বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

উত্তরপ্রদেশ — ভোটযুদ্ধের চালচিত্র

উত্তরপ্রদেশ — ভোটযুদ্ধের চালচিত্র

পর্যবেক্ষক

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২— ১৪ জানুযারি, সকালেই খবর এল উত্তরপ্রদেশে বিজেপি জোট ছেড়েছেন আপনা দলের বিধায়ক চৌধুরি অমর সিং। এর আগেই বিজেপি ছেড়েছেন যোগী মন্ত্রিসভার তিন মন্ত্রী সহ ১০ জন বিধায়ক। চৌধুরি অমর সিংকে নিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়াল ১১। দলত্যাগীদের দাবি, তাদের আস্তিনের তলায় আরও অনেক তাস রয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের ভোট নিয়ে অনেক দিন ধরেই দুশ্চিন্তায় ছিল বিজেপি। সেই দুশ্চিন্তা কৃষক আন্দোলনের কাঁটা। গত এক বছর ধরে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ক্রমশ প্রসারিত কৃষক আন্দোলনে নরেন্দ্রে মোদির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল। কৃষকেরা এভাবে শিবির করে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকলে উত্তরপ্রদেশের ভোটে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে এই আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত নজিরবিহীন ভাবে সমঝোতার পথে এগোতে হয় মোদিকে। তিন কৃষি আইন বাতিল করে আপাতত পিছু হঠে মোদি সরকার। তারপরেই ফসলের দাম নিয়ে আন্দোলনের দাবি জোরদার হতে শুরু করে।
মোদি ভেবেছিলেন, আপাতত কৃষক আন্দোলনকে ঠেকিয়ে নানা কৌশলে উত্তরপ্রদেশের মসনদ দখলের খেলা শুরু করবেন। এবং ভোটে জিতলে আন্দোলনকারী কৃষকদের ভালরকম শিক্ষা দেবেন। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের ঘা শুকনোরে আগেই আঘাত এল অন্য দিক থেকে। এতদিন টাকা দিয়ে বিরোধীদলের বিধায়ক কিনে, ভোটারদের রায় উল্টে দিয়ে, রাজ্যে রাজ্যে সরকার গড়েছে বিজেপি। টাকা দিয়ে সাংসদ কিনে সংসদে জনবিরোধী বিল পাসের খেলা চালিয়ে গেছে। এবার সেই ভাঙনের ঘুনপোকা খোদ মোদি, যোগী এবং শাহর দলেই। এবং এই ভাঙনে সিঁদুরে মেঘ হয়ে দেখা দিচ্ছে জাতপাতের সমীকরণ। মুখ্যমন্ত্রী যোগী ঠাকুর সম্প্রদায়ের। তাঁর আমলে উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে নির্যাতিত দলিতেরা। হামলা হয়েছে ওবিসিদের ওপরেও। সেকারণে ভাঙন দরেছে বিজেপির সমর্থনের ভিতে।  যে অ-যাদব ওবিসি ভোট ছিল বিজেপির ভরসা, তাদেরই মুখিয়ারা বিজেপি ছেড়ে যোগ দিতে চলেছেন অখিলেশের সমাজবাদী পার্টিতে। ভোটের আগে মুখ খুলছেন দলিতেরাও। ওদিকে ঠাকুরদের একচেটিয়া প্রভাবে ক্ষুব্ধ উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ লবি। ওবিসি ও দলিতদের বড় অংশ এবার বিজেপি বিরোধিতায় ঝুঁকে পড়তে  সমাজবাদী পার্টির দিকে। ইতিমধ্যেই বিজেপির গতবারের ফর্মুলা অনুসরণ করে অখিলেশ রাষ্ট্রীয় লোক দল সহ একাধিক ছোট ছোট দলকে বিজেপির আওতা থেকে বের করে এনে আলাদা জোট তৈরি করে ফেলেছেন। জাতপাত ভিত্তিক এই জোট ওবিসি ও দলিতদের ভোট ভাল রকম টানতে পারলে বিজেপির বিপদ বাড়বে।
ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ লবির ভোট ভাগ হতে পারে কংগ্রেস ও বিএসপির মধ্যে। তাতেও বিজেপির ভোট কমতে পারে। মায়াবতী না চাইলেও দলিত ভোটের একাংশ যাবে বিজেপির বিরুদ্ধে। বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছেন কৃষকেরা। কৃষি বিল বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁরা গড়ে তুলেছেন জাঠ-মুসলিম ঐক্য। ফলে গতবারের মতো মুজফফরনগরের ফর্মুলায় ভোট ভাগ করা বিজেপির পক্ষে সহজ হবে না। এর সঙ্গে ফসলের দাম, জ্বালানির দাম, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক ইস্যুগুলিকে সামনে এনে ফেলেছেন কৃষকেরা। ফলে এই সব ইস্যুতেও এবার ভোট ভালরকম প্রভাবিত হতে পারে।
কংগ্রেস কৌশলে রাজ্যের তপ্ত ইস্যুগুলিকে সামনে এনে ফেলেছে। যোগী আমলে উত্তরপ্রদেশে অবর্ণনীয় অত্যাচারের সামিল মহিলারা। প্রিয়াঙ্কার নেতৃত্বে সুকৌশলে সেই ইস্যুকে সামনে এনে ফেলেছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের ডাকে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে মহিলাদের জমায়েত হচ্ছে চোখে পড়ার মতো। নারী নির্যাতনকে ভোটে  ইস্যু করতে উন্নাওয়ের ধর্ষিতার মাকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস। আশা কর্মীদের ভাতাবৃদ্ধি আন্দোলনের নেত্রী পুনম পাণ্ডেও কংগ্রেস প্রার্থী। আবার সিএএ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রীও রয়েছেন দলের প্রার্থী তালিকায়। এভাবে রুটিরুজির আন্দোলন,মহিলাদের সম্ভ্রম রক্ষার আন্দোলন এবং সিএএবরোধী আন্দোলনকে নির্বাচনী ময়দানে এনে ফেলেছে কংগ্রেস।
কৃষকশক্তি, কংগ্রেস, এসপি নেতৃত্বাধীন জোট বহু ইস্যুকে একইসঙ্গে এনে ফেলেছে উত্তরপ্রদেশের ভোট ময়দানে। প্রতিটি ইস্যুর পিছনে রয়েছে একাধিক সামাজিক শক্তি ও তাদের ভোট। এটাই উত্তরপ্রদেশের এখনকার সমাজ জীবনের ছবি যাকে গত পাঁচ বছর ধরে জাগিয়ে তুলেছে কেন্দ্রে মোদি ও রাজ্যে যোগী সরকার।
উল্টোদিকে, বিজেপির হাতিয়ার আইনশৃঙ্খলার তথাকথিত উন্নয়ন, কিছু হাইওয়ে ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি। যতদূর মনে হচ্ছে, ভাগাভাগি ও বিদ্বেষের রাজনীতিকে ভরসা করেই উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী তরী পার হতে চাইছে যোগী সরকার। তবে সেখানেও বিজেপি স্বস্তিতে নেই। কারণ হরিদ্বারের ধর্ম সংসদে বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য নিয়ে পুষ্কর সিং ধামি সরকরের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, নরেন্দ্র মোদি অজেয় এই মিথ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। মোদিকেও মাথা নত করানো যায় দেশের সামনে তা প্রমাণ করে দিয়েছেন আন্দোলনরত কৃষকেরা। আবার এখন প্রতিদিন মোদি, যোগী,অমিত শাহের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দলছাড়ার সাহস দেখাচ্ছেন মন্ত্রী, বিধায়কেরা। অনেকের মত, এসব লোককে বিজেপি আর টিকিট দেবে না । তাই এত বিদ্রোহ। কথাটা কিছুটা সত্যি হতেই পারে। বাকি অর্ধেক সত্যি হল, বিজেপিই ক্ষমতায় ফিরছে এটা নিশ্চিন্ত হলে ক্ষমতার ছাঁট পাওয়ার আশায় এই সব লোকেরা বিজেপিতেই থেকে যেতেন। কারণ তাঁরা জানেন, যতই বিদ্রোহী হোন, ইডি, সিবিআই, আয়কর দপ্তরের থাবা থেকে তাঁরা বেরোতে পারবেন না। দলত্যাগীদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও এই প্রতীতি জন্মেছে, যে এবার বিজেপির আসন টলটলায়মান। তাই নেতৃত্বে থাকা ফ্যাশিস্ত ত্রয়ীর হুমকি অগ্রাহ্য করেই দলের বাইরে চলে আসার মতো ঝুঁকি নিতে পারছেন তাঁরা। সম্ভবত কোথাও এঁরা বুঝতে পেরেছেন যে বিজেপির ছায়া হয়ত পশ্চিমগামিনী। তাই হাওয়া বদলের স্রোতে গা ভাসিয়েছেন তাঁরা।
নির্বাচনের ফল আগাম নিশ্চিত বলে দিতে পারে একমাত্র ভাড়াটে কর্পোরেট সমীক্ষকেরা। কারণ সেই ফল না মিললেও কিছু এসে যায় না। কারণ তাঁরা প্রাক ভোট সমীক্ষার ফলগুলি প্রকাশই করেন শাসকের পক্ষে জনমত যাতে ঢলে পড়ে সেই জন্য। যাঁরা বাস্তব প্রবণতার ভিত্তিতে জনমতের ঝোঁক বোঝার চেষ্টা করেন, তাঁরা এখন এটা বলতেই পারেন যে এবার উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভোটযুদ্ধের জমি বহু কণ্টকে সমাকীর্ণ। শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির সাহায্য এতো কাঁটাকে দলিত করে জয় হাসিল করা রীতিমতো কঠিন। তার ওপর স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির লৌহমূর্তি যখন গলতে শুরু করেছে। তাই অযোধ্যার বাইরে উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ দেহাতি জমিতে এবার ভোটে নতুন রামায়ণও লেখা হতে পারে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.