বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
বাংলা ভাষায় ‘বিবেক’ শব্দটি সাধারণত ব্যবহার হয় নীতিবোধ বোঝাতে, যা থাকে প্রত্যেকের মনের মধ্যে। “এমন কথা বলতে তোমার বিবেকে বাধল না?” এ প্রশ্ন আমরা যখন কারওকে করি, তখন তার সহানুভূতির অভাব, ন্যায্যতার বোধের অভাবকে বোঝাতে চাই। আগেকার দিনে যাত্রাদলে বিবেকের একটি চরিত্র থাকত, যিনি নাট্যপালার ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝে মাঝে এসে অত্যাচারীর কুকাজে আক্ষেপ প্রকাশ করতেন, এবং পীড়িত, দুঃখীর প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতেন। আদতে সংস্কৃত ভাষায় ‘বিবেক’ মানে হল জল-দুধ পার্থক্য করতে পারার ক্ষমতা, এবং যা ভাল তাকে বেছে নিয়ে গ্রহণ করতে পারার শক্তি। আধ্যাত্মিক জগতে নিত্য-অনিত্যের (যেমন নিত্য আত্মা আর অনিত্য জগৎ) ভেদ করার শক্তি হল ‘বিবেক,’ তাই অদ্বৈত বেদান্তের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘বিবেকচূড়ামণি’। আর জাগতিক অর্থে ‘বিবেক’ ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, কল্যাণ-অকল্যাণের বিচারের ক্ষমতা, এবং শ্রেয় বিকল্পটিকে গ্রহণের শক্তি বোঝায়।
প্রাচীন গ্রিস থেকে আধুনিক ভারত, রাজনীতির ইতিহাস দেখিয়েছে যে দেশের পরিচালনার প্রশ্নে এই বিবেক-শক্তিকে অল্প কিছু প্রভাবশালীর ছোট বৃত্ত থেকে মুক্ত করে গণপরিসরে প্রতিষ্ঠা করতে পারে যে সব দেশ, সে সব দেশই গণতন্ত্র। ভারতের সংবিধান বলছে, দেশের ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণের বিচার হবে সংসদে। সংসদ ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তিপীঠ।
ভারতের মানুষ ভোট দিয়ে সংসদকে তার শক্তি ফিরিয়ে দিলেন। বিতর্ক-বিবেচনা-বিবেক ফের প্রতিষ্ঠিত হল রাজনীতির কেন্দ্রে। এই ফল দেখে মনে হয়, ব্যক্তির মতো, দেশের মানুষও ঠেকে শেখে। ২০১৯ সালে যে বিপুল জনাদেশ একটি দল পেয়েছিল, তার পিছনে সম্ভবত ছিল অনেকের এই ধারণা যে, কথা কম হলে কাজ বেশি হবে। জোটসঙ্গী বা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় সময় নষ্ট না করে দ্রুত আইন পাশ করতে পারলে শাসক দল চটপট তার নীতি কার্যকর করতে পারবে, সংস্কারে গতি বাড়বে।
দেখা যাচ্ছে, কথা সত্যিই কম হয়েছে। সপ্তদশ লোকসভা ইতিহাসে সব চাইতে কম দিন বসেছে (বছরে গড় ৫৫ দিন)। যে ২২২টি বিল পাশ হয়েছে, তার ৩৫ শতাংশ লোকসভায় পেশ হওয়ার পরে এক ঘণ্টারও কম সময় আলোচনার পরে পাশ হয়েছে, ৫৮ শতাংশ পাশ হয়েছে পেশ হওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যে। কথা বলার চেষ্টা দমন করেছে কেন্দ্রের শাসক দল — রাজ্যসভা ও লোকসভা মিলিয়ে ২০৬ জন সাংসদ সাসপেন্ড হয়েছেন। শেষ অধিবেশনে (ডিসেম্বর ২০২৩) এক সঙ্গে ১৪৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। কার্যত বিরোধীশূন্যতার সুযোগে বিনা বিতর্কে সরকার পাশ করিয়ে নেয় গোটা পঁচিশ আইন। তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ফৌজদারি আইনে সংস্কার।
আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজেরও একটা ভূমিকা থাকে। নিয়ম হল, যে কোনও আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সে বিষয়ে মতামত প্রার্থনা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। নাগরিক সংগঠন বা যে কোনও ব্যক্তি সে বিষয়ে মতামত পাঠাতে পারেন, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগও তাঁরা পান। মোদি সরকারের আমলে এই পুরো প্রক্রিয়াটি দেখনদারিতে পরিণত হয়েছিল। কোনও কোনও আইনের খসড়া প্রকাশ করার পর নাগরিক সমাজকে মাত্র পনেরো দিন সময় দেওয়া হয়েছে মতামত জানানোর। ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, কার্যকর-অকার্যকর বিচার না করেই আইন পাশ করে তৎপরতা দেখাতে চেয়েছিল নরেন্দ্র মোদির সরকার। এ হল বিবেকহীনতা, যার অপর পিঠ স্বৈরতন্ত্র।
ভারতের মানুষ দেখছেন, একক শক্তি আরও কার্যকর হবে, এমন ধারণা কেবল গণতন্ত্র-বিরোধী নয়, গণস্বার্থ-বিরোধী। গত পাঁচ বছরে দেখা গেল কী? সংসদে বিতর্ক এড়িয়ে সরকারের যে সময়-পরিশ্রম বাঁচল, তার বহুগুণ বেশি সময় ও শ্রম সাধারণ মানুষকে ব্যয় করতে হল আইনের বিরোধিতা করতে। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন, শ্রম কোডের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন, সিএএ-র বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলন তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত। আইনের ভাল-মন্দের যে বিচার হওয়ার কথা সংসদে, সে কথাগুলো ধর্নায় বসে বলতে হল সাধারণ মানুষকে।
অনেকে এই সব আন্দোলনকে খুব গৌরবান্বিত করে ‘স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জয়’ বলে পতাকা নাড়তে থাকেন। অবশ্যই এই আন্দোলনগুলির গণতান্ত্রিক মূল্য রয়েছে — বিশ্বের যে কোনও অঞ্চলে বিবেকহীন শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সংগ্রাম লড়াই গোটা মানবজাতির কাছে মূল্যবান। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় বিচার করলে দেখা যাবে, ভারতে এ আন্দোলনগুলো নতুন জমি দখলের লড়াই নয়, হারাতে-বসা জমি ধরে রাখার লড়াই। যে সব অধিকার বহু আগেই চাষি-মজুর-নাগরিক পেয়েছিল, সংসদের বিতর্কহীনতার সুযোগ নিয়ে সেগুলো কেড়ে নিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। চাষিরা কেন্দ্রের অন্যায্য আইন বাতিল করতে পেরেছেন, শ্রমিকরা পারেননি। নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগের ব্যাপকতা ও তীব্রতা আপাতত অনিশ্চিত। এ সব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বহু ক্ষয়ক্ষতি বইতে হয়েছে মানুষকে, প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। এ বারে ভোটের ফল অধিকারের হারানো জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা বলে দেখা যায়। সেই উদ্দেশেই ফিরিয়ে আনতে হল বিতর্ক-বিচারের জমি, যার পীঠস্থান দেশের আইনসভা।
কেন্দ্রে নতুন সরকার গঠনে বিজেপির জোটসঙ্গী দুটি দলই (টিডিপি এবং জেডিইউ) যে লোকসভায় স্পিকারের পদ দাবি করেছে, তা বিশেষ বার্তাবহ। শাসককে প্রশ্ন করার অধিকার যাতে সহজে খারিজ না হয়, জোটসঙ্গীরা গোড়াতেই তার চেষ্টা করছে। সরকারে শরিক হলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপির প্রতি অন্তত এ বিষয়ে আস্থা রাখছেন না চন্দ্রশেখর নাইডু বা নীতীশ কুমার।
নেতাদের দুর্নীতির বহর যখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন রাজনীতির কেন্দ্রে ‘বিবেক’ প্রতিস্থাপনের কথা তুললে অনেকে হয়তো হাসি চাপতে পারবেন না। কিন্তু এ বারের নির্বাচন সে দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যত অর্থশক্তি, রাষ্ট্রশক্তি নিয়ে বিজেপি এ বছর নির্বাচনে নেমেছে, যেমন নির্বিচারে তার প্রয়োগ করেছে, তা অভূতপূর্ব। ভারতে নির্বাচনের ইতিহাসে কোনও দলের একক ভাবে এতখানি শক্তি ছিল কি না, সন্দেহ আছে। এমন বিপুল বিনিয়োগ ও শক্তিপ্রদর্শনের ফলে সত্যিই চারশো আসন পার করার কথা ছিল বিজেপির। তবু জনাদেশ বিজেপিকে খর্ব করেছে।
বিরোধী জোটকে ভোট দেওয়ার পিছনে মতদাতার ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত লাভ-ক্ষতির বিচার অবশ্যই রয়েছে — ভারতে এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, এত স্তরে স্বার্থের সংঘাত, যে কোনও এক কল্পিত ‘জাতশত্রু’ খাড়া করেও অধিকাংশের মতকে এক ছাতার তলায় আনা দুঃসাধ্য। তবে স্বার্থের নানা পরস্পর-বিরোধী স্রোতের মধ্যে দিয়েও জনমতের একটা সুনির্দিষ্ট ধারা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে দেশের কল্যাণ-অকল্যাণের বোধও কি নেই? যেমন ব্যক্তির, তেমন জাতিরও, বিবেক এক অন্তর্নিহিত শক্তি, যা প্রবল প্রতিকূলতার মুখে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করে।
ভারতে এই সামূহিক বিবেক-বোধের শিকড় গভীর। তা নিজের প্রাণরস সংগ্রহ করে রামায়ণ-মহাভারতের মতো মহাকাব্য থেকে, ধর্মগ্রন্ত ও দর্শনের থেকে, অগণিত সাধু-সন্ত, সদাচারী ও পরার্থপ্রাণ মানুষের জীবন, তাদের গান ও কবিতা থেকে। আধুনিক ভারতে রাজনীতির চর্চা যাঁরাই করেন, তাঁদের পথ চলা শুরু করতে হয় কয়েকটি বিতর্ক থেকে। যেমন, অসহযোগ, অহিংসা নিয়ে মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংলাপ, জাতিভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে গান্ধী ও বাবাসাহেব আম্বেডকরের বিতর্ক, দ্বিজাতিতত্ত্ব বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন বনাম গণতান্ত্রিক উদারবাদ, প্রভৃতি। নানা মতের মুখপাত্র হিসাবে সমাজ ও রাজনীতিতে যাঁরা বহুচর্চিত, তাঁদের একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তাঁরা নিজেদের অন্তরের দোলাচলকে সকলের কাছে তুলে ধরেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, অরবিন্দ, অম্বেডকর, সুভাষচন্দ্র, নানা কমিউনিস্ট নেতারা তাঁদের নানা আদর্শগত এবং ব্যক্তিগত নিজের ভ্রান্তি, সংশয় ও তা নিয়ে বিচারের কথা লিখেছেন। তাঁদের চিঠিপত্রে, জীবনীতেও তা প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রান্ত প্রমাণিত হলে, সঙ্কীর্ণতা বা পক্ষপাত ধরা পড়লে নিন্দিত, হাস্যাস্পদ হবেন, এই ভেবে তাঁরা কুন্ঠিত হননি। বাইরের গণ-আন্দোলনের চালিকাশক্তি যে বিবেকের আন্দোলন, অর্থাৎ কর্তব্য-অকর্তব্য বিষয়ে দোলাচল, তা তাঁরা মানতেন।
বিখ্যাত, ব্যতিক্রমী নেতাদের মধ্যেই এই বিবেক-চর্চা সীমিত ছিল, এমন নয়। বাংলার বিপ্লবীরা সংখ্যায় অল্প হয়েও একটা গোটা জাতির অন্তর স্পর্শ করতে পেরেছিলেন, সে কেবল তাঁদের আত্মত্যাগের জন্য নয়, তাঁদের বিবেকদীপ্ত চিন্তার উৎকর্ষে। জেল থেকে লেখা তাঁদের চিঠি পড়লে স্পষ্ট হয়, আবেগে গা ভাসিয়ে তাঁরা হাতে অস্ত্র তুলে নেননি, নিয়েছেন শ্রেয়-প্রেয় বিচারের পরে। গান্ধীবাদী আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলন, দু’দলেই এমন মানুষ ছিলেন অগণিত। তর্ক করার জন্য তাঁরা নিগৃহীত হয়েছেন, কিন্তু হাল ছাড়েননি। সম্প্রতি হাতে এসেছে এক স্বল্পপরিচিত বিপ্লবীর আত্মজীবনী। বিধুভূষণ মজুমদার (১৮৯৮-১৯৬৫) ফরিদপুরের ছেলে, যুগান্তর পার্টিতে ছিলেন, স্কুলজীবন থেকেই বিপ্লবী দলের সংগঠক। ১৯১৯ সাল, যখন তিনি প্রথম শ্রেণীর (এখন দশম শ্রেণী) ছাত্র, সেই সময়ে যুগান্তর পার্টির এক নেতার সঙ্গে তাঁর বিতর্ক হয়।
“আমার ধারণা ছিল বিপ্লবী কর্মীরা যত বেশি জনসাধারণের সহিত মিলিতে পারিবে, সুখে দুঃখে সমভাবে তাহাদের সমব্যথী হইতে পারিবে, ততই তাহারা জনসাধারণের চিত্ত জয় করিতে পারিবে। ... শুধু কতিপয় কর্মীর অক্লান্ত চেষ্টা ও চরম আত্মোৎসর্গই যথেষ্ট নহে, ইহার সঙ্গে চাই নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণ মনের সংযোগ।” এর বিপরীতে ‘পূর্ণদা’ নামে এক নেতা মনে করতেন “... বিপ্লবীদের জীবনে শুচিতা ও ধর্মভাব তাহাদের কর্ম প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করিয়া বৈপ্লবিক জীবনের দুর্ধর্ষ বেপরোয়া মনোভাবের উপরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়া অজ্ঞাতসারে কর্ম বিমুখ করিয়া তোলে, স্বপ্নবিলাসী করিয়া দেয়। ... তাহারা ভাল মানুষ হয়, কাজের লোক হয় না।” দীর্ঘ দু’রাত বিতর্ক হয়, তারপর সভা ডেকে বিধুভূষণকে বহিষ্কার করা হয়। বিধুভূষণ যুগান্তর ত্যাগ না করেই নতুন সংগঠন শুরু করেন (‘বিপ্লবী বিধুভূষণ মজুমদারের অপ্রকাশিত আত্মজীবনী’, ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, ২০২৪)।
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে কত ভাঙন, কত বিশ্বাসঘাতকতা, কত ক্ষুদ্রতা-ব্যর্থতা। সেই পাঁকের মধ্যেও ঝকঝক করে ওঠে এই বিচারের মণিমাণিক্য। দু’রাত ধরে বিতর্ক চলছে, বিপ্লবীর চরিত্র কেমন হওয়া উচিত? দু’জন বক্তা, তাদের ঘিরে অনেক শ্রোতা। স্বাধীনতার অমৃতকালে এমন বিতর্ক কোথায়? উন্নয়ন কেমন হবে, শিক্ষা কেমন হওয়া দরকার, কেমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাই, আর্থিক বৈষম্যের ক্রমবর্ধমানতা উপকারী নাকি ক্ষতিকারক, অনুদান বৃদ্ধিতে কল্যাণ নাকি অকল্যাণ, তা নিয়ে নেতাদের নিজেদের মনে কী সংশয়, দলের ভিতরে তাঁরা কী আলোচনা করছেন, কোন বিষয়ে মতের পার্থক্য হচ্ছে, সে সব কিছুই কেউ জানতে পারছে না। তাঁরা যতই নিজেদের একে অপরের চাইতে ভিন্ন বলে দেখাতে চাইছেন, ততই মানুষের চোখে তাঁদের মিলটাই প্রকট হচ্ছে। তাঁরা সবাই সংশয়হীন, অভ্রান্ত, প্রশ্নের উর্ধ্বে।
নরেন্দ্র মোদি খুব খুশি যে, তিনি জওহরলাল নেহরুর মতো পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। দশ বছর নেহরুর ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে কাটালেন তিনি। তাঁর সঙ্গে নেহরুর পার্থক্য এই যে, মোদির সংশয় কীসে, কী নিয়ে তিনি নিজের সঙ্গে নিজে তর্ক করেছেন, তা আজ অবধি জানা গেল না। আরএসএস-বিজেপির ঘোষিত অবস্থানের বাইরে মোদি কখনও কিছু বলেননি, বিরোধী বা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা। অপর দিকে, নেহরু কেবল যে গান্ধীর সঙ্গে অর্থনীতির গতি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক করেছেন তা-ই নয়, মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভারতীয়দের মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব নিয়ে তাঁর বিতর্ক হয়েছে। নেহরুর কথা ও কাজের অনেক কিছুই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তিনি যে কেবল সমর্থন পাওয়ার জন্যই মুখ খোলেননি, বিতর্কে নেমেছিলেন এবং চিন্তার ক্ষেত্রে নিজের সবলতা-দুর্বলতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি, গণতন্ত্রে এর মূল্য কম নয়। অন্য দিকে, মোদি এত দিন ধরে ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে কেবলই প্রচার করে এলেন। যা করছেন তা কেন করছেন, কেন তা ঠিক কাজ, আর কিছু করলে আরও ভাল হতো কি না — এ নিয়ে তিনি একটা কথাও বলেননি। তিনি যে ‘মানবত্ব’ থেকে ‘দেবত্ব’-এর দাবি করতে পারলেন, তার অন্যতম কারণ তাঁর এই সংশয়হীনতা। গণতন্ত্রে যা বিবেকহীনতার অপর নাম।
এই নির্বাচন এক দুর্বল, জোড়াতালি দেওয়া জোটকে অনেকখানি শক্তি দিয়ে ‘সংশয়াতীতের শাসন’ থেকে দেশকে উদ্ধার করল। সবার কথা শোনাই শাসকের কাজ, সে ভাবই আইন পাশ হবে, তা প্রতিষ্ঠা করল।
তবে আইনসভার এই প্রত্যাবর্তন থেকে রাজ্যগুলি কতটা শিক্ষা নেবে, সে প্রশ্ন ওঠা দরকার। একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ আটটি রাজ্যে ২০২১ সালে বিধানসভায় যতগুলি বিল পেশ করা হয়েছিল, তার সবগুলি পাশ হয়েছে বিল পেশ করার দিনই। ‘ফিনান্স বিল’ অর্থাৎ বাজেট, পুলিশ, পূর্ত বিভাগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে সরকারি বরাদ্দ কোনও আলোচনা ছাড়াই পাশ হয়েছে যাচ্ছে কী করে, এ প্রশ্নও আর কেউ তুলছে না। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ওয়েবসাইট দেখাচ্ছে, অধিকাংশ প্রশ্ন করছেন শাসক দলের বিধায়করা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দরিদ্রের মধ্যে সম্পদবণ্টনের নানা প্রকল্পের জন্য যে সমর্থন পেয়েছে, তাকে বিবেকহীনতার সমর্থন বলে ধরে নেওয়া চলে না। এ রাজ্যের আইনসভাকেও ফিরতে হবে বিচারে, বিবেকে। সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। কোন আলোচনার মধ্যে দিয়ে গিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তা-ও জানার অধিকার রয়েছে দেশের মানুষের। বিচার-বিতর্কের বৃত্ত যত ক্ষুদ্র হবে, ততই কুক্ষিগত হবে সম্পদ, তার প্রমাণ দেশবাসী বারবার পেয়েছে। আইনসভায় বিতর্ক না করে সিদ্ধান্ত নয়, সংবিধানের এই গোড়ার কথায় দেশের সব সরকারকে ফিরতে হবে। না হলে দেশের মানুষ অধিকারের হারানো জমি ফিরে পাবে না।
----------------------------------------------------
২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদদের ৫০৪ জন (৯৩%) কোটিপতি।
----------------------------------------------------
সাংসদদের ২২৭ জনের (৪২%) সম্পদ ১০ কোটি টাকা বা তার বেশি।
----------------------------------------------------