বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

আইটি কর্মীদের জীবন যন্ত্রণা

আইটি কর্মীদের জীবন যন্ত্রণা

কমল কুমার দাশ

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুন, ২০২২— ল্যাপটপ শাট ডাউন করে প্রীতম হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নেয়। সাড়ে সাতটা। ইস্ অনেক দেরি হয়ে গেল। কথাগুলো মনে মনে বিড় বিড় করতে করতে ব্যাকপ্যাকে ল্যাপটপ ঢুকিয়ে টেবিলটা গুছিয়ে ফেলে ঝটপট। সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে সোজা লিফটের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঠিক এই সময় ডান দিকের করিডোর ধরে ম্যানেজার অঙ্কিত বোসকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে একটু অস্বস্তিবোধ করে সে।
- কী প্রীতম, ব্যাগ নিয়ে কোথায় চললে?
- বাড়ি যাচ্ছি স্যার?
- সেকি, এতো তাড়াতাড়ি? তোমার কাজ শেষ হয়ে গেছ?
- হ্যা স্যার। আমার এ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করে রেখে এসেছি।
- ওকে। গুড। তা না জানিয়ে চলে যাচ্ছো?
- নিচে নেমে ফোন করতাম স্যার।
- ওকে। আসলে আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম।
- কেন স্যার?
- আর বলো না, একটু আগেই মি. ধানুকা ফোন করেছিলেন। ওই যে আমাদের ফরেন ক্লায়েন্ট। ওর কিছু আর্জেন্ট কাজ আছে। করে দিতেই হবে। তুমি ছাড়া তো এ কাজ আর কাউকে দিয়ে হবে না। তাই তোমার কাছে যাচ্ছিলাম। তোমাকে একটু থেকে যেতে হবে।
- সরি স্যার, আমি আর থাকতে পারব না। সেই সকাল সাতটায় অফিসে ঢুকেছি। এখন রাত আটটা বাজতে চলল। আমি আর পারছি না স্যার। শরীর দিচ্ছে না।… প্রীতম নিচু স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করে।
- পারছি না বললে কি হয় প্রীতম। দিস ইজ ভেরি আর্জেন্ট। ক্লায়েন্টকে পারব না, বলা যায়? তাছাড়া হেলথ কেয়ারের কাজ। দিস ইস ভেরি আর্জেন্ট। ঠিক আছে, আমি তোমাকে রাতে খাওয়াবো। ডোমিনোস থেকে পিৎজা আনাচ্ছি। ওকে!
- স্যার…
প্রীতমের কথা শেষ হওয়ার আগেই ম্যানেজার অঙ্কিত দ্রুত পায়ে তার চেম্বারের দিকে হাঁটতে থাকেন। একরাশ বিরক্তি ও অনিচ্ছা স্বত্বেও প্রীতম বসের পিছু পিছু কেবিনে ঢোকে। আ্যসাইনমেন্ট বুঝে নিয়ে সোজা ক্যান্টিনে চলে আসে। হরিদার কাছ থেকে এক কাপ কফি নিয়ে স্মোকিং জোনে চলে যায়। সিগারেট ধরায়। রাগ ক্ষোভ দুঃখ দলা পাকিয়ে যেন গলার কাছে আটকে ধরে। শরীর থেকে অঝোরে ঘাম ঝরতে থাকে। মাথার পেছনটা টনটন করছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু উপায় নেই। অফিসের অতিরিক্ত কাজে সে কোনওদিন না বলেনি। আইটি সেক্টরে কাজ করতে গেলে বসকে না বলা যায় না। গত তিন বছরে আইটি কোম্পানিতে কাজ করতে করতে এই কথটা বিলক্ষণ বুঝে গেছে প্রীতম। রাগ, বিরক্তি, ক্ষোভ গোপন করে কিভাবে মুখ বুজে কাজ করতে হয় তা শিখে গেছে। ব্যক্তিগত সমস্যার কথা, যন্ত্রণার কোম্পানি শোনে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুনলেও তার প্রভাব পড়ে বছর শেষের রেটিংএ ওপর। রেটিং কমে গেলে চাকরিতে তার প্রভাব পড়ে। প্রমোশন, ইনসেনটিভ সব আটকে যায়। প্রয়োজনে বসিয়ে দিতেও পারে। চাকরিটা তার খুব দরকার। সংসারের অনেকটা দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তাই কোনও দিকে না তাকিয়ে ঘাড় গুঁজে টার্গেটের পেছনে ছুটে চলাকে অনিবার্য হিসেবে ধরে নিয়েছে সে। আর টার্গেটের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে সে নিজেই টার্গেট হয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। ক’বছরে প্রীতম এসব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আসলে গত সাতদিন ধরে ভীষণ কাজের চাপ যাচ্ছে অফিসে। রাতদিন এক করে একটা প্রজেক্ট শেষ করতে হয়েছে। শনি-রবিও ছুটি মেলেনি। তাছাড়া কাল সকালে কলকাতা থেকে বাবা ব্যাঙ্গালুরু আসছে। কয়েকদিন এখানে থেকে নতুন ভাড়া বাড়িটা একটু গুছিয়ে দিয়ে যাবে। প্রথম বার আসছে বলে বাবাকে বলেছিল এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসবে। বাবা ব্যাঙ্গালুরু কোনওদিন আসেনি। কিন্তু অফিসের কাজ কখন শেষ হবে সে জানে না। সকাল সাতটায় বাবার ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা। তার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছানো অসম্ভব। এখানে সকালেও ভয়ঙ্কর ট্রাফিক থাকে। এক দেড় ঘন্টার কমে পৌঁছানো যাবে না। তাই। বাবাকে ক্যাব বুক করে দিতে হবে। কিছু একটা বলে ম্যানেজ করতে হবে। অফিসের কথা বলা যাবে না। বাবা দুশ্চিন্তা করবে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে কাজের টেবিলে এসে বসে।
শুধু প্রীতম নয়, বেশিরভাগ আইটি কর্মীকে একরাশ অসন্তোষ গোপন রেখে প্রতিদিন কাজ করতে হয়। কারণ আইটি কোম্পানিতে কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। বারো ঘন্টা, চোদ্দ ঘন্টা কোনও কোনও সময় আঠারো ঘন্টাও কাজ করতে হয়। কোভিডের আগে যখন অফিসে গিয়ে কাজ করতে হতো তখন তবুও কাজটা একটা নির্দিষ্ট সময় সীমানার মধ্যে ঘোরাফেরা করতো। ডেস্কটপের সামনে বসে কাজ করতে হতো। কাজ শেষ করে ডেস্কটপ অফ করে অফিস থেকে বেরিয়ে এলে কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যেত। কর্মীর ওপর বাড়তি কাজ চাপানো কিছুটা হলেও অসুবিধা ছিল। কিন্তু এখন তো কোম্পানি সবার হাতে ল্যাপটপ গুঁজে দিয়েছে। রাতদিন কানেক্ট রাখা যায়। যখন তখন কাজ চাপিয়ে দেওয়া অনেক সুবিধা। আর এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাড়িটাই অফিস। ফলে কোম্পানির সোনায় সোহাগা। সারাক্ষণ কর্মীকে কাজের মধ্যে আটকে রাখা সহজ হয়েছে। কোভিড কারো কারো কাছে সর্বনাশ হলেও কর্পোরেটের কাছে পৌষ মাস। বিশেষ করে আইটি কোম্পানিগুলো কোভিড কালে তাদের মুনাফা অনেকগুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। আর কর্মীরা চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। উপায়ও নেই কোনও। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা। ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে অনিশ্চিতা। রেটিং কমে গিয়ে যে-কোনও মুহূর্তে ছাঁটাই হওয়ার তীব্র ভয়। এই ভয় কতটা তীব্র তা দেবার্ঘ্যের গল্প শুনলে ভালোভাবে বোঝা যায়। দেবার্ঘ্যের অফিস ব্যাঙ্গালুরুতে। কোভিডের আগের কথা। অফিসে গিয়ে সে জানতে পারে তার বাবা মারা গেছেন। প্রথমে ভাবে, অফিসকে জানিয়ে সে কলকাতায় চলে আসবে। বাবার শেষকৃত্যে থাকবে। সাধারণত অফিস এ সমস্ত ব্যাপারে না করে না। কিন্তু পরক্ষণেই তার মাথায় কতকগুলো ভাবনা জট পাকাতে থাকে। সে একটা প্রোজেক্টের কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছে কয়েক মাস ধরে। প্রোজেক্ট শেষের মুখ। ডেডলাইনও এসে গেছে। এই সময় চলে গেলে কোম্পানি এখন কিছু না বললেও বছরের শেষে রেটিং করতে গিয়ে এটাকেই একটা বড় ইস্যু হিসেবে ধরে রেটিং কমিয়ে দেওয়া প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। অনিশ্চিতার ভয়ে এবং প্রতিযোগিতার জন্য আইটিতে সবাই এখন ভালো কাজ করে। তাই বলে কোম্পানি সবাইকে পূর্ণমান দেয় না। কাউকে না কাউকে বলির পাঁঠা হতেই হয়। পয়েন্ট ফোর, পয়েন্ট ফাইভের হেরফের করার জন্য এই সমস্ত ছুটিগুলো অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়। তখন কথায় মাখনের ছুরি মিশিয়ে বলা হয়, আসলে তুমি হঠাৎ ছুটি নেওয়াতে কোম্পানির খুব ক্ষতি হয়েছে। তাই এটা করতে বাধ্য হলাম। এ সমস্ত সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে বাবার মৃত্য শোক গোপন রেখে বাড়িতে না গিয়ে চুপচাপ কাজ করে যায় সে। জুনিয়র থেকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ প্রত্যেককে তাড়া করে বেড়ায় নিরাপত্তাহীনতার এই গভীর অসুখ। ফলে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভয়ঙ্কর চাপ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টার্গেট পূর্ণ করার জন্য সবাই মরিয়া হয়ে ওঠে। এর ফলে শরীর ও মনে বাসা বাঁধছে জটিল অসুখ। নিদারুণ চাপ সহ্য করতে না পেয়ে কাজ করতে করতে হার্টঅ্যাটাকে মারা যাওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। ক্ষমতার জোরে কর্পোরেট সে খবর চেয়ে দেয়। আবার অতিরিক্ত চাপের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেকে নেশার আশ্রয় নেয়। কিন্তু কেন এতো চাপ? বর্তমানে আইটির বাজার অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তুমুল প্রতিযোগিতা। কোম্পানিগুলো বিভিন্ন শর্তে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে কাজ পাচ্ছে। ক্লায়েন্ট সীমিত সময়ের মধ্যে অনেক বেশি কাজ করে দেওয়ার দাবি করছে। কোম্পানি এই চাপ তার কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথচ আগে একটা প্রোজেক্টে যত সংখ্যক কর্মচারী রাখা হতো তা অনেকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বেশি পরিমাণ কাজ করিয়ে নিতে গিয়ে কোম্পানি তার কর্মচারীর ওপর অমানুষিক চাপ তৈরি করে চলেছে নানান উপায়ে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হল রেভিনিউ তৈরি করা। আর কারো কাছে কোনও দায়বদ্ধতা তা্দের নেই।
আপাতভাবে আইটি কর্মীরা প্রচুর টাকা মাইনে পেয়ে একটা ঝা-চকচকে জীবনযাপন করে। এটাও একটা মিথ। আইটি কোম্পানি তার কর্মচারীকে মাইনে দেয় না। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে প্রোজেক্ট বাবদ কর্মচারী পিছু যে টাকা কোম্পানি পায় তার পঁচিশ শতাংশ কর্মচারীকে দেওয়া হয়। আর বাকি পঁচাত্তর শতাংশ উদ্বৃত্ত শ্রম হিসেবে কোম্পানি আত্মসাৎ করে। মাইনে হিসেবে যেটুকু দেওয়া হয় তা তার শ্রমের উৎপাদন মূল্যের ক্ষুদ্রাংশ। এই অর্থের সিংহভাগই কর্মীরা ব্যয় করতে ব্যধ হয় সুস্থভাবে জীবন ধারণের উপকরণ সংগ্রহ করতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে দিনের বেশিরভাগ সময় থাকতে অভ্যস্ত আইটি প্রফেশনাল ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয় বাড়িতে এসি লাগাতে। বাড়ি, গাড়ির ইএমআই দিয়ে মোটামুটি স্বচ্ছল জীবন কাটাতে তার উপার্জনের সবটাই বেরিয়ে যায়। ঘুরপথে সেই অর্থ আবার কর্পোরেটের পেটে গিয়ে জমা হয়। ফলে আইটি কর্মীরা প্রচুর টাকা মাইনে পায় এটা অতিরঞ্জন।
আইটিতে মহিলা কর্মীদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ। এ কথা ঠিক যে যৌন নিপীড়ন বা জাতপাতের বিভাজন আইটি সেক্টরে নেই বললেই চলে। বরং তারা সমতার কথা বলে। কিন্তু মেয়েদের বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন পরিস্থিতিতে প্রচন্ড বিপদের মধ্যে পড়তে হয়। কোথাও ছয় মাস মাতৃত্বের ছুটি পাওয়া গেলেও, কোথাও মাত্র এক মাস মাতৃত্বের ছুটি। গর্ভবতী অবস্থায় যদি কোনও মহিলা স্বাস্থ্যজনিত অন্য কোনও সমস্যায় মধ্যে পড়ে ছুটি চাইতে বাধ্য হন তাহলে কোম্পানি তা মঞ্জুর করে না। তাকে হয় অসুস্থতা নিয়ে কাজ করে যেতে হয়, অথবা চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।
এখন প্রশ্ন, এতো শোষণ পীড়ন থাকা সত্ত্বে আইটি সেক্টরে কোনও কর্মী সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠছে না কেন। তার অন্যতম কারণ কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ একেবারে কম। পারস্পরিক ভাব এবং মতামত বিনিময়ের অবকাশও খুব কম। এক এক জন কর্মী ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পের কাজ করে। বেশির ভাগই কেউ কাউকে চেনে না। জানে না। প্রায় এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করে। কাজের অতিরিক্ত চাপে কোনও কিছু ভাবনাকে মাথায় প্রশ্রয় দেওয়ার মত সময় তাদের হাতে নেই। তার ওপর আছে উপরওয়ালার চোখ রাঙানি। নিয়মের ফাঁস। ফলে বারুদ প্রস্তুত থাকলে বিস্ফোরণ ঘটছে না। তবে আশার কথা অসংখ্য বাধাবিপত্তির মধ্যেও কিছু মানুষ সংগঠিত হচ্ছেন। ইতিমধ্যে একটি ডিজিটাল সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তাঁরা এই আকালে স্বপ্ন দেখছেন সংগঠিত হওয়ার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.