বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
২৫ জুন ১৯৭৫। ওই দিনে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। ওই দিনটিকে সংবিধান হত্যার দিন হিসাবে বিজেপি দলের পক্ষ থেকে পালন করা হয়। অথচ তার আগের দিন ২৪ জুন তাদের নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন বিহার নির্বাচনের প্রাক মুহুর্তে নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণের লক্ষ্যে এক নয়া ফরমান জারি করল। নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হত্যার দিনের সূচনা হল। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ডেপুটি নির্বাচন কমিশনার সঞ্জয় কুমার বিহারের প্রধান নির্বাচন অফিসারকে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR) চালু করার নির্দেশ জারি করলেন। এই এসআইআর ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে
সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রপতি একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ বাকি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন এবং তা অবশ্যই ৩ জনের নির্বাচক কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী হতে হবে। এতকাল কমিটিতে থাকতেন: ১) দেশের প্রধানমন্ত্রী ২) বিরোধী দলনেতা ৩) সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। এটাতে নির্বাচক কমিটির একটা আপাত নিরপেক্ষতা বজায় ছিল। আপাত কথাটা ব্যবহার করা হল কারণ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হলেও কেউ নিরপেক্ষ না হয়ে শাসক দলের অনুগতও থাকেন, তার একাধিক উদাহরণ কয়েকজন প্রধান বিচারপতির অবসরের পর লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। যদি কোনও প্রধান বিচারপতি সত্যিই নিরপেক্ষ হন তাহলে ওই সিলেকশন কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী বা শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
তাই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজ্যসভায়, ২১ ডিসেম্বর লোকসভায় বিলটি পাশ করিয়ে ২৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে ২ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে নতুন আইন লাগু করা হল ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ, চাকরির শর্তাবলী এবং পদের মেয়াদ) আইন, ২০২৩’। এই আইনের ৭ নাম্বার ধারায় বলা হল, ‘... প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে, লোকসভার বিরোধী নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদের একজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত একটি নির্বাচন কমিটির সুপারিশে ভারতের রাষ্ট্রপতি একজন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করেন।’
নির্বাচন কমিটির নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আর থাকল না, সরাসরি প্রধানমন্ত্রী সহ শাসক দলের দু’জন আর একজন বিরোধী দলনেতা — এই ৩ জনই শেষ কথা বলবে। শাসক দল যে নির্বাচন কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই কমিটি যে নির্বাচন কমিশন গঠন করবে তা শাসক দলের নির্দেশে চলতে বাধ্য। তাই আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনে সংবিধানে উল্লেখিত অর্থনৈতিক-সামাজিক ন্যায় পাওয়ার অধিকার থেকে সব চাইতে যারা বঞ্চিত মহিলা, যুব, দরিদ্র ভূমিহীন শ্রমিক-কৃষকদের ভোট দেওয়ার রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল।
৩২৬ অনুচ্ছেদে লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভার প্রতিনিধি নির্বাচনের ভিত্তি হিসেবে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হয়। ৩২৬ অনুচ্ছেদ হল ভারতের নির্বাচনী গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড, যা নিশ্চিত করে যে শাসন জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্যই পরিচালিত হয়। এটি সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভোটদানের অধিকার প্রদান করে। জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০ এর ধারা ১৬-তে ভোটার তালিকা প্রস্তুত এবং তাতে অন্তর্ভুক্তির নিয়মাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
১৯৫০ সালের জনগণের প্রতিনিধিত্ব আইনের ১৯ নম্বর ধারাটি নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা তৈরি, এবং সংসদ ও রাজ্য আইনসভার আসন বণ্টন সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে নির্দিষ্ট করে। যোগ্য প্রত্যেক নাগরিক যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তার জন্য ভোটার তালিকা তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR)
ভোটার তালিকা সংশোধন, এটা স্বাভাবিক এবং নিয়মিত ভাবে চলার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। মৃতদের বা অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়া নাগরিকদের নাম বাদ দেওয়া এবং নতুন নাম যুক্ত করা স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা একেবারেই অন্যরকম। এখানে বিশেষ নিবিড় সংশোধনের মধ্য দিয়ে তালিকা প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে। ২০০৩ সালে বিহারে এ ধরনের নিবিড় সংশোধনের মাধ্যমে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। তখন প্রায় ৭-৮ মাস সময় লেগেছিল এই সংশোধন প্রক্রিয়া চালাতে। তখন প্রায় ৫ কোটি মানুষ ভোটার তালিকায় ছিলেন। এখনও প্রায় ৮ কোটি মানুষ এই তালিকায় আছেন। এবার কমিশন এক মাসের মধ্যে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই সংশোধন প্রক্রিয়া শেষ করবে বলে জানিয়েছে, যা বাস্তবে অসম্ভব। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ২৫ জুন থেকে ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে সকল নাগরিক ফর্ম জমা করবেন। ২৭ থেকে ৩১ জুলাই জমা পড়া ফর্মের উপর ভিত্তি করে ভোটার তালিকার খসড়া প্রস্তুত করা হবে এবং ১ আগস্ট তা প্রকাশ করা হবে। ১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টম্বর খসড়া তালিকার উপর নাগরিকরা দাবি বা অভিযোগ জানাতে পারবেন। ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করতে হবে এবং ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিমার্জিত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হবে। ৩০ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ সংশোধিত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এই নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় সকল নাগরিককে এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করা বাধ্যতামূলক। এই ফর্মে জমা দিতে হবে [ক] ১) পুরোনো ও বর্তমান ছবি; ২) জন্মের শংসাপত্র; ৩) ভোটার কার্ডের নম্বর; ৪) আধার কার্ডের নম্বর (ঐচ্ছিক); (৫) বাবা, মা, স্ত্রী/ স্বামীর ভোটার কার্ডের নাম্বর; ৬) বয়স ১৮ বছর হলে তার প্রমাণ পত্র।
[খ] ১ জুলাই ১৯৮৭-র আগে জন্ম গ্রহণ করলে [ঙ]য় বর্ণিত নথিগুলির একটি জমা করতে হবে; [গ] ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ২ ডিসেম্বর ২০০৪ এর মধ্যে জন্ম গ্রহণ করলে বাবা অথবা মা এর [ঙ]য় বর্ণিত নথিগুলির একটি জমা দিতে হবে; [ঘ] ২ ডিসেম্বর ২০০৪ এর পর জন্ম গ্রহণ করলে বাবা এবং মা উভয়ের [ঙ]য় বর্ণিত ১১টি নথিগুলির একটি জমা দিতে হবে। নিচের দলিলগুলি ১ জানুয়ারি, ২০০৩ বা তার পূর্বে জারি হয়ে থাকলে তা গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হবে।
[ঙ] ১) কেন্দ্র/ রাজ্য সরকার/ পিএসইউ-র পরিচয়পত্র/ চাকরির নিয়োগপত্র/ পিআরও আদেশ; ২) সরকারি/ আধা-সরকারি সংস্থা/ ব্যাঙ্ক/ ডাকঘর/ এলআইসি/ পিএসইউ দ্বারা ১ জুলাই, ১৯৮৭ এর পূর্বে ইস্যু করা যে কোনও পরিচয়পত্র/ সনদ/ দলিল; ৩) উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা জন্মসনদ; ৪) পাসপোর্ট; ৫) স্বীকৃত বোর্ড/ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইস্যু করা ম্যাট্রিকুলেশন/ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ; ৬) উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা ইস্যু করা স্থায়ী নিবাসের সনদপত্র; ৭) আয় সংক্রান্ত প্রমাণপত্র; ৮) উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা ওবিসি/ এসসি/ এসটি কাস্ট সার্টিফিকেট; ৯) পুরসভা/ নাগরিক রেজিস্টার (যেখানে রেকর্ড আছে); ১০) স্থানীয়/রাজ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা পারিবারিক রেজিস্টার এবং ১১) সরকারের নামে ভূমি সংক্রান্ত অর্ডার/প্রমাণপত্র।
ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড বাদ!
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, যে সকল নথিপত্র বেশির ভাগ মানুষের কাছে পাওয়া সম্ভব, যেমন ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জব কার্ড ইত্যাদি নথিগুলিকে গ্রহণযোগ্য ধরা হল না। অবশ্য ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে প্রথম ৩টি নথিকে বিচার্যের মধ্যে নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আসলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি চলছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিশাল অংশের এক শ্রমজীবী মানুষকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়াটাই আসল উদ্দেশ্য। সংবিধানের ৩২৪, ৩২৬ অনুচ্ছেদ এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৬ ১৯, ২১ ধারাতে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করার কথাই বলা হয়েছে। এটি প্রতিটি যোগ্য নাগরিককে শাসনব্যবস্থায় সমান অধিকার প্রদানের মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনার ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ১৮ বছর এবং তার বেশি বয়সী সকল নাগরিককে ভোটাধিকার প্রদান করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ জোরদার করতে জনগণকে তাদের নেতা নির্বাচনের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে। বৈষম্য রোধ করতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে বাধা দূর করে।
সর্বজনীন ভোটাধিকারের ধারণাটিকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চলছে, যা সংবিধানের গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র বা প্রজাতান্ত্রের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী। অবিলম্বে এর বিরুদ্ধে নাগরিকদের সচেতন করা সময়ের দাবি।
লেখক আইনজীবী, সম্পাদক, পশ্চিমবাংলা, অল ইন্ডিয়া লইয়ার্স অ্যসোসিয়েশন ফর জাস্টিস