বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

এসআইআর: ‘অনুপ্রবেশকারীর’ মিথ্যা রাষ্ট্রীয় বয়ান

এসআইআর: ‘অনুপ্রবেশকারীর’ মিথ্যা রাষ্ট্রীয় বয়ান

অতনু চক্রবর্তী

photo

এসআইআর-কে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতি ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সাংবিধানিক নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার হুঙ্কার দিলেন, ‘এসআইআর বিরোধিতায় পথে নামলে গুলি চলবে’। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানালেন, ‘বাংলাতে এসআইআর হবে। অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হবে। এটাই আমাদের কর্মসূচি।’ আর, জাতীয় নির্বাচন কমিশন (ইসি) কিছু ঘোষণা করার আগেই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা জানালেন, ‘এ রাজ্যে ভোটার তালিকায় ২.৪ কোটি অবৈধ নাম ঢুকে রয়েছে, যা বাতিল করা হবে।’ কিছুদিন আগে দিল্লিতে একটি সভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ডিটেক্ট (চিহ্নিতকরণ), ডিলিট (ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ) ও ডিপোর্ট (বিতারণ) — এই তিন ডি’র সূত্র ধরে দেশকে অনুপ্রবেশকারী মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। আর, ভোটার তালিকার ‘শুদ্ধিকরণ’ এর বাহানায় এসআইআর এর সার্জিকাল স্ট্রাইকের নিশানায় যে সংখ্যালঘু বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিক, নারী, দরিদ্র তফশিলি জাতি-জনজাতি ভোটাররাই রয়েছেন, তারাই যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা বিহারের এসআইআর প্রমাণ করেছে।
এই রাজ্যের রাজ্যপাট দখলে মরিয়া বিজেপির কর্মসূচিকে বাধা দিলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালানো, এসআইআর এর কাজটি সম্পন্ন না হলে, ৪ মে, ২০২৫ সময়সীমার ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ শেষ না করলে, রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন বন্ধ করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার আগাম হুঁশিয়ারি বিজেপির তাবড় নেতারা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি কত কোটি অনুপ্রবেশকারীর নাম এখন এই রাজ্যের ভোটার তালিকায় রয়েছে যা বাদ দিয়ে শুদ্ধিকরণ করতে হবে, তাও অনুগত ইসি’কে জানিয়ে পরোক্ষে নির্দেশ দেওয়া হল।
বিহার নির্বাচনের ঠিক আগে অমিত শাহ বলেছিলেন, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা বিহার থেকে অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াব। এই কথা তিনি বলেছিলেন বিহারের আরারিয়ায়, বিহারের সীমাঞ্চলের চারটি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের অন্যতম। মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক জ্ঞানেশ কুমার গর্জন করে জানান, অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর লক্ষ্যই এসআইআর এর গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
এবার, রাজ্যের প্রতিটি জেলায় ইসি ২০০২ এর ভোটার লিস্টের সঙ্গে এ বছরের ভোটার তালিকার ‘ম্যাপিং ম্যাচিং’ শুরু করে দিয়েছে। ইসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনো পর্যন্ত ৭টি জেলার ম্যাপিং ম্যাচিং সম্পন্ন করার পর দেখা যাচ্ছে ২০২৫ এর ভোটার তালিকার নামের সঙ্গে ২০০২ এর তালিকায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ নাম ম্যাচ করছে না। ঝাড়গ্রাম জেলায় দুটি তালিকা মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে মাত্র ৫১.৩৬ শতাংশ নাম ম্যাচ করছে, যা ৭টি জেলার মধ্যে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে নিচের দিকে রয়েছে। আর সর্বোচ্চ হল পাহাড়ি জেলা কালিম্পং — যেখানে ৬৫.২৭ শতাংশ নাম ম্যাচ করেছে।
ইসির ঘোষণা, আলিপুরদুয়ারে ম্যাচিং এর হার ৫৩.৩৩ শতাংশ, কলকাতা উত্তরে ৫৫.৩৫ শতাংশ, মালদা ৫৪.৪৯ শতাংশ, পুরুলিয়া ৬১.২৯ শতাংশ এবং মেদিনীপুরে ৬২.৯৪ শতাংশ। চারটি খুবই জনবহুল জেলা — উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা দক্ষিণ এবং নদিয়ায় এই ম্যাপিং ও ম্যাচিং এর হার কত দাঁড়াল, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। এই সমস্ত প্রাথমিক ইঙ্গিত থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এ রাজ্যেও বিপুল সংখ্যক ভোটারদের নাম তালিকা থেকে মুছে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে।
যে অনুপ্রবেশকারী নিয়ে এত হৈচৈ তুলল বিজেপি ও নির্বাচন কমিশন, বিহারে এসআইআর শেষে তার ফলাফল কি?
বিহার সীমাঞ্চলের চারটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলা — আরারিয়া, কাটিহার, কিষাণগঞ্জ ও পুর্ণিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়ে আপত্তি জানিয়ে মাত্র ১০৬টি দরখাস্ত জমা পড়ে, যা নির্বাচন কমিশনের ৭ নং ফর্ম মারফত দেওয়া হয়। এই সমস্ত দরখাস্ত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ৪০টি নাম ইসি বাদ দেয়। প্রশ্ন হল, বাদবাকি নামের ক্ষেত্রে কি হল? ‘অনুপ্রবেশকারী’র অভিযোগ কতটা সত্যি? এদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিমদের সংখ্যাই বা কত?
ইসি’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোটা সীমাঞ্চলের চার জেলায় ২৪টি বিধানসভা ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব প্রশ্নে সন্দেহ তুলে দরখাস্ত জমা পড়ার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি আরারিয়া বিধানসভা ক্ষেত্রে — মোট ২৯! আর উল্লিখিত ১০৬টি দরখাস্তের মধ্যে ৫৯ জন সফলভাবে নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ নথি পেশ করায় চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় নাম থেকে যায়। কিন্তু, তাদের এপিক নং দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে গিয়ে যখন দেখা হয়, তখন এই ৫৯ এর মধ্যে মাত্র ৩৫ জনের নাম পাওয়া যায়।
১০৬টি নাম নিয়ে যে আপত্তি ছিল, তার মধ্যে ৫৯ জন নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করে, ভোটার তালিকায় তাদের নাম ওঠে, ৪৭ জন তা দেখাতে না পারায় নাম বাদ যায়। আর এই ৪৭ জনের মধ্যে ২৮ জন হিন্দু, ১৯ জন মুসলিম। আর ৪৭টি নামের মধ্যে ৭ জন প্রয়াত (৩ জন হিন্দু, ৪ জন মুসলিম)। সীমাঞ্চলে এসআইআর থেকে যে ৬৪,০৫০ নাম বাদ যায়, তার মধ্যে ২৬,৯৯৩ জন বাদ যায় স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য। মোট ২০ শতাংশ বাদ যায় মৃত্যুর কারণে। কিন্তু প্রধান যে লক্ষ্য নিয়ে বিহারের এসআইআর শুরু হয় তা ছিল অনুপ্রবেশকারী বিতারণ। সেই সংখ্যাটা সবশেষে দেখা গেল মাত্র ০.১৭ শতাংশ (তারা ভারতীয় নয় বলে চিহ্নিত করা হয়। এই সংখ্যাটি ৪০, যার ২৫ জন হিন্দু, ১৫ জন মুসলিম)!
বুঝতে অসুবিধে হয় না, রোহিঙ্গা সহ অনুপ্রবেশকারীরা বিহার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বলে যে চিল চিৎকার করে বিজেপি ও ইসি, তা যে কত বড় ভাঁওতা তা প্রকাশ হয়ে পড়ল।
নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে সীমাঞ্চলে মোট যে ৯,৫৬৭ টি (১৪ শতাংশ) দরখাস্ত জমা পড়ে, তাতে কারণ উল্লখ ছিল না, অর্থাৎ কেন নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন করা হচ্ছে। যে সমস্ত ব্যক্তিরা নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের নাম বা কাদের নাম বাদ গেল, সেই সমস্ত বিবরণ না দিয়ে স্রেফ বলা হয়েছে, ‘ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না’ বা আনডিফাইন্ড। (তথ্যসূত্র: দ্য কুইন্ট, বিকাশ কুমার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫)।
ভোটার তালিকার শুদ্ধিকরণের ঢক্কানিনাদ দিয়ে বিহারে শুরু হওয়া এসআইআর বাস্তব জীবনে প্রতিভাত হল বিপুল সংখ্যক ভোটারকে ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে হরণ করার এক শয়তানি অভিযান হিসাবে। বিহার হল একমাত্র হিন্দি ভাষী রাজ্য, যেখানে বিজেপি দীর্ঘদিন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় নেই। তাকে অন্য আঞ্চলিক দলের ছোট শরিক হয়ে থাকতে হয়েছে এতদিন। এর অবসান ঘটাতে এবারের নির্বাচনে প্রথম যে পদক্ষেপ বিজেপি নিল তা হচ্ছে নীতীশের জেডিইউ’র সঙ্গে সমান সংখ্যক আসন বাটওয়ারা করে বুঝিয়ে দেওয়া যে বিজেপি বিহারে আর ছোট শরিক হয়ে থাকবে না।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে ইসিকে কয়েকবার আদালতে হাজির হতে হয় এসআইআর ধরনের এক অভিযানকে কেন্দ্র করে। ওই পর্বে বোম্বে (এখন মুম্বাই) ও দিল্লিতে বহু সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিককে নোটিশ ধরিয়ে ইসি জানায় যে তাদের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নির্দিষ্ট নথি জমা দিয়ে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা অন্যান্য রাজ্য থেকে এই শহরগুলোতে এসে বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করতেন। যে সমস্ত নথিপত্র ইসি চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং সুপ্রিম কোর্ট ওই সমস্ত নোটিশ বাতিল করে ন্যায্য পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণের নির্দেশ দেয় ইসিকে (লালবাবু হুসেন বনাম ইআরও, ১৯৯৫)। সুপ্রিম কোর্ট ব্যাখ্যা করে জানায়, মর্জিমাফিক হাতে গোনা কয়েকটি নথির উপর জোরাজুরি না করে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সমস্ত ধরনের নথিকেই বিবেচনাধীন করতে হবে। শুরু করতে হবে এখান থেকে যে, তারা সকলেই নাগরিক।
এর বিপরীতে ইসি কয়েকটি মাত্র নথি দেখিয়ে ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণের উপর জোর দেয়। হর্ষ কুমার কিছুদিন আগে বিহারে অনুষ্ঠিত জাতপাত গণনা (২০২৩) এবং তৎসংক্রান্ত ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান (২০০৯) থেকে দেখান যে, বিহারে ইসি যে ১১টি নথি চেয়েছে তার একটিও অধিকাংশ গরিব বিহারবাসীর কাছে নেই। আদালত এর আগেও একাধিকবার জানায়, ভোটার তালিকায় প্রথম নাম তোলার সময় এই ইসিই বিস্তর নথি যাচাই করেই নাম অন্তর্ভুক্ত করে। এখন ইসি কোন যুক্তিতে তারই তৈরি করা তালিকা অস্বীকার করবে?
বিহারের এসআইআর জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কার্যকর করার এক উপায়, খিড়কি দরজা দিয়ে যে হিংস্র নেকড়েটি ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে — এবার সারা দেশেই সে দাপিয়ে বেড়াবে। কেরলে শাসক জোট ও প্রধান বিরোধী জোট একত্রে বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবিত এসআইআর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে এটা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে। বাংলায় সমস্ত বামদল একত্রে কেন্দ্রীয় ইসিও দপ্তরে বিক্ষোভ ও দাবিসনদ পেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিহারে বাদ পড়ল ৪৭ লক্ষ ভোটার, কিন্তু তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হল না। আর এটাকেই ইসি ‘ত্রুটিমুক্ত, নিখুঁত’ ভোটার তালিকা বলে আখ্যা দিল। যে সুপ্রিম কোর্ট অনেক তর্জন গর্জন করেছিল, সেই আবার ইসি’র উপর চূড়ান্ত আস্থা প্রকাশ করে জানাল যে আদালতের পরিপূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে যে ইসি তার দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন, আর অবশিষ্ঠ কাজটিও তারা সম্পন্ন করবে। ভারতে কর্পোরেট ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গঠনের অপর নাম হিন্দু রাষ্ট্র — আরএসএস এর শতবর্ষে বলিষ্ঠ কদমে এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি চলছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.