বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
জানুয়ারি মাসে অযোধ্যায় রাম লালার মূর্তি প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে প্রচারের যে বিপুল ঢেউ তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, তাতেই কর্পোরেট মিডিয়া দাবি করেছিল, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ৪০০ আসন পাওয়া ঠেকায় কে। মোদি নিজেও এমন হাবভাব করছেন যেন নির্বাচনটা হওয়ার আগেই তিনি ৪০০ আসনে জিতে গেছেন। সত্যিই কি তাই? বিষয়গুলির আরও গভীরে যাওয়ার দরকার আছে।
তবে আর আগে একবার দিল্লি-হরিয়ানা সীমানায় কৃষক আন্দোলনের দিকে চোখ রাখা দরকার। এখন প্রতিদিনই প্রায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আন্দেলনকারী কৃষকদের সংঘাত চলছে। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে তরুণ কৃষক শুভকরণ সিংয়ের। তাঁর মৃত্যুর বিনিময়ে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ নিতে অস্বীকার করেছেন কৃষকেরা। তাঁদের বক্তব্য, এই ঘটনায় এফআইআর দায়ের না হওয়া পর্যন্ত শুভকরণের শেষকৃত্য বন্ধ থাকবে। এছাড়া পাঞ্জাব-হরিয়ানার খানাওড়ি সীমানায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬২ বছরের কৃষক দর্শন সিংয়ের। এই নিয়ে এবারের আন্দোলনে ৫ জন কৃষকের মৃত্যু হল। যাই ঘটুক না কেন, কৃষক জমায়েতে কোনও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না।
ওদিকে এই আন্দোলনের জেরে রীতিমতো চাপে হরিয়ানার বিজেপি সরকার। গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন কৃষক নেতার বিরুদ্ধে জাতীয় সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করেছিল খট্টর সরকার। তবে প্রবল চাপে পড়ে সেই প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় হরিয়ানা সরকার। একইসঙ্গে কৃষকদের মন পেতে কয়েকটি শস্য ঋণের সুদ ও জরিমানা মকুব করেছেন খট্টর। মুখে বিজেপি নেতারা বলছেন, কৃষকেরা আমাদের অন্নদাতা। অথচ দিল্লি–হরিয়ানা সীমানায় প্রতিদিনই আরও বাড়ছে পুলিশি ব্যারিকেডের সংখ্যা। বোঝাই যাচ্ছে, স্বামীনাথনকে মরণোত্তর ভারতরত্ন দিয়ে মোদি সরকার যেভাবে কৃষকদের মন জয় করতে চেয়েছিল, সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। প্রতিদিন আলোচনার পাশাপাশি সংঘাত জারি রেখেছেন কৃষকেরা। জয়ন্ত চৌধুরীর বাবা চরণ সিংহকে ভারতরত্ন দিলেও কৃষক আন্দোলনে জাঠেদের অংশগ্রহণ আটকানো যায়নি। সব মিলিয়ে রাম লালার নামে দিল্লি জয়ের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিচ্ছেন উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের কৃষকেরা। কারণ যাঁরা দিল্লি যেতে চান কিন্তু সরকারের বাধায় যেতে পারছেন না, তারা নিশ্চিতভাবেই অন্য পথ খুঁজে নেবেন।
মহাকাব্যের রামচন্দ্র ছিলেন সত্যবাদী। বাবার সত্য রক্ষার জন্য তিনি চোদ্দ বছরের বনবাস বেছে নিয়েছিলেন। আর রাম লালার মূর্তিতে যিনি প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন বলে দাবি করলেন, সেই নরেন্দ্র মোদি কি সত্যরক্ষা করছেন?
ধরা যাক, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির প্রসঙ্গ। ৬.৮ এবং ৫.৯ এর মধ্যে বড় কোনটা। ক্লাস থ্রির ছেলেও বলবে প্রথমটা বড়। সম্প্রতি নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতির বিষয়ে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে ইউপিএ শাসনের ১০ বছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ৬.৮ শতাংশ। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এনডিএ জমানার ক্ষেত্রে এই হার ৫.৯ শতাংশ। ইউপিএ সরকারের দশ বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশের সীমা অতিক্রম করেছে ৬ বার। এনডিএর দশ বছরে মোট তিনবার। এখানেও এনডিএকে গোল দিয়েছে ইউপিএ। কারণ ৩ এর চেয়ে ৬ বেশি। তবু শ্বেতপত্রে দাবি করা হল, ইউপিএ আমলের শেষে ভারতের অর্থব্যবস্থা চূড়ান্ত বেহাল জায়গায় পৌঁছেছিল, তাকে উদ্ধার করেছে এনডিএ। মোদির সংজ্ঞায়, খারাপ করলে ভাল এবং ভাল করলে খারাপ। কমটা বেশি, বেশিটা কম। একেবারে হেগেলের মতো। হেগেল বস্তুকে চেতনার মাথার ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। সেই তত্ত্বকে উল্টো করে চেতনাকে বস্তুগত ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন মার্কস। আজকের ভারতে মোদি সত্য আর মিথ্যাকে উল্টোদিক করে দাঁড় করিয়েছেন। কৃষক সহ ভারতের আপামর জনতা তাকে সিধে করে দাঁড় করিয়ে দেবেন।
মোদির শ্বেতপত্রে বেকার শব্দটিই নেই। সরকারের প্রকাশ করা পিরিয়ডিক লেবার সার্ভে রিপোর্ট জানিয়েছিল, ২০১৭-১৮ সালে ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছেছিল গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে। তখনও কিন্তু কোভিড আসেনি। ২০১৭-১৮ সালের ভোগব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষার ফল প্রকাশই করতে দেয়নি মোদি সরকার। কিন্তু সেই সমীক্ষার ফল ফাঁস হয়ে যায়। তখন জানা যায়, দেশের গ্রামাঞ্চলে ভোগব্যয় কমছে। ভারতে দরিদ্র কতজন তার হিসাব নেই। শুধু বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকে দারিদ্র কমেছে বলে মোদির পরামর্শদাতারা উদ্বাহু নৃত্য করছেন। ফলে মোদি সরকারের মিথ্যা ভাষণের জেরে শ্বেতপত্র হয়ে উঠেছে মিথ্যায় ভরা কৃষ্ণপত্র।
(১১ পাতার পর) ভারত যে বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় একেবারে নীচের দিকের দেশগুলির সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে? এ ব্যাপারে মোদি সরকারের উত্তর, সব তথ্যই ভুলে ভরা। ভারতে ক্ষুধার সমস্যা নেই। দেশে যদি ক্ষুধা না থাকে, তাহলে ৬৭ শতাংশ মানুষকে কেন বিনামূল্যে কিংবা সস্তায় চাল–গম দিতে হয়? কেন খাদ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার ধারাবাহিক ভাবে বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে? কেন চাল, গম, ডাল, চিনি, তেল, আটার দাম ঊর্ধ্বমুখী? মোদি সরকার নীরব। কোনও উত্তর নেই।
মানুষের রুটিরুজি নিয়ে এত মিথ্যা প্রচার করলেও সত্যকে যে আড়াল করা যায় না, তা মোদিও জানেন। তাই মুখে যতই বড়াই করুন ৪০০ আসনে জিতবেন, কার্যত যে তা কঠিন তাও মোদি জানেন। না হলে কংগ্রেসের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের রাজ্যসভার সদস্য কেন করবে বিজেপি? কেন ইডিকে দিয়ে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা? কেন স্রেফ জালিয়াতি করে চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করা? অবশ্য সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কেন কংগ্রেসের নরসিংহ রাওকে মরণোত্তর ভারতরত্ন দিয়ে দক্ষিণের ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা? কেন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের সেঙ্গল নিয়ে এত মাতামাতি? আসলে মোদির দক্ষিণ ভারতের ভাঁড়ার শূন্য। তাই লেগে পড়েছেন দক্ষিণের তীর্থে স্নান করে, দক্ষিণের মন্দিরে পুজো দিয়ে দক্ষিণী হিন্দুর ভোট টানতে। এখানেও তিনি রামের ওপর তেমন ভরসা রাখতে পারছেন না।
সম্প্রতি মোদিকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে নির্বাচনি বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়। এই বুঝি প্রকাশ হয়ে পড়ল, কোন কোন পুঁজিপতি কত টাকা বিজেপির কোষাগারে দিয়েছেন। তার ওপর ইডিকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে ৩৩৫ কোটি টাকা তোলা আদায়ের ঘটনা তো এখন প্রকাশ্যে।
আর এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে রঙ ও কাপড়ের আড়ালে থাকা মোদি সরকারের আসল মূর্তি ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে আসছে। তাই এবারের ভোটে জয় শুধু রামলালার মন্দির উদ্বোধনের ভিডিও দেখিয়ে হবে না। হিন্দুত্বের বিভাজনের নীতিতেও হবে না। দারিদ্র, বেকারি, অভাব, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি— দৈনন্দিন রুটিরুজির সমস্যা মানুষকে এখন প্রতিদিন তাড়িত করছে। সেই ধূলিধূসর বাস্তবের মাটিতে নেমেই মোদিকে ভোটে জিততে হবে। সেই লড়াইয়ে জয় যে সহজ হবে না, তা বুঝিয়ে দিচ্ছে হরিয়ানা সীমান্তে প্রতিদিন আরও বেড়ে ওঠা বিক্ষুব্ধ কৃষকের কাতার। মোদির জয়রথের পথ মসৃণ হবে না কারণ ভারতবর্ষ এখন ‘শবচক্র মহাবেলা প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, পাথরে পাথরে গর্জে ... সুভদ্রার শোক’। কারণ, ‘এই স্তব্ধতা দারুণ স্বচ্ছ, ত্রিকাল বাজায় তাল, পাহাড়চূড়ায় তুষারচর্বি গলবে আগামিকাল’।