বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ভারত-বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ধারণা রক্ষা করতে হবে

ভারত-বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ধারণা রক্ষা করতে হবে

রতন গায়েন

photo

ভারতে সংবিধান প্রণীত হওয়ার পঁচাত্তর বৎসর পূর্তিকে স্মরণীয় রাখতে ‘সংবিধান’দিবস পালিত হচ্ছে এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ‘সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ’শব্দবন্ধ রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। একই সময়ে আমাদের প্রতিবেশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়কালে ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে স্থায়ীভাবে স্থান পাওয়া ‘ধর্মনিরপেক্ষ’শব্দটিকে বাতিল করার দাবির সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ সংবিধানকে কবর দেওয়ার জিগির তুলেছে একদল মৌলবাদী। যদিও ভারতের সংবিধান প্রণয়ণের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস এবং তা রূপায়নে দীর্ঘ পঁচাত্তর বছরের পরিক্রমার সঙ্গে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে সংবিধান সংস্কারের জিগিরকে আদৌ একই বন্ধনীতে ফেলা যাবে না। কিন্তু যেহেতু সংবিধান সংস্কারের জিগির দু’ দেশেই একই সময়ে উত্থাপিত হচ্ছে এবং এই জিগিরের মূল উদ্গাতা মৌলবাদী শক্তি, সেকারণে আমরা বিষয়টি আলোচনা করব। এই আলোচনার অভিমুখ হল মৌলবাদীদের অপপ্রচারকে ভোঁতা করে জনমানসে বিভ্রান্তির যে নিরন্তর অপচেষ্টা, তা নিরসনের ও যুক্তিবাদী আলোচনার পরিসরের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা।
আমরা এই নিবন্ধের আমাদের দেশের সংবিধান দিবসের বিতর্ক ও সংবিধান প্রণয়নের আগে-পরে যেসব বিতর্ক উত্থাপিত হয়েছে সেবিষয়ে আলোচনা করব। একইসঙ্গে, সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অভিঘাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব এবং ভারত-ভাবনার সঙ্গে তার সম্পর্ক কত গভীর, সে বিষয়েও আলোচনা করব। তারপরে বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে প্রাপ্ত সংবাদের উপর নির্ভর করে আলোচনা করব।
এই তথ্যটি সকলেই জানেন যে খণ্ডিত ভারতের ২৯৯ জন সদস্য সংবিধান রচনার জন্য সংবিধান সভায় মিলিত হন। প্রায় তিন বছর ধরে পুঙ্খানুপুঙখভাবে সংবিধানের ধারণাগুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার অভিমুখে ছিল বিশাল এই দেশের অন্তত ১৬১৮টি ভাষা, ৬৪০০ জাতিবর্ণ, সংস্কৃতির বিভিন্নতা, ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ইত্যাদি বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে সংবিধানের ধারণাগুলিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা যাতে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের’বাস্তবতার যথাযথভাবে প্রতিফলন ঘটে। সংবিধান রচনার খসড়া কমিটির সভাপতি ড. বি আর আম্বেদকার খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান সভয় পেশ করেন এবং তা অনুমোদিত হয় এবং ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে জাতীয় সঙ্গীত গৃহীত হয়। ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশিকা।
উপরোক্ত তথ্যটি সংবিধান প্রণয়নের সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্হাপনের ও ভারত–ভাবনা গড়ে ওঠার যে দীর্ঘ বিবর্তন অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়েছে, তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল থেকে দেশকে স্বাধীন করার মহাকাব্যিক সংগ্রামের মাধ্যমে।
উল্লেখ করা জরুরি যে, ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময়কে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্ন হিসাবে চিহ্ণিত করা হলেও ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই, জাতপাতের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, জমিদার ও কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে কৃষক-শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ লড়াই ব্রিটিশরাজ কায়েম হওয়ার পর থেকেই জারি ছিল। বিশদে না গিয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহের উল্লেখ করা যায়। এগুলি ১৭৯৯ সালের চূয়াড় বিদ্রোহ, ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সালের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ১৮৩১ সাল সাল থেকে বহু সময় ধরে চলা ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন, ১৮৫৫-৫৬ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৭৫ সালের দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ এবং ১৮৮৯-৯০ সালের মুন্ডা–কোলদের উলগুলান বিদ্রোহ। এইসব বিদ্রোহের অভিমুখ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কৃষক ও সাধারণ মানুষের তীব্র ঘৃণা ও অবিশ্বাস।
পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব জাতীয় কংগ্রেস শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন নীল চাষিদের উপর জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গান্ধী চম্পারণ সত্যাগ্রহে সামিল হয়ে কৃষকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সেটাই ছিল দেশবাসীর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে এক দিকনির্দেশিকা। তাঁরই নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে আমেদাবাদ মিল ধর্মঘট (১৯১৮)। এরপর একের পর এক কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।বামপন্থীরা জমির প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে কেরালায় পুন্নাপ্রা ভায়লার আন্দোলন, বাংলায় তেভাগার লড়াই, আসামে সুরমা ভ্যালির লড়াই, মহারাষ্ট্রে ওরলি অভ্যুত্থান এবং তেলেঙ্গানার সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম। এই লড়াইগুলি দেশের সর্ববৃহৎ শ্রমশক্তির সমস্যাকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। সংবিধান প্রণেতারা এইসব সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্বও দিয়েছেন।
অন্যদিকে সামাজিক বৈষম্য ও জাতপাতের বিভাজনের বিষয়গুলি নিয়ে সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রবাদী জ্যোতিবা ফুলে (১৮২৭-১৮৯০)। ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক ব্যবস্থার ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন জাতপাতের অবলুপ্তি ঘটাতে না পারলেও জাতপাতের শোষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে। অনুরূপভাবে দলিতের পক্ষ নিয়ে ড. আম্বেদকার যে আজীবন লড়াই করেছেন সেই অভিজ্ঞতা সংবিধান প্রণয়নে বিশেষ সহায়ক হয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেস ও তার নেতা গান্ধীজি এইসব ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তরুণ প্রজন্মের নেতা জওহরলাল নেহরু, সুভাষ বসুরা ডোমিনিয়ন স্টেটাসের গণ্ডি অতিক্রম করে পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। স্বাধীন ভারতের শাসন কাঠামোর রূপরেখা তৈরি হল ১৯৩১ সালের করাচি কংগ্রেসের অধিবেশনে। স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হল নতুন ভারতের সংবিধানে প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সমানাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার এবং মৌল শিল্প ও পরিবহণসহ সব সেবামূলক কার্যক্রমে সরকারি মালিকানা নিশ্চিত করা হবে।
ভারতের ভাষাগত, ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বিপুল বৈচিত্র্যকে ঐক্যবদ্ধ করে ভারতের ধারণা তৈরির মূল কারিগর ছিল দেশের জনগণের উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার প্রেরণার উৎসও এই ঐতিহাসিক লড়াইগুলি। এই লড়াইয়ে ভারতের চরিত্র নিয়ে তিনটি ধারণার মধ্যে অবিরাম সংঘাত চলেছিল। কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বাধীন ভারত হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। বামপন্থীরা উপরোক্ত লক্ষ্যের সঙ্গে সহমত হলেও বামপন্থীরা বলেছিল, রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতায় উত্তরণ ঘটানো শুধুমাত্র সমাজতন্ত্রেই সম্ভব। তৃতীয় ধারনার বাহকেরা জনগণের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একপক্ষ ইসলামি রাষ্ট্র এবং অন্যপক্ষ হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করেছে। প্রথম পক্ষ দেশকে বিভাজিত করে সাফল্য পেলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে আস্থা রেখে গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান প্রণয়ন করেছেন।
সংবিধানের ধারণাগুলি পণ্ডিত নেহরু গণপরিষদে প্রদত্ত ২২ জানুয়ারি ১৯৪৭ সালের ভাষণে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে সদস্যদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, সার্বভৌম স্বাধীন ভারতের যাবতীয় ক্ষমতার উৎস হল ভারতের জনগণ। সমস্ত মানুষকে সামাজিক, রাজনৈতিক ন্যায়, সমমর্যাদা, আইনের চোখে সমানাধিকার, চিন্তার ও কথা বলার স্বাধীনতা, নিজ নিজ ধর্মাচরণের অধিকার, সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী এবং জনজাতিদের উপযুক্ত নিরাপত্তা প্রদান করা হবে রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই প্রাচীন দেশ বিশ্বশান্তি রক্ষায় ও দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে। পণ্ডিত নেহেরুর গণপরিষদে এই বক্তব্যের সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে শুধু সংবিধানের প্রস্তাবনায় নয়, সমস্ত সংবিধানের ধারায় তার প্রতিফলন ঘটেছে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত হয়েছে যে, ‘আমরা ভারতের জনগণ’ভারতকে একটি ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছি’এবং সমস্ত নাগরিকদের জন্য ন্যায়,স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে মূল অভিমুখ।
বিতর্ক উত্থাপিত হয়েছে ‘সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দবন্ধকে সংবিধানে যুক্ত করা নিয়ে। ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংবিধান সংশোধন করে এই কাজটি করা হয়েছিল। এই সংযোজন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে ভারতীয় জনতা দলের নেতারা মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই মামলার রায়ে এই আপত্তি অগ্রাহ্য হয়েছে। কোর্টের রায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করার আগে আমরা সংবিধানের মৌলিক অধিকার, নির্দেশতাত্মক নীতিসমূহ ও সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সম্পর্কিত বিষয়ের কিছু ধারার উল্লেখ করব।
মৌলিক অধিকারের পরিচ্ছদে আইনের চোখে সমানাধিকার (ধারা ১৪), ধর্ম জাত বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য না করা (১৫), কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ (১৬), অস্পৃশ্যতার অবসান (১৭), খেতাব প্রদান বিলোপ (১৮), স্বাধীন মতপ্রকাশ, চিন্তার স্বাধীনতা, সংগঠন গড়া, দেশের যে কোনও স্থানে যাতায়াত ও বসতি স্থাপনের অধিকার (১৯), জীবনের সুরক্ষা (২১), বেগার ও মানুষকে আটক না করা (২৩), বিনা বিচারে আটকে নিষেধাজ্ঞা (২২), ধর্মাচরণে ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা(২৫), বিশ্বাসমতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনার স্বাধীনতা (২৬), সংখ্যালঘুদের শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার অধিকার (২৯,৩০) এবং সর্বোপরি এইসব অধিকার হরণ হলে আদালতে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য আবেদন করার অধিকারের স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে দেশের বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক ধারণার স্পষ্ট উল্লেখ আছে সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ের নির্দেশাত্মক নীতিসমূহে। অসাম্য ও বৈষম্য দূরীকরণ, সমদৃষ্টি, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, সম্পদকে জনকল্যাণে পরিচালনা করা, সম্পদকে ব্যক্তি মালিকানায় পুঞ্জীভূত করায় নিষেধাজ্ঞা, সমকাজে সমবেতন, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, শিশুদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা ইত্যাদি নির্দেশনামা (ধারা ৩৮-৪৭) নিঃসন্দেহে সমাজতান্ত্রিক নীতি আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুপ্রিম কোর্ট ২৫ নভেম্বর ২০২৪এ সংবিধানের প্রস্তাবনায় সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শব্দদুটি বাতিলের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। রায় দিয়েছেন, সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারায় সংবিধান সংশোধনের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা সংবিধানের প্রস্তাবনা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে বাধা নেই। আদালতের অভিমত হল, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আলাদা শব্দ হিসাবে না থাকলেও সংবিধানের গোটা অবয়ব জুড়েই তা নীতি হিসাবে প্রবাহিত রয়েছে। বেঞ্চের মতে প্রস্তাবনায় এমন কিছু যোগ করা হয়নি যা সংবিধানের মূল নীতি এবং কাঠামোর পরিপন্থী।
সংবিধানের ছত্রে ছত্রে ভারত-ভাবনার অনুসারী সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ধারণা বিধৃত। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে মৌলবাদী শক্তির অবদান নেই, তারা ভারত–ভাবনার প্রাণভোমরা যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র, তা উপলব্ধি করতে যে অপারগ হবে তা অবাক হওয়ার নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার বিপুল বৈচিত্র্য সত্ত্বেও দেশের ঐক্য রক্ষা করার প্রধান হাতিয়ার। এই শক্তি মৌলবাদী ইউরোপের জাতি রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের ধারণায় ভারতের সংবিধান পুনর্লিখন দাবি করে চলেছেন। অথচ দূরদর্শী সংবিধান প্রণেতারা দেশের ঐক্য ও সংহতিকে গুরুত্ব দিয়ে সংবিধানে ভারতীয় পরম্পরায় ভারতকে ‘ইউনিয়ন অব স্টেটস’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী ধারণায় জনমানসে এক ‘অপর’কে শত্রু হিসাবে চিহ্ণিত করা হয় এবং ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধে অবিরাম বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি করে। সাম্প্রদায়িক হানাহানি জিইয়ে রেখে, রুজি রোজগারের ঐক্যবদ্ধ লড়াই থেকে মানুষের দৃষ্টিকে বিপথগামী করতে চায়। দেশজুড়ে এই শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই জারি আছে। এই লড়াই দেশের সংবিধান রক্ষা ও ভারত–ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখার ভরসা।
ভারতে যখন মৌলবাদী শক্তি সংবিধান ধ্বংসের অপচেষ্টা জারি রেখেছে তখন আমাদের প্রতিবেশি বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি সেই দেশে সংবিধান সংস্কারের নামে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি বাতিলের দাবিতে ‘আন্দোলন’ জারি রেখেছে। তথ্যটি সকলে জানেন যে, ভারত বিভাগের ফলে সৃষ্ট পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুর্বার আন্দোলন ও মরণপণ লড়াই এবং ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগে নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্ম হয়। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ স্থায়ীভাবে স্থান পেয়েছিল। বাংলাদেশের শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে মৌলবাদী শক্তি দেশের হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার ও ধর্মস্থানের উপর হামলার চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের আ্যাটর্নি জেনারেল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন। এটি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত এক সমদর্শী দেশগঠনের প্রাণভোমরাকে বাতিল করার অপচেষ্টা। সংস্কারের নামে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে যে বাতিল করতে সরকার আগ্রহী, সেই আশঙ্কায় সংখ্যালঘুরা যেমন আতঙ্কিত, তেমনই বাংলাদেশে মৌলবাদী দলগুলির হুমকি তীব্রতর হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের মৌলবাদী শক্তি জোরকদমে হিন্দুত্ববাদের ধারণা জনমানসের মননে গভীরভাবে প্রোথিত করে দ্বিমেরুকরণের রাজনীতি করে চলেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক বড় অংশের প্রচারমাধ্যম। এঁরা ক্রমাগত অর্ধসত্য ও গুজব প্রচার করে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষের বিস্তার ঘটিয়ে চলছে শুধু তাই নয়, একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি করেছে। দুই দেশের মানুষ এই দুঃসহ পরিবেশের অবসান চান।
এমতাবস্থায় দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যে ধরনের যোগাযোগ ও কূটনৈতিক স্তরে তৎপরতা প্রয়োজন ছিল তার অভাব আছে বলে মানুষের ধারণা বেড়ে চলেছে। অথচ এই উত্তেজনা দূর করা দু’ দেশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে খুব জরুরি। বাংলাদেশ যেমন ভারতের থেকে আমদানি ও চিকিৎসা সহ অন্যান্য পরিষেবার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, তেমনি ভারতের এক বড় সংখ্যক মানুষ এই ব্যবসা বাণিজ্যে যুক্ত। উল্লেখ করা দরকার যে, বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প এই অস্থিরতায় দারুণভাবে বিপর্যস্ত। প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান ও দেশের ৮৫ শতাংশ রপ্তানি সহায়ক এই পোশাক শিল্পের ভবিষ্যতের সঙ্গে ভারতের কাপড়ের থান রপ্তানিও জড়িত। দু’ দেশের পারস্পরিক বাণিজ্যের স্বার্থে এই অস্থিরতার অবসান জরুরি।
সব শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা যে এই অস্থিরতা ও মৌলবাদীদের অপপ্রচার ও দাপট প্রশমনে দুই দেশের সরকার উদ্যোগ নেবেন। সঙ্গে সঙ্গে দু’ দেশের মৌলবাদ বিরোধী মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যোগ্য ভূমিকা পালন করবেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.