বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
পঞ্চাত্তর বছর আগে স্বাধীন হয়েও এখন কি দেশের সব মানুষের সেই স্বাধীনতা আছে! মণিপুর রাজ্যে সম্প্রতি ঘটে চলা দিনপঞ্জির দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্ন উঠবেই। যাদের কাছে মহিলা, সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও জনজাতি জনগোষ্ঠীর মানুষ ঘৃণার পাত্র তারাই বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতার কর্ণধারের আসনে। শ্রেণীগত ভাবে এই রাষ্ট্র দখলে রেখেছে কর্পোরেট পুঁজির লুঠের বশংবদরা। তাদেরই হুকুমে ব্যাঙ্ক-বীমা-রেল-বিমান-জাহাজ-বন্দর-জঙ্গল-সর্বত্র লুঠ চলে এবং অবশিষ্ট জাতীয় সম্পদ তুলে দেওয়া হয় লুঠেরা পুঁজির মালিকদের কাছে। এই লুঠ চালাতেই ওদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় বসেছে। এরা রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ রাষ্ট্রীয় অর্থ ভান্ডার, আইন,আমলা-পুলিশ-মিলিটারি, সংবাদমাধ্যমের দখলদারি কায়েম করেছে। দেশের আমজনতার স্বার্থে নয়, মুনিবদের সেবার স্বার্থে। স্বাধীনতার উত্তরকালে অনেক মানুষের, অনেক লড়াই, ত্যাগের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধংস করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ হয়তো এখনও কোনওভাবে দিন কাটিয়ে চলছে, কিন্তু প্রান্তিক গরীব মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তারা দিশাহারা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুর।
“মণিপুরের কাঙপোকপি জেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে ৪ মে, একদল লোক বিবস্ত্র করে পাশবিক উল্লাসে দু'জন জনজাতি মহিলাকে হাঁটাচ্ছে, নির্যাতন করছে এবং শেষে গণধর্ষণ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পুলিশের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সংগঠিত করা হয়েছে এই অপরাধ। পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেনি এই বিভৎস অপরাধের বিরুদ্ধে। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে হয়েছে। অভিযোগ ১৮ জুলাই দায়ের হলেও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের থেকে কি প্রধানমন্ত্রী, কি মুখ্যমন্ত্রী কেউ টু শব্দটি করেনি। ৩ জুলাই থেকেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। তাই মানুষও খবর পাননি। ১৯ জুলাই থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হতেই ছড়িয়ে পড়ে ওই বিভৎস ভিডিও। তারপর সুপ্রিয় কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড় মণিপুরের এই ঘটনায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রিপোর্ট তলব করে বলেছেন, “সাম্প্রদায়িক হিংসায় দীর্ণ একটি অঞ্চলে মহিলাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা সংবিধানের অবমাননা। একদম মেনে নেয়া যাচ্ছে না।” প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমেরিকা, ফ্রান্স ভ্রমণে থাকলেও উনি সব জানতেন। কারণ ফ্রান্সে থাকাকালীন সময়ে ইউরোপের সংসদে ঘটনাটি উত্থাপিত হয়। এরপরে দেশে ফিরেও তিনি নীরব ছিলেন। মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ছুটে যাননি নির্যাতিতা ভারত কন্যাদের কাছে। তিনি হয়তো লক্ষ্য রাখছেন, এই দাঙ্গা কোন দিকে যায় মিজোরামের দিকে না আসাম হয়ে বাংলা, ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা দিকে! কতটা বিস্তার হয় সেদিকে। সংলগ্ন আসামের বরাক উপত্যকায় অনেক বাঙালির পাশাপাশি আছে কিছু খ্রিটান কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। আর এখানে যদি পুরোনো বাঙালি বিরোধী দৈত্যের নিদ্রা ভঙ্গ করা যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
সুপ্রিমকোর্টে হুঁসিয়ারির পরে তিনি মুখ খুললেন দেশবাসীর প্রতি দায় ঠেলে দিয়ে। বললেন, “ঘটনাটি দেশবাসীর কাছে লজ্জার।” কিন্তু এটা দেখার পর কি আমাদের অনেকের বিবেক জেগে উঠেছে?
তাহলে কি হিংসা ও পাশবিক ঘটনাই আমাদের সজাগ হতে সাহায্য করবে? রাষ্ট্র কেন পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদতে দিয়ে যাচ্ছে এক জনগোষ্ঠীর ওপর আরেক দল জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র আক্রমণে! ওই রহস্য উন্মোচন করতে সমস্যার সম্পূর্ণ ব্যাপ্তির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
মণিপু্র রাজ্যের ছবিটি ফিরে দেখা যাক।
দেশের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের রাজন্য শাসিত রাজ্য মণিপুর ভারতে যুক্ত হয় স্বাধীন হওয়ার দু’ বছর পরে, ১৯৪৯ সালে। ভারতের ভূখন্ড থেকে বেরিয়ে যায় বার্মা। বর্তমানে মায়নমারা। মণিপুরে তিনটি গোষ্ঠী মানুষের বাস, মেইতেই, কুকি ও নাগা। এছাড়া অল্প সংখ্যক মুসলিম ধর্মাবলম্বী পোঙ্গল মানুষের বাস। রাজ্যটি নানা বৈচিত্র্যে ভরা। মণিপুরের চারিদিক পাহাড় ঘেরা।
আর জমির নব্বই শতাংশই পাহাড়ে, সমতলে মাত্র দশ শতাংশ। কিন্তু সমতলের জমি পাহাড়ের তুলনায় অনেক বেশি উর্বর। রাজ্যের আশি শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। যদিও কৃষি উৎপাদনের জন্য আধুনিক উৎপাদন যন্ত্র তাদের কাছে পৌঁছায় নি।
কৃষিজীবীর নব্বই শতাংশ বাস করে পাহাড়ে। মণিপুর দেশের একমাত্র রাজ্য যেখানে এখনও জনজাতিরা সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলির অন্তর্ভুক্ত নয়। অবশ্য মণিপুর রাজ্য ভারতে যুক্ত করার সময়ে জনজাতিদের জন্য কয়েকটি আইন করে তাদের জনজাতি হিসেবে কিছু অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। যেমন, জনজাতি ছাড়া বনাঞ্চলে কারো জমি কেনার অধিকার নেই। তবে জনজাতিদের সমতলে জমি কেনার অধিকার আছে। মেইতেই অংশের মানুষরা সমতলে বাস করে, তারা মণিপুরের জনগণের ৫৩ শতাংশ। আর কুকি, নাগা, পোঙ্গল অংশের মানুষ ৪৭ শতাংশ, তাদের বসবাস পাহাড়ে।
মণিপুর বিধানসভায় ৬০টি আসন। এই আসনের ৪০টিই মেইতেই বসবাস, আর মাত্র ২০টি আসনে জনজাতিদের বসবাস। রাজ্যের বার্ষিক বাজেটের আশি শতাংশই খরচ হয় সমতলে। চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই মেইতেই অংশের মানুষরা বেশি সুযোগ পায়, যার ফলে পেছিয়ে আছে জনজাতিরা। এই নিয়ে জনজাতিদের মধ্যে যেমন ক্ষোভ রয়েছে, তেমনি জমি নিয়ে মেইতেই অংশের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে। এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগায় শাসক শ্রেণী। দেখা যায়, রাজ্যের মানুষ যখন তাদের সমস্যা, বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে তখনই শাসক শ্রেণী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ উস্কে দেয়।
ভোট আসে ভোট যায়। রঙ বদলায় ঠিকই, কিন্তু দিন বদলায় না। শাসকরা ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে বিরাজমান প্রতিটি পার্থক্যকে— বিজেপি এই বিরোধ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যেমন, পাহাড়ের বসবাসকারীদের ৯৯ শতাংশই খ্রিষ্টান। আর ইতিমধ্যে রাজ্যে ঢুকেছে মনুবাদী আরএসএস ও বিজেপি। তারা ২০১৭ সালে বিধায়ক কিনে ক্ষমতায় এসেছে। এরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মণিপুরের সরল জনজাতি মানুষের দশটি মধ্যে সাতটি আসনেই জয়ীও হয়েছিল। অমিত শাহ একদিকে যেমন কুকিদের জন্য স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিল, অন্যদিকে মেইতেইদের বলেছিলেন, ক্ষমতায় এসে তারা হিন্দুদের অধিকার রক্ষা করবে। রাজ্য অখন্ড থাকবে, মেইতেইদেরও জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। আর বিজেপি শাসনে আরএসএস-এর আক্রমণের লক্ষ্য খ্রিষ্টান কুকিরা। তারাই মেইতেইদের উৎসাহিত করছে তাদেরও জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতির জন্য পথে নামতে; পাশাপাশি মেইতেইদের দাবি মেনে একাধিক গির্জা সরকারের উদ্যোগে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ২০০৮ সালের উভয়ের মধ্যে শান্তি চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেছে। বিদ্বেষ ছড়িয়েছে সরকার। কিন্তু কেন ? আর কি রহস্য আছে।
এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী মনকি বাত শুনতে পাচ্ছি না কেন! রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকে কেন বিজেপি র আই টি সেলের ভাষ্য ছড়িয়ে দিয়ে বলছেন, “কুকি খ্রিস্টানরা বহিরাগত”। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং যার নেতৃত্বে দীর্ঘ তিন মাস ধরে চলছে দাঙ্গা, মারা গেছেন ১৪০ জন মানুষ, গৃহ ছাড়া হয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ। তিনিই শুধু অপদার্থ?
শাসক বিজেপি চাইছে মণিপুরের এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হোক। এই মুহূর্তে বিতাড়িত মণিপুরবাসীরা আশ্রয় নিয়েছে মিজোরাম, মেঘালয়ের মত রাজ্যে। সামনেই খ্রিটান প্রধান মিজোরামের ভোট। এখানে বসবাস করে মণিপুরের কুকি সম্প্রদায়ের অনেক আত্মীয় স্বজন। তারা হুমকি দিচ্ছে ওখানে বসবাসকারী মেইতেইদের। সেখানেও অশনি সংকেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপর আবার ভারত সরকারের খনিজ ও জিওলজিক্যাল ডির্পাটমেন্টের সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে শিল্পপতিদের নজর পড়েছে মণিপুরের বনাঞ্চল।
সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, পূর্ব মণিপুরের জেলাগুলোতে লাইমস্টোন ও ক্রোমাইট, তামা, নিকেল, ম্যাগনেটাইট ও প্লাটিনাম জাতীয় আকরিক আছে। প্রথমে উল্লিখিত দুটি খনিজ পদার্থ যার আনুমানিক পরিমাণ ২৬ মিলিয়ন টন। ওই খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য শুরু হয়ে গেছে কর্পোরেট প্রভুদের কাছে জমি লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া। এবার জনজাতির বসতি ওই জেলাগুলোতে অরণ্য ও জমি থেকে উৎখাত হতে হবে আদিবাসীদের। নতুন অরণ্য বিল এসে গেছে সংসদে। আর আন্তর্জাতিক সীমানার একশো কিলোমিটারের পর্যন্ত অরণ্যভূমিকে মুক্ত করার কোনও বাধা থাকবে না। থাইল্যান্ড থেকে মায়নমার হয়ে মণিপুর ভারতে তৈরি হচ্ছে নতুন করিডর। শাসকদের নজর আছেই। তারা এই প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভুদের অবশ্যই তুলে দিতে বধ্যপরিকর। সেই জন্য বিজেপি মণিপুরের বিচ্ছিন্নতাবাদী দাঙ্গার তাস খেলেছে। চাইছে এই দাঙ্গাই ছড়িয়ে পড়ুক ভারতের মেইন ল্যান্ডে।
এটাই তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার অভিমুখ। বিজেপির লক্ষ্য হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠন। পুণরায় তারা ক্ষমতা পেলে ওদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে আরও ধ্বংসাত্মক অভিযানে নামবে। সংসদীয় ব্যবস্থার কার্যত অস্তিত্ব আর রাখবে না।
তাই আগামী ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেই দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান রক্ষা করতে বিজেপি বিরোধী সকলকে নিয়ে শুধু ভোটে লড়াইয়ের কথা না ভেবে, এখনই যুদ্ধে নামতে হবে। বিভিন্ন এজেন্ডা উত্থাপন করে বামপন্থীদের উদ্যোগী হতে হবে বিজেপি বিরোধী সকলকে ওই লড়াইয়ে সামিল করার।