বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

নতুন সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের নতুন অধ্যায়

নতুন সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের নতুন অধ্যায়

অতনু চক্রবর্তী

photo

"চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে"
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমর কবিতার এই অমোঘ স্তবক আজও প্রেরণা জাগায় কঠিন কঠোর সময়ে।    আবার নতুন করে ধর্মের মুখোশপরা দুর্বৃত্তরা সাম্প্রদায়িক হিংসা বিদ্বেষ হানাহানির বধ্যভূমিতে গোটা দেশকে পরিনত করতে যখন উন্মুখ, তখন এই ক্রান্তিলগ্নে আবার মে দিবস আসছে — কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায় — রাজার মতন! 
ইতিহাসের পাতা উল্টে  ফিরে যাওয়া যাক ১ মে, ১৮৮৬ সালের সেই দিনটিতে। উত্তর আমেরিকার হাজারে হাজারে  শ্রমিকেরা আট ঘন্টা শ্রম দিবসের দাবিতে কারখানায় কারখানায় ধর্মঘটে সামিল হয়ে সব কিছু স্তব্ধ করে দিলেন। তখন, শিকাগো ছিল শ্রমিক আন্দোলন ও সংগঠনের কেন্দ্রভূমি। যার নেতৃত্বে ছিল বাম কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতি। ঠিক আজকের মতো, সেদিনও শ্রমিক আন্দোলনকে পুঁজিপতি শ্রেণীর নির্দয় নির্মম হামলার মুখে পড়তে হয়, যে শ্রেণীটিকে মদত দিত ব্যবসায়িক  সংবাদমাধ্যম, পুলিশ, বর্বরতা ছিল যাদের চরিত্র লক্ষণ। ১৮৮৬ র মে মাসে শিকাগোর হে মার্কেটে বোমা ছোঁড়ার মিথ্যা অভিযোগে চারজন সম্পূর্ণ  নিরপরাধ শ্রমিককে ফাঁসিতে লটকানো হয়। এই চারজনের মধ্যে ছিলেন অগস্ট স্পাইস ও আলবার্ট পার্সন্স। তাঁদের একমাত্র অপরাধ হল, তাঁরা ছিলেন বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ও সংগঠক। আট ঘন্টা শ্রম দিবস সহ অন্যান্য বিভিন্ন দাবিতে যাঁরা নিরলস ভাবে শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠিত করতেন। 
ঠিক হাল আমলের মতই, সেই সময়ে আমেরিকার বেশ কয়েকটি রাজ্যে আট ঘন্টার শ্রম দিবসের আইন থাকা সত্ত্বেও এই আইনকে বলবৎ করত না শিল্পপতিরা। আইন রক্ষক বা আইন প্রণেতারা  তা দেখেও  চোখ বুঁজে থাকতেন। আইনের সাহায্য না পেয়ে, ১ মে থেকে লাগাতার ধর্মঘটের পথে পা বাড়ানো ছাড়া আর অন্য কোনও পথ  খোলা ছিল না শ্রমিকদের কাছে। আদালতে মামলা চলাকালীন সরকারি আইনজীবী ক্ষিপ্ত হয়ে বিচারককে চোখ রাঙিয়ে বলেন, “এই লোকগুলোকে ফাঁসিতে ঝোলান। আজ গোটা আইনব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। নৈরাজ্য আজ চরমে। ধর্মাবতার, আপনি একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করুন। রক্ষা করুন সমাজ ও সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে।" ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক আগের মূহুর্তে স্পাইস বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন "যদি তোমরা মনে কর, আমাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে গোটা শ্রমিক আন্দোলনকে শেষ করবে, তবে ঝোলাও ফাঁসিতে। তোমরা এমনই এক স্ফুলিঙ্গ উস্কে দিচ্ছো  যা দাবানলের রূপ নিয়ে  সর্বত্র দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়বে,  নির্বাপিত হবে না কোনওদিন।”
একই কথা শোনা গেছিল হরিয়ানার মারুতি সুজুকি কারখানায় বিক্ষোভরত শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে। ফাঁসিতে ঝোলানোর সপক্ষে আদালতে দাঁড়িয়ে সরকারি আইনজীবীর আস্ফালন! 

আজকের স্পাইস-পার্সনস্ রা


দিন বদলেছে। বছর বছর গড়িয়ে পার হয়েছে কয়েকটা শতাব্দী। পুঁজির গঠনবিন্যাসে এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। তা হয়েছে আরো উন্নত, জটিল, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পুঁজিপতিশ্রেণী  হয়েছে অনেক বেশি সংঘবদ্ধ, মারমুখী,  বদলেছে শোষণের রূপ পদ্ধতি। পাল্টেছে সমাজের গড়ন, শ্রমিকশ্রেণীর গঠন বিন্যাস। কিন্তু, বজায় রয়েছে শ্রম দাসত্ব, মুনাফার গড় হারকে ক্রমাগত বাড়াতে নানান কৌশলে শ্রম সময়কে বেআইনি পথে লম্বা করা, উৎপাদিকা শক্তির ক্রমান্বয় উন্নতি ঘটিয়ে অনেক বেশি শ্রমশক্তি নিঙড়ে নেওয়া, আইন কানুনকে ফাঁকি দিতে হরেক কৌশল অনুসরণ করা — আবহমানকাল ধরে চলছে এই শোষণের মারণ খেলা। শুধু মজুরি নয়, মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার, অধিকার ও মর্যাদা আদায় করাটাও যে শ্রমিক আন্দোলনের এক অপরিহার্য উপাদান, কমরেড লেনিন ১৮৯৬ সালে মে  দিবসের এক লিফলেটে তা দেখিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, "আমাদের, শ্রমিকদের রেখে দেওয়া হয়েছে অজ্ঞতার অন্ধকারে, শিক্ষাদীক্ষার বৃত্তের বাইরে, এই জন্য, যাতে আমরা নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার সংগ্রাম কিভাবে চালাব, তা শিখতে না পারি।... অজ্ঞতা ও দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা — এই দু'টি হল শিল্পপতি ও সরকার গুলোর হাতে অস্ত্র, যার মাধ্যমে ওরা আমাদের দাবিয়ে রাখে।
"সব সময়ে ধর্মঘট যে জয়যুক্ত হবে, তার কোনও মানে নেই। ওই প্রচারপত্রে লেনিন লিখেছেন, "অসফল ধর্মঘটগুলো আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও বাস্তবের জমিতে তা মালিকদের মনে ভয়ভীতির তীব্র কাঁপুনি সৃষ্টি করে। তাঁরা ভীত হন এই আশঙ্কায় যে ধর্মঘট হলে তার সংস্থার বিরাট আর্থিক ক্ষয় হবে।" তাই, তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, "ইউনিয়নই হল আমাদের প্রধান শক্তি। উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, একরোখা, উদ্দীপনাময় প্রতিরোধই হল আমাদের একমাত্র শক্তি।"
 আজ শ্রমিকশ্রেণীর এই ইউনিয়ন গঠনের উপরই নেমে এসেছে বিরাট খাঁড়া। যে দেশে মহান মে দিবসের জন্ম, সেই দেশেই সংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে ইউনিয়ন বিরোধী প্রবণতা ব্যাপক ভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে। কিন্তু, তার মধ্যে খুব সম্প্রতি অ্যামাজনের শ্রমিকরা দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে, হাজারো প্রশাসনিক বাধাকে উপেক্ষা করে এই প্রথম ইউনিয়ন গঠন করে বিরাট সাড়া ফেলে দিয়েছেন। অ্যামাজন লেবার ইউনিয়ন হল আমেরিকায় সর্বপ্রথম অ্যামাজনের ইউনিয়ন, দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের সংস্থার শ্রমিক ইউনিয়ন। 

কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তিত সংজ্ঞা


আজ কর্মক্ষেত্রের সংজ্ঞা বদলেছে পরিবর্তিত ডিজিটাল অর্থনীতির হাত ধরে,  কোভিড কালে "ঘরে বসে কাজ করার" নতুন ধরনের সঙ্গে, যা নিয়োগকর্তারা স্বীকার করতে চান না।  এখন শুধু কারখানা বা সংস্থা নয়, বাইরের  রাজপথ যা গিগ শ্রমিকদের কর্মস্থল, গৃহস্থল বা যে কোনও জায়গা থেকে কাজ করা (ওয়ার্ক ফ্রম এনিভেয়ার) নতুন কর্মক্ষেত্র হিসাবে সামনে আসলেও এ নিয়ে আইন তৈরি হয়নি।  সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হলে ক্ষতিপূরণ চিরকাল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দাবি হিসাবে সামনে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণে যত না শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি শ্রমিক মারা গেছেন বিপজ্জনক কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে, লকডাউনে মজুরি না পেয়ে অনাহারে, আর্থিক দুর্দশায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে, শ্রমিক ট্রেন বা আচমকা লকডাউনে নিজ ভূমে ফেরার সময়ে পায়ে হেঁটে, ট্রেনে কাটা পড়ে। কোনও ক্ষেত্রেই এই সমস্ত মৃত্যুকে “কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু” হিসাবে গণ্য করে নিয়োগ কর্তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় নি, তেমন আইনি রক্ষাকবচ না থাকায়।  আর, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে দায়সারা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়েই নিয়োগকর্তারা খালাস পেয়ে যান। ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা হল তাঁর নিকৃষ্ঠতম উদাহরণ। গোটা পৃথিবীতে ভোপাল গ্যাস  অন্যতম বৃহৎ এক শিল্প  দুর্ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও বহুজাতিক ওই সংস্থার সঙ্গে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দরকষাকষি করতে কেন্দ্রীয় সরকার নানান সন্দেহজনক ভূমিকা রাখায় অনেক কম ক্ষতিপূরণ আদায় হয়। আর, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পর ও দেখা গেল সেই বছরে ইউনিয়ন কার্বাইড সবচেয়ে বেশি মুনাফা লাভ করেছে!  
সর্বক্ষেত্রে, সবসময়ে আইন তৈরির সূতিকাগার হল রাস্তার লড়াই, একরোখা আন্দোলন। আপাত দৃষ্টিতে সে দেশ যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন, শ্রমিক শ্রেণীকে দমন করতে, তাঁদের অধিকার কেড়ে নিতে সকলেই এক সূত্রে বাঁধা। আর, যতই প্রগতিশীল আইন বিভিন্ন দেশে দেশে তৈরি হোক না কেন, তার নেপথ্যে রয়েছে সাড়া জাগানো সংগ্রাম। শাসকের মহানুভবতা নয়। 

ডিজিটাল-গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক আজ নতুন এক বর্গ


ভুবনীকরণ, নব্য উদারবাদ টিকে রয়েছে শ্রমের অনিয়ন্ত্রিত বাধা বন্ধনহীন ইনফর্মালকরণের উপর। শ্রমিকশ্রেণীর "স্থায়ী চরিত্র সম্পন্ন" বর্গটিকে ধাপে ধাপে তুলে দিয়ে বিপুল বিরাট এই অস্থায়ী, ইনফর্মাল বর্গের জন্ম দেওয়া হয়েছে, যারাই আজ শুধু উৎপাদন ক্ষেত্রেই নন, পরিষেবা বা সার্ভিস সেক্টর, শুশ্রূষা ক্ষেত্র প্রভৃতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে, এমনকি সরকারি ক্ষেত্রেও প্রাধান্যকারী জায়গায় রয়েছেন। সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, শোভন কাজ, চাকুরির নিশ্চয়তা যাদের কাছে মরীচিকা মাত্র। লক্ষ লক্ষ স্কীম কর্মী ( আশা- অঙ্গনওয়াড়ি-মিড ডে মিল কর্মী), যারা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পরিষেবা সারা বছর, এমনকি  ঘোর করোনাকালেও দিয়ে এসেছেন,  তাঁদের নেই "শ্রমিকের" স্বীকৃতি। পাচ্ছেন মজুরির বদলে " ভাতা "। 
আর, এখন দিনে দিনে ক্রমে বেড়ে চলা ডিজিটাল অর্থনীতি জন্ম দিয়েছে বিরাট বহরের গিগ - প্ল্যাটফর্ম - ডিজিটাল কর্মী — যারা দুনিয়া জুড়েই লড়াই করছেন নিজেদের "শ্রমিক" হিসাবে প্রমাণ করার জন্য! ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, আদালতগুলো গিগ শ্রমিকদের সপক্ষে বেশ কিছু রায় দিচ্ছে, যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুক্তরাজ্যের শীর্ষ আদালত এই মর্মে রায় দিয়েছে যে এতদিন ধরে "স্বাধীন কন্ট্রাক্টর" এর জামা পরিয়ে যে গিগ কর্মীদের সংজ্ঞায়িত করছিল নিয়োগকর্তারা, তা গ্রহণযোগ্য নয়। স্পষ্টতই এদের মধ্যে রয়েছে শ্রমিক-নিয়োগকর্তার সম্পর্ক। অর্থাৎ, তাঁরা শ্রমিক। স্পেন এই প্রথম এক আইন পাশ করল, যার মাধ্যমে কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে নিয়ন্ত্রিত করা হল, গিগ কর্মীদের সংজ্ঞায়িত করা হল "শ্রমিক" হিসাবে। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ আদালতও এই ধরনের রায় দিয়েছে।  এই সমস্ত গিগ বা ডিজিটাল শ্রমিকদের কর্মপদ্ধতি, কাজের শর্তাবলিকে অ্যালগরিদম এর নানা কারসাজি করে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করার বিরুদ্ধে ইতালির আদালত, সেই দেশের ডাটা সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ গ্যারান্টে বহুজাতিক সংস্থা ডেলিভেরু ও গ্লোভোরকে  বিরাট আর্থিক জরিমানা করেছে। আমাদের দেশেও এই প্রথম সুপ্রিম কোর্ট ডিসেম্বর ২০২১ এ গ্রহণ করল এক জনস্বার্থ মামলা। গিগ শ্রমিক ইউনিয়নদের তরফ থেকে দায়ের করা উক্ত জনস্বার্থ মামলায় সামাজিক সুরক্ষা, শ্রমিকের স্বীকৃতি প্রভৃতি বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ আদালতের নজরে আনা হয়। সুপ্রিম কোর্ট তা গ্রহণ করার পর কেন্দ্রীয় সরকার, উবের-ওলা-জোমাটো-সুইগগির কাছে নোটিশ পাঠিয়েছে। বেশ কয়েকবছর আগে, ২০১৭ সালে, দিল্লি কর্মাশিয়াল ড্রাইভার ইউনিয়ন উবের- ওলা চালকদের জঘন্যতম কাজের পরিবেশ ও নামমাত্র মজুরি নিয়ে এক মামলা করে দিল্লি হাইকোর্টে। তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের অভাব অভিযোগকে শোনার জন্য, নিরসনের জন্য সরকার একটা কমিটি বানাক। 
এখনও পর্যন্ত গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের আইনি স্টেটাস অস্পষ্ট, ধোঁয়াশায় ভরা। মোদি সরকারের তৈরি করা কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি, ২০২০ তে এদের অস্তিত্ব এই প্রথম স্বীকার করে নিলেও ভুল ভাবে সংজ্ঞায়িত করায় তাঁরা সমস্ত ধরনের শ্রম আইনেরই বাইরে থেকে যাচ্ছে। কোড গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের এই ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে — গিগ শ্রমিক হলেন এমনই এক ব্যক্তি সাবেক শ্রমিক-নিয়োগকর্তার সম্পর্কের বাইরে গিয়ে এক ধরনের কাজের ব্যবস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত আর সেখান থেকে কিছু উপার্জন করেন। একই ভাবে, "প্ল্যাটফর্ম" কাজকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে কর্মী-নিয়োগকারীর সাবেক সম্পর্কের বাইরে
অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে কিছু নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে যারা পরিষেবা দিয়ে থাকেন। রাঘববোয়াল বহুজাতিক সংস্থার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে যাদের সমস্ত কার্যকলাপ, গতিবিধি, কাজের শর্ত পরিচালিত, আরও বেশি শোষণের জন্য যে সংস্থাগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তি, অ্যালগরিদমকে হামেশাই কারচুপি করে, উক্ত কোড খোলাখুলি সেই সংস্থগুলোর পক্ষাবলম্বী।  এত দিনকার অর্জিত অধিকারগুলোর উপর কুঠারাঘাত হেনে মজুরি কোড আরও মারাত্মকভাবে শিথিল করেছে বেশ কিছু শর্ত।এই কোড কেন্দ্রীয় সরকারকে শ্রম দিবস নির্ধারণ করার ক্ষমতা দিয়েছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর বা কমানোর দায়িত্ব তুলে দিয়েছে সরকারের তৈরি করা কমিটির হাতে, ইন্সপেক্টর পদ অবলুপ্ত করে ইন্সপেক্টর-কাম-ফ্যাসিলিটেটার পদ আনা হল, যারা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নির্দেশিত অভিযুক্ত সংস্থার দোরে আচমকা হানা দেওয়ার অধিকারকে শিথিল করে দিল। আরও মারাত্মক বিষয় হল, আট ঘন্টার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত শ্রম দিবসকে নস্যাৎ করতে ওকুপেশনাল সেফটি হেলথ ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড (ও এস এইচ ডবলিউ সি) বেশ কয়েক ঘন্টা বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই কোডের ১২৭-১২৮ নং ধারা রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারকে "অর্থনৈতিক কর্মকান্ড", "কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে" বা "আপৎকালীন"  সময়ে স্বাভাবিক শ্রম সময়কে বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর, সেই পরিস্থিতিগুলোকে এতই শিথিল করে দিয়েছে যে নিয়োগকর্তা বা সরকার তা নিজের প্রয়োজন মাফিক কাজে লাগিয়ে নেবে। 
এবারের মে দিবস দুনিয়া জুড়েই শ্রমিকশ্রেণীর কাছে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছে। ট্রেড ইউনিয়নের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিসরকে আরও জীবন্ত ও পল্লবিত করার পাশাপাশি নজর ঘোরাতে হবে অগণন ইনফর্মাল, কন্ট্রাক্ট, গিগ প্ল্যাটফর্ম, স্কীম কর্মীদের সংগঠিত করার সৃষ্টিশীল পদ্ধতি ও রূপের মাধ্যমে। ইউনিয়ন বহির্ভূত হরেক মঞ্চ বা উত্তরণশীল সংগঠনের রূপও সামনে আসছে। যে অন্তসলিলা ফল্গুধারার মতো নির্যাতিত শ্রমজীবী মানুষদের  প্রতিবাদ প্রতিরোধের ধিকি ধিকি আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার বার্তা  সেদিন মে দিবসের বীর শহিদরা ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, তা ডানা মেলে উঠবেই — এই শপথ নেওয়ার দিন এবারের মে দিবসে। শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.