বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
বছরের শেষে দুর্যোগ হানা দিল যোশীমঠে। আকাশ থেকে নয়, বলা যায় পাতাল থেকে ছড়াল যন্ত্রণাজাল। রাস্তা, বসতবাড়ি, সর্বজনীন ভবন, মন্দির সর্বত্র ফাটল দেখা দিল। মাটির মধ্যেই ডুবতে লাগল শহরটা। নতুন বছরের কয়েকটা দিন গড়াতেই তীব্র হতে থাকল সঙ্কট। আতঙ্কিত মানুষজন, উদ্বিগ্ন প্রশাসন। এরই মধ্যে শুরু হল দোষারোপের পালা। সাধারণ মানুষ আঙ্গুল তুললেন ভারী নির্মাণের দিকে। উত্তরাখণ্ড রাজ্যের যোশীমঠ ভারতের প্রতিরক্ষার দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। সেনাশিবির থাকে এখানে, সীমান্তের অভিমুখে চলে ভারী ট্রাক। ফলে রাস্তা বানানোর বা মেরামতির কাজ চলতে থাকে অবিরাম। হিন্দু ও শিখদের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে পুণ্যার্থীরা যান যোশীমঠের পথেই। আবার শুধুমাত্র প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করার জন্য ভ্রমণার্থীদের ভিড় লেগে থাকে মরশুমে। এদের থাকবার জন্য নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে বহুতল হোটেল। এই সব কিছুর জন্য এবং স্থানীয় মানুষের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হয় বিদ্যুতের। তার জন্য আবার দরকার ঢালাও আয়োজন। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বানানো হয়েছে সুড়ঙ্গ। যোশীমঠের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের জন্য বিশেষভাবে অভিযুক্ত হয়েছে ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) অধীনে গড়ে ওঠা তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্প।১
উত্তরাখণ্ডের মানুষের কাছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কোনও নতুন বিষয় নয়। কিন্তু গত এক দশকে বিপর্যয়ের শৃঙ্খলা যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে এই রাজ্যকে। এমন সব বিপর্যয়কে উন্নয়ন প্রকল্পের অভিঘাতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে বারবার। ২০১৩ সালের জুনে ভয়াবহ বন্যার পরে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে তৈরি হয় রবি চোপড়া কমিটি। অনুসন্ধান করতে গিয়ে কমিটির সদস্যরা দেখেন যে বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন নদীর উপর গড়ে ওঠা চব্বিশটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এর ফলে বিপর্যয়ের তীব্রতা হয়েছে অনেক বেশি। কমিটি বিশ্লেষণ করে বলে যে ২২০০ থেকে ২৫০০ মিটার উচ্চতার অঞ্চলে (paraglacial region) থাকা ছিয়াত্তরটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কতটা বিপজ্জনক। প্যারাগ্লেসিয়াল অঞ্চলে ভূগঠন ক্রমাগত বদলাতে থাকে। গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ গলে যাওয়ার পরে যা পড়ে থাকে সেটাই প্যারাগ্লেসিয়াল অঞ্চল। এখানে আলগা মাটি, পাথর ইত্যাদি থাকে যা নদীর প্রবাহে পলি হয়ে মিশে যেতে পারে। বন্যার সময় এই বিপুল পলি ছড়িয়ে জনজীবন স্তব্ধ করে দিতে পারে নদীগুলো। ঠিক এইটাই হয়েছিল ২০১৩ সালের বন্যায়। বিষ্ণুপ্রয়াগ প্রকল্পের ব্যারেজ বিধ্বস্ত হয় বন্যায়। একইভাবে ২০২১ সালে বিপুল ক্ষতি সইতে হয় আগে উল্লিখিত তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্পকে। বিপর্যয় এলে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের জীবন যাতে সুরক্ষিত থাকে তার জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না-থাকার ব্যাপারটাও উঠে আসে বেশ কিছু আলোচনায়।২
উত্তরাখণ্ডের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয় যাতে মনে হয় যেন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে (run-of-the-river (RoR) project) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সেখানে। বাস্তবে তা হয় না। নদীর প্রবাহকে বাঁধ ও জলাধার ব্যবহার করে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় একটা সুড়ঙ্গে। বহু কিলোমিটার দীর্ঘ এই সুড়ঙ্গের শেষে যখন জল বেরোয় তখন সেই গতিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয় বিদ্যুৎ। তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্পে প্রস্তাবিত সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ছিল বারো কিলোমিটার। কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার দীর্ঘও হতে পারে সুড়ঙ্গ। এভাবে নদীর গতিপথে বাধা দেওয়ায় সেগুলো যেন কতগুলো পুকুর বা দীঘির সমষ্টি হয়ে দাঁড়ায়। জলাধারগুলোর কথা উল্লেখ করে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিকে রবি চোপড়া কমিটির রিপোর্টে এভাবেই বর্ণনা করা হয়। এইসব প্রকল্পে বিস্ফোরক ব্যবহার করে সুড়ঙ্গ তৈরি করা এবং বিস্ফোরণের ফলে যে বিপুল পরিমাণ কাদামাটি তৈরি হয় তার উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবও ফুটে ওঠে রিপোর্টে। নিয়ম অনুযায়ী এই মাটি-পাথরের মিশ্রণকে কোনও জায়গায় সমতল করে রেখে তার উপর উর্বর মাটির আস্তরণ দিতে হবে এবং সেখানে লাগাতে হবে গাছ। এর ফলে আলগা মাটি-পাথর ছড়িয়ে পড়ে বিপদ ঘটাতে পারবে না। নিয়মকে গুরুত্ব না দিয়ে নদীর পাড়েই ডাঁই করা থাকে এই মাটি-পাথরের মণ্ড। এর পর নদীর খাতে গিয়ে পড়ে এই মিশ্রণ। বন্যার সময় অগভীর নদীখাতে জল বইতে পারে না, উল্টে নদী এই মিশ্রণকে গিয়ে জমা করে লোকালয়ে, প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। বন্যার আঘাত হয়ে ওঠে ভয়াবহ। ২০১০ সালে কম্পট্রোলার অ্যাণ্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্টেও এই বিষয়ের উল্লেখ ছিল।৩
তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্পে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে যা যোশীমঠের বাসিন্দাদের বিপন্ন করেছে। এর মধ্যে একটা হল গোটা কাজের বিভিন্ন অংশের জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব বন্টন করে দেওয়া। অভিযোগ করা হয়েছে যে কোনও অংশে বিপর্যয় ঘটলে বরাত পাওয়া সংস্থার উপর দোষ চাপিয়েছে এনটিপিসি।৪ জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার (জিএসআই) ভূতপূর্ব মহানির্দেশক টি এস পাঙতে যোশীমঠের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন যে ভূতাত্ত্বিক গঠন বোঝা এবং নির্মাণের ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা কেবল জিএসআই-র কাছেই রয়েছে। অন্যান্য সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়ে বরং পরিস্থিতিকে জটিল করে ফেলা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যে আরও উঠে এসেছে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পদ্ধতির কথা। টানেল বোরিং মেশিন ব্যবহার করে সুড়ঙ্গ খুঁড়লে সেটা ভূগঠনকে ততটা বিপর্যস্ত করে না। মেশিনের সাহায্যে ধীরে-ধীরে খোঁড়া হয় গর্ত আর সঙ্গে-সঙ্গে উপযুক্ত কাঠামো বানিয়ে নতুন ব্যবস্থাটাকে সুস্থির করা হয়।৫ কিন্তু এনটিপিসি-র আনা মেশিন সুড়ঙ্গের একদিকে আটকে যায় ২০০৯ সালে। কোম্পানি অন্য প্রান্ত থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শুরু করে দেয় ভূগঠন-নষ্ট-করার প্রশ্নকে পাশে সরিয়ে রেখে। তার আগেই অবশ্য টানেল বোরিং মেশিন বড় ক্ষতি করে ফেলেছে। ভূগর্ভস্থ একটা জলাধারে গর্ত হয়ে যায় মেশিনের কাজের ফলে। সেখান থেকে প্রতিদিন বেরোতে থাকে ছ’ লক্ষ থেকে সাত লক্ষ লিটার জল। এতটা জলে কুড়ি থেকে তিরিশ লক্ষ মানুষের দৈনদিন প্রয়োজন মিটে যায়। এই জলাধার ছিল মাটির প্রায় এক কিলোমিটার নীচে, যোশীমঠের কাছেই থাকা ট্যুরিস্ট স্পট আউলির নীচে। জল বেরিয়ে যাওয়ার ফলে একদিকে যেমন জলসঙ্কটে পড়েন যোশীমঠের মানুষ তেমনি শুকিয়ে যায় আশেপাশের বেশ কিছু প্রস্রবণ। এর পরে দেখা যায় সবথেকে বড় বিপদ যার কথা বিশেষজ্ঞরা বলে রেখেছিলেন আগেই। জলের চাপ সরে যাওয়ায় প্রবল হয়ে ওঠে যোশীমঠের মাটি বসে যাওয়ার সম্ভাবনা।৬ এটাই ঘটল সম্প্রতি!
যোশীমঠের দুর্বল ভিত নিয়ে ১৯৭৬ সালেই সতর্ক করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকারের গঠিত মিশ্র কমিশন। রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে আশেপাশের পাহাড় থেকে নেমে আসা ধ্বসের মাটির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে যোশীমঠ। তার অর্থ, যোশীমঠ কোনও শক্ত পাথরের ভিতের উপর অবস্থিত নয়। নীচে যা আছে তা হল বালি আর টুকরো পাথরের মিশ্রণ, যোশীমঠ শহরের চাপ ধরে রাখারই ক্ষমতা নেই যেটার। রিপোর্টে ভারী নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল। ভারী গাড়ির চলাচল, গাছ কাটা ইত্যাদির উপরও পূর্ণ নিষেধ জারি করার কথা বলেছিল কমিটি। এর কোনওটাই মানা হয় নি। বরং তপোবন-বিষ্ণুগড়ের সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে যোশীমঠের ভঙ্গুর ভূগঠন বরাবর। এর বিপক্ষে নানা সময় যোশীমঠের বাসিন্দারা আন্দোলন করলেও তা গুরুত্ব পায় নি।৭ যোশীমঠের বিপন্নতার আর একটা দিক লুকিয়ে আছে তার ভূগঠনের মধ্যে। ভূমিকম্প ঘটার সুযোগ থাকে ভূত্বকের ফাটল (fault line) বরাবর। এমনই এক বড় ফাটল (Vaikrita Thrust) রয়েছে যোশীমঠের খুব কাছে। তাই এই জায়গায় নির্মাণকাজের ভার চাপানো বা বিস্ফোরণ ঘটানো নিঃসন্দেহে বিপজনক। সে ব্যাপারটাও খেয়ালে রাখা হয় নি উন্নয়নের ধারায়।৮
যোশীমঠের ডুবে যাওয়া নিয়ে এখন আর সংশয় নেই। প্রশ্ন উঠছে অন্যান্য শৈলশহর নিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং। এখানে পরিস্থিতি যোশীমঠের অনুরূপ নয় ঠিকই তবে দার্জিলিং শহরের আশেপাশেও উন্নয়নের কাজ নিয়ে কিছু উদ্বেগ বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ করছেন অনেক দিন ধরে। এখানেও পণ্ডিতরা মনে করিয়ে দেন যে হিমালয়ের উদ্ভব হয়েছে এশিয়া মহাদেশের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ডের সঙ্ঘাতের ফলে। এখানে বারবার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। দার্জিলিং এই বিপদ থেকে মুক্ত নয়। কখন এই ভূমিকম্প আঘাত করবে জানা নেই। এদিকে দার্জিলিং খুব ধ্বসপ্রবণ এলাকা। একটানা ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ধ্বসের ঘটনা ঘটে যায় বিভিন্ন জায়গায়। এমন একটা জায়গায় পাহাড়ের স্বাভাবিক ঢালের তোয়াক্কা না করে মাটি কাটা, রাস্তা বানানো, কংক্রীটের বহুতল গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। দেশের অন্যান্য বহু শৈলশহরের মত দার্জিলিংয়ে নিকাশি ব্যবস্থা উপযুক্ত নয়। এর ফলে জল জমে, তারপর চুঁইয়ে চলে যায় মাটির নীচে এবং সেখানে ফাটল তৈরি করতে সাহায্য করে। অতএব দার্জিলিং শহরে বিপদের সম্ভাবনা ঘনীভূত হয়ে আছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে উন্নয়নের কাজ করা দরকার ভূগঠন বুঝে, সুস্থায়ী পথে। গৃহ নির্মাণে স্থানীয় প্রাকৃতিক বস্তুর ব্যবহার বাড়ানো, নির্মাণ নকশায় ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা রাখা জরুরী। সনাতনী পথে, স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে নির্মাণ করলে যে ভূমিকম্পেও নিরাপদ থাকা যায় তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে মেঘালয়ের শিলং শহরে, হিমাচল প্রদেশের কিছু জায়গায়।৯
আমরা কি সেই প্রজ্ঞার পথে হাঁটার সঙ্কল্প নিতে পারব?
তথ্যসূত্র:
১। P Nallathambi, GROUND SINKING IN JOSHIMATH, UTTARAKHAND, ব্যক্তিগত যোগাযোগে প্রাপ্ত
২। Shruti Jain, Construction of Calamities in the Uttarakhand Himalaya, Economic & Political Weekly, MARCH 27, 2021
৩। ঐ
৪। ঐ
৫। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার ভূতপূর্ব মহানির্দেশক টি এস পাঙতের সাক্ষাৎকার https://www.youtube.com/watch?v=UPHtMjMFeg4
৬। M P S Bisht and P Rautela, Disaster looms large over Joshimath, Current Science, 25 May 2010
৭। Shruti Jain পূর্বে উল্লিখিত
৮। K. S. Valdiya, Damming rivers in the tectonically resurgent Uttarakhand Himalaya, CURRENT SCIENCE, 25 JUNE 2014
৯। Haraprasad Bairagya, Vibhash Chandra Jha, Landslide and seismic activities of Darjeeling district: related problems and sustainable management, Scholars Journal of Arts, Humanities and Social Sciences, 2015; 3(5B):1060-1075