বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
এটা স্পষ্ট যে, বিজেপি খুব দ্রুত হিন্দুরাষ্ট্রের অভিমুখে এগোতে চাইছে। প্রথমে রাজনৈতিক পরিসর দখল, তারপর নির্বাচন কমিশন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ইডি, সিবিআই সহ স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে কব্জা করা। হিন্দুরাষ্ট্রের আদর্শগত ভিত্তি নির্মাণের লক্ষ্যে দেশের ইতিহাসকে মুছে ফেলে নতুন ইতিহাস লেখার কাজ চলছে। বিজেপির শাসনের পিছনে দেশি-বিদেশি ক্রোনিদের পূর্ণ মদত রয়েছে। সম্পদ লুঠের ঢালাও সুযোগ থাকলে ভারত অঘোষিত হিন্দু রাষ্ট্র হল কিনা, তাতে তাদের কিছু এসে যায় না। এই কাজটাই তুর্কিয়েতে করেছেন এর্দোয়ান। একথাও ঠিক যে, ২০২৪এর লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরলে ভারতকে স্বৈরতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার দিকে অনেকটাই এগিয়ে যাবে বিজেপি-আরএসএস।
দ্বন্দ্বের বিপরীত দিকটা হল, সম্প্রতি যে দুটো রাজ্যে বিধানসভা ভোট হয়েছে, সেই হিমাচল ও কর্ণাটকে বিজেপি ধরাশায়ী হয়েছে। একটা রাজ্যে উত্তর ভারতের হিন্দি-হিন্দু বলয়ে। অন্যটা দক্ষিণ ভারতে একমাত্র বিজেপিশাসিত রাজ্য যা নির্বাচনে হাতছাড়া হয়েছে। দুটো রাজ্যেই নির্বাচনে বিজেপির হাতিয়ার ছিল দুটো— মোদির ভাবমূর্তি এবং হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার ইস্যু। অথচ কোনওটাই কাজে লাগেনি। মোদিত্ব কিংবা হিন্দুত্ব— কোনওটাই এই দুই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারেনি। তারা মোদি বা হিন্দুত্বের পক্ষে নয় — মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে ভোট দিয়েছেন। এর আগে দিল্লিতে হেরেছে বিজেপি। পাঞ্জাবেও তারা ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ।
রাজ্যস্তরে এই পাল্টা স্রোতের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে পাটনায় ২৩ জুন ১৫টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের বৈঠককে।
বিরোধীদের সম্পর্কে বিজেপির নীতি একেবারে সাদামাটা। যে কোনও অজুহাতে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ইডি, সিবিআই লাগিয়ে তাদের হেনস্থা ও গ্রেপ্তার করা। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভাঙন ধরানো। নতুবা বিপুল অর্থে বিরোধী বিধায়কদের কিনে নিয়ে সরকার বদল। ওপর তলায় বিজেপি যখন এসব কাজ চালাতে থাকে, তখন নীচুতলায় ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগির কাজটা নিঃশব্দে চালিয়ে যায় আরএসএস, এখন যা মণিপুরে স্পষ্ট। সেখানে হিন্দু মেইতেইরা হামলা করছে খ্রিস্টান মেইতেইদের ওপর, শুধু খ্রিস্টান কুকিদের ওপর নয়। রাজ্যে রাজ্যে এই সর্বনাশা ছকের পিছনেও রয়েছে ভোটের সমীকরণ।
একদিকে বিরোধীদের ওপর ক্রমাগত হামলা, অন্যদিকে হিমাচল ও কর্ণাটকে জনমতের বিজেপি বিরোধী বার্তা— এই দুই পরিস্থিতিই বিরোধী শিবিরকে একইসঙ্গে সক্রিয় এবং উৎসাহিত করেছে। নীতীশ কুমারের পাটনার বৈঠক থেকে পরবর্তী বৈঠকের দিন স্থির করা হয়েছে। এর মানে, বিরোধী ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। বিরোধী বৈঠকে যেসব দল জড়ো হয়েছিল, তাদের মধ্যে তিনটি ধারা রয়েছে। প্রথমত, কংগ্রেস ও তার সহযোগী দলগুলি। দুই, তিনটি বামপন্থী দল। তৃতীয়ত, তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির মতো কয়েকটি দল, যারা এতদিন বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া করে টিকে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু বিজেপি তাদের পরিসর দখলে ঝাঁপিয়ে পড়ায় এই দলগুলি বিরোধী জোটে সামিল হতে চাইছে। আর রয়েছে সমাজবাদী পার্টির মতো দল যারা নিজেদের গড় রক্ষায় সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। আবার মারাঠি হিন্দুত্বের প্রতীকগুলিকে পুরোপুরি বর্জন না করেও বিরোধী জোটে থাকতে চায় উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা।
রাহুল গান্ধী চাইছেন বিজেপি বিরোধিতাকে একটা ভিন্ন ন্যারেটিভে দাঁড় করাতে। এককথায় ক্রোনি ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের অবাধ শোষণের বিপরীতে ইউপিএ-এর জনমুখী মডেল অর্থনীতিতে ফেরার কথা বলেন রাহুল। যদিও ক্রোনি ও একচেটিয়া পুঁজিকে একেবারে খারিজ করে নয়, বরং সেগুলিকে রাষ্ট্রের লাগাম পরিয়ে রাখার ভাবনা হয়ত মাথায় রয়েছে তার। অন্যদিকে লালু-নীতীশ ও তাদের অনুগামী দলগুলি বিজেপির জাতপাতের রাজনীতির জবাব দিতে চায় মণ্ডল ২ সংস্করণের মাধ্যমে। নতুন এই ছককে বলা হচ্ছে পিডিএ বা পিছড়ে, দলিত, অল্পসংখ্যক। অন্যভাবে বললে, পশ্চাদপদ, দলিত ও সংখ্যালঘু। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই বিহারে জাতপাতের গণনা করতে চেয়েছিলেন নীতীশ, যা শেষ পর্যন্ত আটকে দেয় আদালত। পিডিএ হিসাবটি সামনে আনতে পারলে প্রমাণ হয়ে যাবে এদেশে উচ্চবর্ণগুলি সংখ্যালঘিষ্ঠ। সেই উচ্চবর্ণের ছাতার তলায় যে হিন্দুত্ব বিজেপি নির্মাণ করছে এবং তাতে সমাজের যে নীচুতলাকে জুড়ে নিতে চাইছে, তাদের অবস্থান পুরোপুরি আলাদা। এই ফর্মুলায় বিজেপির হিন্দুত্ব নির্মাণের ছককে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে কংগ্রেস, তাদের সহযোগী দলবল এবং বামেদের ন্যারেটিভগত ঐক্য গড়ে তোলাটা সহজ।
শিবসেনা বিজেপির সঙ্গ ছেড়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ব পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারেনি। কেজরিওয়াল একেবারেই নিজের দলীয় স্বার্থের ভিত্তিতে দর কষাকষি করছেন। সম্ভবত বিপদে পড়ে জোটে সামিল তিনি। সম্ভবত জোটের সবচেয়ে অনিশ্চিত শরিক। তৃণমূল কংগ্রেস জোটে থাকার কথা ভাবছে বটে, কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গের সব লোকসভা আসন জেতা। এখানেই আম আদমি পার্টি, তৃণমূলের মতো দলগুলির সঙ্গে জোট ধর্মের সঙ্ঘাত বাধার সম্ভাবনা প্রবল। একই পরিস্থিতি অখিলেশ যাদবকে ঘিরে, কারণ অখিলেশ উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসকে একচুল জমিও ছাড়বেন না। ফলে বিজোপি বিরোধিতার কাঠামোর মধ্যেই এই সব দলের সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় ধারার দলগুলির সঙ্ঘাত থাকবে।
এই স্বার্থ সঙ্ঘাত যে একটা গুরুতর সমস্যা তা বোঝেন জোটের উদ্যোক্তারা। সেকারণে রাজ্যভিত্তিক বোঝাপড়ার একটা ভাবনাও আসছে। সমাধানের একটা সূত্র তৃণমূলের— একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী। যদিও এনিয়ে পাটনার বৈঠকে কোনও কথা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। নানান ধারার বিজেপি বিরোধী দলকে একসূত্রে গেঁথে ফেলাটা যে খুব সহজ কাজ নয়, বিজেপিও সেটা জানে। তাই তারাও এই জোট ভাঙার খেলায় নামবে। যাঁরা বিরোধী জোটকে শক্ত জমির ওপর দাঁড় করাতে চান, তাদের সামনে জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে আঞ্চলিক দলগুলির আঞ্চলিক স্বার্থকে কতদূর ও কীভাবে ধারণ করা যায়, তার একটা সমাধানসূত্র বের করতে হবে। আবার জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে আঞ্চলিক দলগুলিকে আঞ্চলিক স্বার্থ কিছুটা পিছনে রাখার মতো সাহসী মনোভাবও দেখাতে হবে। বিরোধী জোট গড়ার ক্ষেত্রে, ১৯৭৭ এর সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির এটাই মৌলিক ফারাক।
বিজেপি বিরোধী রাজনীতির যে তিনটি ভিন্ন স্রোত, ২০২৪এর লোকসভা নির্বাচনের আগে সেগুলিকে একই সঙ্গমে মিলিয়ে দিতেন পারেন কিনা বিরোধী নেতারা, আগামী দিনে সেদিকেই নজর থাকবে রাজনৈতিক মহলের।