বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২১— সীমানা বন্টনের ক্ষত তৈরি করে যায় ব্রিটিশরা। স্বাধীনতার পর দুই রাজ্যের মধ্যে সমঝোতা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনও সীমারেখা নিয়ে কথা হয়নি আজও। এক ইঞ্চিও জমি না ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। শান্তি চান, তবে এক ইঞ্চি জমি না ছেড়ে। অন্যদিকে, মিজোরাম সরকারও অটল তাদের অবস্থানে। এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। যদিও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। সম্প্রতি আসাম-মিজোরাম সীমানায় দখল নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। জানা গিয়েছে, ওই সংঘর্ষে মৃত্যু হয় আসামের ৬ পুলিশকর্মীর। এরপর চলে পরস্পরের ওপর দায় চাপানোর পালা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে নালিশও জানান আসাম ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীরা। উল্লেখ্য, অমিত শাহের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সফর সেরে আসার পরই ওই দুই রাজ্যের সীমানা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই সংঘর্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই কারণ লুকিয়ে রয়েছে। এই সংঘর্ষকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখতে নারাজ তাঁরা। কিন্তু কেন?
প্রত্যক্ষ কারণ: আসাম ও মিজোরাম রাজ্যের সীমানার সমস্যা আজকের নয়। এর ১৫০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। এই সীমানা নিয়ে দুই রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি হয়ে থাকলেও একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সাম্প্রতিক ঘটনায় মিজোরাম সরকারের বক্তব্য, লয়লাপুরের কাছে জাতীয় সড়কে কোনও অনুমতি ছাড়াই আসাম পুলিশের একটি দল প্রবেশ করে। সেখানে মিজোরাম পুলিশ থাকা সত্ত্বেও আসাম পুলিশের আইজিপি, ডিসি, এসপি এবং কাছাড় জেলার ডিএফওএর নেতৃত্বাধীন একটি দল বেশ কিছু গাড়িতে ভাঙচুর করে। মিজোরাম পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল (নর্দান রেঞ্জ) লালবিয়াকথাঙ্গা খিয়াঙতের অভিযোগ, আইতলাঙে প্রবেশ করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা।
আসাম সরকারের পাল্টা দাবি, পরিস্থিতি আগেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। তা সামাল দিতে আসাম পুলিশের একটি দল সেখানে যায়। পাল্টা আসাম পুলিশের উপর হামলা করা হয়। দুই সরকারই টুইট করে পরস্পরকে বিঁধতে থাকে। টুইটারেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেন দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং জোরামথাঙ্গা।
শাহি সফর: এর দিন পাঁচেক পর শিলংয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। জানা গিয়েছে, আসাম-মিজোরাম সীমানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। ওই বৈঠক শেষে মিজোরাম সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, বোঝাপড়া ও শান্তির মাধ্যমে সীমানা-সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। অন্যদিকে, আসাম প্রশাসনের তরফে মিজোরাম পুলিশকে হিংসা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ শাহ সফরের পর দুই সরকারের বাক্য-বিনিময়ে কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি।
ড্রাগ ইস্যু: আসামের বিজেপির দাবি, তাদের সরকার মাদক পাচারে কঠোর অবস্থান নেওয়ায়, সীমানায় হিংসায় মদত দিচ্ছে মাদক-মাফিয়ারাই। তাদের কাছে খবর রয়েছে, এ সব মাদক মায়ানমার থেকে মিজোরাম হয়ে আসামের মধ্য দিয়ে গোটা দেশে পাচার হয়। ওই সীমানায় মাদক-মাফিয়াদের দাপট রয়েছে বলে দাবি আসামের। সংঘর্ষে স্থানীয়দের মধ্যে যে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়ার অভিযোগ মিলেছে, এর সঙ্গে মাদক-মাফিয়াদের যোগ রয়েছে বলেও তারা মনে করছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, প্রতি বছর প্রায় ৮০০-৯০০ কোটি টাকার মাদক পাচার হয় এই রুট দিয়ে। এখনও পর্যন্ত ৫ হাজার কোটি টাকার মাদক পাচারের খবর রয়েছে।
ধর্মীয় কারণ: আসাম ও মিজোরাম পাশাপাশি দুই রাজ্য হলেও, ধর্মীয় অনুপাত সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসামে হিন্দু প্রায় ৬০ শতাংশ। মুসলিম ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে প্রায় ৮৭ শতাংশ খ্রিস্টান মিজোরামে। হিন্দু মাত্র ৩ শতাংশ। অনেকক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা দানা বাঁধে এ সব সংঘর্ষে।
লাইফলাইন আসাম: আন্তঃরাজ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে আসামের উপর নির্ভরশীল মিজোরাম। আসামে কোনওরকম অসুবিধা হলে তার ফল ভুগতে হয় মিজোরামবাসীকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০২০-তে আসামে জাতীয় সড়ক ৩০৬ অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মিজোরামে আমদানি-রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয় কেন্দ্রকে। শুধু সীমানা নয়, বিভিন্ন ইস্যুতে আসাম-মিজোরামের বিবাদের নজির রয়েছে।
ফিরে দেখা: গত বছর অক্টোবরেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল আসাম-মিজোরাম সীমানা। এক সপ্তাহের মধ্যে দু’দুবার ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। এই ঘটনায় ৮ জন গুরুতর জখম হন। ভাঙচুর করা হয় দোকানপাট। ১৯৬৫ পর বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার সংঘর্ষে লিপ্ত থেকেছেন স্থানীয় মানুষরা। ২০০৮ সালে এ সব সংঘর্ষ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে মনোহর পরিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস।
পরোক্ষ কারণ: সাম্প্রতিক ঘটনার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে আসামও মিজোরাম সীমানার ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক কারণ। সীমানা বন্টনের ইতিহাস ১৫০ বছরের পুরনো হলেও, কোনও রাজ্যের কাছে সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। আর তার জেরেই বিভিন্ন সময়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সীমানা বিতর্ক।
ভৌগোলিক সীমানা: আসাম ও মিজোরামের মধ্যে ১৬৫ কিলোমিটার সীমারেখা রয়েছে। আসামের ৩ জেলা কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ এবং মিজোরামের কোলাসিব, মামিট ও আইজল জেলার রয়েছে ওই সীমা রেখায়। কাছাড় জেলাতে এই সংঘর্ষ হয়। উল্লেখ্য, আসামের আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসাবে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে এবং মিজোরামের বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সঙ্গে। অর্থাৎ মাদক পাচার থেকে শরণার্থী— এই দুই রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘রাজ্য’ মিজোরাম: অবিভক্ত আসাম থেকে ১৯৭১ সালে দ্য নর্দান এরিয়া (রিঅর্গানাইজেশন) অ্যাক্টে মণিপুর, মেঘালয় এবং ত্রিপুরাকে আলাদা রাজ্যের তকমা দেওয়া হয়। কিন্তু মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশকে মর্যাদা দেওয়া হয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের। এরপর ১৯৮৭ সালে ৫৩তম সংবিধান সংশোধনীতে ২৩তম রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পায় মিজোরাম।
সীমানা বন্টনের ক্ষত: অবিভক্ত বাংলা থেকে প্রথম আসামকে আলাদা করা হয় ১৮৭৫ সালে ‘নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার’ হিসাবে। পাশাপাশি আসামের বরাক উপত্যাকার কাছাড় থেকে আলাদা করা হয় লুশাই হিলসকে। যা পরবর্তীকালে মিজোরাম হিসাবে পরিচিতি পায়। তবে লুশাই হিলস অবিভক্ত আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সিদ্ধান্ত মিজো সম্প্রদায়ের প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেই নেওয়া হয় বলে জানা যায়। দু’ বছর পর গেজেট প্রকাশ করে ওই জায়গায় ‘ইনার লাইন রিজার্ভ ফরেস্ট’ তৈরি করা হয়।
পরবর্তীকালে ১৯৩৩ সালে আরও একবার সুস্পষ্টভাবে সীমানা বন্টন করে ব্রিটিশরা। কিন্তু সে সময় মিজো-সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। তাই মিজোরামের মানুষ মনে করেন ১৮৭৫ সালে নোটিফিকেশন অনুযায়ী এই বন্টন হওয়া উচিত। অন্যদিক ১৯৩৩ সালের নিয়ম অনুযায়ী সীমা নির্ধারণ করে আসছে আসাম সরকার। উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালে মিজোরামের রাজ্য সীমানা তৈরি হয় ১৯৩৩-এর আইন অনুযায়ী। যার ফলে মিজো সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ আরও প্রবলভাবে দানা বাঁধে।
সীমানা বন্টনের ক্ষত তৈরি করে যায় ব্রিটিশরা। স্বাধীনতার পর দুই রাজ্যের মধ্যে সমঝোতা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনও সীমারেখা নিয়ে কথা হয়নি আজও। ওই সীমারেখাকে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শরণার্থী সমস্যা: সীমানা বন্টনকে সামনে রেখে সাম্প্রতিক সংঘর্ষগুলিকে বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। সংযোজন হয়েছে আরও বেশি কিছু উপাদান। তার মধ্যে অন্যতম শরণার্থী সমস্যা। মিজোরাম ও আসামের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুই রাজ্যের সীমানা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে বাংলাদেশি শরণার্থীরা। অবাধ অনুপ্রবেশের ফলে বাড়ছে অপরাধের সংখ্যা। পাশাপাশি প্রভাব পড়ছে সেখানকার জনজাতির সংস্কৃতির উপরও।
গত ২৬ জুলাই মিজোরাম সীমান্তের ঘটনা খুবই দুঃখজনক ও মর্মান্তিক! এর দায় কোনও ভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার ও দুই রাজ্য সরকার এড়াতে পারেন না! আসামের সঙ্গে মিজোরাম-নাগাল্যান্ড-অরুণাচল-মেঘালয়ের সীমানা বিবাদ চলছে! সেই চার-পাঁচ দশকের ইতিহাস! অথচ মনিপুর কিংবা ত্রিপুরার সঙ্গে বিবাদ সেরকম নেই! কেননা ওইসব এলাকায় স্বাধীনতার সময় রাজতন্ত্র ছিল! কিন্তু একসময় ওইসব রাজ্য আসামের সঙ্গে ছিল! আসামের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার পর সীমানা নির্ধারণ হয়নি! মুখ্যমন্ত্রী থেকে পিয়ন এমনকি আম জনতার ভাবাবেগ বিশ্লেষণ করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর সমাধান সম্ভব করা আশু কর্তব্য দুই রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের, সেটা আগের কংগ্রেসের সরকার বর্তমানের বিজেপির সরকার বুঝতে অপারগ! ফলে উভয় রাজ্যের সাধারণ মানুষেরা এর ভোগান্তি সহ্য করছেন! সীমানা নিয়ে আম জনতার কিছু যায় আসে না! গুটি কয়েক কায়েমি স্বার্থান্বেষি ছাড়া! আর রাজনৈতিক দল ও নেতার ঘোলা জলে মাছ ধরে!
আসাম সীমান্তে মিজোরাম পুলিশের গুলিচালনা এবং নির্বিচার হত্যা ১৯৭৯ সালের মে মাসের স্মৃতিকে উসকে দিল। ১৯৭৯ থেকে ২০২১ এই সময়কালে অনেক ছোট-বড় হিংসার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এবছর জুলাই ২৬ তারিখের নিন্দনীয় ঘটনা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে শুধু মানবিকতাই বিপন্ন হল না, প্রশ্ন তৈরি হল ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কেও। আসামের সঙ্গে নাগাল্যান্ডের সীমানা সমস্যা এখনো অমীমাংসিত। সীমানা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সারকারিয়া কমিশনের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে গঠিত INTER STATE COUNCIL অভিভাবকের ভুমিকা পালন করুক। নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর ভাষা নেই। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হোক। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।