বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

মে দিবস আর অধিকারহীনতার কথা

মে দিবস আর অধিকারহীনতার কথা

দেবাশিস আইচ

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— অধিকার কেড়ে নিতে হয়। কেড়ে যে নেব তবে তো থাকতে হবে অধিকার বোধ। ভোট দেওয়ার অধিকার এক অভিবাসী শ্রমিক যেমন বোঝেন, তেমনই বোঝেন কি তাঁর প্রাপ্য কী, আর কতটুকু? বেশ কিছু আন্তঃরাজ্য শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে এই প্রশ্নের উত্তরটুকু জেনে নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সময় মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের জন্য প্রণীত আন্তঃরাজ্য মাইগ্রেন্ট শ্রমিক আইন, নির্মাণ শ্রমিক বিষয়ক আইন, অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা আইন-এর কথা তুলি আর জনে জনে জিজ্ঞাসা করি, তাঁরা প্রথমে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, “এই প্রথম শুনলাম।” সময়টা করোনাকালের প্রথম বছর। ততো দিনে প্রায় ১০-১২ লক্ষ শ্রমিক বাংলায় ফিরে এসেছেন এবং আরও আসছেন। সরকারি হিসেব মতো সংখ্যাটা শেষ পর্যন্ত ২০ লক্ষে দাঁড়াবে।
আমরা যখন এ-ফোর মাপের ১২-১৫ পৃষ্ঠার প্রশ্নপত্র হাতে তাঁদের পড়া ধরছি। কী নাম, কোথায় কাজ করতে গিয়েছিলেন, কী কাজ, কত মজুরি, কীভাবে ফিরলেন… এমন নানা প্রশ্নের জবাব চাইছি, তখন তাঁদের কারও মনে ঘুরছে— এই সাতকাহন উত্তর দিয়ে কি কাজ পাওয়া যাবে? আবার অনেকেই ফের ফিরে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন। ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। আবার তখনও আতঙ্কে বিহ্বল আরও অনেকেই এ রাজ্যেই খুঁজছেন কাজের সুযোগ। সময়টা ২০২০ সালে জুলাই-অগস্ট মাস। যাঁরা ফিরছেন তাঁরা কেন ফিরে যাচ্ছেন? একটাই সাধারণ উত্তর— এখানে কাজ নেই। এই পরিবেশে অধিকার, আইন-টাইন নিয়ে কথা কিছু এগোয় না। ওই তো একটাই লাইন লিখবার— এই প্রথম শুনলাম।
সরকারি আইন আছে অথচ সরকারের কাছেই এই শ্রমিকদের কোনও তথ্য থাকে না। গ্রামকে গ্রাম হাজারে হাজারে শ্রমিক দেশ-গাঁ ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে কাজের সন্ধানে যায়। কোথায় যায়, কী কাজ, কেমন তাঁদের থাকা-খাওয়া, কতই-বা মজুরি, অসুস্থ হলেই-বা তাঁকে কে দেখে এর কোনও পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ রাখে না কোনও সরকার। ২০১৯ সালে মুম্বাইয়ের ‘ইন্ডিয়া মাইগ্রেশন নাও’ বিভিন্ন রাজ্যর শ্রমিক নীতি বিশ্লেষণ করে আন্তঃরাজ্য অভিবাসী শ্রমিকনীতি সূচক প্রকাশ করেছিল। যে বিষয়গুলির উপর ভিত্তি করে তারা বিশ্লেষণ করে এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে, তার মধ্যে রয়েছে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শ্রমনীতি, শিশুকল্যাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন, আবাস ও পরিচয়, সমাজকল্যাণের মত বিষয়। দেখা গেছে অভিবাসী শ্রমিক-অনুকূল নীতিতে কেরালার স্থান প্রথম। সে রাজ্যের প্রাপ্ত স্কোর ১০০-তে ৬২। এরপর রয়েছে মহারাষ্ট্র ও পঞ্জাব। তাদের স্কোর যথাক্রমে ৪২ ও ৪০। বাকি গুজরাত, তামিলনাড়ু, দিল্লি, হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলির স্থান আরও নিচুতে। অর্থাৎ, ওই যে আইনের কথা বলা হচ্ছিল, অধিকারের কথা তার ছিটেফোঁটাও মেলে না ভিনরাজ্যে যাওয়া শ্রমিকদের। নির্মাণ শ্রমিকদের থাকার জায়গা বলতে সাইটের ধারে সারিবদ্ধ ঝুপড়ি। কোথাও এক ইটের বা টিনের দেওয়াল, মাথায় টিনের ছাউনি। এবড়ো-খেবড়ো মেঝেতে চট-কার্ডবোর্ডের উপর বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া কিছু পেতে শোয়া। তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্রের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে যেমন বলেছিলেন অমলেশ ভুঁইয়া, বাসুদেব বসন্তরা। কাজে গিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকেনও অনেকেই। একটি ঘরে চার-ছ’জন। জনপ্রতি ১১০০-১২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে। আবার মহারাষ্ট্রে, হায়দরাবাদে ওস্তাগরদের কাছে কাজ করতে যাওয়া জরি কারিগররা শ্রমিক মহল্লার মধ্যে কারখানারই কোনও এক হল ঘর ভাড়া করে থেকে যেতেন একসঙ্গে ৩০-৪০ জন। মাইগ্রেন্ট মজুরদের জন্য যে, ‘থাকার জায়গা’-র কথা বলা হয়েছে, যা নাকি দেবে নিয়োগকর্তা, তা আসলে কোনওরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই। ওই ঘুপচিতে স্বাস্থ্যবিধান, পরিচ্ছন্নতা ওই যাকে সরকারি ভাষায় ‘হেলথ অ্যান্ড স্যানিটেশন’ বলা হয়— তা এক সুবিশাল ঠাট্টা।
যে আইনের নামই শোনেননি শ্রমিকরা সেই আইনে গোটা গোটা করে লেখা আছে, ভিনরাজ্যে যাবার ‘স্থানচ্যুতি ভাতা’ দিতে হবে। বাড়ি ফেরার ভাতাও। বিনি পয়সায় আসা-যাওয়ার এমন সুযোগ কখনও মেলেনি মুর্শিদাবাদের মহিবুল বিশ্বাস কিংবা উলুবেড়িয়ার নিজাম মণ্ডলদের। লকডাউনে মজুরি, ভাড়া ঘরের ছাদ, সাইটের চালা হারিয়ে কীভাবে শ্রমিকরা গ্রামে ফিরেছেন তার নানা কাহিনি আমরা পড়েছি। শ্রমিকের অভাবে কারখানার চুল্লি যখন টিম টিম করে জ্বলছে, রাস্তা, সেতুর কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, শিল্পমহলে ত্রাহি ত্রাহি রব তখন লকডাউনের সামান্য শিথিল করিয়ে শিল্পপতি, নিয়োগকর্তারা ঠিকাদার এমনকি লেবার অফিসারদের মাধ্যমে শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়েছেন ট্রেনের টিকিট, আগাম ভাড়া দিয়ে বাসের পর বাস বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শ্রমিকদের। ট্রেনের টিকিট অমিল হলে এমার্জেন্সি কাজে প্লেনের টিকিট কেটেও পাঠিয়েছে বড় বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর দায় যেমন আছে, পেটের দায়ও তো কিছু কম নয়। তাই নির্দিষ্ট কাজের প্রতিশ্রুতি মিললেই অনেকেই তখন দলে দলে পাড়ি দিতে শুরু করেছেন। দায়ে পড়ে তখন ‘স্থানচ্যুতি’-র প্লেনভাতাও দিয়েছেন নিয়োগ কর্তারা।
কাজের কাজটি করেছিল ঝাড়খণ্ড সরকার। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যখন ঘোষণা করছেন, এক জন শ্রমিককেও কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে যেতে হবে না। তারা নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেছে। আর তাঁদের কষ্ট পেতে দেব না। এখানে কাজের কোনও অভাব নেই। জুন মাসের ৩ তারিখ যখন তিনি এ কথা বলছেন, বাম শ্রমিক ইউনিয়ন সিটু ‘পরিযায়ী শ্রমিক’-দের ইউনিয়ন গড়ছে, তখন ঝাড়খণ্ড সরকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীন বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন (বিআরও)-এর সঙ্গে রীতিমতো দর কষাকষি করে জানিয়ে দিয়েছে ঠিকাদারদের (এখানে বলা হয় মেট) চুক্তিপ্রথায় এক জনও ঝাড়খণ্ডী শ্রমিক বিআরও-র কাজে যাবে না। আগে বলো আইনমাফিক চুক্তি করবে; মেটপ্রথা বাতিল করবে; শ্রমিকদের নির্দিষ্ট মজুরি সরাসরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ফেলবে, মেটদের হাতে দেবে না; কর্মস্থলের কাঠিন্য-সূচক ও দক্ষতা মেনে মজুরি দেবে; বরফ ছাওয়া পাহাড়ের মাথায়, হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় কাজ করার জন্য উপযুক্ত পোশাক দেবে, চিকিৎসার খরচ, দুর্ঘটনাজনিত সুযোগ-সুবিধা দেবে; বিনাভাড়ায় আসা-যাওয়া, থাকার জায়গা, রেশন দেবে তবেই যাবে শ্রমিকরা সীমান্তের রাস্তাঘাট সারাতে, নচেৎ নয়। যদি রাজি হও এসো মউ সাক্ষর করো। ততোদিনে, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব রেলবোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি লিখে ১১টি ট্রেন চেয়ে রেখেছে। প্রায় ১২ হাজার শ্রমিককে নিয়ে যাওয়া হবে কাশ্মীর, লাদাখ এবং উত্তরভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে।
ঝাড়খণ্ড সরকারের চাপে শেষ পর্যন্ত সব দাবিই মেনে নিল বিআরও। মউ হল না, কেন না তা হতে হলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অনুমতি লাগবে। সে সময় হাতে নেই কিন্তু বলা হল ২০২১-২২ অর্থবর্ষ থেকে ওই রাজ্যের শ্রমিকদের সরাসরি নিয়োগ করবে বিআরও। যে দাবিগুলি করা হয়েছিল তা ‘ইন্টার-স্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কমেন (রেগুলেশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশনস অফ সার্ভিস) অ্যাক্ট, ১৯৭৯ এবং সেন্ট্রাল রুলস, ১৯৮০ অনুযায়ী শ্রমিকদের প্রাপ্য। ১২ জুন আইনি বর্মে, নিয়োগ-নথিতে সুরক্ষিত হয়ে ১৬৪৮ জনের প্রথম দলটি ঝাড়খণ্ডের দুমকা স্টেশন থেকে লাদাখ রওনা দিয়েছিল।
এমন এক পদক্ষেপ করল ঝাড়খণ্ড এই জন্যই যে, লকডাউনের সময় জনমানবহীন পাহাড়ি পথের মাঝে শ্রমিকদের ফেলে পালিয়েছিল মেটরা। কোনও দায় নেয়নি বিআরও। মজুরি মার গিয়েছে। যেমন গিয়েছে দেশের নানা প্রান্তের অধিকাংশ শ্রমিকের। ভাল সময়েও মেটরা সঠিক মজুরি দিতো না। ইচ্ছেমতো দিতো, দায় নিতো না বিআরও। লকডাউনে এমনই পরিস্থিতি তৈরি হল যে, দুর্গম অঞ্চল থেকে হেলিকপ্টার ভাড়া করে শ্রমিকদের উদ্ধার করতে হয়েছে ঝাড়খণ্ড সরকারকে।
এমনই কেটেছে প্রথম লকডাউনের মে দিবস। ২০২০ সালের ১ মে কেন্দ্রীয় সরকার বাড়ি ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের জন্য প্রথম ‘শ্রমিক ট্রেন’ চালু করে। শুধুমাত্র, গুজরাত থেকেই বাড়ি ফেরার জন্য ততো দিনে আবেদন জানিয়ে বসে ছিল ২৫টি রাজ্যের ২০,৯৫,৪২৮ জন। তাঁদের মধ্যে এ রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন ৫১,৯৪৩ জন। বাংলার শ্রমিক ও অন্যান্য পেশার মানুষদের বাড়ি ফেরার জন্য এ রাজ্য সরকারিভাবে ট্রেন প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছিল আরও ১৪ দিন বাদে। ততো দিনে অবশ্য নানা রাজ্য থেকেই এ রাজ্যের সরকারকে নিমরাজি করিয়ে কিংবা কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ঢুকতে শুরু করে দেয়। তা নিয়েও রাজ্য-কেন্দ্র রাগারাগি, চিঠি চালাচালি কিছু কম হয়নি।
শেষ করি ২০২০-র মে দিবসে ৩১ জন বাংলার শ্রমিকের চূড়ান্ত হেনস্থার কথা দিয়ে। এই ৩১ জন ছিলেন ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ জেলার চুহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের এক কোয়ারান্টিন সেন্টারে। ১ মে তাঁদের ওই সেন্টার থেকে একরকম তাড়িয়েই দেওয়া হয়। বারবার তাঁরা আবেদন জানিয়েছেন, অন্তত পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অবধি পৌঁছে দেওয়া হোক। কেউ কানে দেয়নি সেই কাতর আবেদন। শেষ পর্যন্ত কোনও উপায় না দেখে হাঁটতে শুরু করে দলটি। বিকেলে তাঁরা পৌঁছন মেদিনীপুরের কাছে চকসুলিয়া আন্তঃরাজ্য সীমান্তে। সেখানে ওড়িশা পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়। পুলিশ জানায় পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার কোনও অনুমতি তাঁদের কাছে আসেনি। তাঁরা রাস্তাতেই বসে পড়েন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমতির আশায়। রাত পৌনে আটটায় ফের তাঁরা পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিয়েছিলেন ওড়িশার চুহাটের উদ্দেশে। সমাজমাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঝাড়গ্রাম প্রশাসন ২ মে বাস পাঠিয়ে রাজ্যে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.