বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

তেলেঙ্গানার গরীব কৃষক আন্দোলন

তেলেঙ্গানার গরীব কৃষক আন্দোলন

শ্রমজীবী ভাষা নিউজ ব্যুরো

photo

২৪-২৫ মার্চ, ঐতিহাসিক তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের অন্যতম ভূমি সিড্ডিপেট জেলার হুসনাবাদে উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রামীণা পেডালা সংঘমের (গ্রামীণ গরীব সংগঠন) ষষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সিড্ডিপেট জেলা করিমনগর জেলা ভেঙে তৈরি হয়েছে। কয়েক দশক ধরে এই গ্রামীণ গরীব সংগঠন অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানায় গ্রামীণ ভূমিহীন, প্রান্তিক, ছোট, মাঝারি কৃষক, কৃষি শ্রমিক, দিনমজুরদের সংগঠিত করে জমি, গণতন্ত্র ও অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ নিজামশাহী এবং সামন্ত-ভূস্বামীদের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তেলেঙ্গানার বিস্তির্ণ গ্রামাঞ্চলে অভূতপূর্ব জাগরণে ফেটে পড়েছিল লক্ষ লক্ষ কৃষক জনতা। সামন্ত-ভূস্বামীদের কব্জা থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে যে চাষ করে সেই কৃষকের হাতে জমি বন্টন— সেই আন্দোলনের মূল মন্ত্র ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষকরা গড়ে তুলেছিলেন মহান পরিবর্তনের আন্দোলন। কৃষক সংগঠনের পাশাপাশি কৃষকদের গেরিলা সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রায় তিন হাজার গ্রামে সামন্ত-ভূস্বামীদের কর্তৃত্ব ভেঙে পড়েছিল— গড়ে উঠেছিল কৃষক কর্তৃত্ব। সামন্ত-ভূস্বামীদের লেঠেল বাহিনী কৃষক আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হলে এগিয়ে আসে নিজামশাহীর সেনা। কিন্তু ব্যর্থ হয় কৃষক জাগরণকে দমন করতে। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের শাসন ভার ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এদেশের মানুষ পান দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা। নিজাম প্রথমে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি ছিল না। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে তিন দিনের মধ্যে নিজাম ভারতের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলন দমন করতে নির্মম সেনা অভিযান শুরু হয়। সেনা অভিযান ও রাষ্ট্রীয় হিংসার মুখে কৃষক আন্দোলন পশ্চাদ অপসারণ করতে বাধ্য হয়। রক্তের বন্যায় ভেসে যায় কৃষক আন্দোলনের এলাকাগুলি। কৃষক আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। তবু চলতে থাকে কৃষক নিধন। কারণ সামন্ত-ভূস্বামী শ্রেণী অশনি সংকেত পেয়েছিল— তাদের কর্তৃত্ব আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সুতরাং শত্রু শেষ রাখতে নেই। হুসনাবাদ হল অন্যতম সেই ভূমি যেখানে কিছু দিনের জন্য হলেও গরীব কৃষকরা তীব্র আন্দোলনে সামন্ত-ভূস্বামীদের কর্তৃত্ব চূর্ণ করেছিলেন আর তাই সামন্ত-ভূস্বামীরা প্রতিশোধ নিতে হত্যালীলা চালিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর পার হয়ে গেছে। দেশে রাজন্যপ্রথা বাতিল হয়েছে, জমিদারী প্রথা বিলোপ করা হয়েছে, নানা ভূমি সংস্কার আইন পাশ হয়েছে, জমির শিলিং চালু হয়েছে। কিন্তু আইনের ফাঁক ব্যবহার করে নামে-বেনামে সামন্ত-ভূস্বামীরা অন্ধ্র-তেলেঙ্গানায় বিপুল পরিমাণ জমি আজও কব্জায় রেখেছে। স্বামীনাথন কমিশন সারা দেশে মুষ্টিমেয় সামন্ত-ভূস্বামী শ্রেণীর বিপুল পরিমাণ জমি হস্তগত রাখার বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে শিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার করে বন্টনের কর্তব্য হাজির করেছেন। পশ্চিম বাংলায় একের পর এক কৃষক আন্দোলনের ঢেউ তথা ভূমি সংস্কার কর্মসূচির প্রভাবে এখানে জোতদার-জমিদারদের ব্যবস্থা কার্যত অবলুপ্ত হয়েছে। এই রাজ্যে ৮০ শতাংশের বেশি প্রান্তিক-ছোট কৃষক রাজ্যের মোট কৃষিযোগ্য জমির ৫০ শতাংশ ভোগদখল করে। অন্ধ্র-তেলেঙ্গানার পরিস্থিতি অনেকটা আলাদা।
গ্রামীণা পেডালা সংঘম (জিপিএস) সামন্ত-ভূস্বামী প্রথা বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন জারি রেখেছে। গ্রামীণ গরীব সংগঠনের আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামন্ত-ভূস্বামীদের শিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার করে ভূমিহীন-প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা। বনাঞ্চলে অরণ্যের জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার বিরুদ্ধে এই সংগঠন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
জিপিএস প্রায় তিন দশক ধরে অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে এবং বর্তমানে অন্ধ্র এবং তেলেঙ্গানা রাজ্যে হাজার হাজার গরীব ও আদিবাসীদের সংগঠিত করে লাগাতার জমির জন্য সংগ্রাম সংগঠিত করে চলেছে। জাতি, ধর্ম, অঞ্চল ইত্যাদির ভিত্তিতে গ্রামীণ গরীবদের বিভক্ত করার শাসকশ্রেণীর বিভেদমূলক নীতির বিরোধিতা করে কৃষক জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করছে। রাষ্ট্রের নিপীড়নকে প্রতিহত করে কৃষক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

cover

২৩ মার্চ ছিল গ্রামীণ গরীব সংগঠনের সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ। সমাবেশের আগে কয়েক হাজার কৃষক, আদিবাসীদের এক বর্ণময় লাল পতাকা শোভিত উদ্দীপ্ত মিছিল স্লোগান, চিরায়ত বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান, নাচ সহ শহর পরিক্রমা করে। মিছিল ও সমাবেশে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। সমাবেশে অন্ধ্র-তেলেঙ্গানার প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে নবোদয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীদের নাচ-গান সমাবেশের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ওপিডিআর (গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগঠন) এবং ভারত-চীন মৈত্রী সমিতির প্রতিনিধিরা। কৃষক ও আদিবাসীদের আন্দোলনের চলার পথে ওপিডিআর-এর আইনি সহযোগিতা গ্রামীণ গরীব সংগঠনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রতিটি আন্দোলনকেই গ্রামীণ কায়েমী স্বার্থ ও পুলিশের আক্রমণের মোকাবিলা করে এগোতে হয়। মিছিল ও প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠানে পুলিশ প্রশাসনের অসহযোগিতা ও বিধিনিষেধ বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। পশ্চিম বাংলা সহ সারা দেশে যা বহুল পরিচিত।
২৮ মার্চ ছিল প্রতিনিধি সম্মেলন। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধিরা তাদের পরিচালিত আন্দোলন, আন্দোলনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। সমস্ত প্রতিনিধিই তেলেগু ভাষায় আলোচনা করেন। ভাষার অগম্যতা বাধা হিসেবে দাঁড়ালেও ইংরেজি জানা কতিপয় সাথীদের সাহায্যে জানা যায়, প্রতিনিধিদের মূল বক্তব্য হল— জমি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য কৃষক-আদিবাসী সহ গ্রামীণ জনতার কাছে আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। কৃষকের হাতে জমি ও অধিকারের জন্য, সামন্ত-ভূস্বামী প্রথা বিলুপ্তির জন্য, কেসিআর সরকারের জমি বন্টনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক-কৃষক বিরোধী নীতি ও বিভাজনের নীতি এবং কেসিআর সরকারের জনবিরোধী নীতি প্রতিহত করতে আন্দোলন ছাড়া পথ নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.