বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে আসামে ভয়াবহ উচ্ছেদ

সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে আসামে ভয়াবহ উচ্ছেদ

পার্থ সিংহ

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অক্টোবর, ২০২১— আবার নারকীয় উচ্ছেদ। এবার বিজেপি শাসিত আসামে। দরং জেলার সিপাঝরের ধলপুরে ২০ সেপ্টেম্বরে একদফা উচ্ছেদ হয়েছে। এরপর ২৩ সেপ্টেম্বরে ফের উচ্ছেদ করতে এলে প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে পুলিশ বাহিনী। বিক্ষোভ হঠাতে গুলি চালিয়ে পুলিশ খুন করে দু’জন গ্রামবাসীকে। সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিহিত একজন লাঠি হাতে পুলিশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং পুলিশের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। গুলিতে লুটিয়ে পড়া সেই অচেতন মানুষটির উপর তীব্র ঘৃণায় লাফিয়ে পড়ে এক যুবকের বার বার লাথি মেরে চলেছে। সংবাদসংস্থা পিটিআই-এর সনাক্তকরণে জানা গেছে, যুবকটি জেলা প্রশাসনের ভাড়া করা পেশাদার চিত্রগ্রাহক বিজয়শঙ্কর বানিয়া। গরিব মানুষের প্রতি কেন এত বিদ্বেষ? এই যুবকের ঘৃণার নৃশংস প্রকাশ দেখে সারা বিশ্ব শিউরে উঠেছে।

গুয়াহাটি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে দরং জেলার সিপাঝর রেভেনিউ সার্কেলের অন্তর্গত ব্রহ্মপুত্রের চরভূমি ধলপুর ১ এবং ধলপুর ৩ এলাকার সরকারি জমি জবরদখলমুক্ত করে স্থানীয় ভূমিহীন যুবকদের জন্য ৯.৬০ কোটি টাকার গরুখুটি বহুমুখি কৃষি প্রকল্প রূপায়ন করা হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

২০ সেপ্টেম্বর সোমবার অন্তত ৮০০ পরিবারকে একদফা উচ্ছেদের পর, ২৩ সেপ্টেম্বর ভোরে আসাম সশস্ত্র পুলিশের ১২০০ জওয়ানের বিশাল বাহিনী নিয়ে দরং জেলা প্রশাসন ফের উচ্ছেদ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মহিলা ও শিশুসহ সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। ছাত্র সংগঠন আমসু উচ্ছেদ ঠেকাতে মানবশৃঙ্খল করে এবং উপযুক্ত পুনর্বাসনের জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা তাদের এক সদস্য আমিনুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ, ৮০% পরিবার তাদের জিনিষপত্র, ঘরের ছাউনির টিন সরিয়ে নিয়েছিল, কয়েকটি পরিবার তখনও কাজ করছিল, কিন্তু তাদের সে সুযোগ না দিয়ে, পুলিশের জেসিবি দিয়ে ভাঙচুর করে। তখনই উত্তেজনা তৈরি হয়।

উচ্ছেদ হওয়া ফইজুর রহমান জানিয়েছেন, তাঁদের জমি ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হওয়ায় তাঁরা এখানে ডেরা বেঁধেছেন কয়েক দশক আগে, তাঁদের পরিচয়পত্র, এনআরসি তালিকায় নাম, জমির তথ্যাদিও আছে, তাঁরা কেউই বাংলাদেশ আগত নন (দ্য হিন্দু, ২৪/০৯/২০২১)।

সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের গুলির ভয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষ বেরিয়ে আসতেই সশস্ত্র বর্মধারী পুলিশ সরাসরি তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিহিত একটি মানুষ লাঠি হাতে এগিয়ে এলে পুলিশবাহিনী তার বুকে গুলি চালালে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এরপর এক যুবক তার উপর বিষম আক্রোশে ক্রমাগত লাথি, ঘুষি মারতে থাকে। গরিব মানুষগুলির উপর পুলিসের এবং এই যুবকের তীব্র ঘৃণার নৃশংস প্রকাশ দেখে সারা বিশ্ব শিউরে উঠেছে। পুলিশের গুলিতে মারা যায় শেখ ফরিদ ও মইনুল হক এবং আহত হয় ২০ জন। নবম শ্রেণীর ছাত্র, ১২ বছরের ফরিদ পোষ্ট অফিস থেকে তার আধার কার্ডটি সংগ্রহ করে ফিরছিল সেদিন।

রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির অন্যতম এজেন্ডা ছিল, সরকারি জমি থেকে জবরদখলকারী মুক্ত করে স্থানীয় ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করা। এজন্য কিছুদিন আগে হোজাই জেলার লঙ্কা অঞ্চলের ৭০টি এবং সোনিতপুর জেলার জামুগুরিহাটের ২৫টি পরিবারকে উৎখাত করা হয়। সিপাঝর অঞ্চলটি মঙ্গলদই লোকসভার অন্তর্গত। এখান থেকেই আসু ১৯৭৯-৮৫ সময়কালে অনুপ্রবেশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিল। ২০১৯এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্ন তুলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন মঙ্গলদই-এর নির্বাচনী জনসভাতে। বিধানসভার নির্বাচনেও বিভিন্ন জনসভায় বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হয়েছে প্রবলভাবে। আসুর সক্রিয় সমর্থনে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের উচ্ছেদের এই মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে।

ব্রহ্মপুত্রের চরভূমি ধলপুর অঞ্চলটিতে অন্তত ৩০০০ পরিবারের বাস, অধিকাংশই বাংলাভাষী মুসলমান। স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী হীরেন গোঁহাই মতে, আরএসএস-বিজেপির আসল পরিকল্পনা, এই উর্বরা চরভূমি থেকে মুসলমান বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে জমির দখল নেওয়া এবং এই জমি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। (দ্য ওয়্যার, ২৪/০৯/২০২১)।

এর আগে ৭ জুন সিপাঝরের চর-চাপোরি এলাকার ৪৯টি পরিবারকে উৎখাত করে জেলা প্রশাসন। সেসময়, হিউম্যান রাইটস ল নেটওয়ার্ক, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি ও অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আমসু)-র যৌথ তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে, ন্যূনতম পুনর্বাসন না দিয়ে গরিব মানুষের ভিটে-ঘর তছনছ করেছে পুলিশ। অধিকাংশই বাংলাভাষী মুসলমান। চল্লিশ বছর আগে, ১৯৮০-র দশকের প্রথমদিকে তারা এখানে ঘর বেঁধেছিল। প্রতিবারই প্রশাসন উপযুক্ত পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সে নিছক প্রতিশ্রুতি মাত্র।

উচ্ছেদের জন্য জনসমর্থন আদায় করতে অনেকদিন ধরে বিজেপি ওই এলাকায় সূক্ষ্মভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে চলেছে। প্রচার করা হয়েছে, মুসলমানরা নাকি চর-চাপোরির একটি প্রাচীন, ঐতিহাসিক হিন্দু মন্দিরের জমি দখল করে রেখেছে। যদিও, স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য, মন্দিরটি তৈরি হয়েছে ১৯৮৪ সালে উচ্ছেদ হওয়া মানুষেরা এখানে বসতি করার পরে। এখানে তিনটি হিন্দু পরিবার ছিল, দুটি পরিবারর অন্যত্র চলে গেলেও কনক দাসের পরিবার এখনও ছিল, যিনি প্রথম থেকে ওই মন্দিরের দেখাশোনা করতেন। দীর্ঘকাল, এ অঞ্চলে উভয় ধর্মের মানুষেরা পরস্পরের সুখদুঃখ ভাগ করে, শান্তিতে বসবাস করতেন।

২০১৬ সালে আসামে বিজেপি সরকার আসীন হওয়ার পর মন্দির কমিটি দাবি তোলে আশপাশের ১৮০ বিঘা জমি নাকি মন্দিরের এবং সেখানে বসবাসরত বাসিন্দাদের জমি থেকে সরে যেতে হবে। বাস্তবে মন্দির কমিটির কর্তাব্যক্তির এ অঞ্চলের বাসিন্দাই নয়। এই লোভনীয় উর্বর জমির দখল পেতে তারা উদগ্রীব। সমস্যা নিরসনে প্রশাসন মন্দিরের ১২০ বিঘা জমি চিহ্নিত করে— যদিও তার কোনও তথ্যপ্রমাণাদি ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী পদে হিমন্ত বিশ্বশর্মা আসীন হওয়ার পরে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া গতি পায়। ৭ জুন ধলপুরের ৪৯টি পরিবার উচ্ছেদ হয়। অন্যান্য মুসলমান পরিবারের সঙ্গে এতদিন মন্দিরের দেখভাল করে আসা কনক দাসের পরিবারও উচ্ছেদ হয়।

ওই এলাকার সরকারি জমি দখলমুক্ত করে একটি বহুমুখি কৃষি প্রকল্প করতে বিজেপি বিধায়ক পদ্ম হাজারিকা, মৃণাল শইকিয়া, পরমানন্দ রাজবংশী, সাংসদ দিলিপ শইকিয়াকে নিয়ে প্রকল্প কমিটি তৈরি করা হয়। বর্তমান মন্দির কমিটির সম্পাদক ধর্মকান্ত নাথ, তথ্যানুসন্ধানী দলকে জানিয়েছেন, মন্দিরটি নাকি অতি প্রাচীন, নরকাসুরের (পুরাণের প্রাগজ্যোতিষ-কামরূপের ভৌম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা) সময়কালের। যদিও, একটি প্যামপ্লেট ছাড়া মন্দিরের ১৮০ বিঘা জমির দলিল বা তথ্যপ্রমাণাদি কিছু দেখাতে পারেন নি। তিনি জানিয়েছেন, মিয়াঁ মুসলমানদের নাকি এই মন্দিরের উপর দীর্ঘকালের নজর। তাই তাদের উৎখাত করা দরকার।

ধলপুর ৩ এলাকার ২০০টি পরিবার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে গৌহাটি উচ্চ আদালতে মামলা করে। আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী শান্তনু বড়ঠাকুর জানিয়েছেন, মামলা চলাকালীন প্রশাসনের এই উদ্যোগ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আইনবিরুদ্ধ। বলপূর্বক উচ্ছেদকে মানবাধিকারের উপর জঘন্যতম আঘাত বলে অভিহিত করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশন। ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের গৃহীত ৩০ দফা নির্দেশিকাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, উচ্ছেদের আগে সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে, উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শ্রেণী, লিঙ্গ, সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক বিশ্বাস কোনও বিষয়ে বৈষম্য না করে সুরক্ষা ও সবরকম মানবিক সহায়তার বন্দোবস্ত করা। ঘরহারা মানুষদের কার্যকর বিকল্প বাসস্থান, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে অঙ্গিকারবদ্ধ থাকবে সরকার। একের পর এক রায়ে সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, সভ্যসমাজে জীবনের অধিকারের মধ্যেই বিধৃত থাকে খাদ্য-পানীয়ের অধিকার, সুস্থ পরিবেশ, স্বাস্থ্য-শিক্ষার অধিকার, সমাজের প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রবল বিক্ষোভ হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা গৌহাটি হাইকোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে গুলিচালনার তদন্ত করতে চেয়েছেন।

পরিষ্কার হয়ে গেছে, আসামের বিজেপি সরকার, সুচতুর উপায়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে সংখ্যালঘু মানুষদের উৎখাত করে সুবিশাল উর্বরা চরভূমি কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চায়। গণতান্ত্রিক অধিকার দমনে, রাজনৈতিক বিরোধী, প্রতিবাদী এবং অহিন্দু নির্যাতনে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা অতি দ্রুত যোগী আদিত্যনাথের সমকক্ষ হয়ে উঠছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.