বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

মোদির ভারতে শ্রমজীবীদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক অবস্থানে

মোদির ভারতে শ্রমজীবীদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক অবস্থানে

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

এবারের নির্বাচনে মোদির গ্যারান্টি আর চারশো আসন পার করার ঘুড়ি গোঁত্তা খেয়ে পড়েছে। বেগতিক দেখে মোদি, অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপির সব নেতা আরএসএসের নির্দেশে ধর্মীয় বিভাজনকে আঁকড়ে ধরে ভোটে জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তবে যে গভীর পাঁকে তারা পড়েছেন, এমনকী ভোটে জিতলেও, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন।
সেই পাঁক হল দেশের ছিন্নভিন্ন অর্থনীতি। অর্থনীতি নিয়ে স্রেফ কিছু বাগাড়ম্বর করা ছাড়া মোদি সরকার কিছুই করেনি। বরং বলা যায়, এমন কিছু করেছে যা দেশের সম্পদের বৈষম্যকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যা এমনকী ব্রিটিশ শাসন কালেও দেখা যায়নি। “ইনকাম অ্যান্ড ওয়েলথ ইনইকোয়ালিটি ইন ইন্ডিয়া, ১৯২২-২০২৩: দ্য রাইজ অফ বিলিওনার রাজ” শীর্ষক রিপোর্টে থমাস পিকেটিরা জানিয়েছেন, ২০২২-২৩ সালে ভারতের মাত্র ১ শতাংশ লোকের আয় দাঁড়িয়েছে দেশের মোট আয়ের ২২.৬ শতাংশ এবং তাদের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। আয় ও সম্পদের এই বিপুল কেন্দ্রীভবন ঐতিহাসিক নজির তৈরি করেছে। ভারতের ১ শতাংশ ধনীদের হাতে যত সম্পদ এখন রয়েছে, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার ১ শতাংশ ধনীদের হাতে ততো সম্পদ নেই। অর্থাৎ বিশ্বে চরম অসাম্যের দেশ যতগুলি রয়েছে তার একেবারে সামনের সারিতে রয়েছেন মোদির ভারত। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এমনকী ব্রিটিশ আমলেও ভারতে এত সম্পদ ও আয়ের অসাম্য ছিল না। মোদি সরকারের নীতির ফলেই যে এই অসাম্য তৈরি হয়েছে, সেটা আর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। এবারও ভোটের আগে মোদি গ্যারান্টি দিয়েছেন তিনি এদেশে আরও আরও মহিলা ক্রোড়পতি তৈরি করবেন। ক্রোড়পতিদের তিনি কতটা তীব্রভাবে ভালবাসেন, মোদির এ হেন গ্যারান্টিই তার প্রমাণ।
তবে এখানেই শেষ নয়। মোদির আমলে গরিব, মেহনতী মানুষের বঞ্চনার শেষ নেই। শ্রমিক-কৃষকদের কথাই ধরা যাক।
অর্থনীতিবিদ জাঁ দ্রেজ ও রীতিকা খেরা সম্প্রতি হিসাব কষে দেখিয়েছেন, মোদির আমলে দেশে শ্রমজীবীদের প্রকৃত মজুরি একেবারেই বাড়েনি। তাঁরা দেখিয়েছেন, যদি মূল্যস্ফীতির হিসাব ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে ২০১৪ থেকে ২০২৪ এর মধ্যে কৃষি শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বছরে ১.৩ শতাংশ হারে কমেছে। এর উল্টো ছবিটা হল, মনমোহন সিংয়ের আমলে, মানে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশে প্রকৃত মজুরি বছরে ৬.৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। যে মোদি মনমোহন সিংয়ের সরকারকে নিকম্মার সরকার বলে গালি দিতেন। জাঁ দ্রেজ বলেছেন, ‘মোদি ক্ষমতায় আসার আগের ১০ বছরে দেশে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। স্বাধীন ভারতে এটাই সবচেয়ে দ্রুতগতিতে মজুরি বৃদ্ধির পর্ব। আর এখন এই হার একেবারে শূন্য।’ এমনকী ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শুধু কৃষি বা অকৃষি শ্রমিক নয়, বেতনভুক কর্মচারী এবং স্বনিযুক্ত কর্মীদেরও প্রকৃত মজুরি কমেছে। এবং কমেছে মোদির আমলেই। (গ্রোথ ইন রিয়েল ওয়েজেস ভারচুয়ালি জিরো আন্ডার মোদি গভর্নমেন্ট, এলিশা ভারমানি, ২২এপ্রিল, ২০২৪, দ্য অয়্যার)।
২০০৫-২০০৬ থেকে ২০১৩-১৪ সালের মধ্যে সংগঠিত সেক্টরের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ১০.১ শতাংশ। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ সালের মধ্যে এই হার ভীষণভাবে কমে হয়েছে ৬.১ শতাংশ। যদি ধরে নেওয়া এই পর্বে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫.১ শতাংশ, তাহলেই স্পষ্ট হবে যে মোদির আমলে শিল্প শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কার্যত কিছুই বাড়েনি।
দেশের প্রায় ৪৪ কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা একেবারে দুঃসহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। ২০২২এর জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে করা পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের (পিএলএপএস) তথ্য অনুযায়ী, ভারতে স্বনিযুক্ত কর্মীদের হার, ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয় ৫৭.৩ শতাংশ। এদের গড় মাথাপিছু আয় ছিল মাসে ১০,০০০ টাকার অনেক কম। ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরের মধ্যে স্বনিযুক্ত কর্মীদের আয় প্রকৃত অর্থেই কমে গিয়েছিল। অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২২ থেকে জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩ সালের সময়পর্বে নিয়মিত বেতনভুক শ্রমিকদের গড় আয়ও কমে গিয়েছে। অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া সাপলিমেন্ট ২০২২ রিপোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ভারতের ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে এবং তাঁদের জীবনজীবিকার বিপুল ক্ষতি হয়েছে। ইউএনডিপি (২০২২এর সেপ্টেম্বর) যে মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেই রিপোর্ট অনুসারে ভারতে জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বেশি (২৭.৯ শতাংশ) তীব্র দারিদ্রের মধ্যে বেঁচে আছেন। চরম সংখ্যার কথা ধরলে, ভারতে প্রায় ৩০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ১৭৮ টাকার কম।
একই ভাবে ভারতে ২০০৪-০৫ সাল থেকে ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত কৃষিতে গড় বার্ষিক মজুরি বৃ্দ্ধির হার ছিল ১২.৩ শতাংশ। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে মজুরি বৃদ্ধির এই হার ভয়ঙ্করভাবে কমে হয়েছে ৪.৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ সালের মধ্যে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ১ শতাংশেরও কম। কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছে।
এই যখন মজুরি ও আয়ের অবস্থা, তখন শ্রমিকেরা যাতে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারেন সেজন্য কঠোর আইন চালুর ব্যবস্থা করেছে মোদি সরকার।
এখন চালু ২৯টি শ্রম আইনকে বাতিল করে তার জায়গায় আনা হয়েছে চারটি শ্রম কোড। এগুলি হল মজুরি সংক্রান্ত কোড, শিল্প সম্পর্ক বিষয়ক কোড, পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ বিষয়ক কোড এবং সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোড। বাতিল হওয়া আইনগুলিতে আদতে যে সব অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা চালু ছিল, এই সব কোডে সেই সব অধিকার ও সুযোগসুবিধাগুলিকে আরও ছেঁটে ফেলা হয়েছে এবং অনেকগুলিকে স্রেফ বাদ দেওয়া হয়েছে।
কাজে নিয়োগ করার নিয়মকানুন চূড়ান্তভাবে নমনীয় করে তোলা হয়েছে যাতে নিয়মিত উৎপাদনে বেশি বেশি সংখ্যায় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক, ক্যাজুয়াল শ্রমিক, নির্দিষ্ট মেয়াদের কর্মী, শিক্ষানবিশ ইত্যাদি নিয়োগের সুবিধা হয়। বিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরিরও নীচে ফ্লোর লেভেল মজুরি দেওয়াকে আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। দিনে ৮ ঘণ্টার কাজের সময়কে প্রায় তুলে দিয়ে আরও দীর্ঘ সময়ের কাজের দিন চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসবই করা হয়েছে শ্রমিকদের যাতে আরও তীব্রভাবে শোষণ করা যায় তার স্বার্থে।
শিল্প সম্পর্ক কোড এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে কাজের জায়গায় আর ইউনিয়ন করা না যায়। ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার ব্যাপারটাকে আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে। এতটাই কঠিন যে নতুন কোডে ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া কার্যত অসম্ভব। পাশাপাশি রেজিস্ট্রার অফ ট্রেড ইউনিয়নের হাতে খেয়ালখুশি মতো ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ‘ধর্মঘট’ এর সংজ্ঞা সুপরিকল্পিতভাবে এতটাই প্রসারিত করা হয়েছে যে, তাতে এমনকী যৌথভাবে প্রতিবাদ করাকেও ধর্মঘট হিসাবে বিবেচনা করা যাবে। নতুন কোডে কার্যত যে কোনও ধর্মঘটকেই বেআইনি ঘোষণা বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যাবে। শ্রমিকদের ওপর, ট্রেড ইউনিয়নের ওপর কিংবা যদি কেউ কোনওভাবে ধর্মঘটকে সমর্থন করেন তাহলে তাঁর ওপরও বিপুল টাকার জরিমানা চাপানো যাবে এবং জেলে বন্দি করে রাখা যাবে। সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোডে কোনও সুনির্দিষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের উল্লেখ নেই।
মোদির আমলে কৃষিখাতে সরকারি বরাদ্দ কমেছে। কৃষিকাজে গড় বার্ষিক মজুরিবৃদ্ধির হার ১২.৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪.৮ শতাংশ। এমএসপি দাবি করায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন কৃষকেরা। এটাই মোদির আমলের বাস্তবতা।
তথ্যগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সব গ্যারান্টিই আসলে জুমলা। ভোটে জিতে মোদি চান দেশি বিদেশি একচেটিয়া ও ক্রোনি পুঁজির একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করতে। মোদির সেই রাজত্বে শ্রমিক, কৃষক সহ শ্রমজীবী মানুষের কোনও অধিকারই আর নিরাপদ থাকবে না। লাগামহীন শোষণের মুখে পড়তে হবে তাঁদের। একই সঙ্গে মোদি জলাঞ্জলি দিতে চান ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিকে। আর সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে এই দেশকে করে তুলতে চান একটি ঘৃণা সঞ্চারকারী হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র।
সুতরাং কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক জোট এবং তাদের রাজনৈতিক মুখপাত্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি-আরএসএসকে ক্ষমতা থেকে হঠানোই এই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের কর্তব্য।

গত পাঁচ বছরে ব্যাঙ্কগুলি প্রায় ১০.৬ লক্ষ কোটি টাকা মকুব করে দিয়েছে,
যার মধ্যে প্রায় ৫০% বড় শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের। — ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩।
অথচ পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকার ঋণ মুকুব না হওয়ায়
হাজার হাজার গরিব কৃষক আত্মহত্যা করার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.