বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
তুলনাবিহীন হিংস্র প্রত্যাঘাত দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিল মোদি সরকার রাহুল গান্ধীকে অন্যান্যদের তুলনায় কতখানি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মনে করেন। যে দ্রুততার সঙ্গে রাহুল গান্ধীর সাংসদপদ খারিজ করল বিজেপি সরকার, তাতে দুটি বিষয় স্পষ্ট।
প্রথমত, একদা ‘পাপ্পু’বলে যে রাহুলকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন করে দিতে চেয়েছিল বিজেপি-আরএসএস, তারাই এখন রাহুলকে তাদের মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে আসতে দেখে রীতিমতো আশঙ্কিত।
দ্বিতীয়ত, এতদিন দেখা যাচ্ছিল ভোটে নির্বাচিত প্রতিটি বিরোধী দলের সরকারকে ইডি, সিবিআই ও আয়করের মতো এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে হেনস্থা করাকে একটা স্থায়ী কৌশল হিসাবে কাজে লাগাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের বিজেপি-আরএসএস সরকার। রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তে আরও স্পষ্ট হচ্ছে, দরকারে সংসদীয় রীতিনীতিকে দু’পায়ে মাড়িয়েই এগোবে তারা। তোয়াক্কা করবে না আইন, সাংবিধানিক কাঠামো ইত্যাদি কোনও কিছুই। এ হল সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের পথে আরেক পদক্ষেপ। কারণ, যে কোনও ভাবে সংসদে রাহুল গান্ধীর কণ্ঠরোধ করা এবং বিরোধী কংগ্রেসকে দিশাহীন অবস্থায় ফেলে দেওয়াটাই বিজেপির উদ্দেশ্য। সে কারণেই রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বুলেট ট্রেনের চেয়েও দ্রুতগতিতে।
আর এখানেই বিজেপি-আরএসএস সরকারের আসল পরিচয় উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধাপে ধাপে ধ্বংস করো। সারা দেশজুড়ে আদানিদের মতো ক্রোনি পুঁজিকে লাগামহীনভাবে মুনাফা লুঠতে সাহায্য করো। জায়গা করে দাও দেশি-বিদেশি ক্রোনি ও কর্পোরেটদের। আর এদেরই টাকার থলি কাজে লাগিয়ে ভোটে জেতো কিংবা নির্বাচিত বিরোধী সরকারের বিধায়ক কিনে জনতার রায়কে বদলে দাও। এভাবে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করো বিজেপির একচেটিয়া স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। অর্থনীতিতে দেশি-বিদেশি ক্রোনিদের একচেটিয়া, রাজনীতিতে বিজেপি-আরএসএসের একচেটিয়া — এই ছককে কার্যকর করতে করতে এগোচ্ছে বিজেপি।
ঠিক এখানেই গ্রন্থির দুর্বলতম অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে আদানি এবং আদানিদের সেই জায়গায় এনে ফেলেছে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট। পরিণত রাজনীতিকের মতোই রাহুল আদানি ইস্যুতে মোদির বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। কাঠগড়ায় তুলেছেন মোদিকে। মোদি সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, তার বিরুদ্ধে একটা পোস্টারও লেখা যাবে না, লেখা হলেই গ্রেপ্তার করা হবে— ক্রমাগত প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে বিজেপির তৈরি করা এই স্বর্গ থেকে মোদিকে টেনে নামাতে সক্ষম হয়েছেন রাহুল। এছাড়াও, মোদি বিরোধী প্রচারকে সংসদের ঘেরাটোপে আটকে না রেখে ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্যে দিয়ে তাকে জনতার দরবারে নিয়ে গেছেন রাহুল।
স্বয়ং মোদিকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া এবং মোদি বিরোধী রাজনীতিকে জনতার মধ্যে পৌঁছে দেওয়া— এভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে ভিন্ন এক দিশা তুলে ধরতে চাইছেন রাহুল। একইসঙ্গে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির ন্যারেটিভের বিপরীতে সামনে এনেছেন ইনক্লুসিভ ন্যারেটিভ, যার অর্থনৈতিক কনটেন্ট হতে পারে নয়া উদারবাদী কাঠামোকে কিছুটা সঙ্কুচিত করে সেই পরিসর ওয়েলফেয়ার অর্থনীতিকে প্রসারিত করা (গরিবদের নগদ সহায়তা, পুরনো পেনশন স্কিম ফেরানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি ইত্যাদি)। ইতিমধ্যেই লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা দেখা যাচ্ছে।
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিজেপির থেকে আলাদা একটা ন্যারেটভিকে রাহুল যে দাঁড় করাতে চাইছেন, সেটাকেই ভয় পাচ্ছে বিজেপি-আরএসএস। কারণ ক্রোনি পুঁজি ও বিভাজনের রাজনীতির ন্যারেটিভ দেশকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে সেকথা ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছেন দেশের মানুষ।
রাহুলের সাংসদপদ কেড়ে নেওয়ার ঘটনা সচকিত করে তুলেছে সব কটি আঞ্চলিক শক্তিকে। এদের অনেকেই নানা মাত্রায় বিজেপির সঙ্গে আপোষ করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। তবে রাহুলের ঘটনা সেই কৌশলে ধাক্কা দিয়েছে। আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে আলাদা আলাদা ভাবে এজেন্সি দিয়ে মোকাবিলা করা এক জিনিস। আর এই সব শক্তি জোট বাঁধলে যে বিরোধী রাজনৈতিক ধারা তৈরি হয় সেটা অন্য জিনিস। ঐক্যবদ্ধ বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলা করার কৌশল বিজেপির তেমন জানা নেই। বিভাজনের কৌশল ও এজেন্সিকে কাজা লাগানোর খেলায় বিজেপি দক্ষ। রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হওয়ায় বিরোধী ঐক্যের যে সম্ভাবনা তৈরি করছে, তাকে মোকাবিলার কৌশল রচনা করতে হবে বিজেপিকে। এই রাজনীতি অনেক সূক্ষ্ম কৌশলের খেলা এবং সেখানে বিজেপির দক্ষতা প্রমাণিত নয়। জাতীয় রাজনীতিতে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের ঘটনা এক নতুন সমীকরণের দিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে ঠেলে দিয়েছে যার মোকাবিলা বিজেপি শুধু এজেন্সি দিয়ে করতে পারবে না।
আপাতত এই লড়াইয়ের সংহত রূপ দেখা যাবে কর্ণাটক বিধানসভার নির্বাচনে। বিজেপি ক্রোনিদের টাকায় কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী বিভাজনের রাজনীতিকে জিতিয়ে আনতে পারবে, নাকি রাহুলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শক্তির কাছে বিজেপির রথের চাকা কর্ণাটকের মাটিতে ভেঙে পড়বে, এখন সেদিকেই নজর থাকবে গোটা দেশের। দেশব্যাপী মোদি সরকার বিরোধী আন্দোলনে রাহুল কি যোগ্যতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে পারবেন, তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন দেশবাসী।