বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
ভাত দে হারামজাদা:
করোনা, লকডাউন, পরিযায়ী, আধিপত্যবাদ
দেবাশিস আইচ
ব্যান্ডেল: দ্য কাফে টেবল, ২০২২
“খাঁটি, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা”, সততা ও মানবিকতার প্রতিমূর্তি সাংবাদিক টিমোথি অলম্যান-এর অনুভবে, “কেবল ঘটনাগুলোকেই যথাযথভাবে তুলে ধরে না।” “এই সাংবাদিকতার কাজ হল, ঘটনাগুলোর প্রকৃত অর্থও তুলে ধরা। এই সাংবাদিকতা কেবল বর্তমানের জন্যই প্রচণ্ডরকমের প্রাসঙ্গিকই নয়, এটা সময়ের পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়। এটা কেবল ‘প্রামাণ্য সূত্রের’ ওপরেই নির্ভরশীল নয়, পাশাপাশি ইতিহাসকেও উন্মোচিত করে। এই সাংবাদিকতা দশ, কুড়ি, পঁচিশ বছর পরেও ঘটনাবলীর প্রকৃত ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিফলন ঘটায়।”অকৃত্রিম সাংবাদিকতা যখন অতীতের বস্তু হয়ে উঠছে, সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছে অসততার অনুশীলন ও নিরাশার উৎস, ঠিক সেই সময় হাতে আসে কিছু কিছু লেখা, যা আমাদের জানায় অলম্যান-এর কথাগুলো কেবল বলার জন্য বলা নয়, এগুলো চিরায়ত। এমনই কিছু সাংবাদিকতার সঙ্কলন দেবাশিস আইচ-এর ভাত দে হারামজাদা।
শিরোনামটির নির্বাচন সংকলনের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম থেকে, যেটি নেওয়া রফিক আজাদের বিখ্যাত একটি কবিতা থেকে। দেবাশিস তাঁর সংকলনের একটি উপশিরোনামও রেখেছেন: করোনা, লকডাউন, পরিযায়ী, আধিপত্যবাদ।” নাম এবং উপশিরোনাম থেকে স্পষ্ট, এখানে সমাহৃত প্রতিবেদনগুলি করোনা অতিমারি ও তাকে কেন্দ্র করে সরকারি নীতি এবং তার ফলাফল নিয়ে লেখা। কিন্তু এগুলো কেবল “বর্তমানের জন্যই প্রচণ্ডরকমের প্রাসঙ্গিকই নয়”, এই প্রতিবেদনগুলোর মূল্য দীর্ঘকালীন। আজ থেকে তিন-চার-পাঁচ দশক পরে, মানুষ যখন ভিন্ন বাস্তবতার সম্মুখীন, তার সেই বদলে যাওয়া লড়াইয়ের সময়েও এই লেখাগুলো তাকে মনে করিয়ে দেবে, কীভাবে অতিমারির মতো একটি আপাতদৃশ্যে প্রাকৃতিক ব্যাপার আসলে শ্রেণিশোষণেরই একটি রূপ হিসেবে উঠে আসে। সেদিনও এই লেখাগুলো মনে করিয়ে দেবে, কীভাবে একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়কে কাজে লাগিয়ে সমাজের কতিপয় ক্ষমতাধর আরো বেশি ব্যক্তি-সম্পত্তি ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে পারে, এবং তার জন্য ব্যাপক জনসমষ্টিকে নির্দ্বিধায় মৃত্যুর কিনারায় পৌঁছে দিতে পারে। এমনকি যদি বিরাট এক সামাজিক উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে মানুষ একদিকে অতিমারি ও অস্বাস্থ্য ও অন্যদিকে শ্রেণিশাসনের মতো ভয়াবহতা থেকে মুক্তি অর্জনও করে ফেলতে পারে, তবু আজকের দিনে তুলে ধরা বাস্তবতাগুলোর কথা সেই নতুন মানুষের কাছে সতর্কবাণীর কাজ করে যাবে। কারণ, এই লেখাগুলো অতিমারির কালে লেখা হলেও, এবং সেগুলোকে বিশেষ একটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে দেখা হলেও, কার্যত এগুলো যা বলে তা হল কতকগুলো সম্পর্কের কথা: মানুষের সঙ্গে মানুষের ও মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের কথা।
দেশের মানুষ ভুক্তভোগী। স্বাস্থ্যের সুরক্ষায়, রোগ প্রতিরোধ ও উপশমের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা বরাবরই কুৎসিত ও ঘৃণ্য। যখন অতিমারির উপদ্রবের খবর এল তহনও, সকলেই জানেন, আমাদের দেশের সরকার – এবং অন্যান্য অনেক দেশের সরকার – সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট অপরাপর সুরক্ষার কোনও উদ্যোগ করেনি। অথচ, হঠাৎ করে, কোনও আগাম বার্তা ছাড়াই, লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হল। কোটি কোটি মানুষ, বিশেষত দিন আনি দিন খাই গরিবেরা, আতান্তরে পড়লেন। আর সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হতে হল, গরিব মানুষদের সেই অংশটি, যাঁদের জীবিকার সন্ধানে বিভুঁইয়ে গিয়ে থাকতে হয়েছিল। খাবারের অভাব, চিকিৎসার অভাব, পরিজনের সঙ্গের অভাব তাঁদের পথে নামতে বাধ্য করে – একটা দেশের সরকার দেশের মানুষকে কোন অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলতে পারে, লোকস্মৃতি থেকে তাকে হারিয়ে যেতে না দেওয়াটা একটা কর্তব্য বিশেষ। যে কতিপয় সাংবাদিক এই কর্তব্যটি পালন করেছেন, সংসাধনের অভাবের মধ্যে, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তাঁদের দুর্গতির ছবিটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, দেবাশিস তাঁদের মধ্যে একজন।
কেবল লকডাউনের আঘাতই নয়, একই সঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ সরকারি নীতি দেশের মানুষকে নির্মম থেকে নির্মমতর বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কাজ নেই, খাবার নেই, তার মধ্যে নেই স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা। দু মুঠো ভাতের জন্য মানুষের মধ্যে হাহাকার। হাসপাতালে রোগীদের চিৎকার। জীবন সংশয় অবস্থাতেও আসন্নপ্রসবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। গরিবদের সঙ্গে সঙ্গে নিম্ন মধ্যবিত্তদের মুখোমুখি হতে হল চরম বিপদের। খাদ্যাভাব ও অপুষ্টির সঙ্গে সরকারি কুনীতি যোগ করল শিক্ষাগত বঞ্চনা। দীর্ঘকাল স্কুল বন্ধ থাকল, অকারণে, অথচ বিকল্প কোনও ব্যবস্থাও হল না। এমনকি বাচ্চাদের পুষ্টির ব্যবস্থাও তুলে দেওয়া হল। বন্ধ থাকল টীকাকরণের মতো জরুরি কর্মসূচি। এমন ভাব দেখানো হল যেন অতিমারিটাই একমাত্র বাস্তবতা। আর এরই সুযোগ নিয়ে ধনী তার সম্পত্তি বাড়িয়ে তুলল বহুগুণ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মানব সক্ষমতার একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আগে থেকেই বাজারের হাতে ছেড়ে রাখা হয়েছিল। অতিমারির সুযোগে সেই বাজারের যেটুকুও বা পুঁজিপতিদের অধরা ছিল তা পুরো হল। সঙ্গে সঙ্গে শাসকেরা তাদের আধিপত্য আরো ভয়ঙ্কর করে তুলল, ছদ্ম দেশপ্রেম ও উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মান্ধতার শিকড় সমাজের গভীরে ছড়িয়ে দিয়ে। এ-সব কথা ভুলে যাওয়াটা অপরাধ। আর সেই অপরাধ থেকে আমাদের কিছুটা মুক্তি দিচ্ছে, ভাত দে হারামজাদা।
চারটি পর্বে ভাগ করা, একত্রিশটি প্রতিবেদনের এই সংকলন নির্মাণে দেবাশিস আইচ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শনকে মিলিয়েছেন অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে। সাংবাদিকতা কেবল নিজের চোখে দেখা নয়। সাংবাদিকতা হচ্ছে একটা বাস্তবতাকে যথাসম্ভব সর্বাঙ্গীণ রূপে দেখে। সেটা করতে গিয়ে দেবাশিসকে যেমন ঘুরে বেড়াতে হয়েছে পুরুলিয়ার শবরটোলা থেকে নিয়ে চব্বিশপরগণার মজুরদের কুটিরে কুটিরে তেমনি সংগ্রহ করতে হয়েছে দেশের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া অমানুষিকতার পাশাপাশি মানুষের এবং মানবিকতার বেঁচে থাকার সংগ্রামের খবর। নিজের চোখে দেখা ঘটনাগুলোকে তিনি পরীক্ষা করেছেন বিস্তৃত তথ্যের ছাঁকনি দিয়ে, আর বৃহত্তর পরিসরের তথ্যভাণ্ডারের ওপর আলো ফেলবার জন্য ব্যবহার করেছেন নিজের অভিজ্ঞতাকে। এটা সহজ কাজ নয়। এর জন্য চাই এমন এক শিক্ষা যা গড়ে ওঠে, একদিকে দেশ ও কালের গণ্ডী পেরিয়ে এবং অন্যদিকে কাল ও সমগ্র মানবপ্রজাতির সংযুক্তির দর্শন থেকে। বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা - এই দুই দিক দিয়েই দেবাশীষের প্রতিবেদন এই দর্শনের উপলব্ধি ঘটায়। সে-কারণেই তাঁর সঙ্কলন উৎসর্গীকৃত হয় সেইসব চেনা-অচেনা মানুষদের প্রতি যাঁরা মানুষের চরম দুর্ভোগের কালে তার পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার গান গাইছেন, আবার তাঁর লেখার এপিগ্রাফ হিসেবে একই সঙ্গে উদ্ধৃত হয় অমর্ত্য সেন-এর লেখা ও কোনও এক পরিযায়ী শ্রমিকের হাহাকার।
সারা পৃথিবী জুড়েই ক্ষমতার বীভৎস দাপট। সংবাদমাধ্যমও একচেটিয়া ক্ষমতার কুক্ষিগত। চতুর্থ স্তম্ভটিও ক্ষমতার দখলে। সাংবাদিক ইগনাশিও রোমানেট এমনই একটা অবস্থার কথা ভেবে পঞ্চম স্তম্ভের কথা বলেছিলেন, যে স্তম্ভ ক্ষমতার জোটকে চ্যালেঞ্জ করবে। গড়ে তুলবে এক মানবিক জোট। ভাত দে হারামজাদা সেই পঞ্চম স্তম্ভের এক অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ – বর্তমানের ছবি ও ভবিষ্যতের দলিল।