বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

নয়া কৃষিনীতি

নয়া কৃষিনীতি

রতন খাসনবিশ

photo

কৃষিপণ্যের লাভজনক দামের সমস্যা
১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, শ্রমজীবী ভাষা– প্রাক-পুঁজিবাদী কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত লুন্ঠনের পদ্ধতিটি ছিল সরল। যে শ্রমজীবী কৃষিতে ফসল উৎপাদন করে তার কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব সহ নানাবিধ লুন্ঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তার শ্রমের ফসল লুঠ করে নেওয়া হতো জোর-জুলুম করেই। জোর-জুলুমের নৈতিক ভিত্তি অবশ্যই নির্মাণ করা হতো। কিন্তু জোর-জুলুম জোর-জুলুমই — লুণ্ঠন ছাড়া অর্থনৈতিক কোনও নৈর্ব্যক্তিক নিয়মে শ্রমের ফসল লুঠ করার উপায় জানতো না প্রাক পুঁজিবাদ।

পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি এই লুণ্ঠন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এল। পরিবর্তনটি কী ধরনের? থিয়োরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যালু, পার্ট টু, যাকে ক্যাপিটাল-এর চতুর্থ খণ্ড বলা হয় সেখানে কার্ল মার্কস বিস্তৃতভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সংক্ষেপে বললে বিষয়টি দাঁড়ায় এরকম। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে কৃষিতে যে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়, সেই অর্থ ব্যবহৃত হয় অপেক্ষাকৃত বেশি শ্রমঘন উৎপাদনে। অপেক্ষাকৃত বেশি শ্রমঘন কারণ শিল্পের তুলনায় কৃষিতে প্রযুক্তির বিকাশ এতটা বেশি হওয়া সম্ভব হয় না যাতে শ্রমের একক প্রতি উদ্বৃত্ত মূল্য শিল্পের চেয়ে বেশি হতে পারে। এছাড়াও কৃষিতে যে বিনিয়োগ সেই বিনিয়োগের গঠনগত দুর্বলতা থাকে। যন্ত্রপাতি একটা স্তরের পর আর বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা যায় না। বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় ফসলচক্রে যে সার, জল, কীটনাশক ইত্যাদি দরকার হয় তার দরুন খরচ অনুসারে। শিল্পে বিষয়টি অন্যরকম। সেখানে উৎপাদন হয় পুঁজিঘন, প্রযুক্তির বিকাশ পুঁজির ঘনত্ব সেখানে বাড়ায় কৃষির চেয়ে অনেক দ্রুত হারে। মার্কসের কাছে বিষয়টি ছিল এরকম যে, পুঁজিবাদী কৃষিতে স্থির (constant) এবং সঞ্চরণশীল (variable) যে পুঁজি কাজে লাগানো হয়, ওই একই পরিমাণ পুঁজি শিল্পে বিনিয়োগ করলে পুঁজিঘন উৎপাদনের কারণে (constant capital/variable capital = c/v বেশি প্রযুক্তিগত কারণে) সেখানে উদ্বৃত্ত মূল্য বেশি সৃষ্টি হয়। সুতরাং, পণ্যের দাম যদি c+v+s হয়, s যেখানে উদ্বৃত্ত মূল্য, তাহলে সবসময়ই এরকম ঘটবে যে কৃষিপণ্য শিল্পপণ্যের তুলনায় কম দাম পাবে, কৃষি অলাভজনক হবে, বিনিয়োগের অর্থ কৃষি থেকে শিল্পে চলে যাবে। থিয়োরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যালু, পার্ট টুতে সমস্যাটি আলোচনা করে কার্ল মার্কস দুটি বিষয়ের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের প্রথম কথাটি বহুল পরিচিত। পুঁজিবাদী উৎপাদনে কৃষি এবং শিল্প মিলে যে মোট উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয় (S), কৃষি এবং শিল্পে মোট নিযুক্ত পুঁজি (C+V)-র সঙ্গে তার যে অনুপাত (S/C+V) সেটি সমাজে অর্থাৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মুনাফার একটি সাধারণ হার নির্ধারণ করে। কৃষি কম উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারলেও তার উৎপাদিত পণ্যের দাম কৃষিক্ষেত্রে যে c+v+s হবে তার চেয়ে বেশিতে থাকবে। পুঁজিবাদ শিল্পে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের এক অংশ কৃষিতে পাঠিয়ে কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখবে। এটা ঘটার কথা পুঁজিবাদী উৎপাদনে মুনাফার সাধারণ হার অর্থাৎ S/C+V-র যে সাধারণ হার, সেটিকে বলবৎ রেখে। শিল্প বেশি উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করবে যার এক অংশ কৃষিপণ্যের দামে রূপান্তরিত হবে, কৃষি লাভজনক থাকবে। মার্কস দ্বিতীয় যে কথাটি বলেছেন সেটি এরকম যে, মুনাফার সাধারণ হারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কৃষি খুশিতে থাকে না। তাকে দিতে হয় জমির ওপর যে ভূমি খাজনা তার তুল্যমূল্যও। এর সবটাই আসবে শিল্প থেকে। তবেই কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ হবে, কৃষি লাভজনক থাকবে। যদি এটির ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে কৃষি থেকে নিঃশব্দে পুঁজি সরে যাবে, কৃষি পঙ্গু হয়ে যাবে।

কৃষিকে পঙ্গু রেখে পুঁজিবাদী শিল্প টেঁকসই হতে পারে কিনা এ নিয়ে সংশয় আছে। একটা যুক্তি এই রকম যে, শিল্পোন্নত দেশ শিল্পে বিশেষিকরণ ঘটাবে, তাদের দেশে খেতখামার রাখার দরকার নেই। তাঁদের দেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্য বিদেশে বিক্রি করে সেই অর্থে বিদেশ থেকে সস্তায় খাদ্যশস্য আমদানি করা যায়। লাভ এটাই যে শিল্পে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ নিজের দেশের কৃষির সঙ্গে ভাগ করে নিতে হচ্ছে না। বিদেশি শস্য তুলনামূলক ভাবে কমদামে আনা সম্ভব। অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডোর ‘তুলনামূলক সুবিধা’ তত্ত্ব এই যুক্তিকেই জোরদার করে। ইংল্যান্ডে এক সময়ে এই তত্ত্বে নির্ভর করেই খাদ্যশস্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ আইন তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা এই রিকার্ডীয় তত্ত্বে আস্থা রাখার জন্য জোরালো যুক্তি দিতে পারেনি। কথা উঠেছে, নিজ দেশের কৃষিকে বঞ্চিত করলে অর্থাৎ একতরফা শুধু শিল্পপণ্য উৎপাদন করলে খাদ্য সুরক্ষা বিপন্ন হবে। কৃষির সঙ্গে শিল্পের উদ্বৃত্ত মূল্যের কিছুটা ভাগ করে নেওয়া আর ভূমি খাজনার তুল্যমূল্য কৃষিতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা বরং কম ঝুঁকি বহুল। কয়েকশ বছরের অভিজ্ঞতায় বুর্জোয়া অর্থনীতি এই দ্বিতীয় বিষয়টিকে একভাবে মেনে নিয়েছে। কৃষিকে ভরতুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে (অর্থাৎ শিল্পে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ কৃষিক্ষেত্রে দিয়ে দিতে হবে যাতে কৃষি বেঁচে থাকে)।

কাজটি বাজারের নিয়ম মেনে করে ফেলা সম্ভব কি? তাত্ত্বিক দিক থেকে, একটি বিকশিত বাজার ব্যবস্থায় মুনাফার একটা সাধারণ হার থাকার কথা, কৃষিপণ্য তার দামের মধ্যেই ভূমিখাজনার অংশটি নিয়ে নিতে পারতো। বাস্তবে এটি হওয়া কঠিন। বহু শিল্পই মুনাফার সাধারণ হার ধরে লাভের হিসাব করে না যদি না বাজার তাকে সে রকম করতে বাধ্য করে। বাজার ব্যবস্থায় এমন কিছু নিয়ম থাকে না যেটা কৃষিপণ্যের দামে ভূমিখাজনার অংশটি উসুল করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। কৃষিকে লাভজনক বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসাবে টিকিয়ে রাখার উপায় তাহলে কী? উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এই সমস্যা সমাধানের একটা পথ খুঁজে পেয়েছে। পথটি হল রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পথ। শিল্প শিল্পক্ষেত্রে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের একটি অংশ রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছে দেবে (যথা কর্পোরেট ট্যাক্স), আর রাষ্ট্র সেই আহৃত উদ্বৃত্ত মূল্য কৃষিতে পৌঁছে দিয়ে কৃষিকে লাভজনক বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসাবে টিকিয়ে রাখবে। রাষ্ট্র দু’ভাবে একাজ করতে পারে। এক, স্থির পুঁজিতে রাষ্ট্রের ভরতুকি নিশ্চিত করে (সস্তা সার, সেচ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ ইত্যাদি), দুই, উৎপন্ন ফসলে ক্যাশ সাবসিডি পৌঁছে দিয়ে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি দুটি উপায়ই কাজে লাগায় কৃষিকে লাভজনক বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসাবে ধরে রাখার জন্য। নয়া উদারবাদ এই বিষয়টি পছন্দ করেনি। কিন্তু বহু অভিজ্ঞতায় পুষ্ট উন্নত পুঁজিবাদী দেশের জাতিরাষ্ট্রগুলি এসব পরামর্শে কর্ণপাতও করেনি। যথারীতি কৃষি ভরতুকি পেয়েছে, কর্পোরেট ট্যাক্স আদায় করে এই ভরতুকি চালু রাখার ব্যবস্থা করেছে জাতিরাষ্ট্র।

নরেন্দ্র মোদির কৃষি আইন
ভারতে কৃষির পুঁজিবাদী রূপান্তরের পথে এটি সব সময়ই প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল যে বিদ্যমান ব্যবস্থায় কৃষিকে কী ভাবে লাভজনক উৎপাদন ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে তোলা যায়। নেহরুর শাসনকালে বিষয়টি এত জোরালো হয়ে দেখা দেয়নি। কারণ, ভারতের কৃষির পুঁজিবাদী রূপান্তর তখনও দূরায়ত ছিল। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যখন সবুজ বিপ্লব দিয়ে কৃষি বিপ্লব রুখে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে নামলেন, এই প্রশ্নটি তখন ক্রমশ গুরুত্ব লাভ করতে লাগল। গ্রামীণ ভূস্বামী গ্রামীণ কুলাক চাষিতে যত বেশি রূপান্তরিত হতে থাকল এই বিষয়টির রাজনৈতিক গুরুত্বও তত বেশি করে বাড়তে লাগল। শ্রীমতি গান্ধী কৃষিতে পুঁজিবাদী রূপান্তরণ যাতে লাভজনক হয়, সেটা নিশ্চিত করতে সেচ, সার, জল, বিদ্যুৎ ও কীটনাশকে ভরতুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন, অন্যদিকে গড়ে তুললেন এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন যারা সরকারি দাম নির্ধারণ করতে পারবেন চাষের খরচের ওপর একটা ন্যূনতম লাভের অঙ্ক নিশ্চিত করে। শ্রীমতি গান্ধী দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করলেন এই প্রক্রিয়ায় শিল্পের উদ্বৃত্ত মূল্যের একাংশ কর্পোরেট ট্যাক্স বাবদ রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে এসে আর সেই টাকায় কৃষিতে ভরতুকি দিয়ে। ক্যাশ সাবসিডি অবশ্য দেওয়া হলো না এদেশে। কিন্তু সরকার এমন একটি সংগ্রহ মূল্যের কথা বললেন যেটা কৃষি উৎপাদকদের দর কষাকষির একটা রাস্তা খোলা রাখল। সরকারি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়তে লাগলো, রেশন ব্যবস্থাও প্রসারিত হতে লাগলো, বড় শহরগুলো চলে এল পূর্ণ রেশন ব্যবস্থার আওতায়, যে ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার হল ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া তৈরি করা। একই সঙ্গে কৃষক যাতে ফসল বিক্রি সরকার নির্ধারিত মূল্যেই করতে পারে তার জন্য আনা হল মান্ডি ব্যবস্থা। এপিএমসি অ্যাক্ট মারফৎ সব রাজ্যেই যা চালু করা হয়েছিল।

শ্রীমতি গান্ধী কৃষির লাভজনক মূল্য হাসিল করার ব্যবস্থাটি পুরোপুরি তৈরি করে যেতে পেরেছিলেন, একথা বলা যাবে না। কিন্তু কৃষি যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না, শিল্পের টাকায় কৃষিকে বাঁচতে হবে ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র-স্বীকৃত এই সত্যটি তিনি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন। লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলেও এই দিশাতেই দাঁড়িয়েছিল ইন্দিরা যুগের কৃষি।

নয়া উদারবাদ শ্রীমতি গান্ধী সৃষ্ট ব্যবস্থাটিকে কম জোর করার চেষ্টা করতে লাগল রেশন ব্যবস্থা দুর্বল করে, সংগ্রহ মূল্যে যে ২৩টি ফসল মান্ডি মারফৎ বিক্রি হওয়ার কথা সেই ব্যবস্থাটিকে কম জোর করে তুলে। একই সঙ্গে চলতে লাগল একের পর এক ভরতুকি ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা— সারে ভরতুকি থাকবে না, বিদ্যুতে ভরতুকি থাকবে না, সেচের জল বাজার থেকে কিনতে হবে— একের পর এক এই ধরনের ব্যবস্থাগুলি চালু হতে লাগল। শিল্পের উদ্বৃত্ত মূল্যে কৃষি বাঁচবে কিনা, এই বিষয়টিকেই অবান্তর করে দেওয়া হল অর্থনীতির আলোচনায়। ভরতুকি নেওয়া অপরাধ, আর ভরতুকি দেওয়া পাপ, নয়া উদারবাদ গড়ে তুলল এই মতাদর্শগত পরিমণ্ডল।

বিষয়টিকে এক ঝটকায় উল্টোদিকে সরিয়ে নিয়ে এল জাতীয় কৃষি কমিশন, কৃষিবিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথনের নেতৃত্বে যেটি গঠিত হয়েছিল। ইউপিএ-১ এর শাসনকালে বামপন্থীদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ভারতের জাতীয় কংগ্রসকে এই কমিশনের গঠন মেনে নিতে হলো। কৃষি লাভজনক উৎপাদন ব্যবস্থা ইস্যুটি অন্য মাত্রা অর্জন করল। উৎপাদন লাভজনক রাখার উপায়টি হলো এমন একটি দাম কৃষিপণ্য অর্জন করতে পারবে যাতে লাভ নিশ্চিত হতে পারে কৃষি উৎপাদনে। সেই দামে সমস্ত খরচ (শ্রম +অশ্রম) এবং নির্ধারিত ভূমি খাজনা (অন্যকে চাষ করতে দিলে জমির মালিক জমি থেকে যা আয় করতে পারবে) উসুল করার পরেও মোট খরচের ৫০ শতাংশ কৃষি পাবে মুনাফা হিসাবে। অর্থাৎ, শ্রম ও অশ্রম উপাদানে উৎপাদকের খরচ যদি হয় ৬০+৩০ = ৯০ টাকা আর ওই ভূমিখণ্ডটির ভূমিখাজনা যদি হয় ২০ টাকা, তাহলে ওই জমিতে উৎপাদিত ফসলের দাম হবে ৬০+৩০+২০+ ১/২ (৬০+৩০+২০ অর্থাৎ ১১০+৫৫ অর্থাৎ ১৬৫ টাকা। এই দামটাই হবে স্বামীনাথনের সুপারিশ করা ফসলের সহায়ক মূল্য।

স্বামীনাথন কমিশনের এই সুপারিশ ইউপিএ-১ সরকার মেনে নিতে পারেনি। ইউপিএ-২ সরকারও এ নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি অঙ্গাকীর করেন যে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ তিনি কার্যকর করবেন। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার এক বছরের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে শপথ নিয়ে মোদি সরকার জানালো এরকম কোনও অঙ্গীকার তারা করেনি। আজ পর্যন্ত সরকারি সহায়ক মূল্য স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশের মান্যতা দেয়নি। আসলে এই মান্যতা দিতে হলে কৃষি যে ভরতুকি পাবে এবং এই ভরতুকি দেওয়াটা যে অপরাধ নয়, একটি পুঁজিবাদী কৃষি গড়ার পূর্বশর্তই যে এই ধরনের সহায়ক মূল্যের ন্যায্যতা দেওয়া— এই বোধটারই কোনও স্বীকৃতি নেই এদেশের রাষ্ট্রনেতাদের অনুভবে। না থাকার সম্ভাব্য কারণ এই যে এদেশের যে অকৃষি পুঁজি, যে পুঁজি ক্রোনি চরিত্রের, যে পুঁজি নিজেই সরকারি সহায়তা খুঁজে বেড়ায়, সেই পুঁজির চিন্তায় কৃষিকে ভরতুকি দিয়ে বাঁচিয়ে একটি শিল্পসমৃদ্ধ ভারত গড়ার কোনও ভাবনাই নেই। এদেশের রাষ্ট্র এই ক্রোনি পুঁজিকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চায় কৃষির স্বার্থ ক্ষুন্ন করেই। কৃষি যদি প্রাক-পুঁজিবাদে পড়ে থাকত তাহলে সমস্যটা এত তীব্র হতো না। এদেশের আধা সামন্ততান্ত্রিক কৃষি আছে পুঁজিবাদী রূপান্তরের পথে। এই রূপান্তর নিশ্চিত হতে পারে অকৃষির ভরতুকিতে কৃষিকে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। শ্রীমতি গান্ধীর পরে এ নিয়ে যে টালবাহানা চলছে স্বামীনাথন কমিশন সেটিকে একটি বিশেষ পর্যায়ে হস্তক্ষেপ ঘটানোর ব্যবস্থা করতে পারতো যদি বামপন্থীরা ইউপিএ-১ থেকে সরে না আসতেন। চাপ সৃষ্টির রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল যার ফলে।
মোদি সরকার এই বিষয়টিকে এদেশের ক্রোনি ক্যাপিটালের স্বার্থে মোকাবিলা করতে চায়। কৃষি শিল্পের ভরতুকি পাবে না, তাকে বাঁচতে হবে বাজারের ভরসায়। বাজার তাকে মুনাফার সাধারণ হার অনুসারে উদ্বৃত্ত মূল্য হাসিল করার ব্যবস্থা রাখবে না, বাজার তাকে ভূমিখাজনার তুল্যমূল্য আদায় করতে দেবে না। আর এ সব সহ্য করেই বাঁচতে হবে কৃষিকে।

ভারতীয় কৃষির পুঁজিবাদী রূপান্তরণের দায় এদেশের শিল্পপুঁজি বহন করতে রাজি ছিল না। পুঁজির স্বাধীন বুর্জোয়া বিকাশের শর্ত অনুপস্থিত থাকার কারণেই এটি ঘটেছিল এদেশে। এদেশের বুর্জোয়া জমিদার রাষ্ট্র কিন্তু একদিকে যেমন ভূস্বামীর পুঁজিবাদী রূপান্তর চেয়েছে, অন্যদিকে ওই রূপান্তরণের দায় দেশি পুঁজির ওপরেই ন্যস্ত করতে চেয়েছে। এই নিয়ে টানাপোড়েনের যে ইতিহাস সেটি হলো প্রাক-মোদি কৃষিনীতির নির্যাস। নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে চাইছেন। এদেশের শিল্প এবং সেবা পণ্যে নিয়োজিত পুঁজি কৃষির পুঁজিবাদী বিকাশের দায় বহন করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি লাভ করেছে তাঁর শাসনকালে। এদেশের দেশি পুঁজির ওপরের অংশটি ইতিমধ্যে রূপান্তরিত হয়েছে ক্রোনি ক্যাপিটালে। এই ক্রোনি ক্যাপিটাল কৃষি নিয়ে যা করতে চায় সেটাই মোদির কৃষিনীতি।

ক্রোনি ক্যাপিটাল কৃষির পুঁজিবাদী রূপান্তরণ যে দায় সৃষ্টি করে, সেই দায় থেকে অব্যাহতি চায়। উদ্বৃত্ত মূল্যের ওপর মুনাফার সাধারণ হার (S/C+V) তো কৃষিকে দেওয়া যাবেই না, ভূমিখাজনার তুল্যমূল্য কৃষিকে ফেরত দেওয়ার প্রশ্নই নেই, বরং কৃষি নিজ ক্ষেত্রে যে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে সেই উদ্বৃত্ত মূল্যেই ভাগ বসাতে চায় ক্রোনি ক্যাপিটাল। কাজটা সম্পন্ন করার জন্য খুবই ভাবনা চিন্তা করে কৃষি বিষয়ক তিনটি আইন প্রণয়ন করেছে মোদি সরকার। প্রথম আইনে যেমন ইচ্ছা তেমন দামে ফসল কেনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে অকৃষি পুঁজিকে। ‘লাভজনক কৃষি’ অর্থনীতিটিই অবান্তর করে দিতে চায় এই আইনি বিধান। বলা হচ্ছে যে মান্ডিতে সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করা যাবে। ঘটনা এটাই ঘটবে যে মান্ডিগুলিই ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হবে, সরকার রেশন ব্যবস্থা তুলে দিয়ে ফসল সংগ্রহের দায় থেকে অব্যাহতি নেবে। সহায়ক মূল্য স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ সহ অবান্তর হয়ে যাবে এই পথে। বেসরকারি মান্ডি ফসল কিনবে কিন্তু ফসলের দাম তার উৎপাদন মূল্য অনুসারে নির্ধারিত হওয়ার কোনও ব্যবস্থাই থাকবে না। মান্ডি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আছে। কিন্তু তার উত্তরে এটা বলা যাবে না যে সহায়ক মূল্যের অর্থনীতিটি বাতিল করতে হবে। বেসরকারি ফসল সংগ্রহকারীদের সহায়ক মূল্যের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে মোদি আসলে সেই রাস্তাই খুলে দিলেন যাতে কৃষিতে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য অকৃষি পুঁজির হাতে চলে যায় এই পথ ধরে। এটি নিশ্চিত করার জন্য অর্থাৎ অকৃষির কৃষিকে লুণ্ঠন নিশ্চিত করার জন্য মোদি সরকার এনেছেন দুটি সহযোগী আইন। একটি ধানচালের বাজারে কৃত্রিম অভাব ঘটিয়ে অকৃষি পুঁজি যাতে মুনাফা অর্জন করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যটিতে আছে চুক্তি চাষ, যে চুক্তিতে কৃষি দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসাবে অকৃষি পুঁজিকে মোকাবিলা করবে। এই মোকাবিলার ফল অবশ্যই যাবে অকৃষি পুঁজির পক্ষে।

ভারতীয় কৃষির পুঁজিবাদী রূপান্তরণে যে পথটি গৃহীত পথ হিসাবে চিহ্নিত ছিল নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও যে পথটির গুরুত্ব কেউই অস্বীকার করতে পারতেন না, মোদির নতুন আইন দাঁড়িয়ে আছে এই পথের বিপরীত মুখে। এই ভাবে কৃষিকে লুন্ঠন করে যদি শিল্পপুঁজি বাঁচতে পারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন কিংবা জার্মানি অথবা জাপানের কৃষি অর্থনীতি এপথ ধরেই তার রূপান্তরণ ঘটাতো। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এই দেশগুলিকে শিখিয়েছে যে মুনাফার সাধারণ হার আর ভূমিখাজনার তুল্যমূল্য কৃষি যদি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পুঁজিবাদের সাধারণ নিয়মেই কৃষি ক্রমশ বিনিয়োগ হারাবে, দেশি কৃষি পঙ্গু হবে। যেটা আবার পঙ্গু করবে দেশি শিল্প ও অকৃষিকাজের উৎপাদনকেও। নরেন্দ্র মোদি এত গভীর গিয়ে বিষয়টি বুঝতে রাজি নন। যে ক্রোনিরা তাকে গদিতে বসিয়েছে তারাও কৃষি এবং শিল্পের পুঁজিবাদী আন্তসম্পর্কটি তলিয়ে বুঝতে রাজি নন। ধান্দা পুঁজি চলে আশু স্বার্থে। এরাও চলছেন আশু স্বার্থে। রাষ্ট্রের দায় থাকে আশু স্বার্থের বাইরে শ্রেণী হিসাবে বুর্জোয়ার যে দূরায়ত স্বার্থ থাকে সেটি হৃদয়ঙ্গম করে বুর্জোয়ার উষ্মা উপেক্ষা করেই দীর্ঘমেয়াদি কৃষি নীতি প্রবর্তন করার। ভারতে সমস্যা এটাই যে রাষ্ট্রযন্ত্রটি এখন যাদের হাতে তারা এই কথাটি বুঝতে রাজি নন। কৃষি তছনছ করে তার উদ্বৃত্ত মূল্য লুন্ঠন করার রাস্তা নেবে ক্রোনি ক্যাপিটাল। যে কৃষি টিকে আছে সেটিও পঙ্গু হবে, যার দায় শেষ পর্যন্ত এসে পড়বে অকৃষিতে নিয়োজিত পুঁজির ওপরেই। অবিলম্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন এই শক্তিটিকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে আনা দরকার। ভারতবর্ষ একদা ছিল দুর্ভিক্ষের দেশ। সেই অবাঞ্ছিত সময়ে ভারতকে ফেরত নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা রুখে দেওয়া দরকার। বাতিল করা ছাড়া অন্য কোনও কিছু দাবি এই কৃষি আইনকে ঘিরে গড়ে তোলা উচিত হবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.