বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা ১ জানুয়ারি, ২০২২— ইউনাইটেড ফোরাম অফ ব্যাঙ্ক ইউনিয়নস (ইউএফবিইউ) এর ডাকে ১৬-১৭ ডিসেম্বর এ বছর দ্বিতীয়বার দুদিনের দেশব্যাপী ধর্মঘটে সামিল হলেন ব্যাঙ্কশিল্পের আধিকারিক ও কর্মচারীরা। এর আগে মার্চ মাসের ১৫-১৬ তারিখ ইউএফবিইউ এর ডাকে ব্যাঙ্কশিল্পে ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। গত ১ ফেব্রুয়ারি সংসদে পেশ হওয়া কেন্দ্রীয় বাজেটে দুটি ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল এই ধর্মঘট।
বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে সংযুক্তিকরণ
২০১৪ সালের মে মাসে যখন বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয় তখন আমাদের দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা ছিল ২৬টি। সংযুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমে হয়েছে ১২টি। ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে এক ফতোয়ার মধ্য দিয়ে ১০টি ব্যাঙ্ককে কমিয়ে করা হয়েছে ৪টি ব্যাঙ্ক। এই ফতোয়ায় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর অবলুপ্ত হয়েছে। একটি স্থানান্তরিত হয়েছে দিল্লিতে, অপরটি চেন্নাইতে। প্রথমটি ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, অপরটি এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক। ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক পরিচিত ছিল এই রাজ্যের ব্যাঙ্ক হিসেবে, এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন ব্যাঙ্ক। সংযুক্তিকরণের ফলে এই দুটি ব্যাঙ্কের অবলুপ্তি এবং ফলস্বরূপ দুটি ব্যাঙ্কের হেড অফিস এই রাজ্য থেকে স্থানান্তরিত হওয়া নিয়ে এখানকার রাজ্য সরকার কোনও উচ্চবাচ্য করে নি। সংযুক্তিকরণের পরিণতিতে এখন চলছে ব্যাপক সংখ্যায় শাখা বন্ধ করা এবং কর্মী সংকোচন। দেশে বেকারের সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি যখন রেকর্ড পরিমাণ তখন ব্যাঙ্কশিল্পে চলছে ঢালাও পদের অবলুপ্তি। এ সবই চলছে বেসরকারিকরণের লক্ষ্য পূরণ করার জন্য। জনবিরোধী এই সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালের প্রথম নরসিমহম কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে। সুপারিশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে আনা। ১৯৯১ সালের সেই সুপারিশ এখন কার্যকারী করতে বর্তমান বিজেপি-এনডিএ সরকার বেপরোয়া।
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সুফল
স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্যে দেশের অর্থ ব্যবস্থার পরিকল্পিত বিকাশের স্বার্থে ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের দাবি উত্থাপন করেছিল। দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার মধ্যে তখন বিরাজমান ছিল এক অস্থিরতা। ‘ব্যাঙ্ক ফেল’ জনমনে কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে বিবেচিত হতো না। ১৫ আগষ্ট ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯ জুলাই ১৯৬৯ এর আগে পর্যন্ত ৬৫০টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ‘ফেল’ করে। এই ধারার গুণগত পরিবর্তন হয় ১৯৬৯ সালের ১৯শে জুলাই প্রথম পর্বে ১৪টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় পর্বে ১৯৮০ সালের ১৫ই মার্চ আরো ৬টি ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ হয়। অবশ্য এর আগে ১৯৫৫ সালে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে স্টেট ব্যাঙ্ক এবং ১৯৫৯ সালে দেশের পূর্বতন রাজ পরিবারের মালিকানাধীন বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি জাতীয়করণ করে স্টেট ব্যাঙ্কের ৭টি সহযোগী (অ্যাসোসিয়েট) ব্যাঙ্কের সৃষ্টি করা হয়েছিল। আজ এই সবকটি ব্যাঙ্কই অবলুপ্ত, এগুলিকে স্টেট ব্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
জাতীয়করণের সুফল হিসেবে ব্যাঙ্কের পরিষেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে ব্যাপক সংখ্যায় শাখা বিস্তারের মধ্য দিয়ে। অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণদান নীতির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়েছে দেশের কৃষিক্ষেত্র, স্বনিযুক্তি প্রকল্প, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা,স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্র এবং প্রান্তিক সাধারণ মানুষ। সরকারি সামাজিক প্রকল্পের সিংহভাগ রূপায়িত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। বহুল চর্চিত প্রায় ৪৩.৯৩ কোটি জন্ধন্ অ্যাকাউন্ট এর মধ্যে ৪২.৬৬ কোটি অ্যাকাউন্টই খুলেছে রাষ্ট্রায়ত্তব্যাঙ্ক। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলো ছিল সমাজের উচ্চবিত্তের স্বার্থে, জাতীয়করণের পর তা পৌঁছলো সাধারণ মানুষের অঙ্গনে। শাখার ব্যাপক বিস্তারের ফলে ৭ লক্ষ বেকার যুবক যুবতীর কর্মসংস্থান হয়। নীচের সারণির দিকে তাকালে জাতীয়করণের পর গত ৫ দশকে ব্যাঙ্ক শিল্পের বিস্তারের চিত্রটা বোঝা যায়।
১৯৬৯ ২০২১
ব্যাঙ্কের মোট শাখার সংখ্যা ৮০০০ ১,১৮,০০০
মোট আমানত ৫০০০ কোটি ১৫৭ লক্ষ কোটি
মোট ঋণদান ৩৫০০ কোটি ১১০লক্ষ কোটি
খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমাদের দেশের স্বয়ম্ভরতা (সবুজ বিপ্লব) অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা; বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং নাবার্ড সহ।
বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক (১৯৭৫) এবং নাবার্ডের(১৯৮২)প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার ৯০% আসে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে। ১৯৯১ সালের পর থেকে নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে সরকারি অংশীদারিত্ব আর ১০০% নেই। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় অবস্থান ৯০% থেকে নেমে প্রায় ৭০% এসে পৌঁছেছে। কিন্তু তবুও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এখনো লাভজনক। গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বাণিজ্যিক লাভের চিত্র নিম্নরূপ।
অর্থ বর্ষ মোট বাণিজ্যিক (অপারেটিং) লাভ
২০০৯-১০ ৭৬,৯৪৫ কোটি
২০১০-১১ ৯৯,৯৮১ কোটি
২০১১-১২ ১,১৬,৩৩৭ কোটি
২০১২-১৩ ১,২১,৮৩৯ কোটি
২০১৩-১৪ ১,২৭,৬৩২ কোটি
২০১৪-১৫ ১,৩৮,০৬৪ কোট
২০১৫-১৬ ১,৩৫,২৩৮ কোটি
২০১৬-১৭ ১,৫৯,০২২ কোটি
২০১৭-১৮ ১,৫৫,৫৮৫ কোটি
২০১৮-১৯ ১,৪৯,৬০৩ কোটি
২০১৯-২০ ১,৭৩,৫৯৫ কোটি
২০২০-২১ ১,৯৭,৩৭৬ কোটি
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ধারাবাহিকভাবে বাণিজ্যিক লাভ করা সত্ত্বেও, ২০১৫ সালের ১৪ আগস্ট গৃহীত ‘ইন্দ্রধনুশ' দলিলের সুপারিশ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বাণিজ্যিক মুনাফা থেকে অনাদায়ী ঋণ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করে উপুর্যপরি নিট্ লোকসানের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
লুঠ চলছে
ব্যাঙ্কশিল্পে অন্যতম উল্লেখযোগ্য সমস্যা হচ্ছে পুঞ্জীভূত অনাদায়ী ঋণ যার পরিমাণ এবছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাৎসরিক হিসাব অনুযায়ী ৬,১৬,৬১৫ কোটি টাকা। এর সিংহ ভাগই বকেয়া রয়েছে দেশের বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীর কাছে। জালিয়াতি করে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে বহাল তবিয়তে বসে আছে বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি, মেহুল চোক্সি ও আরো অনেকে। এরা প্রত্যেকেই বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার টাকায়। ব্যাঙ্কিং পরিভাষায় আগে এদেরকে বলা হতো ‘উইলফুল ডিফলটার’। ইন্দ্রধনুশ দলিলে এদেরকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ‘অসহযোগী ঋণগ্রহীতা’ (Non-cooperative borrower) হিসাবে। সংজ্ঞার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় ব্যাঙ্ক লুটেরাদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব। যারা জেনেবুঝে বকেয়া ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছে না তাদেরকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপকারি’ না বলে ‘অসহযোগী দেনাদার’ বলে অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জরুরি প্রয়োজনীয়তাটাকেই লঘু করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনের দাবি এই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বৃহৎ কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিধি প্রয়োগ করে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ব্যাঙ্কের পাওনা টাকা আদায় করা হোক, কিন্তু এই লুটেরাদের স্বার্থবাহী কেন্দ্রীয় সরকার সে পথে হাঁটতে রাজি নয়। শুধু তাই নয়, ইনসলভেন্সি ও ব্যাঙ্করাপটসি কোড ২০১৬ প্রয়োগ করে বকেয়া টাকার ওপর বিপুল পরিমাণ ছাড় দিয়ে ‘হেয়ার কাট’ এর নামে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে বকেয়া ঋণ আদায়ে সমঝোতা করা হচ্ছে। ‘হেয়ার কাট’-এর নামে লুটের বহরের পরিমাণ নীচের সারণির দিকে তাকালে বোঝা যায়।
(কোটি টাকায়)
ঋণগ্রহীতা বকেয়া টাকা সমঝোতার হেয়ার কাট %
পরিমাণ
এসার স্টিল ৫৪০০০ ৪২০০০ ২৩
ভুষণ স্টিল ৫৭০০০ ৩৫০০০ ৩৮
জ্যোথি স্ট্রাকচার ৮০০০ ৩৬০০ ৫৫
ডিএইচএফএল ৯১০০০ ৩৭০০০ ৬০
ভুষণ পাওয়ার ৪৮০০০ ১৯০০০ ৬২
ইলেক্ট্রো স্টিলস ১৪০০০ ৫০০০ ৬২
মনেট ইস্পাত ১১৫০০ ২৮০০ ৭৫
অ্যামটেক ১৩৫০০ ২৭০০ ৮০
অলোক ইন্ডাস্টিজ ৩০০০০ ৫০০০ ৮৩
ল্যানকো ইনফ্রা ৪৭০০০ ৫৩০০ ৮৮
ভিডিওকন ৪৬০০০ ২৯০০ ৯৪
এবিসি শিপইয়ার্ড ২২০০০ ১২০০ ৯৫
শিবশঙ্করণ ইন্ডাস্ট্রিজ ৪৮০০ ৩২০ ৯৫
উপরোক্ত ১৩টি ঋণগ্রহীতার কাছে মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৪,৪৬৮০০ কোটি টাকা, সমঝোতার মধ্য দিয়ে আদায় হয়েছে ১,৬১,৮২০ কোটি টাকা, ব্যাঙ্কগুলির মোট লোকসান ২,৮৪,৯৮০ কোটি টাকা, হেয়ার কাট এর পরিমাণ ৬৪%।
লুটেরারাই ব্যাঙ্কের মালিক হতে চায়
১৯৬৯ সালের ১৯শে জুলাই এক অধ্যাদেশের মধ্য দিয়ে ১০০% মালিকানা নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো যাত্রা শুরু করে। ১৯৯১ সালে নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতি গ্রহণ করার আগে পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক শিল্পের বিপুল বিস্তার ঘটে। ১৯৯৩ সালে ব্যাঙ্কিং কোম্পানিস (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ট্রান্সফার অফ আন্ডারটেকিংস) অ্যাক্ট, ১৯৭০ ও ১৯৮০ সংশোধন করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে সরকারি অংশীদারিত্ব ৫১% পর্য্যন্ত নামিয়ে আনার বিধান করা হয়। কিন্তু এই আইনগুলির ৩(২ঈ)ধারা অনুযায়ী বেসরকারি অংশীদারদের ভোটাধিকার ১০% পর্যন্ত এখনও সীমিত, তাই ৫১% পর্যন্ত বেসরকারি মালিকানার বিধান থাকলেও ব্যাঙ্কগুলির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এখনও বিরাজমান।
এবছরের বাজেট প্রস্তাবে ২টি ব্যাঙ্ক বিক্রি করার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রি করতে গেলে উপরিউক্ত দুটি আইন ও ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত অন্যান্য আইনের বিভিন্ন ধারার পরিবর্তন দরকার। সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে ব্যাঙ্কিং আইন সংশোধনী বিল ২০২১। চলতি শীতকালীন অধিবেশনের আলোচ্য সূচিতে এই সংশোধনী বিল অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা হচ্ছে বিল পাশ করিয়ে দুটি ব্যাঙ্ক বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার রাস্তাটাকে প্রশস্ত করা। এই কাজে সফল হলে সাধারণ মানুষের উপরে নেমে আসবে আঘাত। পরিষেবার পরিধি সংকুচিত হবে শাখা বন্ধের মধ্য দিয়ে।
সংযুক্তিকরণের কুফল এর মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। ১ এপ্রিল ২০১৯ ব্যাঙ্ক অফ বরোদা’র সাথে বিজয়া ও দেনা ব্যাঙ্ক যুক্ত হওয়ার পর ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, মার্চ ২০২১ এর হিসাব আনু্যায়ী ১২৬৮টি শাখা বন্ধ করেছে। ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক এবং ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক ১ এপ্রিল ২০২০ সালে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এ পর্যন্ত ৬৪৩টি শাখা বন্ধ করেছে। অনুরূপভাবে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক এর সাথে করপোরেশন ও অন্ধ্র ব্যাঙ্ক যুক্ত হওয়ার পর ২৭৮টি শাখা বন্ধ করা হয়েছে । ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক এর সাথে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক সংযুক্ত হওয়ার পর ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক ২৫৯টি শাখা ও ২৮১টি প্রশাসনিক অফিস ইতিমধ্যেই বন্ধ করেছে এবং প্রথম পর্বের বন্ধের তালিকায় আরো ২০টি শাখা আছে। সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক যুক্ত হওয়ার পর কানাড়া ব্যাঙ্ক গত জুন মাস পর্যন্ত ৬১৪টি শাখা বন্ধ করেছে। উল্লেখ্য ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক এর সাথে করপোরেশণ ও অন্ধ্র ব্যাঙ্ক, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক এর সাথে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক এবং সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক কানাড়া ব্যাঙ্ক এর সাথে সংযুক্ত করা হয় ১ এপ্রিল, ২০২০ থেকে। ১০টি ব্যাংককে এক ধাক্কায় ৪টি বানিয়ে দেওয়া হয়। এটি ‘মেগা মার্জার’ হিসাবে পরিচিত। দেশের ব্যাঙ্কশিল্পের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৫টি অ্যাসোসিয়েট ব্যাঙ্ককে স্টেট ব্যাঙ্কের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল যার পরিণতিতে স্টেট ব্যাঙ্ক এ পর্যন্ত ১৯৯৮ টি শাখা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন প্রতিটি ব্যাঙ্কেই কর্মী সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা হচ্ছে। যে শাখাগুলিতে কয়েক বছর আগে শতাধিক কর্মী কাজ করতেন সেখানে এখন কাজ চালানো হচ্ছে হাতে গোনা কয়েকজন কর্মী দিয়ে। গ্রাহকরা প্রয়োজনীয় পরিষেবা পাচ্ছেন না, পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বিরুদ্ধে মানুষের মনে অসন্তোষ দানা বাধাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। আঘাত নেমে এসেছে প্রবীণ নাগরিকদের ঊপরে। বিজেপি-এনডিএ জমানায় মেয়াদি আমানতের উপরে সুদের হার কমানো হয়েছে প্রায় ৩%। এটা করা হয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে কম সুদে ঋণ দেওয়ার স্বার্থে।
দুটি ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করতে সফল হলে সরকার এই জায়গায় থেমে থাকবে না। ন্যাশনাল ডিমনিটাইজেশন পাইপলাইনের নামে যেভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে একের পর এক বেসরকারি সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে তাতে এই আশঙ্কা থেকেই যায় যে আগামী দিনে আদৌ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কোনও অস্তিত্ব থাকবে কি না।
রাষ্ট্রায়ত্ত না থাকলে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত মানুষের সঞ্চয়ের কোন নিরাপত্তা থাকবে না। কৃষক, বেকার যুবক যুবতী, গরিব ছাত্রছাত্রী, ক্ষুদ্রমাঝারি ও কুটির শিল্প ব্যাঙ্কঋণ পাবে না। দেশের অর্থব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের পরিসর সংকুচিত হবে। দেশের আর্থিক ক্ষেত্রে নেমে আসবে কালো ছায়া।
তাই সংগ্রাম চলছে
নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির সূচনাকাল ১৯৯১ সাল থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে ধারাবাহিকভাবে ব্যাঙ্কশিল্পের কর্মী ও আধিকারিকরা সংগ্রাম চালিয়ে আসছে্ন। একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বনাশা নীতির বিরুদ্ধে তাঁরা এ পর্যন্ত ৭০ দিন ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। বিগত ৩০ বছরের এই ধারাবাহিক সংগ্রামের ফলেই আজও দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে আছে এবং ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক ধ্বসের ধাক্কার প্রতিফলন আমাদের দেশে সে ভাবে পড়েনি। ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্মিলিত জোরালো প্রতিবাদের ফলেই ২০১৭ সালের এফ.আর.ডি.আই. বিল বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল এই সরকার। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা উপেক্ষা করে, ৭০০’র বেশি কৃষকের শহিদের মৃত্যু বরণের মধ্য দিয়ে, দীর্ঘ ১ বছরের লাগাতার কৃষক সংগ্রামের ঐতিহাসিক সাফল্য শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের কাছে উৎসাহ বর্ধক ঘটনা। ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলন এই সাফল্যে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং ১৬-১৭ ডিসেম্বরের দেশব্যাপী ব্যাঙ্ক ধর্মঘটকে সর্বাত্মকভাবে সফল করেছে ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকলে উপকৃত হয় দেশের সাধারণ মানুষ। তাই সর্বস্তরের গ্রাহকবর্গ, সাধারণ মানুষ ও ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনের সম্মিলিত শক্তি দিয়েই প্রতিহত করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাঙ্ক বিক্রির সর্বনাশা পদক্ষেপকে।