বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

মৎস্যজীবী ও মৎস্যশ্রমিকদের জীবন

মৎস্যজীবী ও মৎস্যশ্রমিকদের জীবন

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

প্রকৃতির বৈচিত্রময় আচরণ, খামখেয়ালীপনা, রুদ্র রূপ যারা হেলায় মোকাবিলা করে জীবন সংগ্রাম চালান এবং মানুষের জরুরি প্রয়োজন মেটান তাদের অন্যতম হল মৎস্যজীবী ও মৎস্যশ্রমিকরা। এদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য নয়। আবার মৎস্যজীবীদের মতো প্রকৃতিকে মোকাবিলা না করলেও তাদের জীবন যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য সহযোগী, মৎস্য চাষের অনুসারী কাজে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক যাদের, সেই মানুষদের সংখ্যাও কম নয়। এই সমস্ত মানুষের জীবিকা মৎস্যনির্ভর। মানুষের দৈনন্দীন জীবনে মাছের প্রয়োজনের যোগান দিতে মৎস্যজীবী ও অনুসারী সহযোগীরা শ্রম দিয়ে চলেছেন।
সারা দেশে মৎস্যজীবীদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি মানুষ। এর মধ্যে মাছ ধরতে সমুদ্রে পাড়ি দেন প্রায় ৫০ লক্ষ। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর এবং সমুদ্রে মৎস্যজীবীদের মেহনতে যে মাছ ধরা হয় তা দেশের বাজারে মানুষের প্রয়োজন মেটাবার পর বিদেশের বাজারে মাছ রফতানি করে বছরে আয় হয় প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ দেশের অর্থভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। মৎস্য উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে চীন। তারপরেই আমদের দেশের স্থান। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩ কোটি মানুষ মৎস্য চাষের জীবিকায় নিযুক্ত থাকলেও পরোক্ষে সংখ্যাটি প্রায় দ্বিগুণ। মাছ চাষ, মাছ শিকার ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণ, জাল তৈরি ও মেরামতি, নৌকা তৈরি ও মেরামতি, মাছ শুকানো, ক্রেতাদের জন্য বাজারে মাছ পৌঁছে দেওয়ার কাজে বিপুল সংখ্যাক মানুষ যুক্ত। এই সমস্ত অংশের মানুষরাই দরিদ্র এবং কঠিন শ্রমে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ হয়।
প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশকে মোকাবিলা করে ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন শ্রম করে মৎস্যজীবীরা জীবিকা করেন, তাদের লড়াকু মেজাজের প্রতিফলন দেখা যায় লড়াইয়ের ময়দানে। দেশ ও রাজ্যের গণআন্দোলনে তাদের অগ্রণী ভুমিকা নিয়ত লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন রাজ্যে তাদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে দেশব্যাপী মৎস্যজীবী ও মৎস্যশ্রমিক ফেডারেশন। সম্প্রতি হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় হয়ে গেল তাদের তৃতীয় সর্ব ভারতীয় সম্মেলন। সেখানে তাদের গুরুতর সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে— নির্দিষ্ট করা হয়েছে আগামী পদক্ষেপ সমূহ। কৃষক আন্দোলনের অগ্রগতি ও প্রাথমিক সাফল্য তাদের উজ্জীবিত করে— দেশব্যাপী মৎস্যজীবী আন্দোলনের গুরুত্ব সংগঠকদের উপলব্ধিতে আসে। কৃষক সভার উদ্যোগেই মৎস্যজীবী আন্দোলনের সূচনা হয়। পরবর্তী সময়ে কৃষক সভার সহযোগিতায় ও নেতৃত্বে মৎস্যজীবীদের পৃথক সংগঠনের বিকাশ ঘটে। আজ কৃষক ও মৎস্যজীবী আন্দোলন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠছে।
বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসনে শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করে পুঁজিপতিদের সম্পদের পাহাড় স্ফীততর হচ্ছে। বিপরীতে, শ্রমজীবী মানুষ পুঁজির শিকারে পরিণত হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। মৎস্যজীবীদের বড় অংশ উৎপাদনের উপকরণের সব হাতিয়ার হারিয়ে মৎস্যশ্রমিকে পরিণত হচ্ছেন। তাদের হাতে নেই মৎস্য শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় নৌকা বা ট্রলার, সমুদ্র বা সমুদ্র উপকূলে মৎস্য চাষের অধিকার তারা ক্রমশই হারিয়ে ফেলছেন দেশের নীতি নির্ধারকদের পুঁজির স্বার্থবাহী নীতি ও সিদ্ধান্তের ফলে। সুতরাং গতর বিক্রি করাই তাদের একমাত্র রাস্তা। নয়া উদারনীতির পর্বে পুঁজির মালিকরা মৎস্য উৎপাদন ও যোগানের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে দখলদারির বিস্তার ঘটিয়েছে।
চিরাচরিতভাবে নদী, খাল-বিল-বাওড়, জলাশয়ের উপর নির্ভর করে চলতো মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা। এক্ষেত্রেও জীবিকার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময়ে লড়াই করতে হয়েছে তাদের। এখন সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বৃহৎ পুঁজির মালিকরা প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দখলদারি কায়েম করছে নানা কৌশলে। মৎস্যজীবীদের জীবিকার ক্ষেত্র হয়ে পড়ছে সীমিত। বহু ক্ষেত্রে তারা বাসস্থান চ্যুত হচ্ছেন। মৎস্য সমুদ্র ও সমুদ্র উপকূলে প্রবল ঢেউ, ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তারা মৎস্য শিকারে অভ্যস্ত ছিলেন। আজ সমুদ্র ও সমুদ্র উপকূলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কার্যত বৃহৎ পুঁজির মালিকদের কর্তৃত্ব। মৎস্য চাষে বৃহৎ মালিকদের কর্তৃত্বই কেবল নয়, সেখানে তারা তৈরি করছে ‘একোয়া কালচার’, তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র। সমুদ্র ও সমুদ্র উপকূলের উপর মৎস্যজীবীদের প্রায় সমস্ত অধিকারই লঙ্ঘিত হচ্ছে। অসহায় মৎস্যজীবীরা পরিণত হচ্ছে শ্রম দাসে।
ভারত সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বলে আমাদের দেশের সামুদ্রিক জলসীমার মধ্যে বিদেশি ট্রলারের প্রবেশ ও মাছ ধরা অনুমোদিত। তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামুদ্রিক মাছ যথেচ্ছভাবে তুলে নিচ্ছে। দেশের বাজারে সামুদ্রিক মাছের সংকট দেখা যাচ্ছে। ভারত সরকার তাদের ‘ব্লু ইকনমি’ প্রকল্পে উপকূল এলাকা লীজ দিয়ে দিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কাছে। তারা উপকূলের বালি ও খনিজ উত্তোলনের অধিকার পেয়ে যাচ্ছে এবং পর্যটন ব্যবসাও চালাতে পারবে। অতীতে উপকূল থেকে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা ছিল রাজ্য সরকারের হেপাজতে। বর্তমান আইনে রাজ্যের সেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকা ও বাসস্থান-চ্যুতির সমস্যা অনিবার্য।
বর্তমানে পরিবেশগত সমস্যা সরাসরি মৎস্যজীবীদের জীবনকে সংকটগ্রস্থ করেছে। কারখানার বর্জ্য পদার্থ সমুদ্র-নদীতে মিশে যাচ্ছে। যথেচ্ছ কীটনাশকের ব্যবহার সমুদ্র-নদী-খাল-বিল-জলাশয়ের জল দূষিত হচ্ছে। জল দূষণ মাছ উৎপাদনে কতটা প্রতিকূলতা তৈরি করছে, সহজেই অনুমান করা যায়। এর জন্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন মৎস্যজীবীরা।
রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের সময় ১৯৭৭ সন থেকে এ রাজ্যে মৎস্য উৎপাদন ও মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার সুরহার জন্য তৈরি করা হয়েছিল সহস্রাধিক সমবায়। তার মধ্যে ছিল বৃহৎ সমবায়, প্রতিটি জেলায় পৃথক জেলা সমবায়। তৈরি করা হয়েছিল মৎস্য উৎপাদন গ্রুপ। সরকারি, আধা সরকারি জলাশয়গুলির লীজ নেওয়ার জন্য মৎস্য সমবায়গুলিকে বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হতো না। সরকারি নীতির কারণে মৎস্যজীবী সমবায়গুলিই জলাশয়ের লীজ পেত অনেক কম অর্থের বিনিময়ে। মৎস্যজীবীরা সরকারি, আধা সরকারি জলাশয়ে মাছ ধরে সংসার প্রতিপালনের সুযোগ পেত। এই সময় পর্বে পশ্চিমবাংলা মৎস্য উৎপাদনে ভারত সেরার স্থান দখল করেছিল। এখন তৃণমূল সরকারের আমলে সরকারি, আধা সরকারি জলাশয়ে অনুপ্রবেশ করেছে বেসরকারি উদ্যোগ। শাসক দলের মাতব্বরদের যোগসাজসে বহু ক্ষেত্রে তারাই এবং জলাশয়গুলির লীজ দখল করছে। পিছু হঠছে সমবায়গুলি। মার খাচ্ছে দরিদ্র মৎস্যজীবীরা।
সেই সময় সীমান্তবর্তী এলাকায় সকল মৎস্যজীবীদের পরিচয়পত্র দেওয়া হতো। ফলে তারা সীমান্ত রক্ষী বাহিনি ও পুলিশের নিয়মিত হেনস্থা থেকে রক্ষা পেত। সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীরা পেত বায়োমেট্রিক কার্ড। চালু করা হয়েছিল ‘সেভিংস কাম রিলিফ’ প্রকল্প। এই প্রকল্পে অনেকটা প্রভিডেন্ড ফান্ডের সুবিধা পেত মৎস্যজীবীরা। তৈরি করা হয়েছিল রঙিং মাছের প্রকল্প। এই প্রকল্পের ফলে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। অন্তর্দেশীয় ও সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের ঋণের ব্যবস্থা করা হয় এফএফডিএ এবং বিএফডিএ দ্বারা। চালু হয়েছিল অনেকগুলি মৎস্য বন্দর এবং মৎস্য বাজার। এছাড়া বরফ কল ও মাছ প্রক্রিয়াকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল।
এই সব উদ্যোগের ফলে সেই সময় রাজ্যে মাছ উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। রাজ্যের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার মাছ অন্য রাজ্যে ও বিদেশে রফতানি হতো। রাজ্যের ১৫ লক্ষাধিক মৎস্যজীবী পরিবারের জীবনে খানিকটা অনুকূল অবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু গত এক দশকে এই সব প্রকল্পের অনেকগুলি বন্ধ; কোনওটা চললেও তা নিতান্ত কোনওক্রমে। সমবায়গুলির নির্বাচন বন্ধ। চলছে শাসক দলের মাতব্বরদের দখলদারি। যৌথ উদ্যোগ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় চলছে অবাধ লুঠ। সমবায়গুলির উপার্জন বৃদ্ধির জন্য একদা লাগানো মেহগনি, সেগুন সহ মূল্যবান অরণ্যসম্পদ লুঠ হয়ে যাচ্ছে। উপার্জন কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবী পরিবারগুলির জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মৎস্যজীবী সমবায় ও মৎস্যজীবীরা আজ বিপন্ন। অনেক জায়গায় সমবায় তুলে দিয়ে স্থানীয় মাতব্বররা জমি-জলাশয়-ভেড়ি ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্র অনেকটাই ফড়ে-দালাল-লুঠেরাদের কব্জায়। মৎস্যজীবীরা ক্রমশ এই অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন।
কেরালায় বাম-গণতান্ত্রিক সরকার বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমবায়কে বিকল্প হিসাবে সামনে এনেছে। বিধানসভা ভিত্তিক সমবায় গড়ে তুলছে। সমবায়ের মাধ্যমে মাছ চাষ ছাড়াও মাছ বাজারজাত করার হচ্ছে। মৎস্য বাজারগুলির আধুনিকিকরণ করা হচ্ছে। চার শতাধিক গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়েছে যারা মাছের প্রক্রিয়াকরণ করে বর্ধিত মূল্য সৃষ্টি করছে। ৩৯০টি গুচ্ছ প্রকল্পে কমপ্লেক্স তৈরি করে মৎস্যজীবী পরিবারগুলির জন্য উন্নত মানের বাসস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় সমান সংখ্যক গুচ্ছ প্রকল্পে কমপ্লেক্স তৈরি করে বাসস্থান নির্মাণ করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়াও মৎস্যজীবীদের জন্য ১২৬৫টি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ১৫০০ পুরাতন বাড়ি মেরামতের কাজ শেষ হয়েছে। প্রতি মাসে ১,৪৫,০০ মৎস্যজীবী পরিবারের কাছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর কিটস বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। কেরালার বাম-গণতান্ত্রিক সরকার কঠিন শ্রমে নিযুক্ত এই অংশের মানুষের মানোন্নয়নে সারা দেশের মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.