বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ভাষা সন্ত্রাসের আড়ালে অপরায়ণের ছক

ভাষা সন্ত্রাসের আড়ালে অপরায়ণের ছক

রতন গায়েন

photo

সাম্প্রতিক সময়ে ওডিশা, হরিয়ানা, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে বাঙালি শ্রমিকদের উপর নিগ্রহ চলছে। ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের ‘পুশব্যাক’ করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। ভিন রাজ্যে কর্মরত অনেক বাঙালি পরিবারকে বাড়ির মালিক বিতাড়িত করেছে। তাঁরা বহু যন্ত্রণা ভোগ করে বহু কষ্টে বাংলায় ফিরে এসেছেন। এঁরা ‘অনুপ্রবেশকারী’, কারণ দিল্লি পুলিশকর্তার মতে এঁদের ভাষা ‘বাংলাদেশি’। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে এর কোনও প্রতিবাদ করা হয়নি। শাসক দলের আইটি সেলের প্রধান পুলিশকর্তার বক্তব্যে সায় দিয়ে অর্বাচীন মন্তব্য করেছেন। রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক ঘটনার বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়ে ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে এখানকার ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে, বাংলা ভাষা সংবিধানের অষ্টম তপশিলে উল্লেখিত দেশের স্বীকৃত ২২টি ভাষার অন্যতম। এবছরেই কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছেন। এই তথ্য পুলিশকর্তার অজানা থাকতে পারে — কিন্তু বিজেপির আইটি সেলের প্রধানের অজানা থাকার কারণ নেই। তিনি ভাষা বিশেষজ্ঞ বলেও পরিচিত নন। তাই তাঁর মতো ব্যক্তি যখন পুলিশ কর্তার বক্তব্যের সম্প্রসারণ করে বলেন যে বাংলা ভাষা কোনও সংহত ভাষা নয় এবং এটি একটি জাতিসত্তার অভিব্যক্তিমাত্র তখন তাঁর অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত হয় না। শাসকদলের ধারাবাহিক বিভাজনের চেষ্টা ও দেশের মুসলিম সম্প্রদায় সহ অন্য সংখ্যালঘুদের ‘অপর’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার মধ্যেই আইটি সেলের প্রধানের করা মন্তব্যের কারণ নিহিত আছে। মনে রাখা দরকার যে প্রতিবেশী বাংলাদেশের ভাষাও বাংলা এবং লিপিও অভিন্ন। কিন্তু উচ্চারণ ও বাক্য গঠনের ভিন্নতা আছে। বস্তুত সব ভাষার আঞ্চলিক বিভিন্নতা ভাষার এক স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। রাজস্থান ও পাকিস্তান সীমান্তের রাজস্থানীদের ভাষার মধ্যে পাকিস্তানের ভাষার উচ্চারণ বা বিহারের ভোজপুরি ভাষার সঙ্গে নেপালি ভাষার মিল দেখে সীমান্তবর্তী রাজস্থানের ভাষাকে পাকিস্তানি ভাষা কিংবা নেপালের সীমানায় বিহারের ভোজপুরী ভাষাকে নেপালি বলে দেগে দেওয়া যায় না। তেমনই বাংলাভাষী মানুষ যখন আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণে বাংলায় কথা বলেন যার সঙ্গে বাংলাদেশের কথ্য বাংলার সঙ্গে সাদৃশ্য থাকে, তখন সেই মানুষকে ‘বাংলাদেশি’ বলা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সে বিষয়ে সংশয় থাকে না। বিজেপি নেতা এ-ও জানেন যে, দেশভাগের পরে ও আগে আগত বাঙালিরা তাঁদের কথ্য ভাষা ও উচ্চারণের বৈশিষ্ট্য নিয়েই ভারতের নাগরিক।
দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিকদের নিশানা করার আর একটি বড় কারণ হল এঁদের বেশির ভাগই মুসলমান। ধর্মের সঙ্গে ভাষাকে মিশিয়ে তাঁদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করা এবং তথাকথিত ‘বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশি’ ও ‘রোহিঙ্গা’ বিতাড়ন বঙ্গ বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক প্রকল্প। এই প্রকল্পে মদত দিতেই বিজেপির আইটি সেলের এমন মন্তব্য।
অবৈধ ‘অনুপ্রবেশকারী’ বিশেষভাবে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে বিতাড়নের নির্দেশনা পহেলগাঁও-এর বর্বরোচিত ঘটনার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জারি করে। ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন করে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী অনুপ্রবেশকে দেশের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, এরা দেশের জনবিন্যাসকে শুধু বদলে দিচ্ছে তাই নয়, মানুষের রুজি কেড়ে নিচ্ছে, আদিবাসীদের হটিয়ে দিয়ে তাদের জমিজমাও দখল করে চলেছে। এই মন্তব্য বিপজ্জনক। অথচ প্রধানমন্ত্রী এই তথ্য দেশবাসীকে জানালেন না কত পরিমাণ জল, জমি, জঙ্গলের অধিকার কর্পোরেটের দখলে যাওয়ায় কত সংখ্যক আদিবাসীকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। পদ্ধতি মেনে অনুপ্রবেশ বিতাড়নেও কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু রাজ্যের বিরোধী দলনেতা যে ৪০ লক্ষ থেকে দু’ কোটি ‘অনুপ্রবেশকারী’ ‘রোহিঙ্গা’ ও ‘বাংলাদেশি’ ‘অনুপ্রবেশকারী’র মনগড়া তথ্য অহরহ প্রচার করে চলেছেন তা যে ভিত্তিহীন তা দুটি তথ্য থেকে স্পষ্ট হবে। এক, ওডিশার ঝাড়সুগদায় ৪৪৭ জন আটক বঙ্গবাসীর মধ্যে ৪০৩ জন অল্পদিনেই ছাড়া পান, বাকিদের নিয়ে তদন্ত চলছে। দুই, হরিয়ানার গুরুগ্রামে শয়ে শয়ে আটক বঙ্গবাসীর মধ্যে শেষ অবধি বাংলাদেশি পাওয়া গিয়েছে মাত্র দশজন। কথা হল অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিন্ত তা চিহ্নিত করার যথাযথ পদ্ধতি (due process of law) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আতঙ্ক ছড়িয়ে বাঙালি হিন্দু-মুসলিমদের কল্পিত ‘বাংলাদেশি ভাষা’র মিথ্যা সংবাদ প্রকাশিত হয়ে চলেছে তা সম্পূর্ণ আইন বিরুদ্ধ ও অমানবিক।
লক্ষণীয়, কেরল ছাড়া অন্য রাজ্যগুলিতে বাঙালি শ্রমিক আক্রান্ত হলেও কর্মরত অন্যান্য রাজ্যের শ্রমিক বা উঁচু পদে কর্মরত বাঙালিরা কিন্তু আক্রমণের শিকার নন। কারণটা স্পষ্ট। ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানের’ উদ্গাতারা কলকাতা-কেন্দ্রিক বাংলাভাষীদের সঙ্গে তথাকথিত ‘বাংলাদেশি ভাষার’ বিভাজন সৃষ্টি করে এই অংশকে তাদের প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র যে ধর্মনিরপেক্ষতা, ভাষা নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের পরিসর দিয়েছে তা হিন্দুত্ব প্রকল্পের সঙ্গে খাপ খায় না। আবার ইসলামি মৌলবাদ বারবার বাংলা ভাষাকে ‘হিন্দু’ হিসাবে দাগিয়ে উর্দু চাপানোর চেষ্টা করেছে। হিন্দু মৌলবাদ কিছু বাংলা শব্দ (পানি, গোস্ত, গোসল ইত্যাদি) ব্যবহারকারী বাংলাভাষী মানুষের ভাষাকে ‘মুসলমানি ভাষা’ বলে চিহ্নিত করে বিভাজনকে আরও চওড়া করে চলেছেন।
অথচ উপরোক্ত শব্দের সঙ্গে উর্দু, ফারসি বা আরবির কোনও সম্পর্ক নেই। বাংলা হরফ অভিন্ন, কিন্তু কয়েক কিলোমিটার অন্তর কথ্যভাষা পাল্টে যায়। এটিই স্বাভাবিক। বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি কয়েক শতকে গ্রাম-শহরের শ্রমে-ঘামে সৃষ্ট। অপরায়ণের ধারা এই বাঙালি সত্তাকে খণ্ডিত করতে চায়। বাংলা ভাষায় যেসব বিদেশি ভাষার সংযোগ হয়েছে তা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। পরিতাপের বিষয় হল কলকাতা কেন্দ্রিক বিশিষ্ট বাঙালির একটা অংশ বাংলা ভাষায় তথাকথিত মুসলমানি শব্দের বিলোপ চান। সেকারণে ভিন রাজ্যে দরিদ্র শ্রমিকের নিগ্রহের ঘটনার প্রতিবাদে সামিল হতে এঁদের দেখা যায়নি। নীরব থেকে এঁরা কার্যত এই আক্রমণকে সমর্থন করে চলেছেন। বিজেপি ও সংঘ পরিবার এই অংশটিকে তাদের প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করে এই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে চায়।
এই প্রেক্ষাপটে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভিন রাজ্যে আক্রান্ত শ্রমিকের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন এবং দুটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এক, ভাষা আন্দোলন; দুই, ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পে যুক্ত হতে পরামর্শ দিয়েছেন এবং যতদিন তাঁরা কাজে যুক্ত না হতে পারবেন রাজ্য সরকার তাঁদের এক বছর পাঁচ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করবেন। বর্তমান কর্মস্থল থেকে ফিরে আসার খরচ বাবদ আরও পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার কথাও ঘোষিত হয়েছে।
এই দুটি কর্মসূচিই ভ্রমাত্মক।
বর্তমানের ভাষা সন্ত্রাসের উৎসে আছে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের চেষ্টা। এর সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। এটি প্রশাসনিক স্তরে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারকে যৌথভাবে এবং দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সেই মর্মে আন্দোলনও সংগঠিত হওয়ার আশু প্রয়োজন। সেই পথে না গিয়ে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়ে সমস্যার অভিমুখ বদলে বাঙালি আবেগ সৃষ্টি করার এই প্রয়াস ২০২৬-এর ভোটে শাসক দলের পক্ষে গেলেও উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে আদৌ সহায়ক হবে না। বরং এই ঘোষিত আন্দোলন দুর্নীতি, চাকরিহারা হাজার হাজার শিক্ষকের আন্দোলন ও রাজ্যের কাজের সুযোগ না থাকার কারণে পরিযায়ী হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্গতিকে আড়াল করবে। বিজেপিও এই বিষয়টিকে হিন্দু সমর্থন ভিত্তি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে অপরায়ণের জোরদার প্রচার করে চলেছে। এই ঘৃণার রাজনীতি রাজ্যের শাসক দলকে মানুষের জীবন জীবিকার প্রশ্নগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষকে ভিন্ন পথে চালিত করার পথকে সুগম করেছে। এইসব বিভ্রান্তি বিবদমান দুই পক্ষের সহায়ক হলেও এতে বিপন্ন বাঙালি শ্রমিকের সমস্যার সমাধান নেই।
আবার আক্রান্ত শ্রমিকদের তাঁদের বর্তমান কর্মস্থলে নিরাপত্তা দেওয়ার সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে রাজ্যে ফিরিয়ে আনা ও কাজ না পাওয়া পর্যন্ত কিঞ্চিৎ যে ভাতার ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী করেছেন তা আপাতদৃষ্টিতে কল্যাণকর। কিন্তু এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ১৯ ধারায় ভারতের যে কোনও স্থানে নাগরিকদের যাতায়াত, বসবাস ও কাজের অধিকার স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ভাষা ও ধর্মের ভিন্নতাকে অতিক্রম করে সকলের নিরাপত্তা প্রদান করা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন না করে গরিব শ্রমজীবীদের ফিরে আসার ডাক শ্রমিকদের অপমান করা হচ্ছে। এটা উভয় সরকারের চরম অপদার্থতা।
রাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে কত সংখ্যক শ্রমিক কাজ করেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে ২২.৪০ লক্ষ শ্রমিক যাঁরা বাংলার বাইরে কাজ করেন তারা সবাই শ্রমশ্রী প্রকল্পের সুবিধা পাবেন যদি তাঁরা শ্রমশ্রী পোর্টালে নাম নথিবদ্ধ করেন। যদিও ২২.৪০ লক্ষ শ্রমিক বাইরে কর্মরত বলে ঘোষণা করা হয়েছে, ওয়াকিমহলের অভিমত হল এই সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। যে কোনও হিসাবেই সংখ্যাটি বিশাল ও উদ্বেগের। রাজ্যে কাজের সুযোগ থাকলে তাঁদের ভিন রাজ্যে যেতে হতো না। করোনা-কালে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক অশেষ কষ্ট স্বীকার করে রাজ্যে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁরাও কিন্তু আবার অন্য রাজ্যে কাজের তাগিদে ফিরে যেতে গেছেন। তাঁদের দেশের যে কোনও স্থানে কাজের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। ভাতার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের অপমান করাও সঙ্গত নয়। দরকার তাঁদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা। ভাষা সন্ত্রাসের আড়ালে যে বিভাজনের অপচেষ্টা চলেছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করা জরুরি। যে রাজনৈতিক দল বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি’ ভাষার তকমা দিয়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিত করার কর্মসূচি নিয়ে অপরায়ণকে চওড়া করার খেলায় মেতেছেন, তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা দরকার। সব বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব গণতান্ত্রিক মানুষেরও এটা কর্তব্য। যেসব বাঙালি বুদ্ধিজীবী এখনও নীরব আছেন, তাঁরা বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় এগিয়ে এসে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের অপচেষ্টা ব্যর্থ করার কর্মসূচিতে সামিল হবেন বলে প্রত্যাশা। ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সংগঠিত হলে যে কোনও প্রান্তে আক্রমণকারীরা কোনও বাংলাভাষী শ্রমিকের দেশের কাজের সংবিধান সম্মত অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.