বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

মানবাধিকার লঙ্ঘন: লক্ষ্য নাগরিক-সমাজ

মানবাধিকার লঙ্ঘন: লক্ষ্য নাগরিক-সমাজ

পার্থ সিংহ

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১— সপ্তদশ শতকে ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুইসের সরকারে প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন যাজক ডিউক অফ রিচেলিউ (কার্ডিনাল রিচেলিউ নামেই সমধিক পরিচিত)। স্বৈরতান্ত্রিক এককেন্দ্রিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রবক্তা, রাজতন্ত্রের অন্যতম সহযোগী এই যাজক একদা বলেছিলেন, “তুমি যদি অতীব সজ্জন মানুষের লেখা মাত্র ছয়টি লাইন আমাকে এনে দাও, তাহলে তার মধ্যে আমি এমন কিছু খুঁজে বার করবো, যা দিয়ে তাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো যাবে”।
কার্ডিনাল রিচেলিউ-এর পদাঙ্ক অনুসারীরা তাদের বিরুদ্ধ মতকে নির্মূল করার জন‍্য কারান্তরালে খুনের পরিকল্পনা করে হত‍্যা করতে পারে অতিবৃদ্ধ অসুস্থ ফাদার স্ট্যান স্বামীকে। অনন্তকালের জন্য কয়েদ করতে পারে অশীতিপর কবি ভারভারা রাও, অসুস্থ অধ্যাপক সোমা সেন, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা, সুধা ভরদ্বাজ, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং কিংবা ছাত্র নেতা উমর খালিদ, গুলফিশা ফতিমাসহ আরও বহুজনকে। তাদের বক্তব্যের মধ্যে দেশবিরোধী বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের উপকরণ ঠিক খুঁজে পেয়ে যায় তারা। জুন মাসে তিন ছাত্র আন্দোলনকারীকে জামিন দিতে গিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের যুগান্তকারী মন্তব্য ছিল, “ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করতে সংবিধান স্বীকৃত প্রতিবাদের অধিকার ও সন্ত্রাসবাদী কাজের মধ্যে পার্থক‍্যকে বিলীন করে দিতে রাষ্ট্রের এই চেষ্টা যত বেশি গতি পাবে গণতন্ত্র ততো বিপদগ্রস্ত হবে।”
দিল্লির মসনদে বসার পর থেকে ঔপনিবেশিক নাগরিক নিয়ন্ত্রণমূলক আইনগুলোকে ক্রমাগত আরও ভয়ঙ্কর নিষ্পেষণের হাতিয়ার করে তুলেছে বিজেপি (হিডেন অ্যাজেণ্ডা বাহাইণ্ড ক্রিমিনাল ল রিফর্মস, কীর্তি সিং, ফ্রন্টলাইন, ২৫/০৯/২০২১)।
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ শাসকেরা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকারী কুখ্যাত রাওলাট আইন এনেছিল। থিওসফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি জি.এস. অরুণডেলকে ১৯১৯-এ লেখা এক চিঠিতে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘এই আইন সাপের মতো প্যাঁচের মতো জড়িয়ে ধরেছে ভারতীয়দের শরীর’। জঘন্য অপব্যবহারের নজির সামনে আসায় দুটি কালাকানুন টাডা এবং পোটা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর সেই একই ধাঁচে, সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম রুখতে আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ)কে আরও কঠোর করে তুলতে যথাক্রমে ২০০৪, ২০০৮, ২০১২ সালে সংশোধনী আনে ইউপিএ সরকার। প্রাথমিকভাবে এই আইনটি হয়েছিল সন্ত্রাসবাদী কাজে নিযুক্ত সংগঠনকে নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত করতে। এযাবৎকাল, সরকার শুধুমাত্র কোনও সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করতে পারতো আর কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনানুগ পদ্ধতিতে বিচার করে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘোষণা করার এক্তিয়ার ছিল আদালতের। সম্প্রতি বিপুল ক্ষমতাধর মোদি সরকারের করা ২০১৯-এ সবচেয়ে মারাত্মক সংশোধনীটির ফলে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মচারীই সন্দেহবশে কোনও ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করে দিতে পারে। সরকারের রাজনৈতিক প্রভুদের আজ্ঞা পালনে, বশংবদ একজন রাজকর্মচারীর মর্জির উপর নির্ভর করছে কোনও ব্যক্তির স্বাধীনতা, সামাজিক মর্যাদা। ফলে, ভারতীয় সংবিধানের মর্মবস্তু “ক্ষমতার স্বাতন্ত্র‍্যের (Separation of Power) তত্ত্বকে নস্যাৎ করে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার স্বাধীন ক্ষমতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই আইনের বিধানে বিচারক পুলিশের দেওয়া তথ্যের উপরেই ভরসা রাখতে বাধ্য, সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী তা যাচাই করতে পারেন না। আসলে, দেশের নিরাপত্তার অজুহাতে অপছন্দের ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকাল জেলবন্দী করাই সরকারের লক্ষ্য। তা স্পষ্ট হয়েছে, গত জুন মাসে দিল্লি-হাইকোর্টের রায়ে। বিচারপতিরা ছাত্র আন্দোলনকারীদের জামিন দিতে গিয়ে তাঁদের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, "আইনসভার উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রতিরক্ষার পক্ষে হানিকর সন্ত্রাসবাদকে একটি নির্দিষ্ট সুনির্দিষ্ট অপরাধের শ্রেণীভুক্ত করার। প্রতিবাদ বা এমন কোনও কাজ প্রকৃতপক্ষে আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা, যেহেতু দেশের প্রতিরক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক নয় তাই সন্ত্রাসবাদের অপরিহার্য বৈশিষ্টের মধ্যে কখনই পড়বে না। সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ, প্রতিবাদ দমন করতে আইনটি প্রণয়ন করা হয়নি।" আবার হিতেন্দ্রবিষ্ণু ঠাকুর মামলায় (১৯৯৪) শীর্ষ আদালতের মন্তব্য ছিল, একজন সাধারণ অপরাধীকে কোনওমতেই সন্ত্রাসবাদীর তকমা দেওয়া যায় না।
বিজেপি জমানায় ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার বেড়েছে ৭২% (দ্য হিন্দু, ১০/০২/২০২১)। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-২০২০ সময়কালে ইউএপিএ প্রয়োগ করে ১০৫৫২ জন মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন আর নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২৫৩ জন (যারা অনেকেই আবার উচ্চ আদালত থেকে মুক্তি পেতে পারেন)। অর্থাৎ প্রতি বছর ১৫০৭ জন গ্রেফতার হয়েছেন আর মাত্র ৩৫ জন (২.৩২%) দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। গড়ে ৯৮৫টি মামলা হয়েছে প্রত্যেক বছর আর তদন্ত হয়ে বিচারের জন্য পড়ে থাকা মামলা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০.৫৮% হারে। সারা দেশে ২০১৯-এ ইউএপিএ-তে সর্বোচ্চ ১৮৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল (স্ক্রল, ১৫/১১/২০২১)। সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ করা। ফলে, সিএএ-এনআরসি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের ধর্না, চাক্কা জ্যামের ডাক ইত্যাদি সরকার বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্যে পুলিশ, তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের নির্দেশে, দেশের সার্বোভৌমত্ব, নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ ইঙ্গিত দেখছে।
কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে নতুন এক তদন্ত সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি গঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালে মুম্বইতে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে। দেশের যে কোনও স্থানে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হলে, সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে এড়িয়ে তারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তদন্ত করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর ভয়ানক আঘাত ছিল এই আইন। এনআইএ-র এক্তিয়ার ছিল আইনটিতে তালিকাভুক্ত (Scheduled) আণবিক শক্তি আইন, ইউএপিএ, অ্যান্টিহাইজ্যাকিং আইন, বেসামরিক বিমান পরিবহন সুরক্ষা, নৌপরিবহন সুরক্ষা আইন, গণবিধ্বংসী অস্ত্র ও তার পরিবহন আইন এবং সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, জাল নোট সংক্রান্ত কয়েকটি নির্দিষ্ট আইনের আওতায় দেশের ভিতরে সার্বভৌমত্ব, সুরক্ষা ও ঐক্য বিঘ্নকারী কোনও অপরাধের তদন্ত করার। বিজেপি সরকারের ২০১৯-এর সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দিষ্ট অপরাধের তালিকায় যোগ করা হল (ক) বিস্ফোরক আইন, (খ) অস্ত্র আইন, (গ) তথ্য প্রযুক্তি আইন এবং (ঘ) মানব-পাচার বিরোধী আইন (আইপিসির অন্তর্গত)। শুধু দেশের মধ্যে নয়, অন্য দেশে সংঘটিত কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে দেশবিরোধী ঘটনারও তদন্ত করতে পারবে তারা। সংবিধান মতে (২৪৫/২ ধারা) অবশ্য, দেশের গণ্ডির বাইরে কাজ করবে এমন আইন প্রণয়ন অসিদ্ধ। নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিক প্রভুদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে এই তদন্ত সংস্থাটি প্রায় ব্যক্তিগত সেনার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিচারপতি এ.এন. মুল্লার বিখ্যাত উক্তি তারই প্রমাণ। মহারাষ্ট্রে যতদিন বিজেপি ক্ষমতায় ছিল ততদিন পর্যন্ত ভীমা-কোরেগাঁও মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে ছিল মহারাষ্ট্র পুলিশ। বিজেপি-বিরোধী জোট সরকার ক্ষমতায় এসে মামলাটির তদন্তভার রাজ্যনিয়ন্ত্রিত বিশেষ তদন্ত সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করতেই, তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মামলাটির তদন্তভার স্বনিয়ন্ত্রিত এনআইএ-র আওতায় নিয়ে আসে। সদস‍্য দেশ সহ ভারতও রাষ্ট্রপুঞ্জের রেজোল্যুশন (২০১৫) মিনিমাম রুলস ফর দ্য ট্রিটমেন্ট অফ প্রিজনার্স বা নেলসন ম্যান্ডেলা রুলসকে মান্যতা দেওয়ার শপথ নিয়েছিল। বাস্তবে এনআইএ-র সচেতন অমানবিক নৃশংসতা অশীতিপর অসুস্থ ফাদার স্ট্যান স্বামীকে উপযুক্ত চিকিৎসা ব‍্যবস্থাপনাকে প্রতিহত করে জেলেই খুন করল। অসুস্থ সোমা সেন, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, গৌতম নওলাখা, সুধা ভরদ্বাজদেরও একইভাবে জেলেই বন্দী। অথচ ভীমা-কোরেগাঁও মামলার মূল অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদী শম্ভাজি ভীড়েকে (মোদি যাকে মহাপুরুষ আখ্যা দিয়েছেন) আজ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি আর মিলিন্দ একবোটে জামিনে মুক্ত (দ্য কুইন্ট, ১২/০৭/২০২১)। ছত্রধর মাহাতো একদশক বাদে গতবছর জানুয়ারিতে জামিনমুক্ত হন। ফের তাকে, জামিন পাওয়া মামলাতেই, ২৮ মার্চ ভোররাতে ঘরের দরজা ভেঙ্গে গ্রেফতার করেছে এনআইএ। অতি সম্প্রতি কাশ্মীরের অগ্রণী মানবাধিকার কর্মী মোদি সরকারের প্রবল সমালোচক, খুররম পরভেজকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করেছে তারা। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের স্পেশাল রিপোর্টার মেরি লেলর সহ বিভিন্ন দেশ। অথচ, ২০০৭-এ আজমের শরীফ দরগায় (মৃত ৩, আহত ১৭), হায়দ্রাবাদের মক্কা মসজিদে (মৃত ৯, আহত ৫৮) সমঝোতা এক্সপ্রেসে (মৃত ৬৮, আহত ১২) এবং ২০০৮-এর মালেগাঁওতে (মৃত ৬, আহত ১০০) ভয়াবহ বিস্ফোরণ কাণ্ডে বিচারপতির সামনে অপরাধ কবুল করা, চার্জশিট প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ ইউ-টার্ন নিয়েছে সেই এনআইএ। বিজেপি দেশের সরকারে আসীন হওয়ার পর সেই অপরাধীরা জামিনে জেলের বাইরে আর বিচারপ্রক্রিয়া শীতঘুমে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অভিযুক্ত বর্তমান শাসকদলের অন্যতম সাংসদ। নৃশংস মজফফরনগর দাঙ্গায়(২০১৩) অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলি সম্প্রতি তুলে নিয়েছে যোগী সরকার (দ্য প্রিন্ট, ২৭/০৩/২০২১)। ২০০২-এর দাঙ্গায় নারোদা পাতিয়াতে ৯৭ জনকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার নায়ক কুখ্যাত বাবু বজরঙ্গি, মায়া কোডনানি জেলমুক্ত। মজার ব্যাপার, গত ১২ অক্টোবর, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মানবাধিকারের বাছাই করা ব্যাখ্যার প্রতি সতর্ক করেছেন এবং বলেছেন, রাজনৈতিক প্রিজমের ভিতর দিয়ে দেখে এবং রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব কষে মানবাধিকারের সবচেয়ে বেশি উল্লঙ্ঘন হয়। কার্ডিনাল রিচেলিউ-এর উত্তরসূরীদের ধারাবাহিকতায় রয়েছে মিথ্যাভাষণ, তঞ্চকতা, ভণ্ডামি।
জাতীয় সুরক্ষা আইন (এনএসএ) আরেকটি নিবর্তনমূলক আটক আইন। গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বরে সংসদে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পেশ করা তথ্যে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে মোট ১১৯৮ জন সন্দেহভাজনকে এনএসএ আইনের আওতায় গ্রেফতার করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৬৩৫ জনই প্রমাণাভাবে মুক্তি পেয়ে গেছে (দ্য হিন্দু, ১৬/০৯/২০২০)। অর্থাৎ দেশের সুরক্ষা বিঘ্নকারী অধিকাংশ সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ যোগাড় করে উঠতে না পারলেও তাদের স্বচ্ছন্দে আটক করে রেখেছিল পুলিশ। গত বছর সেপ্টেম্বরে, ডা. কাফিল খানের বিরুদ্ধে জাতীয় সুরক্ষা আইনে আনা মামলাটি খারিজ করতে গিয়ে প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতিরা বলেছিলেন, ডা. খানের বক্তৃতার বিভিন্ন পছন্দ মতো অংশ উদ্ধৃত করে ইচ্ছাকৃত তাঁর বক্তব্যের ভুল অর্থ করেছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরকে অসাংবিধানিকভাবে, স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দ্বিখণ্ডিত করে কেন্দ্রীয় শাসনাধীন করার পর, স্বেচ্ছাচারী প্রশাসন পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট (পিএসএ)-র নির্বিচার অপব্যবহার করে চলেছে সেখানে। এই আইনেও সন্দেহভাজনকে বিনাবিচারে অনির্দিষ্টকাল জেলবন্দী করে রাখা যায়। অভিযুক্তের বিচার চাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারটুকুও নেই। কতজনকে আটক রাখা হয়েছে তার কোনো সরকারি তথ্যও পাওয়া যায় না। জম্মু-কাশ্মীর কোয়ালিশন অফ সিভিল সোসাইটির ২০১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ৫ই আগস্টে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর মাত্র পাঁচ মাসে ৪১২ জনকে আটক করা হয়েছে পিএসএ-এর আওতায় [দ্য অয়্যার, ২৮/০১/২০২০]।
আন্তর্জাতিক অলাভজনক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউসের সাম্প্রতিক হিউম্যান ফ্রিডম ইনডেক্স রিপোর্টে বিশ্বে ১৬২টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১১১, গত বছরের ৯৪তম স্থানে। আর এক গবেষণা সংস্থা, সুইডেনের ভি-ডেম ইন্সটিটুট–এর রিপোর্টে ভারতকে বিশ্বের দশটি নির্বাচনী স্বৈরতান্ত্রিক (ইলেকটোরাল অটোক্রেটিক) দেশের মধ্যে রাখা হয়েছে। বিশ্বখ্যাত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের এবছরের (২০২১) রিপোর্টে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২ নম্বরে স্থান (২০১৬-এ ছিল ১৩৩) দিয়ে ভারতকে সাংবাদিকদের কাজ করার পক্ষে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বারংবার প্রমাণিত হয়েছে এইসব নিবর্তনমূলক আটক আইনের বিপুল অপব্যবহারের নমূনা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অদ্ভুত একটা সাদৃশ্য আছে এধরনের প্রত্যেকটি আইনে। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে, সাংবিধানিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে অভিযুক্তের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে আটকানো, বিলম্ব করা আর বিচারের এক্তিয়ার কেড়ে নিয়ে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থাকে যথাসম্ভব অকেজো করে দেওয়া। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৪৫৬/২০০৩-এর প্রস্তাব অনুযায়ী, সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন প্রণয়ন করতে হলেও তা হতে হবে অলঙ্ঘনীয় (নন-ডেরোগেবল) আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু দেশের নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যায় নাগরিকের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষেত্রটিতে। বারংবার লঙ্ঘিত হয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ধারাগুলি। নাগরিক সমাজই চতুর্থ যুদ্ধক্ষেত্র, বিদেশি আক্রমণকারী নয়, তারাই দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক আর তাদের বিরুদ্ধেই যে দেশের যাবতীয় যুদ্ধ-প্রস্তুতি তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। পুলিশ রাষ্ট্রের দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এ নাৎসি শাসনকালে একাধিক ডিক্রি জারী করে হিটলার গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব বিচারব্যবস্থা। গড়ে উঠেছিল নাৎসি বিশেষ আদালত যন্দাগেরিস্তা, ভক্সগেরিস্থফ। ফুয়েরারের ইচ্ছের, তাঁর পুলিশ-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়া অসম্ভব ছিল আদালতের। ভারতীয় নাৎসিদের জমানায় বিচারব্যবস্থাকে যত দিন না সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত যথাসম্ভব তাদের এক্তিয়ার কেড়ে নেওয়া হবে সংসদে জান্তব সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অসাংবিধানিক আইন, অর্ডিন্যান্সকে অস্ত্র করে। ফ্যাসিস্ত হিন্দুরাষ্ট্রের পূর্ণতা প্রাপ্তি হলে, রাষ্ট্রের সংবিধানসম্মত তিনটি স্তম্ভ আইনসভা, প্রশাসন ও ন্যায়ালয়ের স্বতন্ত্র ক্ষমতার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পূর্ণ রূপায়ণ হবে গোলওয়ালকরীয় মতাদর্শের।
ইতিহাস দেখিয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাচনী সড়ক ধরে এগিয়েই ফ্যাসিস্তরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে আর ক্ষমতা থেকে সরেছে একমাত্র সভ্যতা বিনাশী যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে। বর্তমান যুগে, প্রথাগত যুদ্ধ একপ্রকার অবাস্তব। আশা জাগিয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন হার না মানা কৃষক আন্দোলন। ক্ষমতাদর্পী ফ্যাসিস্তরা বাধ্য হয়েছে সাময়িক পশ্চাদপসারণে। ছত্তিশগড়ে শঙ্কর গুহনিয়োগীর সৃষ্টিশীল, নানামুখী গণআন্দোলনের প্রাণবান ঐতিহ্য যে উদাহরণ তুলে ধরেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় কৃষক আন্দোলনও আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে আঞ্চলিকতা, জাত, ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য, প্রাণবন্ত, স্বতোৎসারিত এক নাছোড় গণআন্দোলনই পারে ফ্যাসিস্তদের অশ্বমেধের ঘোড়াকে রুখতে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.