বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

অগ্নিবীর প্রকল্প: কার নিরাপত্তা?

অগ্নিবীর প্রকল্প: কার নিরাপত্তা?

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

photo

২০২২ সাল, ১৪ই জুন, বিজেপি সরকারের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘স্থল-নৌ-বায়ু’ সেনায় চালু হল চার বছরের চুক্তিভিত্তিক ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প। তারপর থেকেই ধুন্ধুমার কাণ্ড; জ্বলে উঠল রাজধানী এক্সপ্রেস থেকে সরকারি বাস। চললো দফায় দফায় লাগাতার ট্রেন অবরোধ। এ সব করেছিল হবু সেনা জওয়ানরাই। সে সব আমরা সকলেই জানি। কিন্তু কেন করল? যারা শাসকের নির্দেশে প্রাণ দিতে পণ করেছিল, তারাই হঠাৎ শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলো কেন? আর শাসকই বা কেন এই প্রকল্প শুরু করে নিজেদের সম্ভাব্য সামরিক শক্তিকে ক্ষুব্ধ করে তুলল?

অগ্নিবীর প্রকল্প


এখন সামরিক বাহিনীতে চার বছরের এই চুক্তি ভিত্তিক প্রকল্প লাগু হয়েছে, দেশের ১৭-২৩ বছর বয়সী যুবক-যুবতীদের জন্য। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, প্রথমে ছয় মাস ট্রেনিং পরে সাড়ে তিন মাস চাকরি। এর পর, এর মধ্যে যারা প্রতিযোগিতা করে, ভাল ফল গড়ে বেড়ে উঠবে তাদের ২৫ শতাংশকে বাহিনীতে রাখা হবে এবং যারা তেমন ফল করতে পারবে না তাদের বাতিল করা হবে। অর্থাৎ, তারা আর বাহিনীতে দীর্ঘস্থায়ী চাকরির সুযোগ পাবে না, কাজ হারাবে। তবে তাদেরকে খালি হাতে ঘরে ফেরানো হবে এমনটাও নয়; বরং সান্ত্বনা বাবদ হাতে ১১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা গুঁজে বীরের ‘সম্মান‘ দেওয়া হবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু আসল বিষয়, এর বদলে এরা কেউ আর আগের মতন অবসরকালীন ভাতা ও অন্যান্য বিশেষ সুবিধাগুলো পাবে না। ২০২০ সালে ডিপার্টমেন্ট অব মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স এই প্রকল্পের পরিকল্পনা করে। সে সময়ে এই প্রকল্পের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন, খোদ সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত মহাশয়। যিনি মারা যাওয়ার (২০২১ ডিসেম্বর) যাওয়ার ছ’মাসের মধ্যেই চালু হয় এই প্রকল্প।

শাসকের সাফাই


এই প্রকল্প ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর “নতুন অন্যান্য পদাধিকারীদের” (other ranks) চাকরিতে নেওয়ার কৌশল বা পরিকল্পনা মাত্র; যারা “Tour of Duty” তে থাকবে দেশকে সারাক্ষণ সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে সরকারের প্রধান যুক্তি, ভারতের সামরিক বাজেটে অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের ভাতা কমানো। যা বছরের পর বছর বেড়ে চলেছে। এর ফলে ভারতীয় সেনাশিবির’কে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মোটেই সাজিয়ে তোলা যাচ্ছে না। ভারত আন্তর্জাতিক বিশ্বের চোখে দুর্বল হয়ে পড়ছে। যদিও এ নিয়ে অবশ্য সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধানরা অনেকেই ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি টিভির পর্দায় বসে সারাদিন আরএসএস-বিজেপি সরকারের ওকালতি করা, মেজর জিডি বক্সি টুইট করে বলেছিলেন –“This is an across the board change to convert Indian armed forces to a short tenure Quasi – conscript force like the Chinese.”

বিরোধিতার মূল কারণ


আরএসএস-বিজেপি ঘনিষ্ঠ জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বছর দুয়েক আগে বলেছিলেন, ভারত সরকারকে সরাসরি নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। যারা এর বিরোধিতা করছেন তাঁদের বক্তব্য, এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মূলত সেটাই ঘটবে। বদলে যাবে সামাজিক সমীকরণ, বলা ভাল সমাজের সামরিকীকরণ হয়ে যাবে। এর কারণে, দিনমজুর ঘরের সন্তান, শিক্ষার্থীসেনা, শুভম বলছেন, বর্তমানে স্থায়ী রুজিরুটির জায়গা ক্রমশ কমে আসছে, চার বছর বাদে একটা ব্যাচ থেকে যখন প্রশিক্ষিত সেনারা বেকার হয়ে ফিরবে তখন সামাজিক ভাবে রাস্তা-ঘাটে মারামারি লেগে থাকবে, তাদের ভাবনা আর পাঁচটা সাধারণ নাগরিকের মতো থাকবে না। তাই, সাধারণ সমাজের ক্ষতি হবে।

প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন


এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিজেপি বিরোধী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল পথে নেমেছে। আন্দোলন গড়ে তোলাবার চেষ্টা করেছে। যদিও তাদের লক্ষ্য ছিল কেবলই বিজেপি বিরোধিতা, তাই সে ভাবে বিজেপি বিরোধী শিবিরগুলির নেতৃত্বে গড়ে ওঠেনি তেমন কোনও আন্দোলন। কিন্তু মূল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে; প্রশিক্ষণরত সেনাদের নেতৃত্বে। যার আঁচ বিহার-ঝাড়খন্ড-উত্তরপ্রদেশ-অন্ধ্র হয়ে এ রাজ্যেও এসে পড়েছে, শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসেও আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে সরকারও বহুজনকে গ্রেফতার করেছে, কালা আইন “UAPA” প্রয়োগ করে। এ প্রসঙ্গে আরেক প্রশিক্ষণরত আন্দোলনকারি হবু-সেনা, বিশাল বলছে, এই প্রকল্প অন্যায়। ২০১৯ সালে সেনাবাহিনীর লিখিত পরীক্ষা এবং ২০২১ সালে মেডিকেলে পাশ করা একজন ছাত্র বিশাল, যাঁর “এনরোলমেন্ট” নম্বর আসা বাকি ছিল কেবল। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার আগেই ২০১৯ সালের ব্যাচের সমস্ত পরীক্ষা ক্যানসেল করে “অগ্নিবীর” প্রকল্প লাগু হয়। সেজন্য বিশাল সহ আরো অনেকেই আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। এই আন্দোলন করবার অপরাধে অনেকের মতন বিশালেরও বেশ কিছুদিন হাজতবাস হয়। বিশালেরও শাসক পক্ষের সাকরেদদের কাছ থেকে দেশপ্রেমীর বদলে “দেশদ্রোহী” আখ্যা জোটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রায় ১৪ লক্ষ সেনাবল নিয়ে গঠিত, যাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেরেকেটে মাত্র দেড় থেকে দুই শতাংশ যায়। ফলত, এ রাজ্যে এই প্রকল্প নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও এ আন্দোলনকে রাজ্য সরকার সেসময় কড়া হাতে দমন করে।

আন্তর্জাতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সম্পর্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্য


আধুনিক বিশ্বে আর আমেরিকার একাধিপত্য নেই তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশ্ব ক্রমশ দ্বিমেরু কিংবা বহুমেরু শক্তিতে ভাগাভাগি হয়ে চলেছে; রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের পর থেকেই। রাশিয়ার সামরিক-কূটনৈতিক জোর এবং চীনের উদীয়মান অর্থনীতি আজ আমেরিকাকে ক্রমশ বুড়ো বাঘে পরিণত করেছে বিশ্বের দুয়ারে। যারা এখন নিজেদের গর্জনে নিজেরাই কাহিল! এ দিকে ‘উন্নয়নশীল’ ভারতের বাজারে রয়েছে অফুরন্ত খনিজ সম্পদ ও ব্যাপক জনগণের কায়িক এবং মানসিক শ্রম। যার দিকে তাকিয়ে উন্নত বিশ্বের তাবড় যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র। যারা মূলত অক্টোপাসের শুঁড়ের মতন অর্থনৈতিক-সামরিক-রাজনৈতিক-কূটনৈতিক শুঁড় বিছিয়ে রাখে, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির পাহাড়সমান সম্পদ লুট করে নিজেদের দেশের পুঁজিপতি শ্রেণীর অতি মুনাফার খিদে মেটানোর জন্য। যার ফলে এদেরই মধ্যে আজ গোটা দুনিয়াটাই ভাগাভাগি হয়ে যায় অনায়াসে, যেখানে ‘উন্নয়নশীল’ ভারত রয়েছে মধ্যে। গত নব্বইয়ের দশক থেকে উদারিকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়ন-এর হাত ধরে ভারতরাষ্ট্র আমেরিকার একপাক্ষিক পক্ষপাতিত্ব করলেও বর্তমানে আস্তে আস্তে সেই মোড় বাঁক নিয়েছে। ভারত ক্রমশ রাশিয়া-চীনের দিকেই সরছে। তাই আমেরিকার রাজনৈতিক হুংকার ও সামরিক জোট “Quad” এর আইনপ্রণালী (ক্যাটসা) অগ্রাহ্য করে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক জোট এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক জোটেই (BRICS-SCO) মনোসংযোগ ঘটিয়েছে ভারত। যার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের দুয়ারে ভারত সরকার নিজেদের দরকষাকষির জোরও বাড়াতে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাঝামাঝি অবস্থান রাখতেও সক্ষম হয়ে উঠেছে। অবশ্য ‘বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়ানো’ আকাশকুসুম স্বপ্নও অনেকে দেখছেন! এমত অবস্থায়, ভারত সরকার দেশের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানেই প্রায় ১০০% দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজিপতিদের বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে, যার মধ্যে দেশের অস্ত্রপ্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিও রয়েছে। সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্পেও প্রবেশ করেছে দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির বিভিন্ন সংস্থা। এ সবের ফলে সংশয় জাগে, সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের উপর সরকারের কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে, আর কতটা পুঁজির।

পরিশেষে


সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত কিংবা গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কৃষকদল সমাজ বিকাশের পথের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল পুরো বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে, যা বিশ্বে সমাজবিজ্ঞানের প্রগতির পথ সুগম করে। তাঁরাই ছিল সেসময় সেই দেশের সেনাবল। বর্তমানে আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান বেড়ে চলা বেকারত্ব, যার অন্যতম প্রধান কারণ সমস্ত ক্ষেত্রেই চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ। সাধারণ মানুষের চেতনার মানও হচ্ছে নিম্নমুখী; ফলতঃ ক্রমাগত রুদ্ধ হচ্ছে ভারতীয় সমাজ বিকাশের প্রগতির গতিও। আজ এই প্রকল্পের সৌজন্য দেশের ছাত্রযুবদের একটা অংশ সামাজিক উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবলই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবে যা দেশের ভেতরে আরো নানান অরাজকতা-অশান্তি সৃষ্টি করবে। এখন দেখবার বিষয় তারা যুদ্ধটা কাদের স্বার্থে এগিয়ে নিয়ে যাবে! হয় দেশের সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী মানুষ এই যুদ্ধ ঠেকিয়ে সমাজ বিজ্ঞানের প্রগতির পথ সুনিশ্চিত করবে, নয়তো অগ্নিবীরেরা পেটের জ্বালায় এই পরিকল্পিত যুদ্ধ ধ্বংস করে, শাসকশ্রেণীর সমস্ত বাঁধন ছিন্ন করে, সমাজের বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.