বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ওষুধ শিল্প, অতিমারি ও শিল্প শ্রমিক

ওষুধ শিল্প, অতিমারি ও শিল্প শ্রমিক

প্রদীপ রায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য দিয়ে শুরু করা যাক। উৎপাদনী ক্ষেত্রে যুদ্ধাস্ত্র আর ওষুধ ব্যবসায় মুনাফা সর্বাধিক, লাগামছাড়া। আর দু'টি ব্যবসাতেই কারও কারও পৌষ মাস, আর আমজনতার সর্বনাশ!
এই আলোচনা মূলত দেশীয় ওষুধ শিল্প ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। তার আগে সংক্ষেপে বিরাজমান পরিস্থিতি এক ঝলকে বুঝে নেওয়া যাক। বিশ্বজুড়ে সব ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, ওষুধের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অবশ্যম্ভাবী ভাবে এই শিল্প একচেটিয়া পুঁজিপতিদের খপ্পরে পড়েছে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্রমশই আলগা হয়েছে। একচেটিয়াকরণ কি পর্যায়ে পৌঁছেছে? কেবল উৎপাদনী ক্ষেত্র ধরলে এদেশে ভেষজ বা ওষুধের কোম্পানির সংখ্যা দশ-এগারো হাজারের কম নয়। বিপণন ব্যবস্থা ধরলে আরও বেশ কয়েক হাজার। অথচ দেশের আভ্যন্তরীণ ওষুধের বার্ষিক বাজারের প্রায় ৪৩ শতাংশ দখল করে রয়েছে মাত্র ১০টি কোম্পানি। কেবল তাই নয় প্রথম ১০০টি কোম্পানির কব্জায় রয়েছে ঐ বাজারের ৯৭ শতাংশ। রপ্তানি ক্ষেত্রের একচেটিয়াকরণ আরও মারাত্মক। রপ্তানি বাজারের মূল্যও আভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যের কাছাকাছি। ওষুধের সবচাইতে বৃহৎ বাজার আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশও একইভাবে প্রথম দশটি কোম্পানির কবলে। অবশ্য মূল্যের বিচারে এই বাজারগুলির পরিমাণগত তফাত আকাশ-পাতাল। বিশ্বে ওষুধ বাজারের মোট আয়তনের বিচারে তৃতীয় এবং মোট মূল্যের বিচারে চতুর্দশ অবস্থানে রয়েছে ভারতের ওষুধ- ব্যবসা। পাশাপাশি আরও দু'টি তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এতদসত্ত্বেও মূল্য বিচারে সারা বিশ্বের মোট ওষুধ বাজারের মাত্র ১.৫ শতাংশের অংশীদার ভারতবর্ষ। আর দ্বিতীয়ত বিশ্বের প্রায় সব দেশের তুলনায় ভারতে ওষুধের দাম অপেক্ষাকৃত কম। অথচ ষাটের দশক পর্যন্ত এদেশে ওষুধের দাম ছিল উঁচু তারে বাঁধা; বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে। ক্রমবর্ধমান জনরোষের বাধ্যবাধকতায় সত্তরের দশকের গোড়া থেকেই সরকার একের পর এক, MRTP (দি মনোপলিজ রেস্ট্রিক্টিভ ট্রেড প্র্যাক্টিসেস অ্যাক্ট), বিভিন্ন ধারা সহ FERA (দি ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট), IPA'70 (দি ইন্ডিয়ান পেটেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭০) এবং ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য DPCO (দি ড্রাগ প্রাইস কন্ট্রোল অর্ডারস) চালু করে। এগুলি যথার্থই আত্মনির্ভর ভারত গড়ার পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল; বিশেষত ওষুধের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানিগুলির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় (মূলত ফর্মূলেশন ওষুধ তৈরির প্রয়োজনে আকরিক ওষুধ তৈরি) দেশীয় কোম্পানিগুলি বেড়ে ওঠার সুযোগ পেল। এদেশ হয়ে উঠল তৃতীয় বিশ্বের জন্য সস্তার ওষুধ তৈরির অন্যতম পীঠস্থান এবং জেনেরিক ওষুধ প্রস্তুতের কেন্দ্রস্থল। স্মরণ রাখতে হবে যে শিল্পটি ধীরে ধীরে দেশে অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি পেল। এর পরপরই এদেশে ফান্ড ব্যাংকগুলির নির্দেশিত নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির হাত ধরে IPA'70 কে হঠিয়ে আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আইনের আগমন ইত্যাদি। লঘু হতে হতে একে একে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল সাধারনের স্বার্থবাহী এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকারী উপরোক্ত আইনগুলি। যে বিদেশি কোম্পানিগুলি লাভের পুঁজি দেশে নিয়ে যেতে পারছেনা এবং এদেশে লগ্নি করে কারখানা স্থাপন করার বাধ্যবাধকতা মানতে না পেরে পগার পার হয়েছিল, তারাই উদার অর্থনীতির মসৃণ রাস্তায় গ্রিন ফিল্ড, ব্রাউন ফিল্ডের গাঁট এক ঝটকায় সামলে ১০০ শতাংশ বিনিয়োগের ছাড়পত্র পেয়ে গেল। আদায় করে নিল এদেশের ওষুধের বিনিয়ন্ত্রিত বিস্তীর্ণ বাজার। ইতিমধ্যে ধারাবাহিক বিনিয়োগ বঞ্চনায় বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানিগুলি ধুঁকতে শুরু করেছে। বিশাল বিশাল ফার্মেন্টর ভিত্তিক আকরিক ওষুধ তৈরির কেন্দ্রগুলিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হল এবং চীন থেকে আকরিক ওষুধ আমদানি করে 'ফর্মূলেশন' ওষুধ বিক্রি করতে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলি অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। ফলত আজ চীনের সাথে বৈরিতার কারণে হঠাৎই দেশে আকরিক ওষুধ তৈরি করে আত্মনির্ভরতার ডাক 'হালে তেমন পানি' যোগান দিতে পারছে না।
ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ভ্যাকসিন কারখানাগুলিকে পঙ্গু করা হয়েছে। চালু ভ্যাক্সিনগুলি এখন ২ থেকে ৩ গুন দাম দিয়ে সরকারই খরিদ করে। ফলত করোনাকালে বিদেশ বা দেশের রিসার্চ কেন্দ্রে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের মূল্য নির্ধারণের শর্তাবলী মূলত ব্যক্তি মালিক ঠিক করার সাহস দেখায়। বিশেষত ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় ইত্যবসরে। NPPA (ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি)-এর তত্ত্বাবধানে ওষুধের মূল্য আর আগের মতো উৎপাদনের খরচের বিচারে স্থির করা হয় না, হয়, বাজারের ১ শতাংশের বেশি দখল করে থাকা ওষুধগুলির গড় মূল্যের বিচারে। আর এখানেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, উদারবাদী অর্থনীতির দৌলতে ততদিনে DPCO অনুযায়ী ওষুধের সংখ্যা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল এবং বেশিরভাগ ওষুধের মূল্যই বিনিয়ন্ত্রিত ছিল। ফলে আজ যে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির কারণে শোরগোল উঠেছে তার নীল নকশা রচিত হয়েছে অনেকদিন আগেই।

শিল্প শ্রমিক


নয়া উদারবাদী অর্থনীতির হাত ধরে ওষুধ শিল্পের মালিকরা প্রথমে নিজেদের গুছিয়েছে, পরে একের পর এক, উৎপাদন, বিলি এবং শেষে বিপণন ব্যবস্থার খোল-নলচে ধারাবাহিকভাবে বদলে চলেছে। যৌথ উদ্যোগ, মার্জার, মেগা-মার্জার, অধিগ্রহণ ইত্যাদির হাত ধরে এই সময়ে দেশি বিদেশি বহুজাতিক সংস্থা বাজারে অংশীদারিত্ব পাকা করেছে বা বাড়িয়ে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ভোগ্যপণ্য শিল্পের দেশি-বিদেশি বৃহৎ শিল্পপতি তাদের বিস্তৃত নেট-ওয়ার্ক নিয়ে এবং লগ্নি বা ফাটকা পুঁজির কোম্পানিগুলি ফর্মুলেশন ওষুধের ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে। পাশাপাশি রিসার্চ নির্ভর, যথেচ্ছ মুনাফার উৎস পেটেন্টকৃত ওষুধ ব্যবসায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে, যার আয়তন বহু উন্নত দেশের বাজারের চাইতেও বেশি। কর্পোরেটদের এই স্বার্থ চরিতার্থ করতে দেশের সরকার পেটেন্ট, OTC (OVER TRADE COUNTER) ড্রাগ পলিসিসহ বড় ব্যবসাদারদের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সব আইন বদলাচ্ছে। আর এই সমস্ত পরিবর্তনে সবচাইতে এবং সর্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের।
ওষুধের প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলির বিলোপ করা হয়েছে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রথম দশকে। সব কর্মীকে হঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উৎপাদন ব্যবস্থা তুলে নিয়ে ভাগে ভাগে নিয়ে যাওয়া হল দেশের কোণায় কোণায় স্থাপিত SEZ (স্পেশাল ইকনোমিক জোন) বা NIMZ (ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং জোন) অঞ্চলে। সেখানে উন্নত প্রযুক্তি— কর্মীসংখ্যা কম, মাস-মাইনেও কম। ট্যাক্স-এ দেদার ছাড়, শ্রম আইনের কোনও বালাই নেই; শ্রমিকদের দরকষাকষির সব মঞ্চ নিমেষে অন্তর্হিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানিগুলিতেও যে হাজার হাজার কর্মী কাজ করতেন তা এখন (যে ক'টি বেঁচে আছে) তলানিতে। কারখানার অবস্থা ভগ্নদশা প্রায়। কারখানা ঘিরে গড়ে ওঠা সহায়ক শিল্পগুলি এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা বাধ্য হয়েছেন উৎপাটিত হয়ে অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে। ওষুধ বিলি ব্যবস্থার জন্য সারা দেশ জুড়ে ছিল অফিস, ওয়্যার-হাউস ইত্যাদি। সেগুলির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হল অচিরেই। প্রচুর অফিস কর্মীর চাকরি চলে গেল এক লহমায়। সেই বিলি ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখা হল জায়গায় জায়গায় ফি-বছর নবিকরণের সুযোগ দিয়ে। মোট ব্যবসার মাত্র সামান্য শতাংশ অর্থের বিনিময়ে কিছু CNF নাম্নী বড় আকারের ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে। এরা একসাথে কিছু কোম্পানির ওষুধ বিলি ব্যবস্থার দায়ভার নিল। বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে কিছু কর্মী নামমাত্র বেতনে এই কাজ বেছে নিতে বাধ্য হল; হারিয়ে গেল অসংখ্য স্থায়ী কর্মী।
কারখানা এবং অফিস থেকে স্থায়ী কর্মীদের প্রায় হঠিয়ে দিয়ে ওষুধ মালিকরা বিপণন কর্মীদের অসংগঠিত করার প্রয়াসে নামল। নানা অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে ৬০-এর দশকের শেষ থেকে ওষুধ শিল্পের বিপণন কর্মীরা বিভিন্ন কোম্পানিতে সংগঠিত হতে শুরু করে। তখন শ্রমিক হিসেবে কোনও আইনি অধিকার ছিল না বিপণন কর্মীদের। ১৯৭৬ সালে SPEA বা সেলস প্রমোশন এমপ্লয়ীজ (কন্ডিশনস অফ সার্ভিস) অ্যাক্ট আদায় হয়। বিপণন কর্মীদের আইনি নাম হল 'সেলস প্রমোশন এমপ্লয়িজ'। অর্থাৎ কোন কোম্পানির নিজস্ব ব্র্যান্ডের গুণাবলী দিয়ে কাস্টোমারদের, প্রধানত চিকিৎসকদের কাছ থেকে তাঁর রোগীর ব্যবহারের জন্য প্রেসক্রিপশন বা নিদান আদায় করা হল একজন 'SPE' বা 'সেলস প্রমোশন এমপ্লয়িজে'র মূল কাজ। আনুষঙ্গিক কাজ হিসাবে ওষুধের দোকানে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডটি স্টকিস্ট বা ডিস্ট্রিবিউটর মারফৎপাওয়ার ব্যবস্থা করা। ওষুধ বিক্রির পথটি সরাসরি নয় বলে এই সব কর্মীদের কাজ পরিমাণগত ভাবে মাপা খুবই দুষ্কর। কিন্তু এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কর্মীপ্রতি লাভটুকু বুঝে নিতে মালিককুল কোনও ফাঁক রাখতে রাজি নয়। সেকাজে নজরদারি ব্যবস্থাই এখন মালিকদের অন্যতম আয়ুধ।
নয়া উদারবাদী অর্থনীতির শুরুতেই ওষুধ ব্যবসায়ীরা সংগঠিত সেলসকর্মীদের দু’ভাবে আক্রমণ শুরু করে। প্রথমে অভ্যন্তরীণ সংহতিগুলি, বিশেষত যেখানে দরকষাকষির মঞ্চ রয়েছে সেগুলিকে ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টায় নামে। দ্বিতীয় পথটি হল, দুর্বল, দীর্ঘসূত্রি আইন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রতিবাদী কর্মীদের পাওনাগন্ডা থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত রাখা। অর্থাৎ 'ভাতে মারার' পরিকল্পনা; যাতে ঐ কর্মীদল প্রতিবাদের রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এদিকে এদেশে আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আইন লাগু, MRTP র অন্তর্জলি যাত্রা, FERA র FEMA হওয়া, DPCO র প্রায় হঠে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদির অনুকূল হাওয়ায় দেশি বিদেশি একচেটিয়া ওষুধ কোম্পানিগুলি এদেশে জেঁকে বসে। মূল লক্ষ্য, পেটেন্টকৃত ওষুধ, বিনিয়ন্ত্রিত একচেটিয়া দামে বিক্রি করে লাগামছাড়া মুনাফা কুড়ানো। সেই লক্ষ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে এরা নিত্যব্যবহার্য সাধারণ ওষুধগুলিকে নিয়ে যে সব ডিভিশন তৈরি করেছিল সেগুলি হয় অন্য প্রতিষ্ঠিত দেশি বিদেশি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেছে, না হয় ফ্রাঞ্চাইজির হাতে দিয়েছে। সেগুলির ভবিষ্যৎও অন্ধকারাচ্ছন্ন; উঠে গেছে অথবা পুনরায় হস্তান্তর ঘটেছে। বিদেশি বহুজাতিক PFIZER, NOVARTIS, SANOFI, GLAXO বা দেশি কোম্পানি DR REDDY'S, TORRENT, ZYDUS প্রভৃতি এ বিষয়ে খুবই দক্ষ! আর এই প্রক্রিয়ায় সর্বাগ্রে এবং সর্বতোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে সেলস প্রমোশন এমপ্লয়িজদের। অকালে চাকরি খুইয়েছে, সংসার প্রতিপালনের দুঃসাধ্য চেষ্টায়, কাউকে কাউকে, এমনকি অটো, ট্যাক্সি, ক্যাব চালকের অনভ্যস্ত অনিশ্চিত জীবনকেই আঁকড়ে ধরতে হয়েছে। দু-একটি নমুনা দেখা যাক। মোট বিক্রির বিচারে বিশ্বের সর্ব প্রথম কোম্পানি PFIZER। এদেশে মাঝেমধ্যেই এরা নৈতিকতার দোহাই পেরে কর্মী সাফাই অভিযানে নামে। অথচ কতবার কত দেশে কত অনৈতিক কারণে যে এই কোম্পানিকে জরিমানা দিতে হয়েছে তার শেষ নেই। এই তো সেদিন ফাইজার-বায়োএনটেক-এর করোনার ভ্যাকসিন যে অন্তত ২৪ গুণ দামে বিক্রি করেছে, সে রকমই ইঙ্গিত করেছে অক্সফাম। এদেশে কিছুদিন আগে 'আপ-লিফ্ট'এর ছদ্মবেশে প্রায় ৪৫০ কর্মী ছাঁটাই করেছিল। অতিমারি শুরুর ঠিক আগে ৪টি ডিভিশনের ১৩৫ জন কর্মীকে প্রথমে পদত্যাগ করতে বলে। এঁদের নাকি পুনর্মূল্যায়ন হবে, সেখানে বাছা হবে গুটি কয়েকজনকে! পুনর্মূল্যায়নের ফাঁদে কার্যত ছাঁটাই হতে হল শতাধিক সেলস কর্মীকে। অতি সম্প্রতি বিশাল সংখ্যক কর্মীকে তাড়িয়ে দিয়ে SEBI কে এই বহুজাতিক সাফাই দিয়েছে যে, অতিমারির মধ্যে চিকিৎসক বা অন্যান্য কাস্টমারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য অন-লাইন, অফ-লাইন এবং হাইব্রিড পথে তারা সাফল্য অর্জন করেছে। সুতরাং এত সেলসকর্মীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ স্বল্প সংখ্যক কর্মীই যথেষ্ট। কে জানে মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া নতুন শ্রম-আইন— 'নির্দিষ্ট সময়ের' জন্য 'কর্মী' নিয়োগকেই ভবিতব্য করতে চায় কিনা ফাইজার। উপরোল্লিখিত অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলিরও কর্মী ছাঁটাইয়ের ইতিহাস কম নয়। নোভার্টিস ক্যান্সারের ওষুধের (GLIVEC) একচেটিয়া বিক্রির অধিকার চেয়েছিল। বিভিন্ন আদালতে হারের পর দেশ ছাড়ার ও 'সফ্ট-টার্গেট' হিসাবে সেলসকর্মীদের ছাঁটাইয়ের হুমকি দিয়েছিল। সাম্প্রতিককালে একটি ডিভিশন বন্ধ করে প্রোডাক্টগুলির 'মার্কেটিং' ড: রেড্ডিজ—এর হাতে তুলে দেয়। এদের দুটি ফ্রাঞ্চাইজির কিছু প্রোডাক্টও ড: রেড্ডিজ কোম্পানিকে দেয়। ফলত প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে ৪১৯ জন এবং ফ্রাঞ্চাইজির বেশিরভাগ কর্মীই কর্মচ্যুত হন। আশ্চর্যের বিষয় এরা দেশের আইনকানুনকেও তোয়াক্কা করেনা। বিভিন্ন কোর্টে অন্তত বেশ কয়েকটি বিচারাধীন 'কেস' থাকলেও আইনি বাধ্যবাধকতাকে কোনওরকম পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। অতীতেও Glaxo র কাছে ডিভিশন হস্তান্তর করে ১৩৯ জনের চাকরি কার্যত উড়িয়ে দিয়েছিল। Sandoz ডিভিশন বন্ধ করে প্রোডাক্টগুলি Adcock, শেষে Torrent কে বেচে। আর ১৭৮ জনের চাকরির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। আশ্চর্যের বিষয় যে ভারতীয় কোম্পানি ডাঃ রেড্ডিজের ইতিহাসও অপরিষ্কার। আর এক ভারতীয় কোম্পানি Wockhardt এর কর্মীদের অবসরের বয়স ৬০ থেকে কমিয়ে ৫৮ করে দেয়। Torrent ও Elder -এর কিছু প্রোডাক্ট কেনে এবং সঙ্গে পছন্দ মতো কর্মী বাছাই করে নেয়!
Elder বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘকাল ধরে অসহায় কর্মীরা সরকারের বিভিন্ন দরজায় ন্যায্য বকেয়া আদায়ের জন্য ঘুরে ঘুরে মরছে। ভারতীয় বহুজাতিক Zydusও অতিমারির সুযোগে ডিভিশন বন্ধ করে কয়েক'শ কর্মীকে পথে বসিয়েছে। একদা দেশের এক নম্বর কোম্পানি Sarabhai থেকে খরিদ করা ভেটারিনারি ডিভিশনটি, কর্মীদের দাবি সনদ মীমাংসার প্রাক্কালে, দেশি– বিদেশি তিন ভেঞ্চার কোম্পানির দেশীয় উদ্যোগের কাছে বেচে দেয়। বহু টালবাহানা অন্তে দাবি সনদ মীমাংসা হয়েছে বটে, তবে তা অশুভ সঙ্কেতবাহী। অতিমারিতে Zydus দাঁত নখ বার করে, কোনও রকম আইনের তোয়াক্কা না করে পঞ্চাশের বেশি এ রাজ্যের কর্মীকে ছাঁটাই ও গণ বদলি করে। প্রতিবাদ স্বরূপ অন্যান্য কর্মীরা একদিন গণ-ছুটি নিলে সেই আইনের দোহাই দিয়ে ৮ দিনের মাইনে কেটে নেয়। এসবের প্রতিবাদ প্রতিরোধের আশার দীপ জ্বালিয়ে তুলেছেন আর এক দানব বহুজাতিক Sanofi র কতিপয় অকুতোভয় কর্মীরা। এঁরা দেশি কোম্পানি Universal কেনার কারণে এক দশক আগে সানোফির কর্মী হয়েছিলেন। লকডাউনের কঠিন সময়ে এঁদের ডিভিশন বন্ধ করে প্রোডাক্টগুলি আর কর্মীদের এক সদ্যোজাত কোম্পানির কাছে বেচে দেয় সানোফি। প্রায় ৩০০'র অধিক কর্মী অথৈ জলে পড়েন। সারা দেশের ষাটের অধিক কর্মী 'পণ্য' হিসাবে বিক্রি করার এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান; দেশের আইনের কাছে কর্মী বিক্রি করবার সব শর্ত জানবার অধিকার দাবি করে। কর্তৃপক্ষ এখনও নিশ্চুপ। আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে ঐ কর্মীরা সব ঝুঁকি নিয়ে লড়াই চালাচ্ছেন। স্প্যানিশ কোম্পানি Exeltis, ড্যানিশ কোম্পানি Lundbeck প্রত্যেকেই এই কঠিন অতিমারির সময়ে হয় কর্মীদের ন্যায্য দাবিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে না হয় বন্ধ করে কর্মচ্যুত করেছে।
অতিমারিতে ওষুধের বেশিরভাগ কোম্পানি মুনাফা করেছে বলে জানা গেলেও কত শত ছোট, আঞ্চলিক কোম্পানি যে বাজারের বকেয়া গুটিয়ে আনতে পারেনি বলে কর্মীদের বেতন থেকে শুরু করে সব পাওনা বন্ধ করেছিল, এমনকি ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কর্মীদের সেই ক্ষতির কোনও সুরাহা আজও হয়নি। অতিমারির সময় বৃহৎ কোম্পানিগুলি বিপণন কর্মীদের নিজস্ব মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। এই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' বস্তুটি ফিল্ডের কাজে অচল। বিশেষত সে সময় চিকিৎসকেরা বাস্তবিকই ব্যস্ত; অসুস্থ রোগী আর মৃতের মিছিল আটকাতে আক্ষরিকভাবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। শেষে কোম্পানিগুলি কর্মীদের, চিকিৎসকদের মোবাইলে কোম্পানির নির্ধারিত app নামিয়ে যোগাযোগ চালাতে ফরমান দেয়। এতে কাস্টমারদের প্রাইভেসি হরণের অভিযোগে বিপণন কর্মিরা অভিযুক্ত হবেন এই আশঙ্কায় প্রতিবাদ জানালে, কর্তৃপক্ষ নানা হুমকি দেয় এবং শেষে মাইনে কেটে রাখে।ফাইজারের অনলাইন, অফলাইন এবং হাইব্রিড কাজের গাউনা এবং কর্মী ছাঁটাই অপকর্মের এই হল পূর্বাতিহাস। অতিমারিতে 'সিম' ও 'জিপিএস' সম্বলিত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মীদের উপরেও নজরদারির ব্যবস্থা পোক্ত করতে চেয়েছে কর্তৃপক্ষ। আউটডোর কাজে এইভাবে নজরদারি ব্যবস্থা এবং সেই সূত্রে সমস্ত প্ৰকারের কাস্টমারদের উপর নজরদারির দায় কীভাবে কর্মীরা নেবেন তার কোনও সদুত্তর কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত দেয় নি। উপরন্তু বিভিন্ন app ভিত্তিক কাজের সুবাদে সবার ব্যক্তিগত 'ডাটা' কেন 'সার্ভিস প্রোভাইডারে'র হাতে পৌঁছাবার অসাংবিধানিক, অনৈতিক কাজে এই সব কর্মীরা লিপ্ত থাকবেন, তার কোন জবাব নেই। এক্ষেত্রে গায়ের জোরে কর্তৃপক্ষ যেটা পারে সেটাই করেথাকে, অর্থাৎ কর্মীদের ফিল্ড-কাজ দিনের পর দিন অস্বীকার করে হুমকি চালানো এবং শেষে মাস-মাইনে থেকে বঞ্চিত করার মতো বেআইনি কাজ করা। কেবল এই নয়, অতিমারিতে এ রাজ্যে যখন সরকার আংশিক লকডাউন চালাচ্ছে এবং অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রে সীমিত সংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিল, তখন কেন্দ্রীয় সরকারি ওষুধ কোম্পানি সহ বেশিরভাগ কোম্পানি কর্মীদের 'জরুরি পরিষেবা কর্মী' হিসাবে কাজে নামাতে চেয়েছিল। অথচ উৎপাদন, অফিস ও স্টকিস্ট/ডিস্ট্রিবিউটর ছাড়া কেউ এই 'জরুরি' তকমার আওতাধীন নয়। SPEA ও অন্যান্য আইনে বিপণন কর্মীদের কাজের ব্যাখ্যাও রয়েছে। তবে যে দেশে প্রতিবাদ করলে অপরাধী বানিয়ে ব্যক্তিবিশেষের বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার ৭৫ বছরের জন্য সরকারের কাছে রেখে দেওয়ার আইন অনুমোদন পেতে চলেছে, সেখান মালিক পক্ষও বোঝে যে তাদের বেআইনি কাজ-কারবার চালিয়ে যাওয়ার ছাড় কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করা যেতে পারে।
এর মধ্যেই শ্রম আইন গুলির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সেলসকর্মীদের SPE Act উবে গেছে। যে অধিকার পাওয়া গিয়েছিল এবং সাম্প্রতিককালে ওষুধ শিল্প ছাড়াও অন্যান্য দশটি শিল্পে যার বিস্তৃতি ঘটেছিল, তা রসাতলে পাঠানো হয়েছে। নিয়োগ পত্রে বেতনের বার্ষিক বৃদ্ধির উল্লেখ, বাৎসরিক ছুটির হিসাব দেওয়া, বাইরে বিশেষত হাসপাতাল ইত্যাদিতে কাজ করার কারণে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে 'কোয়ারনটাইন' ছুটির ব্যবস্থাসহ সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি বর্তমান আইন অনুযায়ী জমা ছুটির পরিমাণ অর্ধেক হবে এবং অবসরের সময় জমা ছুটি বাবদ পাওনার পরিমাণ তিন-চতুর্থাংশ কমে যাবে! বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে ত্রিপাক্ষিক কমিটি গঠিত হয়েছিল। মালিকদের এই অপরিমিত কাজের চাপে বিধ্বস্ত কর্মীদের দাবিতে 'ওয়ার্কিং রুলস' তৈরি করার কথা চলছিল সেখানে। ইউনিয়নগুলি খসড়া জমা করেছিল। কিছুদিন পর সরকার যে খসড়া প্রকাশ করে তা মালিকদের চাহিদার হুবহু প্রতিলিপি ছাড়া আর কিছু নয়। ইউনিয়নগুলির প্রতিবাদ লিপি জমা পড়েছে কিন্তু বিগত ৫ বছরের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক কমিটির মিটিং ডাকার ফুরসৎ পায়নি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক!
উপরে ওষুধ শিল্পের বা শিল্প শ্রমিকদের যে চেহারা উপস্থাপিত করার চেষ্টা হয়েছে তা খণ্ড চিত্র মাত্র। বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মালিকশ্রেণী আজ শতাধিক বর্ষ পুরনো (১৩৩ তম) মে-দিবসের আবহ ফিরিয়ে এনেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পূর্বে এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিক, বিশেষত বিক্রয় প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ভ্রাতৃপ্রতিম সংঠনগুলিকে একত্রিত করে শ্রমের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে কতখানি নামবেন তা আগামীদিনই বলবে। শেষ কয়েক বছরের প্রস্তুতি এবং সাম্প্রতিককালের দীর্ঘ আন্দোলনের সাফল্য সেই বার্তাই দিচ্ছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.