বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ইতিহাসের শক্তি সরকারের ভক্তি!

ইতিহাসের শক্তি সরকারের ভক্তি!

শান্তনু চক্রবর্তী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— ব্যাপারটা হয়ত কাকতালীয়! কিংবা পুরোদস্তুর কাকতালীয়ও হয়ত নয়। কারণ মোদি–শাহি জমানায় সরকারি কোনও তালই স্রেফ আমলাতান্ত্রিক কাকের ঠোক্করে প্রচারের ডাল থেকে আমজনতার উঠোনে দুমদাম এমনি পড়ে না! ফলে এই যে এক সকালেই দু’ দুটো হেডলাইন টেলিভিশনের পর্দায় ধামাকাদার ‘ব্রেকিং’ হয়ে ফাটল, সেটাও হয়তো একটা মতলবি সুতোয় বাঁধাই ছিল। তাই পঞ্চাশ বছর পরে যে দিন ইন্ডিয়া গেটে ইন্দিরা গান্ধীর জ্বালানো অমর জওয়ান জ্যোতি নিভিয়ে, সেই স্মৃতি–আগুনের একখানি শিখা মশালে করে চারশো মিটার বয়ে নিয়ে গিয়ে নরেন্দ্র মোদির বানানো জাতীয় যুদ্ধ স্মারকের আরও উজ্জ্বল–দাউদাউ, আরও গরম দেশপ্রেমিক জ্যোতিপুঞ্জে বা অগ্নিকুণ্ডে মিশিয়ে দেওয়া হল, সেদিনই প্রধানমন্ত্রীজির টুইটার হ্যান্ডেলে আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল। ১৯৭১–এ বাংলাদেশের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ জওয়ানদের স্মৃতি মুছে দেওয়া নিয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই মোদিজি জানালেন, ওই ইন্ডিয়া গেটেই বসছে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের গ্রানাইট পাথরের আঠাশ ফুট উঁচু মূর্তি। তবে শিল্পীর ঘরে সবে তো অর্ডার গেছে, তাই যদ্দিন মূর্তি প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে খালি বেদিতে লেজার – খেলায় দাঁড়িয়ে থাকবেন হলোগ্রাম নেতাজি। অশরীরি, ভার্চুয়াল! থেকেও নেই বা নেই হয়েও আছেন!
কে বলে মোদিজির ইতিহাসবোধ নেই! গড়পরতা রাজনীতিবিদদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আছে বলেই তো তিনি এই প্রতীকি খেলাটা খেলতে পারলেন! এক প্রতীকি–ঢিলে রাজনীতি আর ইতিহাসের দু’ দুটো পাখিও মারলেন!তিনি ভালই জানেন, গত ৭৭ বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে সুভাষচন্দ্রের শরীরী উপস্থিতি না থকালেও তিনি প্রবলভাবেই থেকেছেন। স্বাধীনতার আগেই ১৯৪৫–৪৬–এ আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানিদের বিচার পর্বেই দেশজুড়ে আম জনতার যে মন–মর্জি–মেজাজের হদিশ মিলেছিল, তাতেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক বুঝে যায় এবার পাকাপাকি ভারত ছাড়ার সময় এসে গেছে। সেটাও নেতাজি–ক্যারিশমা, তাঁর দেশপ্রেম–সাহস–বীরত্ব–কুরবানির জন্যই। প্রায় গণবদ্রোহের সেই বারুদভরা সময়েও আজকের বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের পূর্বজরা অবশ্য মোটের ওপর সাম্রাজ্যে অনুগতই ছিলেন। তারপর–দেশভাগ, র‌্যাডক্লিফের সীমান্ত–কাঁটাতার পেরিয়ে যে খণ্ডিত স্বাধীনতা এল, সেখানে সুভাষচন্দ্র হয়ে উঠলেন এক অসমাপ্ত বিপ্লবী–পুরাণকথার নায়ক— মিথিক্যাল হিরো! সে ন্যরেটিভ–এর একদিকে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র, তার অজস্র অপূর্ণতা, স্বপ্নভঙ্গ, বেদনা, বঞ্চনা, অপমান, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের অসংখ্য অসুখ–বিসুখ, হত, স্থবিরতা, জটিলতা— আর অন্যদিকে অশ্বারোহী এক পবিত্র আগ্নেয় স্বপ্ন–পুরুষ তাঁর পরনে সামরিক উর্দি, কোমরে তলোয়ার! বিষ্ণু দের পদ্যের ভাষায় ‘শ্যামবাজারের মোড়ে/ টগবগে এক ঘোড়া/ মস্ত আকাশ জোড়া/ তার পিঠেতে ঠাকুর বসে/ ফুলের মালায় মোড়া’।
আম ভারতীয় জনতার এই স্বপ্নের নেতাজি মূর্তিটাই নরেন্দ্র মোদির চাই। এই শুদ্ধ, নিষ্কলঙ্ক দেশপ্রেমিক অবতার — মানুষের হৃদয়ের স্টুডিওয় আবেগের গ্রানাইটে যার নির্মাণ। স্বাধীনতার কোনও কলুশ যাঁকে ছুঁতে পারেনি— সংসদীয় গণতন্ত্র, ভোটের রাজনীতি, উন্নয়নের দুর্নীতি, রাজনীতির মাফিয়াকরণ, কিচ্ছু না! এই নেতাজিকে ঘিরে একদিকে, ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নেই’ গোছের দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার— অন্যদিকে, সুভাষচন্দ্র থাকলে ভারতবর্ষ কী হতে পারত, সেই কল্প–সম্ভাবনাগুলির জাল বোনা। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, ‘সুভাষ হয়ে উঠেছেন আধুনিক ভারতের বিকল্প সম্ভাবনাগুলির প্রতীক। আর স্বাধীনতার যা কিছু গলদ, অনাচার তার দায় তাঁর শত্রুশিবিরের’ (পড়ুন নেহেরু ও জাতীয় কংগ্রেসের)! জনতার স্মৃতি–সত্ত্বা–স্বপ্নের এই নেতাজিকেই তো ইন্ডিয়া গেটে গ্রানাইটে গেঁথে রাখতে চান মোদি। তাহলেই নেতাজিকে নিয়ে সেই ১৯৩৮–৩৯ থেকে কংগ্রেসের যে অস্বস্তির উত্তরাধিকার আছে, তার নাকের ডগায় এবং তারই পাল্টা হিসেবে নেতাজি–ঐতিহ্য বা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ‘নেতাজি কাল্ট’–এর ওপর মোদি, বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের একচেটিয়া দখল, অধিকার এবং প্রভুত্ব কায়েম হবে। এমনকি নেতাজি এখন যেমন আছেন, আগামী ২০২৪ সাল অবধিও যদি সেভাবেই ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক আলোকপুঞ্জ হয়েই থেকে যান, তাতেও নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশ্য পূরণে কোনও অসুবিধে হবে না। কারণ ও ‘ভার্চুয়াল’ নেতাজিও যে শক্তিছ্বটা ছড়াবেন, তার পাশে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী তথা ইন্দিরা গান্ধী অবদানের অমরজ্যোতি নিভিয়ে দেওয়ার ঝুঁকিও নেওয়া যায়।
আসলে স্বাধীনতার এই ৭০ বছরে সরকারি খরচে যে অমৃত মহোৎসব–এর ডাক দেওয়া হয়েছে, মোদি সরকার সেটাকে একটা ইতিহাস যুদ্ধ করে তুলতে চাইছে। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসটাকেই খোলনলচে শুদ্ধ বদলে ফেলতে চাইছে। খুব স্বাভাবিক। যে ইতিহাসে তাদের কোনও মতাদর্শগত ভূমিকা নেই, তাদের নিজেদের কোনও আইকন বা নায়ক নেই, তাদের পরিবারের কেউ যে সংগ্রামের পাঁচশো কিলোমিটারের মধ্যেও কোনওদিন আসেননি, সেই ইতিহাসকে না পালটে উপায় কী?তাদের সেই কর্মসূচিতে প্রথমেই স্বাধীনতা সংগ্রামের চরিত্রটাই পাল্টে ফেলা হচ্ছে! সেটা শুধু দু’শ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই থাকছে না। পিছিয়ে চলে যাচ্ছে দশম শতাব্দীতে। এখানে বিদেশি হানাদার মহম্মদ ঘোরির মোকাবিলা করছেন স্বদেশীযোদ্ধা পৃথ্বীরাজ চৌহান। আরএসএস তো বরাবরই স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে হাজার বছরের পুরনো বলে মনে করে। মোদি সরকারও সেই লাইনেই পৃত্থিরাজ, রাণা প্রতাপ, ছত্রপতি শিবাজি বা উত্তরপ্রদেশের কোনও কিংবদন্তীর রাজা সুহেলদেব, সবাইকেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে চালাতে চায়। সেদিন কলকাতার এক টিভি চ্যানেলে বিজেপি–র এক বাঙালি নেতা তো দেখলাম আলগোছে ‘বারো ভুঁইঞা’র একজন প্রতাপাদিত্য রায়ের নামটা ভাসিয়ে দিয়ে ‘স্বাধীনতা যোদ্ধা’দের ‘সংশোধিত তালিকা’য় বাংলার সম্ভাব্য দাবিটাও বোধহয় জানিয়ে রাখলেন।
আসলে ফর্মূলাটা তো খুব সোজা। গজনির সুলতান মামুদ থেকে শুরু করে দিল্লির বাদশা ঔরঙ্গজেব, এঁরা সব্বাই ‘বিদেশ’ থেকে এসেছেন, বিদেশে তৈরি ধর্মে বিশ্বাস রেখেছেন। ‘হিন্দুস্থান’-এর মাটি দখল ও অপবিত্র করেছেন। এই অনুপ্রবেশকারী দখলদারদের বিরুদ্ধে এই ভারতের ভূমিপুত্র যে সব বীরপুরুষ হিন্দু সন্তানরা অস্ত্র ধরেছেন, সঙ্ঘ–ইতিহাস তাদের সবাইকেই স্বাধীনতা সংগ্রামীর মর্যাদা দিতে চায়। তবে বহিরাগত বাবরের কামান–বন্দুকের বিরুদ্ধে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন যে ইব্রাহিম লোদি, দিল্লির সুলতানতের সেই শেষ প্রতিনিধিকেও ‘স্বাধীনতার শহিদ’ বলা যায় কিনা, এ ব্যাপারে সঙ্ঘি ইডিয়লগদের কোনও লেখাঝোখা এই প্রতিবেদকের চোখে পড়েনি। আসলে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’কে হাজার বছর পিছতে গেলে এমন আরও অনেক সমস্যা হতে পারে। কারণ মধ্যযুগের ভারতে অনেক যুদ্ধই হয়েছে এক মুসলিম শাসকের সঙ্গে অন্য মুসলিম শাসকের। এক হিন্দু রাজার সঙ্গে অন্য হিন্দু রাজার। তাছাড়া মুঘল বাদশা আকবর, শাহজাহান বা আওরঙ্গজেব ভারতের মাটিতেই জন্মেছেন, এদেশেরই বিভিন্ন শহরে তাঁরা সমাধিস্থ হয়েছেন। ভারতবর্ষে তাঁরা কোনও উপনিবেশ গড়েননি। এদেশের সম্পদ লুট করে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে নিজেদের পিতৃভূমিতে পাচার করেননি। যে হিন্দু শাসকদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হযেছে, তারাও যে যার নিজের রাজপাট, জায়গীর বাঁচাতেই লড়েছেন। তামাম হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা রক্ষার কোনও পবিত্র দায় তাঁদের ছিল না— কারণ আজকের মতো কোনও ভারতীয় নেশন–রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠাটাই তখন সম্ভব ছিল না। ফলে ঐক্য–সংহতির কোনও জায়গা ছিল না। এমনকি সঙ্ঘের স্বপ্নের হিন্দু ঐক্যও নয়!
আকবর যখন রাণাপ্রতাপের মেবার আক্রমণ করছেন, তখন অধিকাংশ রাজপুত রাজারাই তাঁর পক্ষে, মেবারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। সমস্যা আরও আছে। হিন্দু বিদ্বেষী আওরঙ্গজেব কাশী–মথুরায় মন্দির ধ্বংস করছেন, এই হিন্দুত্ববাদী প্রচারের পাশেই তো থেকে গেছে গাদা–গুচ্ছের ফরমান–পরওয়ানা— যেখানে দেখা যাচ্ছে হিন্দু মন্দির নির্মাণ, সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের খরচ চালানোর জন্যই তিনি প্রচুর জমি–জায়গির দানও করছেন। তাহলে কি আওরঙ্গজেবের আমলে হিন্দু-শিখদের ওপর অত্যাচার হয়নি? নিশ্চয় হয়েছে। কিন্তু সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চেয়েও রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সামরিক প্রয়োজনটাই মূল বিবেচ্য থেকেছে। এটা আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, সাধারণ ইতিহাসের বইতে তাঁর প্রতিস্পর্ধী হিন্দু মারাঠা ‘কুলমান তিলক’হিসেবে যাঁকে তুলে ধরা হয়, সেই শিবাজি মহারাজের ক্ষেত্রেও তেমনই একইরকম সত্যি।
শিবাজি কেন মুসলিম নগর– কেল্লা-মহল্লা ফতেহ্ করেও বিজিত বা বন্দিনী মুসলিম পুরনারীদের তাঁর সৈন্য বাহিনী দিয়ে গণধর্ষণ করানোর আদেশ দেননি, সেজন্য হিন্দুত্ববাদের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা দামোদর বিনায়ক সাভারকার আক্ষেপ করেছেন। কিন্তু ওটা শিবাজির রাজনৈতির স্ট্র্যাটেজির মধ্যেই ছিল। যেমন তাঁর মারাঠা বাহিনীকে হিন্দু এলাকাতে কর আদায়ে তিনি প্রয়োজনীয় বল প্রয়োগে ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন। আসলে ইতিহাস তো হিন্দুত্ববাদের নিয়মে নয়, চলে সত্য আর তথ্যের পথে। তাকে জোর করে সে রাস্তায় চালাতে গেলেই মুশকিল। তখন হলদিঘাট বা হলদি ঘাটির যুদ্ধে রাণাপ্রতাপকে জিতিয়ে দিতে হয়। নইলে নাকি রাজপুত জনপ্রিয় বিশ্বাসে আঘাত লাগে!প্রায় সাড়ে চারশ বছর ধরে রাজপুত লোকবিশ্বাস নিশ্চিন্তে জানল হলদিঘাটির যুদ্ধে রাণাপ্রতাপ পরাজিত হয়েছিলেন বা রণকৌশলমাফিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সাময়িক পালিয়েছিলেন। কোথাও বিশ্বাস বা রাজপুত বীরগরিমার কোনও সমস্যা হল না। ২০১৪এ মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই কেন টনক নড়ল, সে সব কথা না তোলাই ভাল।
এখন আরএসএস–এর নিজেদের স্কুলে নিজেদের পাঠ্য বইয়ে এ সমস্ত ‘ইতিহাস’ পড়ানো বা ছাপানো যেতে পারে। তাকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক, পেশাদার ঐতিহাসিকদের তরফে উদ্যোগ এখনও খুবই সীমিত। কিন্তু একই কাজ যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুরু হয়? তখন তো ঠেকানোর কোনও জায়গাই থাকবে না। আর অমৃত মহোৎসব-এর নামে ইতিহাস ফিরে লেখার সেই আয়োজনই করা হয়েছে সরকারের তরফে। তারই একটা হাতে গরম নমুনা পাওয়া গেল প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর পাক্ষিক পত্রিকা নিউ ইন্ডিয়া সমাচার-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীনে একটি বিভাগ থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় লেখা হচ্ছে: ‘স্বাধীনতা আন্দোলন শুধু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার আগেও ভারত দাসত্বের মধ্যে দিয়ে গেছে।’মানে সেই আক্রমণকারী বহিরাগত মুসলিম বনাম দেশভক্ত ‘স্বদেশী’ হিন্দুদের দ্বন্দ্বের তত্ত্ব। কিন্তু সরকরি পরাধীনতার ইতিহাসে তো ব্রিটিশ শাসনের দু’শ বছরকেও বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। তার কী হবে? এখানে সরকারের তরফে নেওয়া হয়েছে এক নতুন কৌশল। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিন্দুত্ববাদী নেতাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নাই বা থাকল। তার হিন্দুকরণ তো করা যায়!
‘নতুন ভারতের অমৃত যাত্রা’ নামে ওই প্রবন্ধে তাই দুর্দান্ত অভিনব একটি তত্ত্ব আনা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে:ভক্তি আন্দোলনই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ভক্তি আন্দোলনের পূরোধা চৈতন্য মহাপ্রভু, স্বামী বিবেকানন্দ, রমন মহর্ষী দেশ জুড়ে আধ্যাত্মিক জাগরণের কথা ভেবেছিলেন। সেই জাগরণই ১৮৫৭–র মহাবিদ্রোহের প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছিল। ইতিহাস গুলিয়ে, ঘেঁটে দেওয়ার এমন প্রয়াস বোধহ হয় আরএসএস–এর শাখাগুলোয় বা প্রাথমিক স্কুলগুলোতেও দেখা যায় না। ১৫–১৬ শতকের ভক্তি আন্দোলন, বাংলায় যার নেতা ছিলেন চৈতন্যদেব, অসমে শঙ্করদেব, পাঞ্জাবে গুরু নানক, উত্তরভারতে সন্ত কবীর–দাদু, পশ্চিমভারতে সন্ত তুকারাম এবং আরও অনেকেই— সে আন্দোলন তো জাতপাতে দীর্ণ হিন্দু সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিরুদ্ধে, মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেই সামাজিক আন্দোলন হিন্দু ধর্মের ভীত কাঁপিয়েছিল, শিখ মতবাদের মতো নতুন ধর্মবিশ্বাসেরও জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তার কী ভূমিকা?
১৮৫৭–য় কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ভারতীয় সৈন্যরাই বা ভক্তি আন্দোলন থেকে কী প্রেরণা পেলেন? তার ওপরে কলকাতার বিবেকানন্দ (জন্ম ১৮৬৩) ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির রমন মহর্ষী (জন্ম ১৮৭৯) বা কিভাবে চৈতন্যদেবের সমসাময়িক হলেন আর সিপাহী বিদ্রোহে অনু্প্রেরণা দিলেন? যদি ধরে নিই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দর হিন্দু হিন্দু পুনরুত্থানবাদের সঙ্গে ভক্তিবাদকে এখানে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, তাহলেই বা সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে তার যোগসূত্র সরকারি কাগজে ঘটা করে ছাপা হল কী করে?
১৮৫৭–র মহাবিদ্রোহর পেছনে অনেক প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ ছিল। বাহিনীর ব্রিটিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে নিচু তলার সাধারণ বারতীয় সেনাদের অনেক ক্ষোভ ছিল। তাছাড়া এই সেনাদের অধিকাংশই এসেছিলেন মধ্য ও উত্তরভারতের কৃষক পরিবার থেকে। সেখানকার মহালওয়াড়ি কৃষি–রাজস্ব ব্যবস্থায় বিপুল খাজনার চাপে কৃষক-জমিদার দু’ তরফেরই নাভিশ্বাস উঠেছিল। ব্রিটিশের ধনতান্ত্রিক ‘মুক্ত বাণিজ্যের নীতি’ তাঁত শিল্পী সহ যে বহু ভারতীয় কুটির শিল্পী শ্রমিক–কারিগরদের রুজিরুটি কেড়েছিল, তারাও অনেকে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। তাছাড়া গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির দেশীয় রাজ্য দখলের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী ক্ষিদে নবাব–রাজা–সামন্ত প্রভুদের একই সঙ্গে বিপন্ন ও মরিয়া করেছিল। নিজেদের রাজ্য বাঁচাতেই তাঁরা বিদ্রোহী সিপাহীদের পাশে এসে দাঁড়িযেছিলেন। আধুনিক যুদ্ধ ও সামরিক সংগঠনের হাল হকিকত জানা প্রশিক্ষিত বিদ্রোহী সৈন্যরা এই অভিজাত শ্রেণীর নেতৃত্বের ওপর বিশেষ কিছু নির্ভরশীল ছিলেন না।
এভাবেই বিভিন্ন শ্রেণী ও স্বার্থগোষ্ঠীর মানুষ, নানা ক্ষোভ–বঞ্চনা–বিপন্নতা থেকে এক জায়গায় এসেছিলেন। দেশজুড়ে গণ–অভ্যুত্থানের চেহারা না নিলেও এই বিদ্রোহে হিন্দু–মুসলিম ঐক্য একটা জরুরি ভূমিকা নিয়েছিল। বিধর্মী বিদেশি ইংরেজ শ্বেতাঙ্গ জাতি গরিমার ঔদ্ধত্বে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানের ধর্ম ও ইমানের অমর্যাদা করছে, এই ধারণাটা ক্রমেই প্রবল হচ্ছিল। এনফিল্ড রাইফেলের চর্বি মেশনো কার্তুজ–বিতর্ক সেই ক্রোধের বারুদে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছিল। কোনও পরিস্থিতিতেই বিদ্রোহীরা এই সাম্প্রদায়িক সংহতিকে ক্ষুন্ন হতে দেননি। দিল্লি নগরি প্রায় চারমাস তাদের দখলে ছিল। অনভিজ্ঞ প্রায় অশিক্ষিত বিদ্রোহী সিপাহীরা তাঁদের ‘ধর্মনিরেপেক্ষ’ সংবিধান তৈরি করেছিলেন। দিল্লির বিখ্যাত উর্দু খবরের কাগজে হিন্দু ও মুসলিম বিদ্রোহীদের ‘‌হোস্‌লা’‌ বা ‘উদ্দীপনা’ বজায় রাখার জন্য আবেদন প্রকাশিত হয়। সে জন্য বিদ্রোহী সিপাহীদের ভক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা দরকার পড়েনি। যে যার নিজেদের ঐশ্বরে বিশ্বাস রেখেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। বিদ্রোহের সুবর্ণ জয়ন্তী বছরে (১৯০৭) সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম পূর্বপুরুষ হিন্দুত্ববাদী দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকর এই মহাবিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলেছেন। কিন্তু কোনও ভক্তি বা আধ্যাত্মবাদী তত্ত্ব আওড়াননি! বা তার দরকার পড়েনি।
তাহলে তাঁর উত্তরসুরী নরেন্দ্র দামোদর মোদির কেন স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের গায়ে ভক্তি, আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের চাদর চড়ানোর দরকার পড়ছে?পড়ছে, কারণ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে যতো বেশি অতিন্দ্রিয়বাদী আধ্যাত্মিকতার দৈবি বা আধা দৈবিক মাহাত্মে ছেয়ে ফেলা যাবে, সেই ইতিহাস আলোচনা থেকে ততই সাম্রাজ্য, উপনিবেশ, জাতীয়তাবাদ, স্বরাজ, সাম্য, গণতন্ত্র, সমাজবাদ, নারী–শ্রমিক–কৃষক–নিম্নবর্গের ভূমিকা, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গকে দূরে ঠেলা যাবে। আর সেটা যত সফলভাবে করা যাবে ততই স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘ পরিবারের অনুপস্থিতি নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোও এড়ানো যাবে।
এ ব্যাপারে স্বয়ং মোদিই ‘মার্গ দর্শক’–এর ভূমিকা নিয়ে নিয়েছেন। গত বছর মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডিযাত্রার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন: ‘দেশের সন্ত, মহান্ত, আচার্যরাই স্বাধীনতা আন্দোলনের শিখা জ্বালিয়ে রাখার কাজটি করেছেন। সেদিক থেকে ভক্তি আন্দোলনই গোটা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত তৈরি করেছিল। ’আর কী চাই, প্রধানমন্ত্রীই যখন এভাবে ইতিহাস বৃক্ষের গোড়া কাটতে লেগে গেছেন, তখন তার সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের পত্রিকায় তো লেখা হতেই পারে ‘এখন অমৃতকালে দেশে আবার আধ্যাত্মিক জাগরণ হচ্ছে। এই আধ্যাত্মিক জাগরণই ভারতের পুনর্নিমাণের ভিত হিসেবে কাজ করবে।
ভারতের পুনর্নিমাণ মানে ভারত ইতিহাসেরও নির্মাণেরও পুনর্নিমাণ— বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনাতেই তো সে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু অখ্যাত ব্যক্তিত্ব বা গোষ্ঠীকে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’এ সংযুক্ত করা হচ্ছে। আইসিএইচার ইতিমধ্যেই ১৪৬টা নামের তালিকাও তৈরি করে ফেলেছে। জনশ্রুতি, লোকগাঁথা, প্রবাদ কাহিনীর নায়করাও সেখানে বাদ যাবেন না। পোস্ট–স্ট্রাকচারালিস্টরা তো কবেই বলে দিয়েছেন তথাকথিত সাক্ষ্য–প্রমাণ নির্ভর ‘বৈজ্ঞানিক ইতিহাস’নির্মাণের কোনও মানেই হয় না। বাস্তব ঘটনা নয়, অতীতকে খুঁজতে হবে স্মৃতি ও কল্পনার ভাঁজে ভাঁজে। মোদি সরকার সেখানে ভক্তিবাদ আমদানি করছেন। সেই নির্মাণের প্রক্রিয়ায় হয়তো হিন্দুত্ববাদের অগ্রপথিকরাও কোনওদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশেষ যোদ্ধা হিসেবে ইতিহাসে ঢুকে পড়তে পারেন। গান্ধীর হত্যাকারীকে সন্ত–শহীদ বানানোর চেষ্টা শুরু তো হয়েই গেছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কও জনপ্রিয় বিশ্বাসে গুমনামি বাবা হয়ে বাঁচলে সঙ্ঘ পরিবারের কোনও মতাদর্শগত অসুবিধে নেই। হীরক রাজার জবানিতে বলা যায়— লাভ আছে বরং ক্ষতি নাই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.