বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

কৃষক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি

কৃষক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ নভেম্বর, ২০২১— দেশের রাজধানীর সীমানা ঘিরে কৃষক আন্দোলন প্রায় এক বছর পার হতে চলল। আন্দোলন বছরের সমস্ত ঋতুই পার করল। শুধু কৃষকরা নয়, কৃষক রমণীরাও দীর্ঘতম এই কৃষক আন্দোলন সফল করতে পথে নেমেছেন। দাবি আদায় না করে তাঁরা ঘরে ফিরবেন না। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনকে শাসকরা শান্তিপূর্ণ থাকতে দেয়নি— আক্রমণ হেনেছে। কিন্তু প্রত্যয়ী কৃষক আন্দোলন সমগ্র দেশসহ পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কৃষক জনতা তাঁদের পরিচিত পরিবেশে নয়, বসে আছেন রাজধানী ঘিরে প্রশস্ত রাজপথে। সমাজের অন্যান্য অংশের বিপুল সমর্থন ছাড়া এমন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। শ্রমিক-ক্ষেতমজুর সহ সমাজের নানা অংশের মানুষের প্রত্যক্ষ সহায়তা আদায় করে নিয়েছে এই আন্দোলন।
কৃষিতে সংকট চলছে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে। সরকারি নীতির কারণেই এই সংকট এবং এই সংকটে বিপর্যস্ত কৃষি ও কৃষক। মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়েছে মোদি সরকারের তিনটি কৃষি আইন। বৃহৎ কর্পোরেটদের স্বার্থে অতি দ্রুত কৃষককে জমি ও জীবিকা থেকে নির্মম প্রয়াস চলছে; সামান্য সংখ্যক মজুর ব্যবহার করে যন্ত্রের সাহায্যে কৃষি উৎপাদনের রাস্তা পরিস্কার করছে সরকার। ইতিমধ্যেই কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সার, বীজ, কীটনাশক, যন্ত্র সহ সমস্ত কৃষি উপকরণের বাণিজ্য বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হস্তগত। বর্তমান কৃষি আইন তিনটি জমি, কৃষি উপকরণের পর দেশের কৃষি উৎপাদন ও কৃষি বাণিজ্য বৃহৎ কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের তুলে দেওয়ার আইনি উদ্ধেশ্যেই রচিত।
কয়েক দশক আগে কৃষি ক্ষেত্রে এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় কৃষকদের নিঃস্ব হওয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল আত্মহত্যা। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের ধারায় কৃষক সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ উঠে দাঁড়িয়েছেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের রাস্তায়। এই আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে। ইতিমধ্যে প্রাণ দিয়েছেন সাড়ে ছয় শতাধিক কৃষক।
আন্দোলনের যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে উত্তর-পশ্চিম ভারতে, তেমন সাড়া অবশ্য সর্বত্র নেই। বাস্তবতারও যথেষ্ট পার্থক্য আছে। সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে প্রায় ছয় দশক আগে পুঁজিবাদী কৃষির সূত্রপাত হয়েছিল যে সমস্ত এলাকাগুলিতে—পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সহজাত সংকট সেই সমস্ত এলাকাগুলিতে ফেঁটে পড়েছে। ওই সমস্ত এলাকাগুলিতে মান্ডি ব্যবস্থায় কৃষক ফসল বিক্রিতে কিছুটা সহায়তা পেত। যদিও সেই সুবিধা প্রধানত হস্তগত করতো বৃহৎ জমির মালিকরা, ছোট জমির মালিকরাও একেবারে বঞ্চিত হতো না। নতুন আইনে সেই সহায়তা কার্যত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সর্বনিম্ন দরে মান্ডি থেকে ফসল কেনা সম্ভব ছিল না। আমাদের রাজ্য সহ দেশের অন্যত্র কৃষকদের এই সুবিধা ছিল না। আমাদের রাজ্যে মান্ডি থাকলেও সেগুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইকেল স্ট্যান্ড বা গরু-ছাগলের বিশ্রামের স্থান। তাই মান্ডি প্রথা তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে এখানে তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। বিগত বামফ্রন্ট সরকারের সময় নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও সমবায় ও স্বনিযুক্তি দলগুলির মাধ্যমে ধান ক্রয়ের যে ব্যবস্থা ছিল আজ তা আর কার্যত নেই। ধান কেনার পুরো বিষয়টাই আজ ফড়েদের দখলে। এখন বাস্তবে ফসলের সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাটি তলানিতে পৌঁছেছে।
হতাশা ও আত্মহত্যার পর্ব পার হয়ে কৃষক আন্দোলন ধীরে ধীরে সাহস সংগ্রহ করেছে। ব্রিটিশ আমলে রচিত জমি অধিগ্রহণ আইনের বিরুদ্ধে দেশের নানা প্রান্তে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হতে শুরু করে। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার দাবিতে আন্দোলন ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করে। মোদি সরকারের প্রথম পর্বে ফসলের লাভজনক দামের দাবিতে ও মধ্যপ্রদেশে কৃষক হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশের কৃষক সংগঠনগুলি সারা ভারত কিসান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি গড়ে তোলে। মোদি সরকারের দ্বিতীয় পর্বে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার ও স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার দাবিতে আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হয়। বিদ্যুৎ আইন বাতিলের দাবিও সামনে আসে। শ্রম কোড বাতিলের দাবির সঙ্গে দেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির বিরুদ্ধে কৃষক-ক্ষেতমজুর-শ্রমিক সংগঠনগুলি বৃহত্তর আন্দোলনের জোট গড়ে তোলেন।
শোষকদের সঙ্গে সমাজের শ্রমজীবী বিভিন্ন অংশের শ্রেণী দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে। শ্রমজীবীদের বিভিন্ন অংশের উপর প্রবল আক্রমণ বৃহত্তর ঐক্যের পথ প্রশস্ত করেছে। দেশব্যাপী অসংখ্য যুক্ত আন্দোলন ও কর্মসূচি এবং দেশব্যাপী একাধিক ধর্মঘট সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরছে।
পরিস্থিতির তারতম্য থাকলেও কৃষি সংকটের প্রতিফলন সারা দেশেই প্রকট। সে কারণে চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রতি অন্যান্য স্তরের মানুষের সমর্থন প্রসারিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী সংকটের বোঝা শ্রমজীবী জনগণকে বইতে হচ্ছে। সংকট জর্জরিত জনগণের জীবন যন্ত্রণা ঐক্যের বাস্তব ভিত্তি প্রস্তুত করছে। সমস্ত সংকটের পিছনে রয়েছে অতি ধনীদের বেপরোয়া লুঠের ছক। সরকার সেই লুঠকেই আইনি রূপ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত করছে।
গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে বামপন্থীদের পরিচালিত কৃষক সংগঠনগুলি কৃষিপণ্যের লাভজনক দাম দাবি করে আসছে। ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকারকে বামপন্থীদের সমর্থনের অন্যতম শর্ত ছিল, কৃষিপণ্য ক্রয়ে সরকারি উদ্যোগ। সেই সময় স্বামীনাথনের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন কৃষি সংকট দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করে। কিন্তু সেই সরকার তা কার্যকর করেনি। পরে মোদি সরকার স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করতে অস্বীকার করে চলেছে। বিপরীতে বৃহৎ কর্পোরেটদের স্বার্থে কৃষি ও কৃষক বিরোধী সংস্কারগুলি বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

cover

অর্থনীতির সামান্য পাঠ যাদের আছে, তারা সকলেই জানেন, কৃষির বিপর্যয় শুধু কৃষকের বিপর্যয় নয়, সমগ্র অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। কৃষি অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে চীন দেশে গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত কৃষিপণ্য অনেক বাড়তি দামে সরাসরি ক্রয় করে নেওয়া হয়। আবার ভর্তুকি দিয়ে ১৪৬ কোটি নাগরিককে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এর জন্য চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। বরং চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষ স্থান গ্রহণ করেছে। সুতরাং কৃষিপণ্যের লাভজনক দামের বিষয়ে শাসক-শোষকদের অপপ্রচারে ভুল করলে চলবে না। ২০১৪ সালে নির্বাচনে জেতার জন্য বিজেপি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মতো ফসলের উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম দেবে বলে অঙ্গীকার করেছিল। এখন অস্বীকার করছে।
বিজেপি ব্যতীত অন্য দলগুলি যারা বৃহৎ কর্পোরেটদের স্বার্থে সংস্কারের পক্ষে ছিল, তারাও কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের রাজ্যের শাসক তৃণমূল দল চরিত্রগতভাবে বৃহৎ কর্পোরেটদের স্বার্থকে সেবা করলেও কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু সংযুক্ত কিসান মোর্চার আহুত সর্বভারতীয় ধর্মঘট বিরোধিতা থেকে বিরত হয়নি। আঞ্চলিক শাসক দলগুলির দ্বিচারিতা ও দোদুল্যমানতা আগামী দিনেও লক্ষ্য করা যাবে। যারা প্রকাশ্যে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করছে, তাদেরও বিভিন্ন অংশ কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে। তাদের চতুর ভূমিকা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।
আবার একথাও সত্য কৃষক আন্দোলন বিকাশের নানা পর্যায়ে অনেক ভিন্ন মতাদর্শের সংগঠনও আন্দোলনে সামিল হয়েছে। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার ও ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি সামনে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা দাবি আন্দোলনে উঠে এসেছে। পরবর্তী সময়ে শুধু কৃষক নয়, ক্ষেতমজুর ও শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ দাবিকেও সমর্থন করা হয়েছে। ফলে আন্দোলনের ভিত্তি ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। আন্দোলন ক্রমশ বাড়তি শক্তি সঙ্ঘত করেছে। আন্দোলনের গতিপথে এই উত্তরণ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
কৃষক আন্দোলনের গতিপথে সাম্প্রদায়িক বিভেদের কূটকৌশলকে ছিন্ন ও প্রতিহত করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যর শক্তি দেশবাসীর সামনে এসেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-জাঠঐক্য দেশবাসীকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। একদা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কেন্দ্র মুজফফরনগরে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ বিশাল সমাবেশ পিছিয়ে থাকা জনতার মধ্যে আশা জাগিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের কঠিন বাস্তবতা রাজনৈতিক দৃষ্টিকে স্পষ্ট করেছে।
অপপ্রচার ও আক্রমণ করে আন্দোলনকে ভাঙা যায়নি। লখিমপুর খেরি বা কারনালে নৃশংস আক্রমণ করেও সরকারকে পিছু হঠে কিছু আংশিক দাবি মানতে হয়েছে। আন্দোলন ভাঙার জন্য ষড়যন্ত্র ও তৎপরতা চলতে থাকবে। তবে কৃষক আন্দোলন এখন অনেক পরিণত। সরকার ও শাসকদের সমস্ত চক্রান্ত ভেদ করে আন্দোলন এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস।
বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকট থেকে আমাদের দেশ বাইরে নয়। শাসক-শোষকদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এই দ্বন্দ্বের বিকাশ নির্ভর করবে আন্দোলনের আরও ব্যাপ্তি ও আরও তীব্রতার উপর। সেই লক্ষ্যেই কৃষক আন্দোলনকে পরিচালনা করতে হবে। বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থার রমরমা বাজার আজ শক্তিশালী নয়— আমাদের দেশেও আন্দোলন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থাকে প্রতিহত করা সম্ভব।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.