বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
কাশ্মীরে, ইসলামিক সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হলেন ২৬-জন হিন্দু।
বেছে বেছে ‘হিন্দু’ খুঁজেই মেরেছে তারা।
তবে, পহেলগাময়ের যে টাট্টু ঘোড়া চালক সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ আক্রান্তদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই হিন্দু নন। তিনিও ইসলামি। কিন্তু সন্ত্রাসীদের বাধা দিতে গিয়ে তিনিও শহীদ হয়েছেন।
অর্থাৎ, কাশ্মীরের ইসলামি মানেই সন্ত্রাসী না। সন্ত্রাস-বিরোধীও বটে। কাশ্মীরে যে মানুষগুলো মোমবাতি হাতে প্রতিবাদ মিছিল করেছেন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, যাঁরা ডাল লেকের পাড়ে আওয়াজ তুলেছেন, “পর্যটকরা আমাদের অতিথি, হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই”, তাঁরাও ইসলামি। পহেলগামেয়ের সন্ত্রাসীদের কথা বলে যারা ইসলাম বিরোধিতার কুৎসিত সাম্প্রদায়িক জিগির তুলতে চাইছে, তাঁদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে।
উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে কোটিকোটি ধর্মবিশ্বাসী মানুষ কখনোই এক কাতারে পড়েন না। না ইসলামি, না হিন্দু, না খ্রিস্টান, না বৌদ্ধ। সব ‘ধর্ম’র ইতিহাসেই অজস্র মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানির ঘটনা পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই ‘ইতিহাস’-এর দোহাই দিয়ে বর্তমানে হিন্দু-ইসলামিক হানাহানি উস্কে দেওয়া, চরম অমানুষতার প্রকাশ।
পহেলগামে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা খুন করলো বেছে বেছে ‘হিন্দু’দের। কিন্তু তারা শুধু পহেলগামেই ইসলামি (আদিল হুসেন)-কে হত্যা করেনি। সারা পৃথিবী জুড়ে, দেশে দেশে তারা বারবার সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। বিভৎসভাবে হত্যা করেছে হাজার হাজার ইসলামি মানুষকে। মসজিদ-ও তাদের হামলা থেকে বাদ যায় নি।
আজ যারা এই হত্যাকাণ্ডকে উপলক্ষ্য করে ভীষণ ‘মানবিক’ সাজতে চাইছে, তাদের একাংশকেও আমরা বারবার জহ্লাদের ভূমিকায় দেখেছি ভারত। কখনও দাঙ্গাবাজ হিসাবে হাজার হাজার ইসলামিকে হত্যা করতে; কখনও ‘নকশাল’ নাম দিয়ে আদিবাসী ও হিন্দু সহ অসংখ্য শিশু-যুবক-নারী-বৃদ্ধকে হত্যা করতে।
পহেলগামের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনও সম্পর্ক নেই। এগুলো সবই তাদের দেশীয় বিদ্রোহ। তাঁদের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে। একটা নয়, দুটো নয়, কয়েক ডজন রাজ্যে – নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীর, দক্ষিণে, ছত্তিশগড়ে, মণিপুরে।” (বিবিসি বাংলা) কিন্তু সারা পাকিস্তান জুড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ যে নিজেদের স্বাধীনতার দাবিতে জীবন বাজি রেখে লড়াই চালাচ্ছেন এবং পাকিস্তানী শাসকরা তাঁদের বর্বর সহিংসতার সঙ্গেই দমন করছে, তা নিয়ে তিনি চুপ।
‘সন্ত্রাসী’ অথবা ‘দাঙ্গাবাজ’, নামের ফারাকে কিছুই যায় আসে না। কাদের কী ‘বিশ্বাস’, তা বিচার করতে বসে মানবসমাজের অথবা নিহতদের পরিবারের কোনও লাভ নেই। ‘ধর্ম’-র মুখোশ পরে যারাই সাম্প্রদায়িক হানাহানি করে, তারা সকলেই মানবতার শত্রু। ইসলামি, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ… যা-ই পরিচয় হোক তাদের।
পহেলগাম হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারত সরকার অত্যন্ত কড়া মনোভাব দেখাচ্ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁরা ‘কল্পনাতীত’ শাস্তির কথাও বলছেন। পাল্টা পাকিস্তান-ও যুদ্ধ প্রস্তুতির হুমকি শোনাচ্ছে। তবে একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার: পুরো কাশ্মীর সবসময়েই সশস্ত্র বাহিনীতে মোড়া থাকে। পুলিশ, বিএসএফ, মিলিটারি, সবকিছুতেই ভরা কাশ্মীর। তবে আশ্চর্যের বিষয়, যখন এই সন্ত্রাসী হামলা এবং বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটে, একজন সশস্ত্র বাহিনীর দেখাও মেলে নি সেখানে! এমনকি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে, সন্ত্রাসীরা চলে যাবার প্রায় একঘন্টা পরে সেখানে ভারতীয় সেনা বাহিনী হাজির হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে সারা দেশেই চর্চা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় বৈঠকেও ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’র বিষয়টি ওঠে।
কিন্তু আশঙ্কা হয়, আবার যদি পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়েই যায়, দুই দেশেরই প্রচুর সেনার হয়তো মৃত্যু হবে। অসামরিক মানুষজনও নিহত হবেন। জনগণের দুর্দশাও বাড়বে। যুদ্ধে সম্ভবত কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খরচও হবে! কিন্তু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শেষ হবে কী? যাঁরা পহেলগামে ২৬-জন নিরীহ হিন্দু-ইসলামি মানুষকে হত্যা করলো, তাদের ‘শাস্তি’ হবে কী? তাদের যারা মূল মদতদাতা, তাদের আদৌ ছোঁয়া যাবে কী?
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই সন্দেহ। ঘর পোড়া গরু তো, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলেই আশঙ্কা হয়! বারবার ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দুই দেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি তাতে এতটুকুও কোণঠাসা হয়নি। বরং তা বেড়েই চলেছে!