বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

চলমান কৃষক আন্দোলন: শিক্ষা ও তাৎপর্য

চলমান কৃষক আন্দোলন: শিক্ষা ও তাৎপর্য

দীপক পিপলাই

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১— ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষ থেকেই বিভিন্ন সময়ে একের পর এক উল্লেখযোগ্য কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে নানা অঞ্চলে। প্রতিটি সংগ্রাম ও আন্দোলন থেকেই মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছেন ভারতীয় জনগণ। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী ও সামাজিক ঐক্য-র এক অভূতপূর্ব নজির গড়ে উঠছে সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর, ধানসা, কুন্দলি, চিল্লা, ফরিদাবাদ, সাবোলি সহ দিল্লীর মোট ১১টি বর্ডার অঞ্চলে, চলমান কৃষক আন্দোলনের ময়দানে। সিঙ্ঘু বর্ডারে ১০-১২ কিলোমিটার এবং টিকরি বর্ডারে ১৫-১৬ কিলোমিটার জুড়ে আন্দোলনরত কৃষকদের সারি এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করে। এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাঞ্জাবে, কিন্তু তা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ে হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে; তারপর কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, ওড়িষা, কেরালা সহ বিভিন্ন রাজ্যে। আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ডেও এই আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। গত শতাব্দীর চল্লিশের ও নব্বইয়ের দশকে সাড়া জাগানো শ্রমিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সামাজিক অংশগ্রহণের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নজির গড়ে উঠেছিল বাংলার মাটিতেও, ঠিকই। কিন্তু ৩২-টি কৃষক ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে এবং ৭-টি রাজনৈতিক দলের সমর্থনে গড়ে ওঠা বর্তমান কৃষক আন্দোলনকে ঘিরে যে প্রধান প্রধান ১০টি বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে, সেগুলো শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, অভূতপূর্বও বটে।
১) ছোট-মাঝারি-বড়, সবধরনের কৃষকরাই একযোগে এই আন্দোলনের শরিক। সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে। কৃষক সমাজের নানা স্তরের মধ্যে স্বার্থকেন্দ্রিক নানারকম দ্বন্দ্ব এক স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু কৃষক-বিরোধী সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগঠিত এই সংগ্রামে যেভাবে বৃহত্তর কৃষক-ঐক্য গড়ে তুলে ১৫ মাস লাগাতার আন্দোলনের এক অনন্য নজির গড়ে উঠেছে, তার তুলনা নেই।
২) 'নেতৃত্ব'-র কেতাবি ধারণা এখানে অচল। শুধু 'নেতা'-রা মিটিংয়ে বসবেন, 'লাইন' ঠিক করবেন, ভাষণ দেবেন, কর্মীদের জন্য 'আদেশ' জারি করবেন - এই সবকিছু পরিচিত চিত্রই এখানে অনুপস্থিত। আক্ষরিক অর্থেই সাধারণ কৃষকদের, এমনকি জড়ো হওয়া সহযোগীদেরও সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমেই গৃহীত হচ্ছে সিদ্ধান্ত। কখনও হয়তো 'নেতৃত্ব'-র মতকে খারিজ করেও। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতামতের নেতারা থাকলেও, সকলের মধ্যে প্রকাশ্যে মতবিনিময়ের মাধ্যমেই স্থির হচ্ছে আন্দোলনের পথ। দেখা যাচ্ছে - 'নানা মত, এক পথ।'
৩) কৃষক আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও, ক্রমশই তা রূপ পাচ্ছে সামাজিক গণআন্দোলনে। কৃষক ছাড়াও সমাজের নানা অংশ হয়ে উঠছে স্বৈরাচারী-উদ্ধত শাসক বিরোধী এবং কর্পোরেট-বিরোধী অতি গুরুত্বপূর্ণ এই আন্দোলনের অংশীদার। রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক, ডাক্তার, উকিল, ছাত্র ইত্যাদি, একের পর এক রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা শাসক-বিরোধী সংগ্রামী মানুষেরাও শরিক হচ্ছেন আন্দোলনে। তাঁদের সকলের মতামতকেই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হচ্ছে।
৪) কমিউনিস্টরা সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা/কর্মীরা সরাসরি যুক্ত রয়েছেন আন্দোলনে। বিচিত্র মতের সম্মেলনে চলছে আন্দোলন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে চলছে না ক্রমবিকাশমান এই লড়াই। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
৫) আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিঁকিয়ে রাখার এক অভূতপূর্ব পদ্ধতি চালু হয়েছে। পালা করে পরিবারের লোকজন এবং কৃষকরা হাজারে হাজারে এসে অবস্থানে শামিল হচ্ছেন নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে। বিপুল সংখ্যক নারীদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পাশাপাশি, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদনের জরুরি কাজও চলছে। এখনও পর্যন্ত ৬৭০-এরও বেশি আন্দোলনকারী কৃষকের মৃত্যু হয়েছে শাসকগোষ্ঠীর আক্রমণে অথবা প্রচণ্ড ঠান্ডার ফলে। এসব খবর চেপে যাচ্ছে বড় বড় সংবাদমাধ্যম। কিন্ত সংগ্রামী তেজ ও জেদ বজায় রেখে, অবস্থানে অনড় রয়েছেন তাঁরা। এখনও অবস্থানে রয়েছেন পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি কৃষক।
৬) যাঁদের মৃত্যু হচ্ছে আন্দোলনের কারণে, তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার নৈতিক দায়িত্ব পালনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসছেন দেশ-বিদেশের সহযোদ্ধারা। অর্থ, খাদ্য, পোষাক ইত্যাদির নিয়মিত সরবরাহ জারি থাকছে তাঁদের জন্য। এই কাজের জন্য পৃথক সংগঠনও গড়ে উঠেছে। "আমি মারা গেলে পরিবারের কী হবে!" - এই দুশ্চিন্তা থেকে তাঁরা মুক্ত রাখছেন লড়াইয়ের সংগ্রামী সহযোদ্ধাদের। ফলে, আন্দোলনে সক্রিয় কর্মীদের সংখ্যায় কোনও ঘাটতি থাকছে না।
৭) দেশ-বিদেশের নানা পেশায় নিযুক্ত মানুষজনের ঐকান্তিক ও অকল্পনীয় সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা এই আন্দোলনের অন্যতম শক্তি। কৃষক-বিরোধী শক্তির বর্বরোচিত হামলায় আহতদের চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য, ১১ মাসেরও বেশি সময় ধরে, ২৪-ঘন্টার ব্যবস্থা করেছেন এঁরা। লড়াই জারি রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এঁরাই যোগাচ্ছেন। এবং, বিভিন্ন সহযোগীর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের বদলে শুধুমাত্র বস্তুগত সহযোগিতাই গ্রহণ করা হচ্ছে, এমন নজিরও দেখা যাচ্ছে।
৮) জাতিগত (Nationality) পার্থক্য, জাতগত (Caste) ভেদাভেদ, ভাষাগত (Language) বৈচিত্র্য, বর্ণগত (Colour) ভিন্নতা, ধর্মগত (Religion) বিদ্বেষ, সবকিছুই এখানে মুছে গেছে লড়াইয়ের ময়দানে। অবস্থানের জায়গায় নামাজ রত মুসলমান কৃষকদের পাহারা দিচ্ছেন হিন্দু কৃষকরা, কিম্বা লঙ্গরখানায় একসঙ্গে রান্নার কাজে হাত লাগাচ্ছেন এবং খাওয়াদাওয়া করছেন, গান গাইছেন হিন্দু-মুসলমান-শিখ সম্প্রদায়ের মানুষজন - এটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। আন্দোলনের ময়দানে গড়ে উঠছে বৃহত্তর সামাজিক ও গণসাংস্কৃতিক ঐক্যের এক অভূতপূর্ব এবং বহু-আকাঙ্ক্ষিত নজির।
৯) শাসকপক্ষের লাগাতার, শক্তিশালী ও বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক আগ্রাসনের সামনে জনগণের যে কোনও আন্দোলনই বেশিদিন টিঁকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমান কৃষক আন্দোলন একবছরেরও বেশি সময় ধ'রে শুধু যে বেঁচে আছে তা-ই নয়, গণভিত্তি-নির্ভর এই আন্দোলন ক্রমবিকাশমান।
১০) বৃহত্তর সমাজের উপর নির্ভর করে চলমান এই বহুমাত্রিক কৃষক আন্দোলন ভারতীয় সমাজে একধরনের নবজাগরণের সূচনা ঘটাচ্ছে কিনা, তা-ও আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখা দরকার। আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নতুন নতুন মূল্যবোধকে যেভাবে এই লড়াই সামনে নিয়ে আসছে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি রাজ্যে আন্দোলনের শুরু হলেও, আজ তা কার্যত সমগ্র ভারতবাসীর স্বার্থবাহী লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
গতবছর (২০২০) অগাস্ট মাসে যখন নতুন কৃষি বিলের কথা প্রকাশ্যে আসে, তখনই পাঞ্জাবে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ট্রাক্টর ও মোটরসাইকেল মিছিল হয়; ২৫ সেপ্টেম্বর হয় পাঞ্জাব বন্ধ। সন্দেহ নেই নানা ধরণের মতামতের প্রবক্তা, পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সংসদীয় স্বার্থ শক্তিও এই আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে এগিয়ে এসেছে। একথাও ঠিক, তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিজেদের জনসমর্থনের ভিত্তি পোক্ত করা, এবং‌ আগামীতে বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেরাও 'শাসক' হবার/ 'শাসক' থাকার বাসনা পূরণ করা। যাদের শাসন ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের দাবিদাওয়াকে অগ্রাহ্য করাই শুধু নয়, কৃষক-পেটাই এমনকি কৃষক-হত্যার জন্যেও দায়ী, তাদেরও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হিসাবে দেখা যাচ্ছে! কিন্তু এটাই স্বাভাবিক। চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, স্বৈরাচারী, আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের এবং দেশি-বিদেশি কর্পোরেট-পুঁজির উলঙ্গ উমেদার, নয়া-পরাধীনতার পুরোহিত বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগঠিত লড়াইয়ে এই ধরনের বৃহত্তর ঐক্যের অবশ্যই দরকার আছে। কৃষক সমাজের আশু প্রয়োজনে, এবং দীর্ঘমেয়াদী বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে। লড়াইয়ের ময়দানেই শেষপর্যন্ত ঝাড়াইবাছাই হবে খাঁটি ও মেকি বন্ধুত্বের।
ভারতবর্ষ জুড়ে অনৈক্য, বিভ্রান্তি আর ব্যর্থতার প্লাবনের মাঝে বর্তমান কৃষক আন্দোলন এক ঝোড়ো হাওয়া। গণআন্দোলনের এক নতুন দিশা। 'নির্বাচিত' শাসককুলের বিশ্বাসঘাতকতায়, দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির কাছে ভারতবর্ষ আজ খুল্লামখুল্লা দাসত্বের নয়া ইতিহাস রচনার দোরগোড়ায় উপস্থিত! এটাই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ভারতব্যাপী আত্মশক্তি-নির্ভর তীব্র গণআন্দোলনে ভয়ঙ্কর শাসকগোষ্ঠীকে ঝাঁকানি দেবার, এবং সমগ্র সামাজকে জাগিয়ে তোলার। শুধুমাত্র স্বপ্ন, আবেগ, বিশ্বাস, 'তত্ত্ব' ইত্যাদিতে ভরসা ক'রে আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রাম প্রভৃতিতে যে কখনোই বেশিদূর এগোনো যায়না, তা এক বহুপরীক্ষিত সত্য। আন্দোলনের শিকড় থাকা জরুরি সমাজের গভীরে। দীর্ঘদিন যাবৎ আন্তরিক অন্বেষণ চললেও, দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলার কোনও সঠিক পথ অধরাই থেকে যাচ্ছিল। আলোচ্য এই কৃষক আন্দোলন সেক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমী আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের সামনে। আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট পুঁজির ভুরু কুঁচকে উঠেছে; দুশ্চিন্তায় ঘুম ছোটার জোগাড় হয়েছে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী উদ্ধত, সাম্প্রদায়িক, স্বৈরাচারী ও কৃষক-বিরোধী শাসকগোষ্ঠীর। শাসকবর্গ প্রথম থেকেই অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আন্দোলনকে ধ্বংস করার। কখনও এই লড়াইয়ের বদনাম করার জন্য 'খালিস্তানপন্থী', 'আন্দোলনজীবী', 'দেশবিরোধী' ইত্যাদি তকমা লাগিয়েছে। কখনও গুলি চালিয়ে কিম্বা গাড়ি চাপা দিয়ে খুন করেছে আন্দোলনকারী কৃষকদের। কিন্তু সবকিছুই ব্যর্থ হয়েছে। আক্রমণের ও শহীদের সংখ্যা যত বেড়েছে, লড়াইয়ের হাত ধরা সংগঠনও ততো বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঞ্জাবের প্রায় ১০০-টি সংগঠন এবং সর্বভারতীয় স্তরে ৪০০-টিরও বেশি সংগঠন আজ এই দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী কৃষক আন্দোলনের সহযোদ্ধা।
২৬ নভেম্বর ২০২০, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে লক্ষলক্ষ মানুষ বন্ধ পালন করেছেন কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে; সর্বনাশা নয়া শ্রম-আইন বাতিল ইত্যাদি বিভিন্ন দাবিতে। ২০ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ৪১ জন; ৩০ ডিসেম্বর অবধি ৫০ জন; ২ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত ৫৭ জন; ৫ মার্চ অবধি নিশ্চিতভাবেই ২৪৮ জন; ১০ জুলাই পর্যন্ত ৫৩৭ জন; নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত শহীদ হয়েছেন ৬৭০ জনেরও বেশি।
আন্দোলনের স্বার্থে এবছর ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত, সরকারের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন আন্দোলনরত ৯ জন কৃষক। পাঞ্জাবে অতীতের একাধিক গৌরবোজ্জ্বল সামাজিক-সংগ্রামের ইতিহাস যে বর্তমান আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে, এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, শিখ ধর্মগুরু সন্ত বাবা রাম সিং আত্মহত্যা করেন। ১৪ তারিখে তিনি সুইসাইড নোটে লিখে যান, "বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলিতে শুধু তাক করা মানুষই মারা যায়। কিন্তু অবিচারের এক খোঁচায় মৃত্যু হয় বহু মানুষের। অবিচারের যন্ত্রণা ভোগ করা অপমানজনক।"
'পঞ্চ নদীর তীরে' বসবাসকারী শিখ সম্প্রদায়ের অকল্পনীয় বীরত্বের গাথা রচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, "জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,/চিত্ত ভাবনাহীন" ('বন্দী বীর', ৩০ আশ্বিন ১৩০৬)। বাবা রাম সিং যেন তারই আধুনিক প্রতিচ্ছবি!
এতো শহীদের আত্মাহুতি এবং অসংখ্য মানুষের অত্যাচারিত হবার বিনিময়ে, বর্তমান কৃষক আন্দোলনের প্রাথমিক জয় ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। উদ্ধত ও স্বৈরাচারী শাসক প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে এবং তিনটি প্রধান দাবির একটি মেনে নেবারও প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছে। সংযুক্ত কিসান মোর্চা বলেছে, "ঐতিহাসিক এই কৃষক আন্দোলনের প্রথম বড় জয়কে শহীদদের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হল।" যদিও ৬৭০ জনেরও বেশি কৃষক-মৃত্যুর জন্য দায়ী হলেও অনুশোচনাহীন, এবং অনর্গল মিথ্যাচারে পটু কোনও শাসকের মুখের কথায় কখনোই বিশ্বাস করা যায়না। আন্দোলনরত কৃষকরাও, স্বাভাবিকভাবেই, তা বিশ্বাসও করেননি। তবুও কৃষক আন্দোলনের চাপে, অহংকারে ভরপুর শাসককে ১৫ মাস পরে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা, নিঃসন্দেহেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। দাবি আদায়ের কাজে আন্দোলনকারীদের মনোবল এতে বহুগুণ বাড়বে। শাসকদের 'গণতান্ত্রিক' বাগাড়ম্বরের অন্তঃসারশূন্যতাও প্রমাণিত হল। কৃষক সমাজের তথা শ্রমজীবী মানুষের বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শক্তি এবারে হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছে সাম্প্রদায়িক-স্বৈরাচারী শাসক।
নিজের ঘোষণাকে বরবাদ করার জন্য এখন নানা কৌশল নেবার চেষ্টা করবে আত্মম্ভরী শাসক। করবেই। ক্ষমতার গদী আঁকড়ে থাকার জন্য উদ্ধত শাসক চিরকালই, সর্বত্রই মরিয়া প্রচেষ্টা চালায়। এখন তাদের আন্দোলন দমনের মানসিকতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে। এটা অনিবার্য। আন্দোলনকারী কৃষকদেরও সেইমতো তৈরি থাকতে হবে। জয়োল্লাসের পাশাপাশি সতর্কতা। নতুন আঘাতকে যথাযথ প্রত্যাঘাত করার প্রস্তুতি। আশার কথা, সংযুক্ত কিসান মোর্চা জানিয়েছে তাঁদের আন্দোলন আগের মতোই চলবে। লখনউ ও মুম্বাইতে পূর্ব ঘোষণা মতোই বসবে কিসান মহাপঞ্চায়েত; ২৬ নভেম্বর, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের একবছর পূর্তিতে রাজধানীতে হবে ট্রাক্টর প্যারেড; সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরুর দিন থেকে প্রতিদিন ৫০০ কৃষক শান্তিপূর্ণভাবে ট্রাক্টরে সংসদ অভিযান করবেন; ইত্যাদি। কয়েক হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে যে কয়েকশো মিথ্যা মামলা করা হয়েছে নানা রাজ্যে, তা প্রত্যাহারের দাবিও রয়েছে। রয়েছে, ৬৭০ জনেরও বেশি শহীদের পরিবারগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারপিছু একজনের চাকরির দাবিও।
কৃষক ও কৃষিবিরোধী আইন সংসদে বাতিল না-হওয়া পর্যন্ত, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঝোষণা না-করা পর্যন্ত, আন্দোলনকারীদের উপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না-হওয়া পর্যন্ত, নিহত কৃষকদের মাথাপিছু ক্ষতিপূরণ না-দেওয়া পর্যন্ত, এবং অন্যান্য সকল দাবি মেনে না-নেওয়া পর্যন্ত বর্তমান কৃষক আন্দোলন যে পূর্বপ্রস্তুতি মতোই চলবে, তা ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে সম্মিলিত আন্দোলনের মঞ্চ থেকে। প্রচণ্ড ঠান্ডা, তীব্র গরম, বৃষ্টির দাপট, শাসকের ধারাবাহিক হামলা - সবকিছুই উপেক্ষা করে যেভাবে বৎসরাধিক কাল লড়াকু কৃষকরা অনমনীয় তেজ নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করছেন এবং মরছেন, তাতে তাঁদের শুধু একটাই কথা বলতে হয়, "সালাম"।
আমরা আশান্বিত। এখন শুধু পরবর্তী ও ধারাবাহিক বিজয়ের অপেক্ষা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.