বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা ২০২৩ সালে বিশ্ব জুড়ে মন্দা আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নয়া উদারনীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণামে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমেই কমেছে। ২০০৮ সালে আমেরিকায় শুরু হওয়া মহামন্দার পূর্ণ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশ সেভাবে প্রত্যক্ষ করেনি। তখনও পর্যন্ত প্রধানত বামপন্থীদের চাপ এবং ব্যাঙ্ক-বীমা কর্মীদের লাগাতার আন্দোলনের কারণে ভারত সরকার এদেশের অর্থ ব্যবস্থাকে পুরো উন্মুক্ত করতে পারেনি। কিন্তু বিজেপি সরকারের শাসনে দেশি-বিদেশি পুঁজির মহালুঠে দেশবাসীর অধিকাংশ অসহায় অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তার নির্মম পরিণতিতে অর্থনীতির আশঙ্কাজনক অবস্থা। সম্প্রতি দেশের সর্ব বৃহৎ পুঁজিপতিদের অন্যতম আদানি গোষ্ঠীর উত্থান ও ধ্বসের পিছনে ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারির প্রকাশ অর্থনীতির বিপজ্জনক প্রবণতাকে স্পষ্ট করেছে।
অক্সফাম প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, দেশের নিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের মোট উৎপাদিত সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। অন্যদিকে, দেশের উচ্চ আয়ের ১০ শতাংশের কব্জায় দেশের উৎপাদিত সম্পদের ৭২ শতাংশ কেন্দ্রীভূত। ফলে দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর সঙ্কট নেমে আসা প্রায় অবধারিত গতি। এই সঙ্কটের প্রভাব শুধু মাত্র দেশের মধ্যেই সীমিত থাকবে না। দেশের প্রায় ১০০ কোটি মানুষের জীবনের সঙ্কটের প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে বিশ্ব পরিধিতে। মনে রাখা দরকার, ১০০ কোটি সংখ্যাটি সমগ্র ইউরোপের জনসংখ্যার দ্বিগুণ।
এই গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার জন্য, প্রয়োজন কর্ম সংস্থানের প্রসার এবং মানুষের উপার্জন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে দেশের বাজারকে উজ্জীবিত করা। এটা কোনও সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রম নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এই পথ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদ সে পথ নিতেও নারাজ।
২০২৩-২৪ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সরকারি উদ্যোগের পরিবর্তে বৃহৎ পুঁজির আরও লুঠের ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। ৮১ কোটি মানুষের খাদ্যে ভরতুকি কমানো হয়েছে ৩১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ৯০,০০০ কোটি টাকা। অথচ বিশ্ব-ক্ষুধার্তের তালিকায় ভারতের স্থান ১০৭তম। প্রতিবেশি সকল গরীব দেশের তুলনায় ভারতের স্থান নীচে। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনে খাদশস্য সংগ্রহের জন্য ২০২২-২৩ সালের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৭২,২৮২ কোটি টাকা। এবার তা কমিয়ে করা হয়েছে ৫৯,৭৯৩ কোটি টাকা। প্রায় ১২ শতাংশ ছাঁটাই। বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ কমানোর পরিণামে রেশন ব্যবস্থা ও বিনা মূল্যে খাদ্য বন্টন ব্যবস্থায় আঘাত নামিয়ে আনা হল। মিড ডে মিলের বরাদ্দও ৯.৪ শতাংশ কমানো হয়েছে। পুষ্টিভিত্তিক ভরতুকি ছাঁটাই হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।
গভীর কৃষি সঙ্কটে নিমজ্জিত কৃষি অর্থনীতিকে সুরক্ষার নামে বাজেট বরাদ্দে গুরুতর আঘাত নামিয়ে আনা হয়েছে কৃষি খাতে। ২০২২-২৩’র বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ছিল ১,২৪,০০০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থ বর্ষে কৃষি খাতে বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ১,১৫,৫৩১ কোটি টাকা। যে দাবি নিয়ে কৃষকরা দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়েছেন সেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা এবারের বাজেটেও নেই। বরং খাদশস্য সংগ্রহের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দাম স্থির রাখার জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের যে ব্যবস্থা ছিল তা লোপ করা হয়েছে। সারে ভরতুকি ছাঁটাই করা হয়েছে ২২ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা ৫০ হাজার কোটি টাকা। সারের দাম বাড়বে এবং কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রী কিসান তহবিলের বরাদ্দ ৬৮ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এসবের পরিণামে কৃষি ও কৃষকের সঙ্কট গভীরতর হতে বাধ্য।
কর্মসংস্থানের আকালের মুখে কোনও নতুন প্রকল্প তো নেই-ই, গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবথেকে লক্ষণীয় ১০০ দিনের কাজ বা রেগায় বরাদ্দ ছাঁটাই। এক বছর আগের ৮৯,০০০ কোটি থেকে কমিয়ে এবার রেগায় বরাদ্দ করা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি।
দেশের আর্থিক ব্যবস্থার মূল সূত্রগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনগুলি মেটাবার দায়িত্ব অনেকটাই রাজ্য সরকারের উপর ন্যস্ত। ফিনান্স কমিশনে সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্যগুলি কেন্দ্রের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে অর্থ পায়। এবারের বাজেটে রাজ্যের প্রাপ্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে। ফলে গ্রামীণ উন্নয়ন সহ রাজ্যের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আঘাত নেমে আসবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি জলাঞ্জলি যাচ্ছে শুধু নয়, রাজ্যের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে রাজ্যগুলির বরাদ্দ ছিল ৪,৬০,৫৭৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে রাজ্যগুলির বরাদ্দ ছিল ৩,৬৭,২০৪ কোটি টাকা (বৃদ্ধি ১৫.৩ শতাংশ)। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে রাজ্যগুলির বরাদ্দ হয়েছে ৩,৫৯,৪৭০ কোটি টাকা (হ্রাস ১৪.৯ শতাংশ)।
বিজেপি সরকার ক্রমবর্দ্ধমানভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আক্রমণ নামিয়ে আনছে। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র অবহেলিতই থেকেছে। মুল্যবৃদ্ধি জনিত কারণে জনজীবনের যন্ত্রণা লাঘবে কোনও ব্যবস্থা নেই বাজেটে। মহামারির সময়ে দেখা গিয়েছিল দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা। অর্থমন্ত্রীর দাবি, এবার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে। বাস্তবে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে ৩৪ শতাংশ বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় বিপুল হ্রাস হয়েছে। বস্তুত এস্বাস্থ্য বিমার ভবিষ্যৎ নিয়েই এদিন প্রশ্ন উঠেছে।
জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনগুলি সুরহার জন্য ব্যবস্থা না থাকলেও এবারের বাজেটে মূলধনী খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিগত অর্থবর্ষে মূলধনী খাতে বরাদ্দ ছিল ৭ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এবার মূলধনী খাতে বরাদ্দ ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ লক্ষ কোটি টাকা করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রধানত ব্যয়
হবে পরিকাঠামো গড়ে তুলতে, ঋণ পরিশোধে, বৈদেশিক বাণিজ্যে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হলে ঘাটতি মেটাতে। সুতরাং অর্থমন্ত্রী যতই ব্যাখ্যা করুন এর ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে বাস্তবে এর সিংহভাগ সুফল আত্মসাৎ করবে দেশি-বিদেশি বৃহৎ ব্যবসায়ীরা।
অর্থনীতির মন্দা, কৃষি সঙ্কট, গ্রামীণ জীবনে চরম দুর্দশা, কর্মসংস্থান হ্রাস, চাহিদার নিম্নগতি, শিল্প উৎপাদনের অধোগতি, তীব্র মূদ্রাস্ফীতি কোনও ক্ষেত্রেই কার্যকরি সমাধানের রাস্তা না করে এই বাজেট সচেতনভাবেই শ্রেণী স্বার্থ অনুসরণ করেছে— নয়া উদারনীতির রাস্তা আরও উন্মুক্ত করে দেশি-বিদেশি লুঠেরাদের স্বার্থ রক্ষা করতে রচিত।