বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ভারতের 'সিভিল সোসাইটি' যুদ্ধ

ভারতের 'সিভিল সোসাইটি' যুদ্ধ

রঞ্জিত শূর

photo

"The new frontiers of war, what you call the fourth-generation warfare, is the civil Society"— Ajit Doval, National Security Adviser.
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১— এবছর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করবে না পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। গত বছরও করেনি। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এদেশে পশ্চিমবাংলাতেই প্রথম মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছিল। তারপর থেকে লাগাতার প্রত্যেক বছর ধুমধাম করে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করে এসেছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। ব্যতিক্রম গতবছর। হবে না এ বছরও। রাজ্য সরকারের অনাগ্রহ ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুষ্ঠানে আসতে অনীহাই নাকি মূল কারণ। কমিশনের ভাড়ারে নাকি এই উৎসবের জন্য যথেষ্ট টাকাও নেই। সরকার বা মানবাধিকার কমিশন বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন না করলে মানবাধিকার আন্দোলনের ইতর বিশেষ কিছু হয় না, হবেও না। তবে এর দ্বারা মানবাধিকার বিষয়ে সরকার এবং কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝা যায়। বোঝা যায়, সরকার এবং খোদ মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার বিষয়ে কতটা দায়সারা। শুধু রাজ্য কমিশন কেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সম্প্রতি একটা অদ্ভুত আচরণ করেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটা বিতর্ক সভার আয়োজন করেছিল। তার বিষয় ছিল 'নকশালবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে মানবাধিকারই হল সবচেয়ে বড় বাধা'। শুধু এই বিতর্ক সভার আয়োজনই নয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠা দিবসে এবছর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জাতীয় কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরুণ মিশ্র কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। তার বক্তব্য ছিল ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করায় অমিত শাহ'র বলিষ্ঠ ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। ঠিক যে সময়ে গোটা কাশ্মীর কার্যত সেনাবাহিনীর বুটের তলায় সেই সময়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এই বক্তব্য যথেষ্ট বিস্ময়ের কারণ হয়ে উঠেছিল। অমিত শাহের বক্তব্য রাখার আগের দিন জাতীয় কমিশনের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন মানবাধিকার কর্মীদের জন্য বিদেশে দেশের সম্মানহানি হচ্ছে। গতবছর এরকমই একটা অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পশ্চিমের দেশগুলির মানবাধিকার ধারণা নিয়ে এদেশে মানবাধিকার চর্চা করা ঠিক নয়। রাষ্ট্রীয় হিংসা, হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে বেশি নজর না দিয়ে অরাষ্ট্রীয় হিংসার বিরুদ্ধে, মাওবাদী হিংসার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। দেশে শৌচাগার ও ধোঁয়হীন চূলা বৃদ্ধি - কিভাবে মহিলাদের অবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছে সেসব বিষয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর আরও ইঙ্গিত ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে যে সকল মানুষের জন্য যে একগুচ্ছ স্বাধীনতা ও অধিকারের কথা বলেছে তা এদেশে অচল। মোদি-শাহ'র এসব ভাবনাচিন্তার প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে অজিত দোভালের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে।
সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেছেন, নাগরিক সমাজই হল নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। আইপিএস অফিসারদের পাসিং আউট প্যারেডের শেষে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, প্রথাগত যুদ্ধে এখন বিপুল খরচ। তাই সেই যুদ্ধ এখন সম্ভব নয়। নাগরিক সমাজকে প্রভাবিত করে দেশের ক্ষতি সাধন হতে পারে। তাই আইপিএস'দের প্রতি তার পরামর্শ নাগরিক সমাজ যাতে ঠিক পথে চলে সেটা দেখা তাদের কর্তব্য। তিনি বলেছেন, নাগরিক সমাজই হল এখন যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টিয়ার। চতুর্থ জেনারেশন যুদ্ধ। তাঁর এই বক্তব্য একদিকে যেমন সচেতন নাগরিক সমাজকে দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে অন্যদিকে পুলিশকে পরামর্শ দিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে।
উপরের এই ছবি থেকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একটা আঁচ নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। কী রাজ্য কী কেন্দ্র মানবাধিকার আন্দোলন এবং মানবাধিকার কর্মীদের মোটেই সহ্য করতে রাজি নয়। নাগরিক সমাজ বলতে অজিত দোভাল কাদের বোঝাতে চেয়েছেন সেটা তিনি অস্পষ্ট রেখেছেন। তিনি সিভিল সোসাইটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। সাধারণভাবে, নাগরিক সমাজ বা সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটি বলতে দেশের শিক্ষিত, সচেতন ও সোচ্চার অংশকে বা তাদের সংগঠনগুলোকে ধরা হয়। তবে দোভালের এই চিন্তা এর আগেও ভিন দেশে শোনা গেছে। একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, সোভিয়েত রাশিয়াকে যুদ্ধ করে হারানো বা ভাঙা যায়নি। তার নাগরিক সমাজকে প্রভাবিত করে, ব্যবহার করে, তবেই ভাঙা গেছে। তাই দোভাল এই নাগরিক সমাজকে নজরবন্দি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীকে। আর সেই নজরবন্দী রাখার রূপ কী ভয়ঙ্কর হতে পারে তা ইতিমধ্যেই দেখা গেছে পেগাসাস ব্যবহারে। পেগাসাস আক্রান্তদের দিন রাত ২৪ ঘন্টা প্রতি মুহূর্তের ছবি পোঁছে গেছে সরকারের ঘরে।
মানবাধিকার আন্দোলন ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি সরকারের এই অতি সচেতনতাকে কিভাবে দেখা দরকার? ভয় নাকি শ্লাঘা? ইতিমধ্যেই ভীমা কোরেগাঁও এর সাজানো মামলায় দেশের ১৬ জন শ্রেষ্ঠ মানবাধিকারকর্মী ও সমাজকর্মীকে জেলে পোরা হয়েছে। মারা গেছেন স্ট্যান স্বামীর মতো দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। জেল খেটেছেন বা জেলে বন্দী আছেন আরো বহু সমাজকর্মী, সাংবাদিক, গণ আন্দোলনের কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী। তাই ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সরকারের এই আক্রমণ কিন্তু মানবাধিকার আন্দোলনের বিরাট স্বীকৃতিও বটে। মানবাধিকার আন্দোলন এবং সিভিল সোসাইটির ক্ষমতা আরও একবার কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সরকারের এই অতি প্রতিক্রিয়া। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা ঘৃণা করেন মানবাধিকার শব্দটাই। কারণ গুজরাট গণহত্যার পর থেকে সরাসরি মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। বারবার তাদের আদালতের কাঠগড়ায় টেনে নিয়ে গেছেন মানবাধিকার কর্মীরাই। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদি যে অন্য কোনও দেশে ঢুকতে পারতেন না তার পেছনেও ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলন। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ মানবাধিকার সম্বন্ধে ভাল কথা বলবেন না সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু যেভাবে সামগ্রিক নাগরিক সমাজকেই যুদ্ধের আঙিনা হিসেবে ঘোষণা করেছে দোভাল তা অবশ্যই মানবাধিকার আন্দোলনের উপর আক্রমণের আশঙ্কার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মানবাধিকার আন্দোলনকেও সে কথা মাথায় রেখেই তাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই ভূমিকার প্রেক্ষাপটে রাজ্যের পরিস্থিতিকে কিভাবে দেখা হবে। আজকের পৃথিবীতে জনমতের ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটা বিরাট ভূমিকা অনস্বীকার্য। অধিকাংশ বড় মিডিয়া হাউসই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত। সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তারা চলে। সত্য প্রকাশে ছোট ছোট পত্র-পত্রিকার ভূমিকা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি একটি প্রশাসনিক বৈঠক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছোট পত্র-পত্রিকার উদ্দেশ্যে বলেছেন, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে হলে পজেটিভ খবর করতে হবে। নেগেটিভ খবর করা চলবে না। উন্নয়নের খবর করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, পত্রিকাগুলি জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠাতে হবে। তারা দেখে পজেটিভ মনে করলে তবেই মিলবে সরকারি বিজ্ঞাপন। তাঁর এই বক্তব্য অত্যান্ত মারাত্মক। সরকারের কোনও বিজ্ঞাপন নীতি থাকবে না। তা না করে শুধু সরকারের গান করলে তবেই মিলবে বিজ্ঞাপন। কি ছাপা হচ্ছে সেটাও নজরে রাখবে এসপি-ডিএম। জরুরি অবস্থার সময় সিদ্ধার্থ শংকর রায়, সুব্রত মুখার্জি পত্র-পত্রিকা সেন্সর করার জন্য যা করত তার সঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর এই পরামর্শের পার্থক্য কতটুকু? কাজেই মমতা ব্যানার্জি সরকার এবং তার নিয়ন্ত্রিত মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার নিয়ে উৎসাহী হবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পথ বেয়ে হুমকি শোনা যায় দেউচা পাচামিতে। দেউচা পাচামিতে বাইরের কেউ যেন ঢুকতে না পারে বা ঢুকে গোলমাল না করতে পারে সেটা দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন ডিএম-এসপিকে। দেউচা পাচামি জুড়ে শুরু হয়েছে হুমকি, বাইক বাহিনীর তান্ডব এবং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম মডেলে উন্নয়নের রাজনীতি।
এই প্রেক্ষাপটে জয় এল দিল্লি সীমান্তে। পাঞ্জাব হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের এক বছরের এক ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিন কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই জয় কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্যে বিরাট ধাক্কা। মোদির অশ্বমেধের ঘোড়া দিল্লি সীমান্তে রুখে দিল কৃষকরা। গদি নাড়িয়ে দিল সব শাসকেরই।বিপুল উৎসাহিত করল আন্দোলনের শক্তিকে। আগামী নাগরিক অধিকার আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন এবং মানবাধিকার আন্দোলনকে এই জয় নিশ্চয় প্রভাবিত করবে, উৎসাহিত করবে। আন্দোলন করলে বিজয় অর্জন করা যায় সাধারণ মানুষের কাছে এই বিশ্বাস আবার নতুন করে ফিরিয়ে দিলো কৃষক আন্দোলন। এই কৃষক আন্দোলনই দাবি জানিয়েছিল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। বাতিল করতে হবে শ্রম কোড। তুলেছিল আরো বহু গণতান্ত্রিক দাবি। সারাদেশের সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষকে তাদের পাশে টেনে এনেছিল। তাই আশা করা যায়, আগামী দিনে আরও বৃহত্তর জোটের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে আরও বৃহত্তর গণআন্দোলন। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সমস্ত সরকারকেই জবাব দেবে সেই জোটবদ্ধ বৃহত্তর গণআন্দোলন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.