয়। সম্প্রতি একটি বাম দলের মহিলা প্রার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর মোকাবিলায় তিনি কী করছেন, প্রশ্ন করতে বললেন, “আমি বলছি, সরকার বদল হলেও প্রকল্প চলবে।” কিন্তু আপনার দল এমন অনুদানের প্রকল্প সমর্থন করে কি? তাঁর সরল উত্তর, “করে না, কিন্তু ভোট পেতে আমাকে কিছু বলতে তো হবে!” কত প্রার্থীকে এমন কত কথা বলতে হয়!

তবু ইস্তেহারের একটা তাৎপর্য আছে বইকি। নানা বিতর্কিত প্রশ্নে একটি দলের যা অবস্থান, যে নীতি-কার্যসূচি সে গ্রহণ করেছে, ইস্তেহারে তা ধরা থাকে। সেখানে কতটা স্পষ্ট, যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারছে দল, কোন কোন বিষয়ে দায়বদ্ধতা স্বীকার করছে, তা-ও একটা পরীক্ষা। কংগ্রেস ‘শ্রমিক’ শিরোনামের নীচে প্রথম প্রতিশ্রুতি লিখেছে — “আমরা শিল্প এবং শ্রম আইনে এমন সংস্কার আনব যাতে শ্রম এবং পুঁজির ভারসাম্য ফিরে আসে, এবং সম্পূর্ণ কর্মনিযুক্তি আর উচ্চ উৎপাদনশীলতার জোড়া লক্ষ্য পূরণ হয়।” এ হল “টিকিও ভাল, টাকও ভাল” নীতি। লক্ষ্যণীয়, কংগ্রেস-সমর্থিত ট্রেড ইউনিয়ন আইএনটিইউসি চারটি শ্রমিক কোড বাতিলের দাবিতে লাগাতার শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। তবু ইস্তেহারে শ্রম কোড বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি কংগ্রেস, সেগুলিকে ‘রিভিউ’ অর্থাৎ পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে কেবল।

সিপিআইএম অবশ্য শ্রম কোড সরাসরি বাতিলের কথা বলছে, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় আইন করার কথাও বলছে। তবে বাম দলগুলিকে তাদের নির্বাচনী প্রচারে — অন্তত পশ্চিমবঙ্গে — অন্য দলের প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রতি যত তোপ দাগতে দেখা গেল, শ্রমিক-সুরক্ষায় ব্যর্থতা নিয়ে তার সিকি ভাগও নয়। এমনকি যে সব কথায় আবেগমথিত হতে পারেন শ্রোতা, যেমন লকডাউনের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্বিষহ দশা, মজুরদের প্রভিডেন্ট ফান্ড-বোনাস লুঠ, শ্রমিক কল্যাণের জন্য গঠিত সেস-তহবিলের টাকায় রাজ্য সরকারের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ, খেতমজুর ও দিনমজুরদের আত্মহত্যায় বৃদ্ধি — সেগুলোই বা কোথায়? পুঁজি আর শ্রমে ‘ভারসাম্য’ ফেরানো যদি সত্যিই বিরোধীদের লক্ষ্য হত, তা হলে গত দশ বছরে শ্রমজীবী নারী-পুরুষের প্রতি রাষ্ট্রের পরিকল্পিত অন্যায়ের বিবরণ সামনে আসত তাদের প্রচারে।

মনরেগায় বরাদ্দ বাড়ানো, কর্মদিবস বাড়ানো, মজুরি বাড়ানোর আশ্বাস কংগ্রেস, বাম, সকলেই দিচ্ছে (তৃণমূল রাজ্য সরকারের ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পে ৫০ দিনের কাজের গ্যারান্টি দিচ্ছে)। গ্রামের শ্রমজীবীর কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু বাজারের অন্যায্যতা দূর করার কাজে তার ভূমিকা সামান্যই।

নির্বাচনের আগে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ছন্নছাড়া দশা দেখে বিরক্ত দেশবাসী। অথচ, এই সব দলের ট্রেড ইউনিয়নগুলি গত দশ বছর একত্রে বারবার ধর্মঘট করেছে কেন্দ্রের শ্রমনীতির বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালে ছেচল্লিশতম জাতীয় শ্রম কনফারেন্সে মোদি আশ্বাস দিয়েছিলেন, ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে আলোচনা করে চুয়াল্লিশটি কেন্দ্রীয় আইন থেকে চারটি শ্রম কোড তৈরি হবে। কাজের বেলা কারও মতামত না নিয়েই শ্রম মন্ত্রক খসড়া প্রস্তুত করে ফেলল। অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন ক্ষুব্ধ হয়ে আলোচনার আহ্বান বয়কট করে। তার উপর ২০১৬ সালে নোটবন্দি, আর ২০১৭-এ জিএসটি চালু করায় বিপুল ধাক্কা এল অসংগঠিত ক্ষেত্রে। পাশাপাশি মনরেগায়, বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বরাদ্দ কমল। নমনীয় শর্তে সুলভ শ্রম ভান্ডার তৈরি করাই সরকারের শ্রমিক নীতি হয়ে দাঁড়াল।

প্রথম বড় মাপের প্রতিবাদ হয়েছিল ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। জাতীয় স্তরের দশটি ট্রেড ইউনিয়নের ডাকে ‘ভারত বন্ধ’-এ যোগ দিল ব্যাঙ্ক, বিমা, পরিবহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, শিক্ষক সংগঠন, ছিলেন কয়লাখনি শ্রমিকরাও। বাণিজ্যিক চেম্বার ‘অ্যাসোচ্যাম’-এর আন্দাজ ছিল, এক দিনে অন্তত ১৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির। দাবির মধ্যে ছিল ন্যূনতম মজুরি-সহ শ্রম আইনগুলিকে বলবৎ করা, সামাজিক সুরক্ষা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ করা, রেল ও প্রতিরক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ করা।

ট্রেড ইউনিয়নদের সঙ্গে কেন্দ্রের তিক্ততা আরও তীব্র হল ‘কোড অন ওয়েজেস বিল’ (বেতন সংক্রান্ত আইন) লোকসভায় পেশ (২০১৭) হওয়ার পরে। এই আইনে ন্যূনতম মজুরি স্থির করার ক্ষমতা কার্যত ছেড়ে দেওয়া হয় নিয়োগকর্তার উপর। কাজের সময়, শর্ত, ছাঁটাই, সবই নিয়োগকর্তার ইচ্ছা-নির্ভর হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আইনে (১৯২৬) সংশোধন করে ইউনিয়নগুলির কাজে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি করে কেন্দ্র। প্রতিবাদে পরবর্তী ধর্মঘট হয় ৮-৯ জানুয়ারি, ২০১৯, তাতে ছাত্র সংগঠন এবং কৃষক সংগঠনও যোগ দেয়। পনেরো থেকে কুড়ি কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ফের সাধারণ ধর্মঘট ডাকে ট্রেড ইউনিয়নগুলি, আবারও বিপুল সাড়া মেলে।

কিন্তু কৃষক আন্দোলন যে ভাবে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিকে দেশবাসীর কাছে একটি ন্যায্য দাবি বলে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, শ্রমিক আন্দোলন সে ভাবে ন্যূনতম মজুরির দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ধর্মঘট এবং অন্যান্য আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক মানুষের যোগদান রাজনৈতিক লাভে পরিণত হয়নি। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলাকালীনই ২০১৯ ও ২০২০ সালে চারটি শ্রম কোড সংসদে পাশ হয়ে যায়। কৃষক আন্দোলনের জেরে ২০২১ সালে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে কেন্দ্র বাধ্য হয়। তার পরে অনেক শ্রমিক নেতা ঘোষণা করেছিলেন যে, চারটি শ্রম কোডও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে কেন্দ্র। কিন্তু তা হয়নি। ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ মোদির জনপ্রিয়তায় প্রভাব ফেলেছে, এখনও অবধি তেমন ইঙ্গিত মেলেনি। ইতিমধ্যে কোভিড অতিমারির দুটি ঢেউ (২০২০-২১) শ্রমজীবীর বিপন্নতা আরও বাড়িয়েছে। কর্মহীনতা বেড়েছে, অতি কম মজুরিতে অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ, বিশেষত মেয়েরা। তবু বেকারত্ব, যথেচ্ছ মজুরি, কাজের অমানবিক শর্ত ২০২৪-এর নির্বাচনে প্রধান প্রশ্ন হয়ে উঠল না।

এর কারণ কী? নানা আলোচনা থেকে তিনটি সূত্র মেলে। এক, ট্রেড ইউনিয়নগুলির দুর্বলতা। প্রধানত সংগঠিত ক্ষেত্রে দরদস্তুর ও আন্দোলনে তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে, যদিও আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে অধিকাংশ কাজ তৈরি হয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোট ছোট উদ্যোগে। ২০০০ সালের পরে সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ তৈরি হলেও, নিয়োগ শুরু হয় প্রধানত ঠিকাদারের মাধ্যমে, চুক্তিতে। এই বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী, অসংগঠিত কর্মীরা ট্রেড ইউনিয়নের আওতার বাইরে রয়ে গিয়েছেন। ফলে ভারতে বেশ কিছু বড় বিক্ষোভ-আন্দোলন ঘটেছে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ছাতার বাইরে। যেমন ২০১১-১২ সালে হরিয়ানার মানেসর এবং রাজস্থানের টাপুকারা হন্ডা কারখানায় শ্রমিকদের ধর্মঘট, ২০১৫ সালে কেরলের মুন্নারে চা শ্রমিক মহিলাদের আন্দোলন, পেনশনের নিয়ম পরিবর্তনের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে বেঙ্গালুরুর গারমেন্ট ফ্যাক্টরির মহিলা কর্মীদের বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ। গত দু’তিন বছরে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি প্রভৃতি স্কিম কর্মীরা জাতীয় স্তরে সংগঠিত ভাবে আন্দোলন করছেন। তাঁদের কোনও কোনও সংগঠনের সঙ্গে নানা ট্রেড ইউনিয়ন যুক্ত থাকলেও, আন্দোলন পরিচালনা করছেন দরিদ্র মহিলারাই।

তা সত্ত্বেও ট্রেড ইউনিয়নগুলির সদস্য ২০০২ সালের পর থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিক রাজনীতিকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে ট্রেড ইউনিয়ন ব্যর্থ হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের দুর্বলতা ছাড়াও সাবেক কারণটি রয়েই গিয়েছে — রাজনীতি এবং মিডিয়াতে ‘এলিট’ বা অভিজাত শ্রেণী ‘ইউনিয়নবাজি’-কে সন্দেহের চোখে দেখে, এবং পুঁজিকে কেন্দ্রে রেখে শ্রমিকদের স্বার্থকে প্রান্তিক করে রাখে। রাজনীতি ও সমাজের উপর নয়া উদারনীতি প্রভাব বিস্তারের পরে জনপরিসরে শ্রমিকের দাবি-চাহিদার ন্যায্যতাকে তুলতে ধরার জন্য নতুন ভাষা, যুক্তিবিন্যাস ও তর্ক-কৌশলের প্রয়োজন ছিল। তা এখনও তৈরি হয়নি। আর একটি কারণ অবশ্যই বিজেপির উত্থান ও তাদের রাজনৈতিক কৌশল, যা শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ বিভাজন করে নানা আবেদন নিয়ে হাজির হয়। পশ্চিমবঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নগুলি ভেঙে গিয়েছে বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলিম, বর্ণহিন্দু-আদিবাসী, মূলবাসী-পরিযায়ী, এমন নানা খণ্ডে। বিরোধী-শাসিত রাজ্যে প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মকে সংগঠিত করাও তেমনই কৌশল। এগুলি উৎপাদন-সম্পদ বণ্টনের প্রশ্ন থেকে দূরে রাখে রাজনীতিকে। ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ বস্তুত রাজনীতির মূলস্রোত থেকে শ্রমিক স্বার্থের, এমনি শ্রমিক পরিচিতির, নির্বাসনের গ্যারান্টি। সঙ্ঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় মজদুর ইউনিয়ন আগাগোড়াই শ্রম কোডের সমর্থন করছে।

খেতমজুর, দিনমজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত কর্মী, চুক্তি কর্মী, গিগ কর্মী — এঁরা এক বিশাল নির্বাচক মণ্ডলী। তা সত্ত্বেও বিরোধীরা কেন তাঁদের স্বার্থকে সামনে আনতে পারলেন না, তার অন্তত একটা কারণ দেশবাসীর সামনে চলে এল নির্বাচনের আগেই — নির্বাচনী বন্ড। শ্রমিককে ‘সম্মান’ দেওয়ার নামে তার অধিকার-হরণ করার মোদিসুলভ ঔদ্ধত্য, কংগ্রেসের ‘ভারসাম্য’ ফেরানোর মিনমিনে আশ্বাস, সব কিছু জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়, কার ঘরে কোন কর্পোরেটের কত টাকা ঢুকেছে, তা দেখলে। তখন কুণাল কামরাকে অনুসরণ করে বলা যায়, ইস্তেহারে অম্বানির নাম লিখে দিলেই তো হতো, আবার দলের নামের দরকার কী? বাকি রইল বাম দলগুলো, যারা টাকা নেয়নি, বা পায়নি। তারা এই নির্বাচনে শ্রমিকদের কথা কতটা কী তুলে ধরল, কোন কোন বিষয়ে নীরব রইল, আর কেনই বা, সে আর এক প্রশ্ন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.