বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

জাতীয় আয়বৃদ্ধি, আমজনতা

জাতীয় আয়বৃদ্ধি, আমজনতা

নির্মলেন্দু নাথ

photo

২০২৪এর লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি কার্যত শুরু হয়ে গেছে। একদিকে বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট বিজেপির দিকে জোরালো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে ইন্ডিয়া জোটের আত্মপ্রকাশের পর শাসক বিজেপি যে উদ্বিগ্ন, মোদির আক্রমণেই তা স্পষ্ট হচ্ছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিপথ কী হবে। এদেশে মোদি সরকারের উদারনীতিবাদী অর্থনীতি ও বিভাজনের রাজনীতি চলবে কিনা স্পষ্ট হবে সেই বিষয়টিও।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অর্থনীতির কথা যদি ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে মোদির রাজত্বে এদেশের অর্থনীতি এক গভীর সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এর প্রধান প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, সমাজে আয় বৈষম্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয়ত বেকারি ও মূল্যবৃদ্ধি সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাচ্ছে। মোদির রাজত্বে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ঋণে বাড়তি সুদের হারের বোঝা, জমা টাকা থেকে সুদ বাবদ আয় কমা — এসবই অর্থনীতির গভীর সঙ্কটের লক্ষ্মণ যার দায় বইতে হচ্ছে এদেশের গরীব ও মধ্যবিত্তকে। খাদ্য নিরাপত্তা, ঋণের ভার এবং আয় বৈষম্য— এই তিনটি সূচকের বিচারে ভারতের অর্থনীতির সঙ্কটের চেহারাটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বদল আনা এবং সাধারণ মানুষকে রিলিফ দেওয়ার জন্য কী ধরনের কর্মসূচিকে জনপ্রিয় করে তোলা দরকার, সেবিষয়ে আলোচনা করা জরুরি।
গণতন্ত্রের একটা নিয়ম আছে। নিয়মটা হচ্ছে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তাকে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ফলে আমজনতার কাছে সরকার তার ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য দায়বদ্ধ। সরকারের তরফে এই কাজ আগেও করা হতো, এখনও করা হয়। তবে পদ্ধতির রূপান্তর ঘটেছে। আগে ছিল ‘‌নিউজ রিল’‌, এখন ‘মন কি বাত’‌। একটা ভিস্যুয়াল, একটা ভার্চুয়াল। স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকে সরকারের কাজকর্ম সাধারণের কাছে পৌঁছনোর দায়িত্ব ছিল ফিল্ম ডিভিশনের। এই সময় প্রতিটি শো’য়ের শুরুতে ফিল্ম ডিভিশনের তৈরি একটা আট–দশ মিনিটের নিউজ রিল থাকত। নিউজ রিলের বিষয়বস্তু থাকত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুসৃত জাতিগঠন সংক্রান্ত সরকারের অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কাজকর্মের বিস্ময়সৃষ্টিকারী অথচ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। শতদ্রু নদীর ওপর ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধ, বরাকর নদীর ওপর মাইথন বাঁধ, এমন সব উদাহরণ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭২ এর মধ্যে এমন ১৮০০টি নিউজ রিল তৈরি করা হয় এবং প্রায় ৮০০০ সিনেমা তৈরি করা হয়। এই সব নিউজ রিলে দেখা যেত মানুষ একত্রে সারিবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্যাপৃত। বিচ্ছিন্নভাবে কোনও ব্যক্তিকে তুলে ধরার প্রবণতা লক্ষ্য করা যেত না। একটা হিসাবে দেখা যায়, যদি কোনও ব্যক্তি বছরে ৭–৮টা সিনেমা দেখে, তাহলে ওই ৮০০০ সিনেমার মাধ্যমে বছরে ২ কোটি ব্যক্তির মনের গভীরে অত্যন্ত কম খরচে সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। নিউজ রিল বা ভিস্যুয়াল পদ্ধতিতে আমজনতার কাছে পৌঁছনোর বিষয়টার অবসান ঘটে সত্তরের দশকের শেষ দিকে।
ভার্চুয়াল যুগ শুরু ২০১০ সাল নাগাদ। ২০১৪ সালে শুরু হয় ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান। ২০১৪ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে বেতার সম্প্রচারিত এই অনুষ্ঠানের শতাধিক পর্ব হয়েছে। বেতার সম্প্রচারিত এই অনুষ্ঠানের শ্রোতৃমণ্ডলী ও উচ্চারিত শব্দ নিয়ে কয়েকটি কথা এখানে বলা হবে।
ক)‌ ২০২২ সালে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটি–র এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মাত্র ৪০ শতাংশ লোক এসম্পর্কে অবহিত। খ)‌ ২০২০ সালে দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনের পর্বে কৃষকেরা এই বেতার অনুষ্ঠানের সময় থালা বাজিয়েছিলেন। গ)‌ ২০১৯ সালে ৬০তম এপিসোডের শেষে দেখা যায় সব মিলিয়ে মন কি বাত–এ ‘যুব’ শব্দটা ৩০ বার উচ্চারিত হয়েছে আর ‘‌অর্থনীতি’‌ শব্দটা মাত্র ৮ বার উচ্চারিত হয়েছে। এসব থেকে বলা যায় প্রচারের ভিস্যুয়াল যুগে যা ছিল মুখ্য এখন প্রচারের ভার্চুয়াল যুগে তা এখন গৌণ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের চিত্রটাও কমবেশি এক। অর্থনীতির ভিত মজবুত করা, জল, জমি, কাজের ওপর মানুষের অধিকার বোধকে জাগ্রত করা ইত্যাদি বিষয়গুলো গৌণ। ‘‌দুয়ারে সরকার’‌ অর্থাৎ মুখ্য হল ‘পাইয়ে দেওয়া’‌ র গল্প। এতে সরকারের ভাবমূর্তি বজায় থাকে, আবার ভোটব্যাঙ্কও অটুট থাকে। আমাদের আলোচনা এই ভাবমূর্তি বজায় রাখার সঙ্গে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির সম্পর্কটি অনুধাবন করা।
২‌
প্রথমেই বলা দরকার জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমার্থক নয়। প্রকৃত অর্থে অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটবে, সাধারণ মানুষের আয় বাড়বে। যে সব দেশ উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনীতিতে কৃষির অংশ কমে এবং শিল্পের অংশ বাড়ে। একটা পর্যায়ের পর শিল্পের অংশও কমতে শুরু করে এবং পরিষেবার অংশ বাড়ে। এধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন হলে শ্রমশক্তির বিন্যাসে তার প্রতিফলন আশা করা যায়। আর তা হলে মানুষ গতানুগতিক খাত থেকে আধুনিক খাতে যেতে পারে এবং তাদের আয় বাড়তে পারে। ১৯৭১ সালে সাইমন কুটনেজৎস এই ধারণার সূত্রপাত ঘটান এবং ভারতে সি এস পাপোলা এবিষয়ে একজন পথিকৃৎ। কাঠামোগত পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় সরবরাহের দিক থেকে আসে প্রাকৃতিক সম্পদের আবিষ্কার, পুঁজির বৃদ্ধি, উন্নত উৎপাদনশীলতার কৌশল, শ্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি। আর চাহিদার দিক থেকে রয়েছে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি, জাতীয় আয়ের বণ্টনে পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তায় নিশ্চয়তা প্রদান প্রভৃতি সামাজিক ও প্রতিষ্ঠানগত পরিবর্তন।
ভারতে অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের ধারা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, পরিকল্পনার প্রথম তিন দশকে জাতীয় আয়ে কৃষির অংশ হ্রাস পাচ্ছে ও পরিবর্তে শিল্পের অংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার কিছুটা নিউজ রিলে ‘‌প্রতিভাত’‌ হত। এরপর জাতীয় আয়ে সেবাক্ষেত্রের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, ১৯৯০–৯২ থেকে ২০০৭–২০০৯ এর পরিসরে সেবাক্ষেত্রের গুরুত্ব ৯.‌৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কাঠামোগত ক্ষেত্রে সূচকের মান ১১.‌৪ হয়েছে (‌সূচকের মান বেশি হওয়ার অর্থ বেশি পরিবর্তন)‌। এখন অর্থনীতিতে সেবাক্ষেত্রের অসংখ্য উপক্ষেত্র রয়েছে। এগুলি হল ১)‌ ব্যাঙ্কিং ও বিমা, ২)‌ কমিউনিকেশন, ৩)‌ রিয়েল এস্টেট, ঘরবাড়ি ব্যবসা, সাধারণ ব্যবসা, এবং ৪)‌ অন্যান্য সেবা। এটা দেখা গেছে যে প্রতিটি উপক্ষেত্রেই বিপুল বিস্তার হয়েছে। এর মধ্যে কমিউনিকেশেনে অগ্রগতির হার ২০০৫–২০১০ এর পরিসরে ২৮ শতাংশ। পাশাপাশি যেটা ঘটেছে তা হল নানান ধরনের ফাইনান্সিয়াল মার্কেট (‌অর্থের বাজার)‌ এর আবির্ভাব। এক কথায় যুগটা হল, পণ্য উৎপাদনের নয়, ‘‌অর্থের বাজারের যুগ’‌।
সঠিকভাবে দেখলে বোঝা যায়, তিনটি বিষয়ের সমাহার এখানে হয়েছে। ১)‌ নয়া উদারনৈতিক মতাদর্শের বাড়বাড়ন্ত, ২)‌ ১৯৭০এর পর স্ট্যাগফ্লেশন ও ব্রেটন উডস–এর পতন, ৩)‌ ইনফরমেশন টেকনোলজির অকল্পনীয় বিস্তার। আন্তর্জাতিক ভাবে ঘটে যাওয়া এই বিষয়গুলো ভারতীয় অর্থনীতিতে সূদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

আগেই বলা হয়েছে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটলে বিভিন্ন ভাবে তার প্রকাশ ঘটে। এগুলির মধ্যে হ্যারড–ডোমারের তত্ত্ব অনুযায়ী জিডিপির বাৎসরিক বৃদ্ধির হার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও সঞ্চয়বৃদ্ধির হার ১৯৫০–৫১ থেকে ২০১১–১৮র পরিসরে আলোচনা করা হবে। এখানে দেখা যাবে তিনটি সূচকই খুব হতাশাব্যঞ্জক নয়। আমজনতার মধ্যে এর প্রতিফলনের স্বরূপ বোঝার জন্য তিনটি সূচক ব্যবহর করা হবে। ১)‌ খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। প্রথমে মনে রাখা দরকার খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কেবল পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চয় করাই যথেষ্ট নয়। দেশের দরিদ্র জনগণ যেন প্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয় করতে পারে (‌যা নির্ভর করে তাদের আয় ও খাদ্যমূল্যের ওপর)‌ তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। ২)‌ আয় বৈষম্যের সূচক ও ৩)‌ ঋণের ভার। এই তিনটি সূচকেই দেখা যাবে ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির বাৎসরিক হার সন্তোষজনক হলেও আমজনতার মধ্যে তার প্রতিফলনের সূচকের মান কাঙ্ক্ষিত নয়, বরং নেতিবাচক।
ভারতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হার, বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার ও সঞ্চয়ের হার ১৯৫০–৫১ থেকে ২০১১–১৮র পরিসরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা সারণি ১ এ রাখা হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকে‌ জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের কম ছিল। ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ একে ‘‌হিন্দু রেট অফ গ্রোথ’‌ বলে অভিহিত করেন। ১৯৮০ সালে উদারীকরণের পর জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হারে ত্বরণ আসে। ২০০১–২০১১ র দশকে এই বৃদ্ধির হার ৭.‌৬৮ শতাংশ হয়।

সারণি ১— জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হার, বিনিয়োগের হার ও সঞ্চয়ের হার, ভারত: ১৯৫০–২০১৮
সময় জিডিপির বার্ষিক বিনিয়োগের হার সঞ্চয়ের হার
বৃদ্ধির হার (‌%) (%) (%)

‌১৯৫১–৬১ ৩.৯১ ১১.৮২ —
১৯৬১–৭১ ৩.৬৮ ১৪.৭১ ৯.৩
১৯৭১–৮১ ৩.০৯ ১৭.৮৬ ১২.৯৬
১৯৮১–৯১ ৫.৩৮ ২১.০৪ ১৭.৩২
১৯৯১–২০০১ ৫.৭১ ২৪.১৪ ২৪.২৭
২০০১–১১ ৭.৬৮ ৩২.৪৪ ৩১.৪২
২০১১–১৮ ৬.৬১ ৩৫.৭৮ ৩১.১৭
সূত্র – অর্থনৈতিক সমীক্ষা বিভিন্ন বছর ও কৌশিক বসু

এই প্রসঙ্গে বলা দরকার সম্প্রতি জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হারকে বাড়িয়ে দেখানোর একটা অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। এখানে দেখা যায় কোভিডের বছরকে ভিত্তিবর্ষ হিসাবে ব্যবহার করে ২০২২ সালে জিডিপির বৃদ্ধির বার্ষিক হার দাঁড়ায় ৮.৭ শতাংশ। ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি ১৯৯০এর পর থেকে তার প্রাথমিক জড়তা কাটাতে পেরেছে, যা তিনটি সূচকেই স্পষ্ট। সঞ্চয়ের প্রসঙ্গে যা বলা দরকার এখনও পর্যন্ত গার্হস্থ্য সঞ্চয়ই সঞ্চয়ের প্রধান উৎস। মোট সঞ্চয়ের মধ্যে ৬৫ শতাংশই হল গার্হস্থ্য সঞ্চয়। এর তাৎপর্য সঞ্চয়ের জগতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের আধিপত্য।
এখন প্রশ্ন, ওপরের তিনটি সূচকের অপেক্ষাকৃত ইতিবাচক মান আমজনতার জীবনযাত্রায় কী ধরনের পরিবর্তন এনেছে তা আলোচনা করা হবে।
প্রথম বিষয়টা হল খাদ্য নিরাপত্তা। এখানে দেখা হবে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণের ধরন এবং প্রত্যেক ব্যক্তির বছরে খাদ্যশস্য গ্রহণের পরিমাণ। ১৯৫১ থেকে ২০১৬র পরিসরে এসংক্রান্ত তথ্য সারণি ২ এ রাখা হয়েছে।

সারণি ২–খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ও বাৎসরিক মাথাপিছু খাদ্যসশ্য গ্রহণের পরিমাণ, ভারত:‌ ১৯৫১–২০১৬
সময় খাদ্যশস্য উৎপাদনের বাৎসরিক মাথাপিছু
পরিমাণ (‌মিলিয়ন টন) খাদ্যশস্য গ্রহণ (‌কেজি)‌

১৯৫১ ৫০.৮২ ১৪৪.১০
১৯৬১ ৮১. ০২ ১৫৭.৬০
১৯৭১ ১০৮.৪১ ১৭১.১০
১৯৮১ ১২৯.৫৯ ১৬৬.০০
১৯৯১ ১৭৬.৩৯ ১৮৬.২০
২০০১ ২১১.৯০ ১৫১.৯০
২০১১ ২৪৪.৪৯ ১৭০.৯০
২০১৬ ২৭৫.১১ ১৭৭.৯০
তথ্যসূত্র:‌ কৃষি দপ্তর ও পরিবার কল্যাণ উন্নয়ন দপ্তর, ভারত সরকার, বিভিন্ন বছর

ওপরের সারণিতে দেখা যায় ধীরগতিতে বাড়লেও, বাৎসরিক মাথাপিছু খাদ্যশস্য গ্রহণের পরিমাণ ১৯৯১ সালে সর্বোচ্চ (‌১৮৬.২০ কেজি)‌ ছিল। এরপর তা হ্রাস পেতে থাকে। ২০১৬ সালে এসে দেখা যায় ভারতে একজন ব্যক্তি বছরে ১৭৭.৯০ কেজি খাদ্যশস্য পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ খাদ্যশস্য উৎপাদিন বাড়লেও কর্মসংস্থানের অভাবে ক্রয়ক্ষমতা না থাকার জন্য মানুষ খাদ্যশস্য ভোগ করতে পারেন না। এর তাৎপর্য হল, জিডিপি বৃদ্ধির হার আশানুরূপ হলেও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি। ওপরের তথ্যগুলি তারই প্রমাণ।
জিডিপি বৃদ্ধির হারের সঙ্গে অর্থনৈতিক অসাম্য বৃদ্ধির বিষয়টি প্রকট। অসাম্য বৃদ্ধির বিষয়টি থমাস পিকেত্তি দেখিয়েছেন ভারতের ক্ষেত্রে ১৯০০–২০২০ সালের পরিসরে। দেখা যায়, ১৯৮০ পর্যন্ত এই অসাম্য কমে এসেছে। তারপর ওপরের দিকের ১০ শতাংশের আয় ও নীচের দিকের ৫০ শতাংশের আয়ের ব্যবধান উত্তরোত্তর বেড়ে গেছে। ওয়ার্লড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ এ দেখা যায়, ওপরের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে মোট আয়ের ৫৭ শতাংশ রয়েছে আর নীচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ রয়েছে। ২০২১এর ভারতের অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেও এই ব্যবধানকে ‘‌হাতির শুঁড়’‌– এর মতো বলে মনে করা হয়েছে।
এই হল একবিংশ শতকের প্রথমপাদের দেশ ও তার রাজ্য। ঋণের বোঝা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। জাতীয় স্তরে ২০১৪–২৩ পরিসরে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ১৫৫ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এতে প্রত্যেক ভারতবাসীর মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১,০৯,০০০ টাকা হয়েছে। এর অর্থ হল, প্রত্যেক ভারতবাসীর ঋণের পরিমাণ বিগত ৯–১০ বছরে আড়াই গুণ বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই। ২০১১ সালে এই রাজ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২ সালে এই ঋণের পরিমাণ হয়েছে ৫.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত বলা দরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের মতো অন্যান্য রাজ্যগুলি হল পাঞ্জাব, কেরল, রাজস্থান, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা। এর তাৎপর্য হচ্ছে কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য বড় বড় রাজ্যগুলির অধিকাংশই ঋণের ভারে জর্জরিত।
এই অবস্থার মধ্যে আসছে লোকসভা নির্বাচন। অর্থনীতির যে কাঠামোগত রূপান্তরের জন্য পণ্য উৎপাদন বিঘ্নিত, কর্মক্ষেত্র সংকুচিত, তা সংশোধনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন দরকার। আপাতত নির্বাচনকে সামনে রেখে কতকগুলি গণতান্ত্রিক অধিকার–এর কথা বলা যায়। এগুলি হল খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার, বিনা খরচে শিক্ষার অধিকার, বিনা খরচে স্বাস্থ্যের অধিকার ও অবসরকালীন ভাতার অধিকার। এসবের সুষ্ঠু রূপায়ণের জন্য বর্তমানে যে খরচ হয় হিসাবে দেখা যায় আরও অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জিডিপি এতে লাগবে। অর্থনীতিবিদেরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, ভারতে ওপরের দিকের ১ শতাংশ ব্যক্তির ওপর ২ শতাংশ সম্পত্তি কর এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ওপর যদি ৩৩.৫০ শতাংশ হারে কর বসানো যায়, তাহলেই ওপরে বর্ণিত ব্যয় বহন করা সম্ভবপর হবে। কাজেই আমাদের মনে হয়, জাতীয় আয় বৃদ্ধি নয়, অধিকারগুলির বাস্তবায়নই নির্বাচনে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.