বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ওয়াকফ সংশোধনী বিল, ২০২৪ প্রসঙ্গে

ওয়াকফ সংশোধনী বিল, ২০২৪ প্রসঙ্গে

পর্যবেক্ষক

photo

৮ আগস্ট বিরোধীদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রী লোকসভায় ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪ পেশ করেন। বিরোধীদের তীব্র চাপে সরকার বিলটি “জয়েন্ট পার্লামেন্টরি কমিটির” কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার জন্য প্রেরণে বাধ্য হয়। কমিটির বিবেচনা সম্পূর্ণ না হওয়া সত্বেও কমিটির শাসকদলের চেয়ারম্যান কমিটির রিপোর্ট সভায় পেশ করেন। সদস্যদের তীব্র আপত্তিতে বিলটি পুনরায় কমিটির কাছে ফিরে গিয়েছে। শাসক দলের চলতি অধিবেশনে বিলটি পাশ করার মনোবাসনা অপূর্ণ থেকে গেল।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, শাসকের এই সংশোধনীটি পাশ করানোর জন্য দ্রুততার পেছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সংশোধনী নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচার নিয়েও।
প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনার আগে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা ও অন্যান্য যেসব বিষয় নিয়ে কথা উঠেছে সেই বিষয়গুলি পরিষ্কার হওয়া দরকার।
সম্পদের মালিক যখন ভগবানের কাছে চিরতরে কল্যাণমূলক কাজের জন্য তাঁর সম্পদ সমর্পণ করেন তখন সেই সম্পদ “ওয়াকফ” সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তিন ধরনের ওয়াকফ আছে -মানব কল্যাণে সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত, পারিবারিক ওয়াকফ যা পরিবারের কল্যাণে ব্যয় হয় এবং জন ও পারিবারিক ওয়াকফ যার উপসত্ত পরিবার ও জনকল্যাণে ব্যয় হয়।
ইবন বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৩২৭ সালে দামাস্কাসে বহু ওয়াকফ গড়ে ওঠে যার মাধ্যমে বিবাহের যৌতুক, ভ্রমণকারীদের খাদ্য পোশাক প্রদান, সড়ক উন্নয়ন প্রভৃতি হতো। অটোমান সাম্রাজ্যে বিপুল সংখ্যক ওয়াকফ গড়ে উঠে। এইসব ওয়াকফের জনমুখী কর্মসূচির ব্যাপকতা প্রবাদ হয়ে আছে। ভারতে ইসলাম শাসনকালে ওয়াকফ গড়ে উঠতে থাকে এবং স্বাধীন ভারতে ওয়াকফগুলির আরো বিস্তার ঘটেছে।
ওয়াকফের প্রসারের ইতিহাস প্রাচীন হলেও এগুলির পরিচালনার কোনও আইন না থাকায় মাতোয়ালি বা ম্যানেজারা ওয়াকফের সম্পদ যেমন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারতেন না, তেমনি তাঁরা দুর্নীতিতেও যুক্ত হয়ে যেতেন। এসবের প্রতিকারে ব্রিটিশ আমলে ১৯১৩ সালে প্রথম ওয়াকফ আইন প্রণীত হয় এবং ১৯২৩ সালে ওই আইনের পরিবর্তন ঘটে। স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালে যে ওয়াকফ আইন প্রণীত হয় তাতে রাজ্যস্তরে ওয়াকফ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় স্তরে ওয়াকফ কাউন্সিলের সংস্থান করা হয়। তাতেও পরিচালন ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ১৯৯৫ সালে পূর্বের সব আইন বাতিল করে যে আইন প্রণীত হয় ২০১৩ সালে তা আবার সংশোধিত হয়। বর্তমান সরকার সেই আইনকে পুনরায় সংশোধনের জন্য বিল এনেছেন তা এখন জয়েন্ট পার্লামেন্টরি কমিটির বিবেচনাধীন। বিরোধীদের এই বিলে প্রবল আপত্তি আছে।
আপত্তির বিষয়গুলি পরিষ্কার করার আগে যেসব বিভ্রান্তি সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলি সমপর্কে কিছু বলা প্রয়োজন।
এক, ওয়াকফ বোর্ড কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করলে, সেই সম্পত্তি আর কোনওভাবে ফেরানো যায় না।
এটি একটি উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তিকর প্রচার। দেশের আইনে এরকম কোনও সংস্থান নেই। কোনও স্থানে কোরানের আয়াত বলে সম্পত্তিকে ওয়াকফভুক্ত করা যায় না।
দুই, ওয়াকফ বোর্ডগুলি ৯.৪ লাখ একর সম্পত্তির মালিক যা কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরি যে ওয়াকফ বোর্ড বা কাউন্সিল কোনও সম্পত্তির মালিক নয়, তারা কেবলমাত্র এগুলির পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। এটিও উল্লেখ্য যে কেবলমাত্র তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা রাজ্যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণে আছে ১০,৩৭,৩৫৮ একর জমি। তাই রেলওয়ের পরে ওয়াকফ বোর্ডগুলি তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্পত্তির মালিক তা নিছকই কুৎসা।
বিলের আপত্তিকর ও বিভাজনমূলক বিষয়গুলি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসা যাক।
এক, প্রস্তাবিত সংশোধনীটি বৈষম্যমূলক। এই বিলে পাঁচ বছর ইসলাম বিশ্বাসীরাই কেবলমাত্র ওয়াকফ তৈরি করতে পারে। অথচ হিন্দু দেবোত্তর সৃষ্টিতে মুসলিমদের কোনও নিষেধ নাই। আর এটাই গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। বস্তুত আবহমানকাল থেকে তাই হয়ে আসছে এবং আগের আইনেও এরকম কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
দুই, সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডে দু’জন অমুসলিম সদস্য সরকার মনোনীত করতে পারবে, কিন্তু মন্দির বোর্ডে কোনও অহিন্দুর প্রবেশের অনুমতি নেই। যে সরকারের ঘোষিত নীতি “এক দেশ এক আইন”, সেই সরকার যখন এমন সংশোধনী আনেন তখন তাতে বিস্মিত হতে হয় এবং একে দ্বিচারিতা বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
তিন, ওয়াকফ সম্পত্তির ডিজিটাল নথিবদ্ধকরণকে একটি বড় সংস্কার বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এই কাজ ২০০৫ সালের সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ইউপিএ সরকারের সময়কালেই শুরু হয়েছে এবং ৪২ শতাংশ জমি ইতিমধ্যেই নথিবদ্ধ হয়েছে। বাকি জমির এক বড় অংশ প্রায় ৫৮,৮৭৮টি জমি বেদখল হয়েছে। এই কাজ প্রস্তাবিত ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তড়িঘড়ি করার পেছনে সম্পত্তিগুলি সরকারে ন্যস্ত করার অপচেষ্টা আছে বলে অনুমানের যথেষ্ট কারণ আছে।
চার, ভোগদখলী ওয়াকফ (waqf by user) হল সেই ওয়াকফ যা মৌখিকভাবে দানে প্রাপ্ত। মুসলিম আইনে, জমি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ তে এই মৌখিক হস্তান্তর আইনসিদ্ধ। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ওয়াকফ সম্পত্তির ডিজিটাল পোর্টালে নথিবদ্ধ করতে বৈধ নথিপত্রের প্রয়োজন হবে। নথিপত্রের দোহাই দিয়ে ওয়াকফের বহু সম্পত্তি হয় সরকার বা জমি হাঙরদের করায়ত্ত হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাবরি মসজিদ মামলায় সুস্পষ্টভাবে ভোগদখলী ওয়াকফের স্বীকৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে যে, কোনও নথি না থাকলেও দখলের প্রমাণই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে। এতদসত্ত্বেও এইসব সম্পত্তির উপর আক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ছয়, সংশোধনীতে ওয়াকফ ট্রাইবুনালের মর্যাদা শুধু হ্রাস করা হয়েছে। মন্দির ট্রাইবুনালের সঙ্গে এই সংশোধনী বিলের ট্রাইবুনালের বৈষম্যও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মন্দির ট্রাইবুনালের রায় চূড়ান্ত বলেও বিবেচিত হলেও ওয়াকফ ট্রাইবুনালের রায় চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে না। এছাড়া যেখানে মন্দির ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে লিমিটেশন আইনের ধারা কার্যকর থাকে না, সেই সুবিধা ওয়াকফের ক্ষেত্রে প্রত্যাহৃত হয়েছে। এর ফলে ওয়াকফ সম্পত্তির বিবাদ দায়ের করার জটিলতার কারণে অনেক সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাবে। লিমিটেশন আইনে এক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের না হলে ওইসব বিষয়ে মামলা দায়ের করা যায় না।
আরো কয়েকটি বৈষম্য বেশ ভাবনার। প্রথমত, হিন্দু দেবোত্তর সম্পত্তি রাজ্য আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। জমিজমা রাজ্য তালিকাভুক্ত হওয়া সত্বেও ওয়াকফ সম্পত্তি ১৯৫৪ সাল থেকে কেন্দ্রীয় আইনে নিয়ন্ত্রিত হয়। এমনকি রাজ্যের বিধি প্রণয়নেরও অধিকার নেই। দ্বিতীয়ত, সংশোধনীতে মহিলা সদস্যদের প্রাপ্যের কম দিয়ে পারিবারিক ওয়াকফ তৈরি হলেও তা বৈধ হতে পারে যা মহিলা অধিকারের পরিপন্থী। অন্যদিকে, ১৯৫৫ সালের হিন্দু

উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী একজন হিন্দু মহিলা সদস্যদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে তাঁর সব সম্পত্তি পুত্রের অনুকূলে দানপত্র করতে পারেন। এমন বৈষম্য নিয়ে সংশোধনীতে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।
এমনই অনেক প্রশ্ন ও বৈষম্য সংশোধীতে রয়েছে। ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা সংকোচন করে সরকার মনোনিত অমুসলিমদের হাতে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ওয়াকফ সার্ভে কমিশনের অবলুপ্তি ঘটনা হয়েছে। সরকার নিযুক্ত এই কমিশন সাক্ষ্য প্রমাণ সাপেক্ষে খাজনা নিরীক্ষা কোনও সম্পত্তি ওয়াকফভুক্ত ইত্যাদি নির্দ্ধারণ করে সরকারের কাছে সুপারিশ করার অধিকারী ছিল এবং এই কমিশন সব সিভিল কোর্টের অধিকারে বলীয়ান ছিল। এই সব কাজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উপর অর্পিত হয়েছে যাঁদের এবিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই। তার উপর জবরদখলে থাকা ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে কতদূর সুবিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
সংশোধনী বিলে চার অক্ষরের ‘Waqf’ বদলে পঞ্চাশ অক্ষরে পরিবর্তন করে ‘United Waqf Management, Empowerment, Efficiency and Development’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নামকরণটি সুশ্রাব্য, কিন্তু সংস্কার কতটা সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুসারী হবে এবং দুর্নীতি দূরীকরণে সহায়ক হবে তা নির্ভর করবে জেপিসি’র সুপারিশ ও শেষমেশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের পর।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.