বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

কর্মী ও বেকারের সংহতি

কর্মী ও বেকারের সংহতি

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— গত ২৮ জানুয়ারি কি ভারতের প্রথম ‘আনএমপ্লয়মেন্ট রায়ট’ হয়েছে? সংবাদমাধ্যমের একাংশের রায় তেমনই। সংবাদমাধ্যম তকমা পছন্দ করে, তাই এমন একটি জুতসই শিরোনাম পেলে তারা ছাড়বে কেন? তবে এটা ঠিকই যে, সে-দিন বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের অনেকগুলি জায়গায় রেলের চাকরির প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে যে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে, তাকে অভূতপূর্ব বললে বিশেষ অত্যুক্তি হবে না। ভারতীয় রেলের হাজার চল্লিশেক পদের জন্য লোক নেওয়া হচ্ছে, দরখাস্ত পড়েছিল প্রায় এক কোটি। অর্থাৎ, গড়পড়তা হিসেবে একটি পদের জন্য আড়াইশো জন করে প্রার্থী। অনুপাতটা এ দেশের মাপকাঠিতে খুব বিস্ময়কর নয়, তবে একসঙ্গে এমন একটা বিপুলসংখ্যা আর তার পাশাপাশি আয়োজকদের অপদার্থতা, দুইয়ে মিলে ‘বেরোজগারি-তাণ্ডব’ কথাটার জন্ম হতে পারে বইকি।
শিরোনাম বা তকমা বড় কথা নয়, বড় কথা এই যে, দেশে বেকারত্বের সঙ্কট ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে এবং তা থেকে পরিত্রাণের কোনও আশা সুদূর দিগন্তেও দেখা যাচ্ছে না। লোকসভায় অর্থমন্ত্রী ‘অমৃত কাল’ নামক হাওয়ার নাড়ু ঘুরিয়ে যাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যত জানিয়ে দিয়েছেন যে আলাদা করে কর্মসংস্থানের দায় সরকার নেবে না, অর্থনীতি যেমন যেমন এগোবে, লোকে তেমন তেমন কাজ পাবে। এই নীতিই তিনি গোড়া থেকে চালিয়ে আসছেন, এ-বার খোলাখুলি বলে দিচ্ছেন। অর্থনীতি এগোনো মানে কী, সেই চর্বিতচর্বণের কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা অনেক কাল ধরে দেখে আসছি যে জিডিপি বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়ে না, ‘কর্মহীন বৃদ্ধি’ই এখন স্বাভাবিক বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ, কাজের বাজারে ঘোর মন্দা চলছে এবং চলবে।
কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যানও সরাসরি সেই ছবিই মেলে ধরছে। আজ নয়, মোদি জমানার প্রথম পর্ব থেকেই। তিন বছর আগে এই ফেব্রুয়ারি মাসেই জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (২০১৭-১৮) ভিত্তিতে জানা গিয়েছিল যে দেশে বেকারত্বের মাত্রা চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সে-খবর ফাঁস হওয়ার পরেই সমীক্ষার রিপোর্টটাই ‘প্রত্যাহার’ করে নেওয়া হয়, তার গণনায় নাকি ত্রুটি ছিল! এটাও তত দিনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে নোটবন্দিই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির একটা বড় কারণ— প্রধানমন্ত্রীর মার বলে কথা। তার পরে এল অতিমারি। আমরা বিস্ফারিত নয়নে দেখলাম— এখনও দেখে চলেছি— সেই বিপদ মোকাবিলায় সরকারের চূড়ান্ত অপদার্থতা এবং নির্মম ঔদাসীন্যের যুগলনৃত্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তার পরিণাম কী, সেই বিষয়ে দুটি পরিসংখ্যান দেওয়া যেতে পারে।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র সঙ্গে ২০২১ সালে যৌথভাবে কাজ করেছেন অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেটা অ্যান্ড ইকনমিক অ্যানালিসিস (সিডিইএ)। তাঁদের বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে, ২০১৬-১৭ সালে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন শিল্পে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটির কিছু বেশি, ২০২০-২১ সালে সেটা নেমে দাঁড়িয়েছে দু’কোটি সত্তর লক্ষ, মানে প্রায় অর্ধেক। প্রসঙ্গত, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র জয়ঢাক বাজানো যখন শুরু হয় তখন বলা হয়েছিল ২০২২ সালে উৎপাদন শিল্পে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা দশ কোটিতে পৌঁছবে। অর্থাৎ, যা দ্বিগুণ হওয়ার কথা ছিল, তা অর্ধেক হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেই অবশ্য কোভিডের উপরে সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হবে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সিএমআইই-সিডিইএ-র দেওয়া দ্বিতীয় পরিসংখ্যানটি কম বয়সিদের কর্মসংস্থান নিয়ে। এই পরিসংখ্যানের দুটি অংশ। প্রথমত, ২০১৯-২০’র তুলনায় ২০২০-২১’এ প্রায় সমস্ত বয়সেরই কর্মরত লোকের সংখ্যা কমেছে, স্পষ্টতই অতিমারির কারণে; কিন্তু সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় কমেছে পনেরো থেকে ঊনত্রিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে। কিন্তু, দ্বিতীয়ত, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাঁরা কাজের বাজারে কাজ খুঁজছেন এবং পাননি, তাঁদের সংখ্যা বাড়েনি, কমেছে। অর্থাৎ, অনেকে কাজ হারিয়েছেন, কিন্তু কাজ খুঁজছেন না— তাঁরা কাজের বাজার থেকে সরে গেছেন। এর কারণ, তাঁরা কাজ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, কিংবা যে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন তার গুণমান অত্যন্ত খারাপ এবং/ অথবা উপার্জনও তথৈবচ। বলা বাহুল্য, তাঁদের অনেকেই কিছু না কিছু করছেন, কারণ কিছু না করলে দিন চলবে না, কিন্তু কাজের বাজার বলতে যা বোঝায় সেখানে সেই কিছু-না-কিছুর কোনও হিসাব নেই।
অন্যভাবে বলা যায় যে, একটা বিরাট সংখ্যার লোক— এবং তাঁদের খুব বড় অংশ বয়সে নবীন— কর্মী এবং বেকার, এই দুই বর্গের মধ্যে ঘোরাফেরা করছেন, কিংবা তাদের মধ্যবর্তী অনির্দিষ্ট এলাকায় তাঁদের অবস্থান। বেকারত্বের পরিসংখ্যান নিয়ে যে কোনও আলোচনার সময় এই কথাটা মনে রাখা দরকার। আমাদের দেশে বহু বেকারই আসলে কিছু না কিছু কাজ করছেন কারণ কাজ না করলে তাঁদের দিন চলবে না; আবার বহু কর্মীই রোজগারের দিক থেকে বেকারের শামিল, কাজ না করলে তাঁদেরও চলবে না। এই সমস্যাটা সাম্প্রতিক কালে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে, কারণ অধিকাংশ কাজেরই মজুরি কমেছে, এবং কমেছে কাজে বহাল থাকবার নিশ্চয়তা। আজ যিনি কর্মী হিসাবে একটা আয় করছেন, কাল তাঁর আয় কমে যেতে পারে, পরশু তিনি ছাঁটাই হয়ে যেতে পারেন। এ দেশে অধিকাংশ কর্মী বরাবরই এই ধরনের অনিশ্চয়তার খাঁড়া মাথায় নিয়ে কাজ করে এসেছেন, কিন্তু এখন প্রথমত সেই অনুপাতটা আরও অনেক বড়ে গেছে, এবং দ্বিতীয়ত অনিশ্চয়তার মাত্রাও বেড়ে গেছে প্রবল ভাবে। সেটা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে আমাদের চার পাশে, কাছে এবং দূরে, দেশে ও দুনিয়ায় সর্বত্র অগণন কর্মীর জীবনে।
স্পষ্টতই, এটা খুব বড় একটা সমস্যা। সমস্যা কেবল ব্যক্তি-কর্মীর নয়, শ্রমিক সংগঠনেরও। কর্মীদের কাজ বজায় থাকার অনিশ্চয়তা যত বাড়ে, শ্রমিক সংগঠনের পায়ের তলা থেকে ততই জমি সরে যায়। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই শ্রমিক সংগঠনগুলি কাজের নিশ্চয়তা কমে যাওয়ার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। এই লড়াইটা শ্রমিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলিকে আরও অনেক জোরদার ভাবে এই লড়াইয়ের শরিক হতে হবে। সেখানে বড় রকমের ঘাটতি আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম আইন সংস্কারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ দেখা গেছে, সেটা এই পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। সরকারি নীতি শ্রমিকের অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুললে তবে তার প্রতিবাদ করা হবে, এটা কিছুতেই যথেষ্ট হতে পারে না; শ্রমিকের মজুরি এবং কাজের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বাড়ানোর জন্য সরকারের উপর চাপ জরুরি।
সঙ্কট মানেই সুযোগ
কিন্তু, তার পাশাপাশি, কাজের অনিশ্চয়তাকে কীভাবে শ্রমজীবীর স্বার্থে ব্যবহার করা যায়, সেই অনিশ্চয়তার বাস্তব থেকে কীভাবে শ্রমিক আন্দোলন শক্তি সংগ্রহ করতে পারে, সেটাও ভেবে দেখা জরুরি। কথাটা শুনতে স্ববিরোধী: কাজের অনিশ্চয়তা কী করে আন্দোলনের শক্তির উৎস হতে পারে! এখানেই দ্বান্দ্বিকতার গুরুত্ব, যে দ্বান্দ্বিকতার কারণেই সঙ্কট একই সঙ্গে সুযোগ সৃষ্টি করে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে সঙ্কটের মোকাবিলা আমাদের একটা নতুন স্তরে নিয়ে যায়। সেই স্তরেও সঙ্কট থেকে মুক্তি নেই— সঙ্কট সতত অনিবার্য— কিন্তু সেটা নতুন স্তরের সঙ্কট। সুযোগকে কাজে লাগানোর উপায় একটাই: সংগঠন, বিশ্লেষণ এবং আন্দোলন। এখন আমরা যে স্তরে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে এক দিকে আছে কর্মীদের কাজের ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা অর্থাৎ যে কোনও সময় বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা; অন্য দিকে বিপুলসংখ্যক বেকার, যাঁদের একটা অংশ কাজ খুঁজছেন এবং অন্য একটা অংশ কাজ পাওয়ার আশা হারিয়েছেন। এই ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যেই নিহিত আছে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনকে নতুন পথ দেখানোর, বৃহত্তর পরিসরে প্রসারিত করার, সামাজিক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কেন, কী ভাবে তা সম্ভব, সে বিষয়ে দু’একটা কথা বলা যেতে পারে।
সমাজ বদলানোর কোনও কল্পিত এবং পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য নেই, তার হাতে-গরম পথনির্দেশিকাও নেই, বাস্তব পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই পথ খুঁজতে হবে— মার্কসীয় সংগ্রাম-দর্শনের এই প্রাথমিক সূত্রটিকে যদি আমরা যথার্থ গুরুত্ব দিই, তা হলে খেয়াল করব যে এখন, বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই, কর্মী এবং বেকারদের লক্ষ্য ও কর্তব্যের মধ্যে একটি বড় রকমের সাযুজ্য তৈরি হয়েছে, যা আগে এতটা জোরদার এবং প্রকট ছিল না। এক জন কর্মী যে কোনও সময় কর্মচ্যুত হতে পারেন, আক্ষরিক অর্থেই রাতারাতি তাঁর অবস্থান বেকারের অবস্থানের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পারে— এমনটাই যদি বাস্তব অবস্থা হয়, তা হলে যাঁদের কাজ নেই তাঁদের প্রয়োজন মেটানোর দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইলে কর্মীরাও এখন সেই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাভাবিক ভাবেই মিলিয়ে দেখবেন, কারণ তাঁরা জানেন যে কালই ওই প্রয়োজনগুলো তাঁদেরও প্রয়োজন হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, কাজের অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়তা— ‘প্রিক্যারিটি’— কর্মীর প্রয়োজন এবং বেকারের প্রয়োজনের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে।
এখানেই শ্রমিক আন্দোলনের সুযোগ। সীমিত অর্থে শ্রমিক আন্দোলন থেকে প্রসারিত অর্থে শ্রমজীবীর আন্দোলন হয়ে ওঠার সুযোগ। সেই আন্দোলন কর্মরত শ্রমিকের মজুরি, ভাতা, কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সক্রিয় থাকবে, কিন্তু সেই পরিধিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখবে না। কর্মরত এবং কর্মহীন, দুই গোত্রেরই শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনের দাবি সেই আন্দোলনের বিষয় হয়ে উঠবে। কোন প্রয়োজন? কী ধরনের প্রয়োজন? এই প্রশ্নের কোনও পূর্বনির্ধারিত উত্তর নেই, বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতেই সংগ্রামী প্রয়োজনের ধারণা তৈরি করতে হবে। সংগ্রামী কথাটা এখানে উদ্দেশ্য এবং বিধেয় দুই দিক থেকেই অর্থবহ: এক দিকে যে প্রয়োজনের দাবিতে সংগ্রাম এগিয়ে যাবে; অন্য দিকে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যে প্রয়োজনের ধারণা গড়ে উঠবে, গড়ে উঠতে থাকবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি ‘মৌলিক প্রয়োজন’ (বেসিক নিডস) স্বভাবতই তার অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে দাবিদার হবে সম্মানের সঙ্গে সামাজিক জীবন যাপনের সক্ষমতা— কেবল ওই মৌলিক প্রয়োজনগুলি পূরণ হলেই যে সম্মানের দাবি মেটে না, পূরণ করতে হয় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার, যাকে এক কথায় বলতে পারি ‘স্ব-ক্ষমতা’। সেই দাবি কর্মরত শ্রমিকের, কর্মচ্যুত বা কর্মহীন বেকারেরও।
স্বাভাবিক ভাবেই, এই সংগ্রামী প্রয়োজনের দাবিকে ঘিরে যে আন্দোলন, তাতে শ্রমিক-কর্মীদের পাশাপাশি বেকাররাও শামিল হবেন। তাঁদের কাজের দাবিও অবশ্যই হবে সেই আন্দোলনের অন্যতম বিষয়। এবং, তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, তা যদি নিছক যে কোনও একটা কাজের দাবিতে নিজেকে সীমিত না রেখে সম্মানজনক কাজের দাবি হয়ে ওঠে, তা হলে বহু কর্মরত মানুষও নিজের স্বার্থেই তাতে শামিল হবেন, কারণ তাঁরা কর্মী হলেও তাঁদের কাজ সম্মানজনক নয়— না উপার্জনে, না কাজের চরিত্রে। এবং, উপরের আলোচনার সূত্র ধরে খেয়াল করা যায়, যাঁরা কাজের বাজার থেকে সরে গেছেন বা সেই বাজারে আসেননি, কাজের গুণমান তাঁদের পক্ষেও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, সেই মানের উন্নতি ঘটলে তাঁরাও হয়তো কাজ খুঁজবেন, তার ফলে কাজের দাবিও জোরদার হবে। কর্মী এবং বেকার, এই দুই বর্গের শ্রমজীবীকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখার প্রচলিত প্রবণতা তাঁদের প্রয়োজন-ভিত্তিক দাবি এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ দুর্বল হবে, তার জায়গায় গড়ে উঠবে তাঁদের পরস্পরের সহায় এবং পরিপূরক হিসেবে দেখবার চেতনা।
কেবল সম্ভাবনা নয়
এই সম্ভাবনা কি কেবল সম্ভাবনা? যদি তা-ই হয়, সেটাকেও তুচ্ছ করা চলে না, কারণ এই সম্ভাবনার রূপরেখা তৈরি হচ্ছে বাস্তবের ভিত্তিতেই। কিন্তু শুধু তা-ই নয়, ইতিহাসে এই সম্ভাবনার সমর্থনও আছে। তার একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে লেখা শেষ করব। দৃষ্টান্তটি আর্জেন্টিনার। লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে নব্বইয়ের দশকে নিয়োলিবারাল নীতির প্রবল আধিপত্য শ্রমজীবী মানুষের জীবনসঙ্কটকে বহুগুণ তীব্রতর করে তুলেছিল। অচিরেই তার বিরুদ্ধে নানা দিক থেকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ উত্তাল হয়ে ওঠে। তার একটি অঙ্গ ছিল ‘বেকারদের আন্দোলন’। বিভিন্ন অঞ্চলে বেকাররা— প্রধানত নানা সংস্থা থেকে ছাঁটাই হওয়া কর্মী তাঁরা— প্রথমে সংগঠিতভাবে কাজের দাবি জানাতে থাকেন। সেই দাবিতে সরকারি কর্তারা কর্ণপাত করেন না। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ক্রমশ বিক্ষোভ আন্দোলন দানা বাঁধে, বহু জায়গাতেই রাস্তা অবরোধ হতে থাকে। নতুন শতাব্দীর গোড়ায় আন্দোলন এক অভূতপূর্ব মাত্রা অর্জন করে, ২০০১ সালে একাধিক জায়গায় লক্ষাধিক বেকারের সমাবেশ হয়। কেবল কাজের দাবি নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয় অন্য নানা দাবি, যেমন বেকারদের জন্য বিশেষ সুযোগ, পুষ্টিকর খাবার, চিকিৎসার সুব্যবস্থা, ইত্যাদি। কিন্তু দেখতে দেখতে সেই দাবিগুলো আর কেবল বেকারদের দাবিতে সীমিত থাকে না, স্থানীয় কমিউনিটির দাবি হয়ে ওঠে, যেমন জলের লাইন চাই, রাস্তা চাই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র চাই, এমন আরও অনেক কিছু। এইভাবে বেকারদের আন্দোলন বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। এবং তার সঙ্গে সংযোগ ঘটে শ্রমিক সংগঠনেরও, বিশেষত ১৯৯২ সালে তৈরি একটি সংগঠনের (সিটিএ)। এই সংযোগের ফলে সিটিএ-র চিন্তায় এবং কর্মপন্থাতেও ক্রমশ পরিবর্তন ঘটে, ইউনিয়নের ভূমিকা এবং ক্ষমতার নতুন ধারণা অর্জন করে তারা, বৃহত্তর সমাজের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে, বলা যেতে পারে বেকারদের আন্দোলন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সামাজিক আন্দোলনের (সোশ্যাল মুভমেন্ট) সংযোগ ঘটায়।
২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি লেখায় সমাজতাত্ত্বিক আনা সেসিলিয়া ডিনারস্টেইন আর্জেন্টিনার এই আন্দোলন নিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা করেছেন। লেখাটির উপসংহারে তিনি বেকারদের আন্দোলনের তিনটি প্রধান তাৎপর্যের কথা বলেছেন। এক, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘বেকার’দের পুঁজিবাদী শোষণের শিকার হিসেবে দেখবার চোখ খুলে গেল, তাঁরা আর ওই শোষণ-কাঠামোর বাইরে ‘সামাজিক সমস্যা’ হয়ে থাকলেন না। দেশের নানা জায়গায় কাজ-হারানো বেকাররা আন্দোলনে সংগঠিত হচ্ছেন, এই দৃশ্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, যে শ্রমিকদের (এখনও) কাজ আছে তাঁদের সঙ্গে বেকারদের শ্রেণী-স্বার্থে কোনও ভেদ নেই। বিশেষত খেয়াল করা দরকার যে, বেকারদের নিজেদের চোখও খুলে গেল, তাঁরা নিজেদের শোষিত অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হলেন।
দুই, অনেক জায়গায় বেকারদের সংগঠনগুলি স্থানীয় স্তরে, প্রায়শই স্থানীয় কমিউনিটির সহযোগিতায়, সমবায়ের ভিত্তিতে নানা প্রকল্প তৈরি করল, যেখানে সেই বেকাররা কর্মী হিসেবে যোগ দিলেন। ‘কর্মরত বেকার’ (ওয়ার্কিং আনএমপ্লয়েড) কথাটা রীতিমতো চালু হয়ে গেল তাঁদের জন্য। এই কাজের অন্য মানে তৈরি হল, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সেটা আর মজুরির বিনিময়ে মালিকের কাজ থাকল না, সেটা হয়ে উঠল ‘আমাদের কাজ’। এই কাজের মধ্যে দিয়ে ‘আমাদের’ কথাটার ধারণাও প্রসারিত হল— স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বেকারদের সংযোগ তৈরি হল।
তিন, বেকারদের সংগঠনগুলি কর্মসংস্থান এবং সামাজিক নীতি বিষয়ে প্রচলিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করল, তুলে ধরল ‘নীচের তলা থেকে জনকল্যাণ’-এর প্রতিস্পর্ধী ধারণা। বেকারদের জন্য দাবিদাওয়াগুলো সামাজিক দাবির সঙ্গে মিশে গেল, এবং সেগুলো আর নিছক ‘টিকে থাকার’ (সারভাইভাল) দাবি থাকল না, হয়ে উঠল এক নতুন সমবায়-ভিত্তিক স্ব-ক্ষম জীবনের দাবি।
আর্জেন্টিনা, সমস্ত অর্থেই, আমাদের থেকে অনেক দূরবর্তী। আমাদের শ্রমজীবী আন্দোলনকে আমাদের বাস্তব অনুসারেই গড়ে তুলতে হবে, অচিরে ‘বেকারদের আন্দোলন’ গড়ে তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু বিভিন্ন প্রশ্নে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে, এমনকি এই দেশেরই এক রাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে অন্য রাজ্যের শ্রমিক আন্দোলনের শেখবার অবকাশ বিস্তর। যেমন, শ্রমজীবীর ‘সাবজেক্টিভিটি’ বা বিষয়ী-সত্তার প্রশ্নটি। আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে সেই সত্তার বিবর্তনে বেকারদের সংগঠন ও আন্দোলনের প্রক্রিয়াটি খুব বড় ভূমিকা নিয়েছিল, যা পরবর্তী কালে, বেকারদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পরেও সংগ্রামী রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। সবচেয়ে গভীর প্রভাব এটাই যে, শ্রমিক-কর্মী এবং বেকারদের কাঁধে-কাঁধ-মিলিয়ে আন্দোলনের বাস্তব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল— প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের প্রসার শ্রমিককে যত সমস্যাতেই ফেলুক এবং পুঁজিমালিকদের ক্ষমতা যতই বাড়িয়ে তুলুক, শ্রমশক্তিকে অগ্রাহ্য করে পুঁজির চলবে না, কারণ শেষ অবধি সেটাই তার স্ফীতি ও সমৃদ্ধির উৎস। আমাদের পক্ষেও এই ইতিহাস খুবই প্রাসঙ্গিক, কারণ বিশ্বায়িত পুঁজির, বিশেষত লগ্নি-পুঁজির ক্ষমতাকে আমাদের বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের পরিচালকরা প্রায়শই সার্বভৌম এবং দুর্জয় বলে ধরে নেন, ফলে সেই আন্দোলন তার কাঠামোর ভিতরে দাঁড়িয়েই তার সঙ্গে দর-কষাকষির গণ্ডিতে সীমিত থাকে। সেই গণ্ডি থেকে বেরোতে হলে সংগঠিত শ্রমজীবীর শক্তিতে বিশ্বাস ফেরাতে হবে। সংগঠনের ব্যাপ্তি এবং আন্দোলনের গভীরতা বাড়ানো ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।
ঋণ: Dinerstein, Ana Cecilia (2013), ‘From Corporatist to Autonomous: Unemployed Workers Organisations and the Remaking of Labour Subjectivity in Argentina’, in Howell, J (2013), Non Governmental Public Action and Social Justice, Vol. 2, Palgrave Macmillan 36-59

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.