বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
মণিপুর জ্বলছে জাতি বিদ্বেষের বিষ ও হিংসায়। মণিপুর জ্বলছে সেখানকার বীরেন সিং সরকার, শাসক দল বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবারের পান্ডা আরএসএস, দেশের ও রাজ্যের রাষ্ট্র-ব্যাবস্থা এবং কর্পোরেট পুঁজির মিলিত ব্যবস্থাপনায়।
৩ মে মণিপুরে হিংসার আগুন প্রথম জ্বলে ওঠে। তারপর প্রায় তিন মাস কেটে গেছে সেই আগুন নেভার কোনও নামগন্ধ নেই। বরঞ্চ এই হিংসার আগুন আরো উসকে দেওয়ার কূট কৌশল আছে। মণিপুরে বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকারের তরফে।
গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে মণিপুর জুড়ে জাতি-হিংসার তান্ডবে এখনো পর্যন্ত দেড়শর বেশি মানুষের জীবন শেষ হয়েছে। আহত প্রায় এক হাজার। ৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২০০টি গ্রাম। এরমধ্যে প্রায় ৬০টি গ্রাম পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে চলে গেছেন।
এই দীর্ঘ সময় ধরে জাতি হিংসার মারন-তান্ডবে মণিপুর ছারখার হলেও তার দিকে গোটা দেশের নজর সেভাবে ছিল না। মণিপুরের খবর প্রচারে কর্পোরেট মিডিয়ার অনিহার জন্য। এর মধ্যেই মণিপুরে ঘটে গেছে আরো এক বর্বরতম ঘটনা। যা প্রকাশ্যে এসেছে জুলাই মাসের চতুর্থ সপ্তাহে একটি ভিডিওর মাধ্যমে। কেউ বা কারা এই ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার পর। এই ভাইরাল ভিডিও আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা গেলো, মেঠো পথ দিয়ে দুই আদিবাসী মহিলাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজনের বয়স কুড়ি-বাইশ। অপরজন চল্লিশের আশেপাশে। তাঁদের ঘিরে কয়েকশ উন্মত্ত জনতা। মেঠো জমিতে আছড়ে ফেলে ওই দুই মহিলাকে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। এই ভয়ঙ্কর ভিডিওর দৃশ্য দেখে গোটা দেশ নড়ে যাওয়ার পর সব মিডিয়া তা নিয়ে খবর করতে বাধ্য হয়। জাতি হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা মণিপুর এখন সবার সামনে। এরমধ্যে সংসদের বাদল অধিবেশনও শুরু হয়েছে। সংসদ উত্তাল হয়েছে মণিপুরের ঘটনায়। সংসদের ভিতরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিবৃতির দাবিতে। সারা দেশ তোলপাড় হচ্ছে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের পদত্যাগের দাবিতে।
মণিপুরে উত্তর-পূর্ব ভারতের খুবই সংবেদনশীল একটি রাজ্য। মণিপুরে মোট ৩৬টি জনজাতি আর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস। এর মধ্যে তিনটি প্রধান অংশ হল ইম্ফল উপত্যকায় বসবাসকারী মেইথেই সম্প্রদায়। যাঁরা হিন্দু ধর্ম বা আদিবাসী সানামাহি ধর্মের অনুসারী। দ্বিতীয় হল কুকি এবং নাগা জনগোষ্ঠী। যাঁরা প্রধানত খ্রিস্টান। এছাড়াও এখানে বেশ কয়েকটি ছোট জনজাতি সম্প্রদায় এবং অন্যান্য রাজ্যের মানুষজনও রয়েছেন।
মণিপুরে এর আগেও অবশ্য এক জনজাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য জনজাতি গোষ্ঠীর সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। অতীতে সেই সব সংঘাত বা দ্বন্দ্বের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক ছিল না। যেমন অতীতে নাগা এবং কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ২০১৭ সালে মণিপুরে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। আর তারপরেই মণিপুরে বিজেপি, আরএসএস, সঙ্ঘ পরিবারের অন্যান্য সংগঠন এবং গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তারা একসঙ্গে মিলেই ষড়যন্ত্র করে এবং ধর্মীয় প্ররোচনা ছড়িয়ে খ্রিস্টান ধর্মালম্বী কুকিদের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মালম্বী মেইথেইদের প্ররোচনা দেয়। এই চক্রান্তে আজ মেইথেই-কুকি জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব হিন্দু-খ্রিস্টান ধর্মীয় সংঘাতে রূপ নিয়েছে। গুজরাটের মতোই মণিপুর আজ উগ্র হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া বাহিনী এবং কর্পোরেট পুঁজির সীমাহীন ধান্দার নতুন গবেষণাগার।
সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে মণিপুরে আসা হাজার হাজার শরণার্থীর অভিবাসনের বিষয়টিকেও কুকিদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করতে কাজে লাগিয়েছে কেন্দ্রের মোদি, মণিপুরের বীরেন সিং সরকার। দেশের মোদি সরকার মায়নামার থেকে আসা শরণার্থীদের উদ্বাস্তু মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। তাঁদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ঘোষণা করে কেন্দ্রের সরকার। এই ঘটনায় মায়ানমার থেকে আসা শরণার্থীরা একদিকে যেমন সমস্যায় পড়েছেন, অন্যদিক, তাঁদেরকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে কুকিদের বিরুদ্ধেও মণিপুরের বাকি অংশের মানুষকে উসকে তোলা হয়েছে। কুকিদের গায়েও অবৈধ বহিরাগতের স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছে বিজেপি এবং আরএসএসের দলবল। এর ফলে কুকি-বিরোধী হিংসার তীব্রতা আরো বেড়েছে।
রাজ্যের বীরেন সিং সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে সেখানে বসবাসকারী কুকি সহ জনজাতি গোষ্ঠীগুলিকে উচ্ছেদ করতে শুরু করেছে। এর পিছনেই রয়েছে ধান্ধার ধনতন্ত্র এবং কর্পোরেট পুঁজির উদগ্র লালসা। রাজ্যের বনাঞ্চল থেকে কুকিদের উচ্ছেদ করার কারণে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে।
এর পাশাপাশি গত আড়াই মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিরন্ময় নীরবতাই হল কুকি-বিরোধী রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের হাতে গরম উদাহরণ। সুপ্রিম কোর্টের তীব্র ভর্ৎসনার আগে পর্যন্ত মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে একটি কথাও মোদি বলেননি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় দেশজোড়া বিক্ষোভের মুখে এবং সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার পর শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে সংসদ চললেও সংসদের মধ্যে নয়। মণিপুর নিয়ে উত্তাল বিক্ষোভে সংসদ অধিবেশন ভেস্তে গেলেও মোদির মুখ থেকে টুঁ শব্দটুকু বার হয়নি। বেকায়দায় পড়ে সংসদের বাইরে সাংবাদিকদের সামনে তিনি মুখ খোলেন। মণিপুরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কড়া আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। মণিপুরে হিংসার তদন্তের ভার সিবিআইকে দেওয়া ছাড়া বেশ কিছুদিন দিন কেটে গেলেও কেন্দ্রের তরফে কোনও কড়া ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। মণিপুরের হিংসা চলছেই। দীর্ঘ নীরবতার পর মণিপুর নিয়ে মোদির মুখের বচনকে অনেকে কুমিরের কান্না বলেই মনে করছেন।
এখানে প্রশ্ন হল মণিপুরের ঘটনার পিছনে কর্পোরেট পুঁজির ধান্দাটা কি? আসলে মণিপুরে খনিজ সম্পদের যে বিপুল ভান্ডারের হদিস মিলেছে সেটাই দেশ ও রাজ্যের শাসক বিজেপি এবং তাঁদের দোস্ত কর্পোরেট পুঁজির প্রধান টার্গেট। যেখানে এই খনিজ সম্পদের বিপুল ভান্ডার সেখানেই মূলত কুকিদের বসবাস। মণিপুরের পাহাড় এবং বনাঞ্চল। তাই সেখান থেকে কুকি খেদাও, খনিজ সম্পদ হাতাও — এটাই দেশ ও মণিপুরে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার এবং কর্পোরেট পুঁজির প্রধান ধান্দা।
জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সমীক্ষা অনুসারে মণিপুরে নিকেল, তামা এবং মহার্ঘ্য প্লাটিনাম গ্রুপের খনিজ পাওয়া গেছে। এছাড়াও আছে ম্যাগনেটাইট, আ্যজুরাইট, ম্যালাকাইট, লাইমস্টোন এবং আরো বেশ কিছু খনিজ সম্পদ। মণিপুরের ২২ হাজার ৩২৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই সমীক্ষা করে জিএসআই। এই বিপুল খনিজ সম্পদের ভান্ডারের উপরে কর্পোরেট পুঁজি এবং মাইনিং কোম্পানিগুলির লালসা।
মণিপুরের বিজেপি সরকার অঙ্ক কষেই মেইথেইদের তফশিলি জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতদিন পাহাড় এবং বনাঞ্চলের জমি কেনার অধিকার মেইথেইদের ছিল না। এখন মেইথেইরা জনজাতি হলে সহজেই পাহাড় এবং বনের জমি কিনতে পারবে। আর সেই জমি বেচেও দিতে পারবে কর্পোরেট পুঁজির পান্ডা এবং মাইনিং কোম্পানিগুলির কাছে।
কর্পোরেট প্রভুদের দিল খুস করার জন্য মণিপুর সরকারের দ্বিমুখী ষড়যন্ত্রের আরো একটি মুখ হল, সেই রাজ্যের শিল্প ও বিনিয়োগ নীতি। মণিপুরের ক্ষমতায় এসেই ২০১৭ সালে রাজ্যের শিল্প ও বিনিয়োগ নীতি নতুন করে তৈরি করে বীরেন সিং সরকার। কর্পোরেট প্রভু এবং মাইনিং কোম্পানিগুলিকে ঢালাও ছাড় এবং আরো নানা সুবিধা দেওয়াই সেই নীতির মূল উদ্দেশ্য। আর সেই লক্ষ্যেই বীরেন সিংয়ের সরকার ২০১৮ সালে মণিপুরের নয়া খনিজ নীতিও তৈরি করে। কর্পোরেট প্রভু এবং মাইনিং কোম্পানিগুলির দিল খুস করে দেওয়ার খনিজ নীতি। তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে শুরু হল রাজ্যের বনাঞ্চল এবং পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে কুকি পরিবারগুলিকে বেপরোয়া ভাবে উচ্ছেদ করার কাজ। লক্ষ্য একটাই। মণিপুরের বন ও পাহাড় থেকে কুকি খেদাও, খনিজ হাতাও। আর গত আড়াই মাস ধরে মণিপুর জুড়ে জাতি হিংসার যে মারণ-তান্ডব চলছে তা সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য এক প্রাণঘাতী গণহত্যা কারসাজি। নিজভূমি থেকে তাঁদের ভিটে-মাটি চাটি করার নিষ্ঠুর পরিকল্পনা।
মণিপুর যখন জ্বলছে তখন আমাদের রাজ্যও গভীর উদ্বেগের ঘটনাবলি ঘটছে। এটা ঠিক যে, মণিপুরের মতো জাতি হিংসার আগুন এ রাজ্যে জ্বলেনি। কিন্তু নারীর উপর অত্যাচার! জান্তব হিংসায় দল বেঁধে পিটুনি! কদর্য উন্মত্ততার ‘‘মব লিঞ্চিং’’! সম্প্রতি মালদায় দুই মহিলাকে নগ্ন করে দল বেঁধে মারের লজ্জাজনক ঘটনা সামনে এসেছে। নারী নির্যাতনের ঘটনায় আমাদের রাজ্যে আজ মণিপুর এবং বিজেপি শাসিত অন্য রাজ্যগুলির ছায়া। মমতার শাসনে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের ঘটনায় দেশের প্রথম দু’ তিনটে রাজ্যের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান। রাজ্য জুড়ে ক্রমাগত বেড়ে চলা নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়ার সরকারি প্রবণতা সামনে এসেছে।
এই রাজ্যে ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জঙ্গল এলাকায় কুড়মি আর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরোধের অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে। কুড়মি জনগোষ্ঠী জনজাতি মর্যাদার দাবি তুলে আন্দোলনে নেমেছে। সাঁওতাল সহ অন্যান্য তালিকাভুক্ত জনজাতি কুড়মিদের দাবির বিরোধিতা করছে। এই দুই অংশের মানুষকে নিয়েই তৃণমূল আর বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে। আদিবাদীদের বিরুদ্ধে কুড়মিদের এবং কুড়মিদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের নানা কৌশলে লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের রাজ্যে নানা ভাবে মানুষে মানুষে বিভাজন ঘটানোর ছক কষছে তৃণমূল এবং বিজেপি। গরিব, প্রান্তিক ও মেহনতি মানুষের মধ্যে বিভাজনের বিষ ঢুকিয়ে তাদের ঐক্য তছনছ করার চেষ্টা হচ্ছে নানান কায়দায়।
বিপদ ওঁত পেতে আছে। তাই যে কোনও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে বামপন্থী কর্মীদেরই সতর্ক থাকতে হবে। কঠোর সতর্কতা যেমন বাইরে প্রয়োজন, তেমনই ঘরেও আজ সম্পূর্ণ সজাগ থাকা দরকার।
না হলেই বিপদ গ্রাস করবে। যে বিপদের থাবায় অতীতেও রাজ্যে অনেকবার জনগণের ঐক্যের ক্ষতি করেছে।