বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— হাথরাস থেকে হাঁসখালি আমার লেখার বিষয় নয়। তবু ...। হাঁসখালির মেয়ে যে পুরুষটিকে প্রেমিক হিসাবে ভেবেছে, সে তার জন্মদিনের সন্ধ্যায় নিজে এবং বন্ধুদের নিয়ে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত মেয়েটির যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে তাঁকে মৃত্যুর কাছে মুক্তি দিয়েছে। রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্বে যিনি রয়েছেন, তিনি বুঝতে পারছেন না – এটাকে ‘লাভ অ্যাফেয়ার্স’ বলবেন, না ‘ধর্ষণ’ বলবেন! যিনি এই ধন্দে পড়েছেন, তিনি একজন মহিলা। ‘মহিলা’ – তাতে আর কী এসে যায়। কারণ, কাঠামো তো ‘ম্যাসকুলিন’। কিছুদিন আগে গাঙ্গুবাই সিনেমা দেখলাম। ভারতীয় সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা এক কিশোরী গঙ্গা, ভালোবেসে কারো স্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত গঙ্গা, গাঙ্গুবাই হয়ে উঠলেন নিজেই সেই ম্যাসকুলিন সংস্কৃতিকে রপ্ত করে। কোনওরকম ব্যতিক্রমহীন ভাবে এই ধরনের নানা ঘটনা সমাজের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আসলে শ্রমের বাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিয়ে লিখতে বসে, সমাজে লিঙ্গ বৈষম্যের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে কাঁটাছেঁড়া করতে করতে প্রসঙ্গ দুটির উল্লেখ।
কম বয়সে মার্কসবাদী ভাবনায় লেখা ‘ছোটদের অর্থনীতি’ বইটি পড়ে, মুনাফা কী করে হয় জানতে পেরে চমৎকৃত হয়েছিলাম। শ্রমসময় কীভাবে চুরি হয়, তা বুঝতে কোনওভাবেই লিঙ্গ বৈষম্যের ভাবনা আসে না। সেক্ষেত্রে শ্রমিক অর্থাৎ মানুষের শ্রেণীগত পরিচয়টাই প্রধান। কিন্তু কোলিয়ারি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে জানলাম, কয়লা শিল্প জাতীয়করণের পর যে সব নারীশ্রমিক মাটির-তলার খনিতে কাজ করতেন তাঁদের ‘সুযোগ’ দেওয়া হয়েছে ভিআরএস নেওয়ার বা ছেলে বা জামাইকে তাঁদের পরিবর্তে নিয়োগ করার। জাতীয়করণের আগে মেয়েরা খনির নিচে এবং উপরে কাজ করতেন। ধীরে ধীরে মহিলা শ্রমিক কম করতে করতে বর্তমানে অল্প কিছু মহিলা শ্রমিককে সারফেসের কাজ অর্থাৎ ঝাড়ু দেওয়া, টেবিল মোছা বা জল দেওয়ার মত কাজে রাখা হয়েছে। অল্প কিছু মহিলা ব্লাস্টিংয়ের কাজের জন্য ‘মাটির গুলি’ তৈরি করেন। অন্যদিকে, আমার বর্তমান বাসস্থানের খুব কাছাকাছি কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের আশেপাশে অনেক ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে, যার বেশিরভাগই গেঞ্জির কারখানা এবং প্লাস্টিক কারখানা। কারখানা লাগোয়া বসতিগুলির মেয়েরা ওখানে কাজ করেন। তাছাড়া এইসব এলাকায় মহিলারা বাড়িতে বসে কিছু কাজ করেন। ঐ এলাকার বাসিন্দা রুপাদি বম্বেতে গৃহপরিচারিকার কাজ করে কিছু টাকাপয়সা জমিয়ে, গ্রামে ফিরে একটুখানি রান্নার জায়গা ও টয়লেটসহ এক কামরার একটা ঘর বানিয়েছেন। চারজন সদস্যের সেই ঘরে গিয়ে দেখেছি, সারা ঘরময় প্লাস্টিকের কৌটো ছড়ানো; দু’তিনজন মিলে কৌটোগুলিতে ঢাকনা লাগানোর কাজ করে চলেছে। জানতে পারলাম না, কী হিসেবে পয়সা দেওয়া হয়। জানতে চাইলে লজ্জিত মুখে বললো, ‘খুব কম’। গৃহশ্রমিক মালাদি, লোকের বাড়ি রান্না করে সন্ধ্যাবেলা এক কামড়ার ভাড়া ঘরে কখনো লেগিংসের সুতো কাটেন, কখনো বালিশের ঢাকনা সেলাই করেন; গৃহশ্রমিক রানী দশ বাড়ির বাসন মেজে ফারের পুতুলের পেটে তুলো ভরে সেলাই করে। সেলাই করে জীবিকা চালানো মেয়েদের একটা পুরোন পেশা। কিন্তু সারাদিন ব্লাউজের হেম করে আর হুক লাগিয়ে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে দিনের শেষে একটু রাত করে ‘মাল’ জমা দিয়ে আর নতুন অর্ডারের বোঝা নিয়ে মহিলা কামরায় আসা-যাওয়া করা সহযাত্রী মহিলা, শহরে আয়ার কাজ করে ফেরা মহিলা, কল সেন্টারে কাজ করে ফেরা ঘুমে কাতর মেয়েটাকে দেখে কে বা হিসেব করতে বসে শ্রমের বাজারে মেয়েদের অবস্থানটা ঠিক কোথায়। যদিও এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা বা লেখাপত্র আছে। তথ্য বলছে, ভারতে শ্রমের বাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণ খুবই কম — বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী ২০ শতাংশেরও নীচে। কিন্তু এর বেশিরভাগটাই আবার অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত।
মেয়েদের শ্রমের বাজারে কম অংশগ্রহণের পিছনে নানা কারণের মধ্যে প্রধানতম কারণ হল গৃহশ্রম, শিশুর দেখাশোনা এবং পরিবারিক বন্ধন। আজও ভারতীয় সমাজের পিতৃতান্ত্রিক সামন্ত সংস্কৃতি মেয়েদের পারিবারিক জীবনে আটকে রাখতে চায়। যদিও এক্ষেত্রে লিঙ্গ ও শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বেশিরভাগ গরীব নিম্নবিত্ত মহিলা যা হোক ধরনের একটা কাজ করেন বা খুঁজে নেন। তাতে তাঁরা বিশেষ পারিবারিক বাঁধার মধ্যেও পড়েন না। বলাই বাহুল্য এসব কাজের জন্য শিক্ষা বা দক্ষতা বিশেষ লাগে না এবং যা মেয়েদের কাজ হিসাবে নিদিষ্ট।
পয়লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ভারতে স্বীকৃত বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এবং অন্যান্য ছোটখাটো ইউনিয়নগুলিও দিনটি স্মরণ করে। দু’চারটে জমায়েত হয়। সাধারণভাবে দেখা যায়, জমায়েতগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জড়ো হন পুরুষ শ্রমিকরা এবং বক্তব্য রাখেন পুরুষ নেতা। নারী-পুরুষের প্রকৃতি নির্ধারিত পার্থক্য স্বীকার করে, কর্মক্ষম মানুষ হিসাবে মেয়েরা যদি শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণ করে তাঁদের শ্রমের যথোচিত মূল্য দাবি না করেন, তবে এই চিত্রের পরিবর্তন হবে না। যদি মেয়েরা পারিবারিক শ্রমের সঙ্গে ফাউ হিসেবে গণ্য কাজগুলির সঙ্গে শুধুমাত্র যুক্ত না থেকে, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ভারী শিল্প সর্বত্র একজন শ্রমজীবী হিসাবে শ্রমের উপযুক্ত মূল্যসহ কাজের সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা, রোজগারের সুরক্ষা, খাদ্য সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষার দাবি করেন, তবে শক্তিবৃদ্ধি হবে শ্রমিক আন্দোলনের। শ্রমিক ইউনিয়নগুলিতে মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সম্ভব হবে। অনেকে বলে থাকেন, কর্মসংস্থানই নেই... কাজেই কাজের বাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণের চর্চা নিষ্ফলা। অর্থাৎ সেই ম্যাসকুলিন ভাবনা। কাজকম্ম কিছু থাকলে কাজের দুনিয়ায় অংশ নাও, নতুবা ওসব আলোচনা বৃথা! এঁদের প্রশ্ন করা উচিত, কাজ নেই তো একজন বেকার যুবক কেন হন্যে হয়ে কাজ খুজছেন? হন্যে হয়ে শ্রমজীবী ঘরের মেয়েরাও কাজ খুজছেন। কিন্তু এখানে আবার সেই শ্রেণী আর লিঙ্গের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। পরিবারকেন্দ্রিক সামাজিক জীবন এবং ভারতের শক্তিশালী সামন্ত সংস্কৃতি শ্রমজীবী নারীদেরকে বাধ্য করে শ্রমের বাজারে অংশ নিতে, পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতিকে সামাল দিতে। প্রায়শই তাঁদের বলতে শোনা যায় – আমাদের স্বামীরা যদি ভাল রোজগার করতো, তবে কি আমাদের এত খাটতে হতো! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাড়ির রোজগেরে পুরুষ, স্বামী বা পুত্রের কাজ চলে গেলে সেসব পরিবারের মেয়েরা জঙ্গী মেজাজে আন্দোলনে অংশ নেন। পুলিশ বা গ্রেপ্তার কোনও কিছুর ভয় করেন না। কাজ হারানোর অসহায়তা থেকে পুরুষরা আন্দোলনে বাড়ির মেয়েদের সাহায্য নিতে বাধ্য হন। শ্রমিক মহিলাদের মধ্যে শ্রেণী সচেতনতার পাশাপাশি লিঙ্গ সচেতনতা গড়ে তোলার ঘাটতি ভারতবর্ষের শ্রমিক ইউনিয়নের একটা বড় দুর্বলতা। মহিলাদের মধ্যে লিঙ্গ সচেতনতার অভাবে, একদিকে পরিবারগুলি সামন্ত সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর হয়ে থাকছে, অন্যদিকে পুঁজিবাদী সংস্থাগুলি শিল্পের মজুত বাহিনী হিসাবে মহিলাদের ব্যবহার করছে। সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের মেয়েদের একটা অংশের মধ্যে লিঙ্গ সচেতনতা দেখা যায়। তাঁরা উচ্চশিক্ষায়, ভারী শিল্পে এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকছেন। উদাহরণ হিসাবে উঠে আসে উড়িষ্যার লাঞ্জিগড়ে বেদান্ত অ্যাল্যুমিনিয়ামের কথা। সেখানে অ্যাল্যুমিনিয়াম প্ল্যান্টের সম্পূর্ণ অপারেশন একটা মহিলাদের টিম পরিচালনা করে। ভারতবর্ষের লোকসভা, বিধানসভায় মহিলারা প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু দেখা যায়, এরা কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী শ্রম আইন পরিবর্তনকে সমর্থন করেন। শ্রেণীগত বৈষম্য বজায় রাখতে তারাও আধিপত্যবাদি ম্যাসকুলিন সংস্কৃতি রপ্ত করেছেন। তবু ব্যতিক্রম কিছু তো থাকেই।
ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে যে ব্যতিক্রমী মহিলাদের কথা বলতেই হয়, তাঁদের মধ্যে সুপরিচিত নাম সন্তোষী কুমারী দেবী; যিনি শুধু নারী শ্রমিকদের নিয়ে নয়, পাট শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমিক ইউনিয়ন করেছিলেন; প্রভাবতী দাসগুপ্ত স্ক্যাভেঞ্জারদের নিয়ে ইউনিয়ন তৈরি করেছিলেন। তাঁর প্রভাবে বেগম সাকিনা ফারুক সুলতান মুয়াইদজাদাও স্ক্যাভেঞ্জারদের মধ্যে ইউনিয়ন করেন। ১৯৪০ সালে তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত ১৮০০ স্ক্যাভেঞ্জারদের স্ট্রাইক বিশেষভাবে স্মরণীয়। সেই সময়কার আরো একজন ব্যতিক্রমী মানুষ বিমল প্রতিভা, যিনি চরমপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে বারবার কারাবরণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে, ১৯৪০ সালে ঘরবাড়ি ছেড়ে রানীগঞ্জ-আসানসোল অঞ্চলে কোলিয়ারি শ্রমিকদের সঙ্গে লেবার লাইনে থাকতেন। তাঁর নেতৃত্বে বেঙ্গল পেপার মিলের আন্দোলন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বীনা দাস, সুধা রায়, মৈত্রেয়ী বোস, ফুলমনি গুহ-র মত রাজনৈতিক মহিলারা জুট, রেল, ডক, আয়রন এন্ড স্টিল, অ্যাল্যুমিনিয়াম শিল্পের মত বড় শিল্পে সফল ভাবে শ্রমিক সংগঠন করেছেন। সেই সময় যেসব শ্রমজীবী নারীরা নেতৃত্ব হিসাবে এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন দুখমত দিদি, যিনি বিলাশপুর থেকে স্বামীর সঙ্গে বরানগর জুট মিলে কাজ করতে এসেছিলেন। ১৯৩৭ সালের সাধারণ ধর্মঘটে দুখমত দিদি প্রায় সাতশ মহিলা জুট শ্রমিককে জড়ো করেছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি সিপিআই-এর সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। তবে দুখমত দিদি আগে শ্রমিক নেত্রী হয়েছেন, পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালে চামেলি তামাং এআইটিইউসি-র নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি এবং সেলি তামাং চা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে পুরো উত্তর বাংলা চষে বেড়াতেন।
দেশ স্বাধীনের পর সংগঠিত ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন অনেক শক্তিশালী হয়েছে, কিন্তু ভারী শিল্প থেকে মেয়েদের ধীরে ধীরে বাদ দেওয়া নিয়ে ইউনিয়নের পুরুষ সদস্যদের বিশেষ কোনও আওয়াজ নেই। ট্রেড ইউনিয়নের বেশিরভাগ পুরুষ সদস্য মেয়েদের জায়গায় ছেলেদের নিয়োগকে সমর্থন করেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণও অনেক কমে গেছে। এক্ষেত্রেও আধিপত্যবাদী ‘ম্যাসকুলিন’ সংস্কৃতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নে মেয়েদের এই অনুপস্থিতি বা সক্রিয়তার অভাবে ইউনিয়নের সিদ্ধান্তে তাঁদের কোনও ভূমিকা থাকছে না; স্বাভাবিকভাবেই ট্রেড ইউনিয়নে মহিলা ইস্যুও উপেক্ষিত হচ্ছে। আবার বেশিরভাগ মহিলা যে ধরনের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত সেখানে কোনও ইউনিয়নই নেই বা থাকলেও তা দুর্বল। এটা একটা বড় বাঁধা, ট্রেড ইউনিয়নের ‘ম্যাসকুলিন’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। তবে নিয়মতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শুধু মহিলাদের প্রশ্নেই নয়, সাধারণভাবেই সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। অবশেষে বলতে চাই, হাথরস বা হাঁসখালির মেয়ে, গাঙ্গুবাঈ, শ্রমজীবী নারী সকলেই ম্যাসকুলিন সংস্কৃতির শিকার – চিন্তার সংযোগ সেখানেই।