বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১— সাম্প্রতিক চলমান কৃষক আন্দোলন বিশেষভাবে ভারতের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে এবং সাধারণভাবে দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটা ব্যতিক্রমী অধ্যায়। নয়া উদারবাদী ও ফ্যাশিস্ট রাজনীতির জোটকে মোকাবিলা করেই এগোতে হচ্ছে এই আন্দোলনকে। এই দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের ফসল হিসাবে ফ্যাসিবিরোধী গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমাজের বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত করতেও সফল হয়েছেন আন্দোলনের সংগঠকেরা। আবার কৃষি ক্ষত্রের সঙ্গে সহযোগী পেশাগুলির (মৎস্যচাষ, পশুপালন ইত্যাদি) সংগ্রাম, দেশজোড়া শ্রমিক সংগ্রাম এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির লড়াইয়ের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ হয়ে উঠেছে কৃষক আন্দোলন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বহু এলাকায় টিকে থাকা সামন্ততান্ত্রিক, আধা সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সেগুলিকে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকা সংস্কৃতি (যার প্রকাশ ঘটে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও নারীদের অবদমিত রাখার মধ্যে দিয়ে) সেই সব শতাব্দীপ্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃত্ব খর্ব করার কাজে এবং এজাতীয় বহুবিধ বিষয়ের ওপর— খুবই বড় ধরনের প্রভাব ইতিমধ্যেই ফেলেছে এই আন্দোলন। গোটা দেশজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই সংগ্রামের বহুবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত ও তার প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি ও সমাজের পরিবর্তনগুলি আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। একেবারে আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকা নেতৃত্বই এই কাজটা সবচেয়ে ভালভাবে করতে পারবেন।
সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনকে চলমান সংগ্রাম হিসেবেই দেখাটাই যৌক্তিক হবে এ কারণে যে, সম্ভবত সংসদে এই বিল প্রত্যাহার হওয়ার পর এই সংগ্রামের পরবর্তী পর্বটা শুরু হয়ে যাবে যা তুঙ্গে উঠবে আগামী বছরের গোড়ায় কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে। কারণ এমএসপি এবং স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ নিশ্চিত করার দাবিতে সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত যে কোনও সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্যই হল ক্ষমতার ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে আনা। উদারনীতির প্রবক্তা কর্পোরেট গোষ্ঠী এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিভূরা অত সহজে কৃষকদের কাছে পুরোপুরি ও চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ করতে রাজি হবে না। এবং দীর্ঘায়ত সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের শক্তি ক্ষয় করে নিজেদের অর্থনৈতিক লক্ষ্যপূরণে তারা বারে বারে সক্রিয় হবে। এই সংগ্রাম চলমান আরও একটা কারণে। ভারতে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ফাঁদে পড়া কৃষি ব্যবস্থার দৌলতে বর্তমান শতকের গোড়ার দশকটা জুড়ে কৃষকেরা ছিলেন অসহায়। এই পর্বে অসংখ্য কৃষক ঋণফাঁদে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ কৃষকের আত্মহত্যার পর্বটা ছিল নয়া উদারবাদী পুঁজির আক্রমণের পর্ব এবং অসংগঠিত কৃষকদের পিছু হঠার পর্ব। এই পর্বেই একে একে কৃষি থেকে সরকারি ভর্তুকিগুলি তুলে নেওয়া হচ্ছিল, কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম উপকরণের দাম ধাপে ধাপে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। ফলে চাষ ক্রমশ অলাভজনক হয়ে ওঠায় এবং ফসলের দাম নির্ধারণে সরকার নিজের ভূমিকা পালনে অস্বীকৃত হওয়ায় ঋণফাঁদে পড়া কৃষকদের আত্মহননের পথ বেছে নিতে হচ্ছিল।
কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর পর্বটা শুরু হয় ২০২০র ১৭ সেপ্টেম্বর মোদি সরকার নয়া কৃষি বিল সংসদে পেশ করার আগে থেকেই। এর প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে মধ্যপ্রদেশের মান্দাসৌরে কৃষক জমায়েতে গুলি চালানোর ঘটনার পর। সেবার ৬ জন কৃষক শহিদ হয়েছিলেন। মোদি সরকার যে নয়া উদারবাদী কর্পোরটে গোষ্ঠীর হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করবে না, সেই ঘটনাতেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এরপর থেকেই শুরু হয় আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি পর্ব। শেষ পর্যন্ত নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় স্তরে গড়ে ওঠে কৃষক সংগঠনগুলিএ সমন্বয়। এই পর্বে আমরা দেখেছি ধাপে ধাপে কৃষক জমায়েতের নানা পর্ব। এর মধ্যে একেবারে গোড়ায় নজর কেড়েছিল বামেদের কৃষকসভার নেতৃত্বে নাসিক থেকে মুম্বই লং মার্চ। সেবার ৭০ হাজার কৃষক ১৬৬ কিলোমিটার লং মার্চ করে ঋণমকুব ও স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর দাবিতে ঘেরাও করেছিলেন মহারাষ্ট্র বিধানসভা। এই জমায়েত ছিল অসহায়তা ও আত্মহননের হতাশা থেকে বেরিয়ে এসে লড়াই আন্দোলনের পথে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু। এই লং মার্চই ভবিষ্যত সর্বভারতীয় কৃষক আন্দোলনের বীজ বপন করে দেয়। এর পরবর্তী ৯ মাসে কৃষকদের আন্দোলন ক্রমশ আরও বৃহত্তর পরিসরে ছড়াতে থাকে ও নানা শ্রেণীর কৃষক শক্তিকে জড়ো করে এক সর্বভারতীয় কৃষক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। সেই সংগঠনই ধাপে ধাপে তাদের শক্তিকে সংহত ও প্রসারিত করে, জমায়েত ও সারা ভারত বনধ পালনের পর্ব পেরিয়ে গত বছরের নভেম্বরে দিল্লি সীমান্তে অবস্থান শুরুর মধ্যে দিয়ে লড়াইয়ের একটা চূড়ান্ত পর্বের সূচনা করে। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এসেছে মোদির কৃষি বিল রদের ঘোষণা। তার মানে এই নয় যে, সংগ্রামের চলমানতা এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামনে আরও অনেক পর্ব বাকি রয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্বের সূচনাবিন্দু তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
কারা শত্রু, কারা মিত্র
প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনে আসলে যাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের দাঁড়াতে হয়েছে তারা কারা। তারা হল দেশি—বিদেশি কর্পোরেট গোষ্ঠী যারা এদেশের কৃষিকে নয়া উদারবাদী পুঁজির লুণ্ঠন ক্ষেত্রে বানিয়ে কৃষকদের নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত করে ফেলতে চায়। এরা হল নেসলে, আইটিসি, পার্লে প্রডাক্টস, ব্রিটানিয়া, হিন্দুস্তান ইউনিভর্সাল, আমুল, আদানি উইলমার, পেপসিকো এবং ম্যারিকোর মতো সংস্থা। এরাই এমএসপি ও মান্ডি ব্যবস্থা তুলে দিয়ে কৃষককে চুক্তি চাষে যেতে এবং কম দামে ফসল বেচতে বাধ্য করে এদেশের কৃষি ক্ষেত্র থেকে বিপুল মুনাফা লাভ করতে টাকার থলি নিয়ে বসে রয়েছে। আর এই বিপুল কর্পোরেট শক্তির রাজনৈতিক প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফ্যাশিস্ত বিজেপির সরকার। এই জোট ভারতীয় কৃষির পূর্ণ পুঁজিবাদী রূপান্তর সম্পন্ন করার দায়িত্বে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে চায়। সেই কাজে পুঁজি বিনিয়োগের দায় এড়িয়ে, এদেশে পুঁজিবাদী কৃষি বাজার গড়ে তোলার দায় এড়িয়ে, কৃষককে সব দিক থেকে স্রেফ লুঠ করাই তাদের লক্ষ্য। এ যেন ঔপনিবেশিক আমলের পরবর্তী একটা দ্বিতীয় পর্ব যেখানে শিল্প কৃষিকে অবাধে লুঠ করে পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলতে চায় এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন করতে চায়। সেকারণেইকর্পোরেট শক্তি ও রাষ্ট্রশক্তির এই বিপুল ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে কৃষকদের।
কিন্তু এই শক্তির বিপরীতে কারা? অনেকেই বলেছেন এবং এখনও বলছেন, ধনী চাষিরাই নাকি টাকা জুগিয়ে এই আন্দোলন গড়ে তুেলছেন। তাদের মদত না থাকলে এতদিন আন্দোলন চলত না। আসলে মান্ডি ব্যবস্থার সুযোগ পায় যে বড় চাষিরা তারাই একে টিকিয়ে রাখতে চাইছে। কর্পোরেট মদতপুষ্ট মিডিয়ার এই প্রচারে যারা বিভ্রান্ত
তাদের বিষয়টা আরও খুঁটিয়ে দেখা উচিত। পাতিয়ালার পাঞ্জাবি ইউনিভার্সিটির দুই অধ্যাপক লখিন্দর সিং ও বলদেব সিং শেরগিল একটা সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, গত এক বছরে কৃষক আন্দোলনে জমির মালিকানা রয়েছে এমন কৃষক যতজন মারা গিয়েছেন তঁদের গড় জমির পরিমাণ ২.৯৪ একর। যদি মৃত ভূমিহীন চাষি, যাঁদের জমি নেই এবং অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করেন, তাঁদেরও হিসেবে ধরা যায় , তাহলে দেখা যাবে এক বছরের আন্দোলন পর্বে যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের গড় কৃষি জমির পরিমাণ আরও কম, ২.২৬ একর। এপর্যন্ত আন্দোলন পর্বে মৃত্যু হয়েছে ৭০০র বেশি কৃষকেরা। এঁদের বেশিরভাগ মারা গেছেন খোলা আকাশের নীচে অবস্থানের সময় প্রবল গরম, প্রচণ্ড বৃষ্টি ও প্রবল শীতের কামড় সহ্য করতে না পেরে। এবং মৃতদের গড় বয়স ৫৭ বছর। আন্দোলন পর্বে মারা গেছেন এমন ৪৫০ জন কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এই বিষয়টা তুলে ধরেছেন ওই দুই অধ্যাপক। আন্দোলনে একজনও বড় চাষির মৃত্যুর খবর নেই। ২০১৫-১৬ সালের শেষ কৃষি সেন্সাসের তথ্য অনুযায়ী, পাঞ্জাবে বড় কৃষকেরা মোট কৃষি জোতের মাত্র ৫ শতাংশের মালিক। ওই তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের ৩৩.১ শতাংশ কৃষকের জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের কম এবং সংজ্ঞা অনুযায়ী তাঁরা ক্ষুদ্রচাষি। আধা-মাঝারি চাষিদের জমির পরিমাণ ৪ হেক্টরেরও কম এবং পাঞ্জাবে ৩৩.৬ শতাংশই আধা-মাঝারি চাষি। এদের সঙ্গে জুড়তে হবে ভূমিহীনদের যাঁরা লিজ নিয়ে চাষ করেন। সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র ও আধা-মাঝারি কৃষকেরাই পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ— রাজ্যের মোট কৃষকদের ৬৬.৭ শতাংশ মানে দুই তৃতীয়াংশ। ভূমিহীন চাষিদের যোগ করলে শতাংশ আরও বাড়বে। বাকিরা হলেন মাঝারি চাষি। নাবার্ড অল ইন্ডিয়া ফিনান্সের ফিনান্সিয়াল ইনক্লুসন সার্ভে ২০১৬—১৭র তথ্য অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশে কৃষকের সংখ্যা ছিল ১৭৬.২২ লক্ষ। তবে তাদের ৯২ শতাংশই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। প্রান্তিক চাষির গড় জোতের পরিমাণ ০.৮০ হেক্টর। এবং ক্ষুদ্র চাষিদের জোতের পরিমাণ ১.৪৩ হেক্টর। কৃষি সেনসাসের তথ্যও বলছে, সারা দেশে ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আরেকটি তথ্য অনুসারে হরিয়ানায় কৃষিকাজে যুক্ত ৩৯ শতাংশের নিজস্ব কোনও জমি নেই। এরা বেশির ভাগ জমি লিজে নিেয় চাষ করেন। হরিয়ানায় মোট চালু জোতের সংখ্যা ১৬.২ লক্ষ। এদের ৬৭ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি জোত। বড় জোতের সংখ্যা মাত্র ৩ শতাংশ। এই তথ্যও ২০১৫- ১৬ সালের। গত ৫-৬ বছরে এই বিন্যাসে বড়সড় কোনও রদবদল হয়নি। তবে বহু কৃষিজীবী চাষ থেকে সরে গেছেন চাষ অলাভজনক হয়ে পড়ায়। তার মানে তথ্যই বলছে যে পাঞ্জাব, হরিয়ানা কিংবা পশ্চিম বা পূর্ব উত্তরপ্রদেশ — সর্বত্রই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিহীন, ক্ষুদ্র, মাঝারি কৃষকেরা। তবে এই সব এলাকার চাষ যেহেতু পুঁজিঘন ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর তাই জমির ফলন অনেক বেশি। এবং সেই ফলনের বেশিরভাগটাই বিক্রি করে আর্থিক স্বাচ্ছল্য পেয়েছেন এমনকি এই সব অঞ্চলের ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরাও। কৃষি থেকে পাওয়া আর্থিক সমৃদ্ধি তাঁদে জীবনধারনের মান উন্নত করেছেন। এর সঙ্গে, বিশেষত পাঞ্জাবে, বিদেশে চাকরি অ ব্যবসার সূত্রে পারিবারিক আয়বৃদ্ধিও ঘটেছে। এই আয়ের একাংশ আবার কৃষিতেই বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এদের আর্থিক সমৃদ্ধি দেখেই ইদানিং একদল লোক না জেনে কিংবা পরিকল্পিতভাবে এদের গােয় সম্পন্ন বা বড় চাষির তকমা লাগিয়ে দিচ্ছেন। এই সব অঞ্চলে বড় ও সম্পন্ন চাষি যারা সত্যিই রয়েছেন, তাদের আর্থিক রাজনৈতিক ক্ষমতা এতটাই যে তাদের পক্ষে কর্পোরেটের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলাটা সবচেয়ে সহজ। নিজেদের স্বার্থরক্ষায় কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে এত তিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে নামার কোনও বাধ্যতা তাদের নেই। ঘটনা হল, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের বিপুল সংখ্যকএই ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরাই এই আন্দোলনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছেন নেসলে, আইটিসি, পার্লে প্রডাক্টস, ব্রিটানিয়া, হিন্দুস্তান ইউনিভর্সাল, আমুল, আদানি উইলমার, পেপসিকো এবং ম্যারিকোর মতো সংস্থা ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি বিজেপির বিরুদ্ধে। সত্যি এ এক অসম লড়াই। নয়া উদারবাদী পুঁজির হামলা থেকে নিজেদের জানমাল বাঁচানোর লড়াই।
য়ুঙ্কার পথ বনাম কৃষক পথ
ভারতের মাটিতে য়ুঙ্কার পথ বনাম কৃষক পথ সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন যে এত কষ্টকর, দীর্ঘস্থায়ী পর্বের মধ্যে দিয়ে যেতে পারল তার কারণ এই বিপুল পরিমাণ ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের হিমালয় সমান জেদ ও ধৈর্য। ক্রমশ তাঁদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, কৃষিকাজ যেবাবে অলাভজনক হয়ে পড়েছে, তাতে তিন কৃষি আইন লাগু হলে তাঁরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নিঃস্ব হবেন না, শেষ পর্যন্ত তাঁদের জমিটুকুও চলে যেতে পারে। জমি কৃষকের অস্তিত্বের অংশ, আবেগের অংশ। সেই জমি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ই হাজারে হাজারে ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষককে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। বিষয়টা একভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কৃষক আন্দোলনের নেতা আশিস মিত্তল। তাঁর মতে, ভারতে মোগল আমলে যে কৃষি ব্যবস্থা চালু ছিল, তাতে খাজনা দিতে না পারলে বা ঋণ শোধ করতে না পারলেও চাযিকে জমি থেকে উৎখাত করা যেত না। তার বদলে ১৮০০ সালের পর থেকে বৃটিশ যেসব নতুন কৃষি আইন চালু করছিলে তাতে দেখা গেল খাজনা বা ঋণের অনাদায়ে কৃষকের জমি জমিদার বা মহাজন কেড়ে নিতে পারবে। জমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার এই আশঙ্কাই সেই পর্বে অস্থির করে তুলেছিল কৃষকদের এবং শুরু হয়েছিল তাঁদের নানা ধরনের লড়াই। পরে সেই সব কৃষক সংগ্রাম সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে মিলে গিয়ে দেশজোড়া মহাসংগ্রামে পরিণত হয়। মিত্তলের মতে, এখনকার পরিস্থিতি সেই রকমই। চাষে ক্ষতি স্বীকার করতে করতে কৃষকদের মনে এখন এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, নয়া কৃষি আইন লাগু হলেই কর্পোরেট তাদের জমি লুঠের সুযোগ পর্যন্ত পেয়ে যাবে এবং এই আশঙ্কাই তাদের ঠেলে পথে নামিয়েছে। বস্তুত নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের টানেই তাঁরা দলে দলে এই মহাসংগ্রামে সামিল হয়েছেন এবং ধারাবাহিকভাবে লেগে থেকেছেন। স্রেফ ধনী চাষির স্বার্থরক্ষায় ৭০০ ক্ষু্দ্র ও প্রান্তিক কৃষক নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেবেন — এমন নির্বোধ তাঁরা নন। ভারতে পূর্ণাঙ্গ ভূমি সংস্কার কখনই হয়নি, এমনকি স্বাধীনতার পরেও নয়। অথচ তা না হলে অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ পুঁজিবাদী রূপান্তর সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদীদের পিছু হঠার যুগে সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে যুগপৎ সংঘাত ও বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। এর ফলে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন তাদের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ কৃষি সংস্কারের মধ্যে দিয়ে সামন্তবাদকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা সম্ভব ছিল না। কারণ তাঁরা ছিলেন সেই সামম্ত শ্রেণীরই কমবেশি রাজনৈতিক প্রতিভূ। ফলে জমিদারি প্রথা বিলোপের মতো কিছু সংস্কার ব্যতিরেকে কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হল। সেই কর্মসূচি স্থগিত রাখায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই খাদ্য সঙ্কটে পড়তে হল দেশকে। সঙ্কটে পড়ল কংগ্রেস শাসন। সেই সঙ্কটের সমাধান করতে গিয়ে শ্রীমতি গান্ধী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে এক ধরনের কৃষি সংস্কার করলেন সবুজ বিপ্লব কর্মসূচির মাধ্যমে। যা ভারতের কৃষিতে আংশিক পুঁজিবাদী রূপান্তরের পথ উন্মোচিত করল। অর্থাৎ নীচু থেকে কৃষক সংগ্রাম গড়ে তুলে সামগ্রিক কৃষি বিপ্লবের ধাক্কায় আধা সামন্তবাদী কৃষির বিপ্লবী পরিবর্তন নয়, নেহাতই ওপর থেকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে সীমাবদ্ধ সংস্কার। এর ফলে রাষ্ট্রের তরফে ওপর থেকে নামনো কৃষি সংস্কারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মূলত শক্তি সংহত করল বড় জমিদারেরা। সংস্কারের ফসল তারাই ঘরে তুলল। এভাবে তৈরি হল বড় বুর্জোয়া-বড় জমিদারদের একটা স্থিতিশীল জোট। সেই কৃষি সংস্কার কর্মসূচিতে রাষ্ট্রের ভালরকম হস্তক্ষেপ স্বীকার না করে উপায়ও ছিল না। সেটা ছাড়া সংস্কারের কোনো অর্থই দাঁড়াত না। কৃষি উপকরণে সরকারি ভরতুকি, মান্ডি ব্যবস্থা ও সরকারি দামে ফসল কেনা— কৃষির আধুনিকীকরণের এই তিন ভিত্তিকে কমবেশি কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছিলেন উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ভূমিহীন চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরাও। সস্তাদরে কৃষি উপকরণ, আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষ এবং বিপুল পরিমাণ বাড়তি ফসল সরকারি দামে মান্ডিতে বিক্রির সুযোগ তাঁরা কাজে লাগিয়েছিলেন। একে চুঁইয়ে পড়া প্রক্রিয়াও বলা যেতে পারে। পুঁজিবাদী সেই কৃষি ব্যবস্থা জনিত স্বাচ্ছ্যন্দ তাঁদের ভারতের বাকি অংশের কৃষকদের ক্ষুদ্র, প্রান্তিকও মাধারি চাষিদের থেকে থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। পুঁজিবাদী ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি চাষি এবংঅপুঁজিবাদী ও মূলত আধা সামন্তবাদী ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি চাষিদের মধ্যে পার্থক্যটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছিল ভারতের মাটিতে। এর জেরে ভারতীয় কৃষিতে নানা ধরনের বৈচিত্রপূর্ণ ও জটিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এবার শুরু হয়েছে উল্টো একটা প্রক্রিয়া। নরেন্দ্র মোদির সরকার, ইন্দিরা গান্ধীর মতোই, ওপর থেকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে, প্রতীকী ভাষায় য়ুঙ্কার পদ্ধতিতে, সবুজ বিপ্লবের সময় গড়ে ওঠা কৃষি কাঠামো ভেঙে ফেলতে চাইছে। এবং ভারতীয় কৃষিকে কর্পোরেট পুঁজির লুন্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করতে চাইছে। এটা কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সেই সব ভূমিহীন, ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি চাষিরা যাদের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ বিপ্লবের পূর্বোক্ত তিন ভিত্তির ওপর। নয়া উদারাবাদী আমলে সেই সব সুবিধাগুলো ক্রমশ চলে যাওয়াতেই তাঁরা ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। তাই টিকে থাকতে হলে মোদির এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে তাঁদের উপায় নেই। এই প্রতিরোধের প্রমাণই গত এক বছর ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি দিল্লি, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্রে। লড়াইয়ের এই পথটিকেই আমরা চিহ্নিত করতে চাই কৃষক পথ হিসাবে। এটা ওপরতলার য়ুঙ্কার পথের বিপরীতে নীচুতলা থেকে পুঁজিবাদী রূপান্তরের কৃষক পথ নয়। কৃষিক্ষেত্রের আংশিক পুঁজিবাদী রূপান্তর মারফৎ গত কয়েক দশকে যতটুকু অর্জন করা গেছে, তা রক্ষার জন্য শুধু ভোটাধিকার প্রয়োগের লড়াইতে সীমাবদ্ধ না থেকে, সরাসরি রাস্তার লড়াইতে সামিল হওয়া। এবং দীর্ঘ, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে কর্পোরেট ও রাষ্ট্রশক্তির জোটকে পিছু হঠতে বাধ্য করা। এখানেই আমরা ভারতের কৃষিক্ষেত্রে আরও একবার দেখছি প্রতীকি অর্থে য়ুঙ্কার পথ বনাম কৃষক পথের লড়াই। ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার পরিসরে এই কৃষক পথের লড়াইয়ের গুরুত্ব সূদূরপ্রসারী।
কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
এক্ষেত্রে সংগ্রাম গড়ে তোলার ধরনগুলো সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করা যেতে পারে। প্রথমত, এই আন্দোলন নতুন কৃষিআইনে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এমন ওপরতলা ও নীচুতলার সব অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। নিজেদের শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থেই বড়, সম্পন্ন কৃষকেরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কৃষির সঙ্গে যুক্তি নানা ধরনের পেশার লোকজনের (কৃষি মজুর, গ্রমীণ গরিব মৎস্যজীবী, পশুপালক ইত্যাদি) ধারাও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। যুক্ত হয়েছেন আদিবাসী, দলিত, তপশিলি জাতি ও উপজাতি, শিল্পশ্রমিক থেকে শহুরে মধ্যবিত্তদের একাংশ। এককথায় সমাজের শীর্ষস্তর থেকে একেবারে নীচুতলা পর্যন্ত — নানা ধারার, নানা পেশার জনস্রোতের এক মহামিলনের ধারা। এ এক নতুন মহাভারতের যুদ্ধ। এযুগের যাঁরা কাহিনিকার তাঁদের, সেই প্রাচীন কুরুক্ষেত্রের কাছে ঘটে যাওয়া এযুগের কুরু পাণ্ডবের মহাসংগ্রামের ইতিহাস তাঁদরেও একদিন লিখতে হবে।
দুই, এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাঞ্জাব থেকে। এই আন্দোলনের নেতাদের সূত্রে আমরা জেনেছি, গোড়া থেকেই পাঞ্জাবের নেতারা এবিষয়ে সতর্ক ছিলেন যে, পাঞ্জাব এককভাবে এ লড়াই লড়লে মোদি সরকার একে খুব সহজেই হিংসার পথে ঠেলে দিয়ে দ্বিতীয় কাশ্মীর বানিয়ে দেবে। এই বন্ধ্যা পরিণতি ঠেকাতে তাঁদের রাস্তা ছিল দুটো। এক, এই লড়াইকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও অসহযোগের পথে রাখতে হবে। দ্রুত সংঘর্ষের পথে সমাধান করতে গেলে সুযোগ পাবে উগ্রপন্থীরা। আর সেই সুযোগে আন্দোলন দমনের অজুহাত পেয়ে যাবে শাসক। অতএব দ্রুত নিষ্পত্তির যুদ্ধ এড়িয়ে আন্দোলনকে করতে হবে দীর্ঘায়ত। সেকারণেই লখিমপুর খেরির নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরেও ধীর, স্থির, শান্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন নেতৃত্ব। এই আন্দোলন যে আগাগোড়া শান্তিপূর্ণ পথ আঁকড়ে ধরে থেকে ক্রমাগত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গেছে, সেই পন্থার পিছনে ছিল এই আন্দোলনকে ঘেরাও করে হত্যা করার পথ এড়ানো। শত্রুর ঘেরাও-দমন ও ধ্বংস নীতি যদি আপনি এড়াতে চান তাহলে রণক্ষেত্রকে ক্রমাগত প্রসারিত করে বাড়াতে হবে মিত্রের সংখ্যা। আর নির্ধারক যুদ্ধের পাতা ফাঁদ এড়িয়ে নিজের সুবিধামতো জমিতে বিপক্ষকে টেনে আনতে হবে। যাকে বলে লং রোপে খেলা, বা দীর্ঘস্থায়ী জন আন্দোলন, যে নামই দেওয়া যাক না কেন, এই আন্দোলনের কৌশলের মধ্যে তার ছাপ স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত, পাঞ্জাবের নেতারা জানতেন জিততে গেলে এই লড়াইকে দেশজুড়ে ছড়াতে হবে। সেকারণে গোড়ায় তাঁদের লক্ষ্য ছিল হরিয়ানার কৃষকদের সামিল করা। পরের ধাপে তাঁরা আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে। হিন্দু-হিন্দি বলয়ের একেবারে মর্মস্থলে তাঁরা আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন সফলভাবে এবং তাতে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে। ক্রমশ জাঠ কৃষি বলয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়া ও অর্থনৈতিক ইস্যুকে সামনে এনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের তিক্ততা মুছে ফেলতে সফল হয়েছেন আন্দোলনের নেতারা। কীভাবে এই বিষয়টি কার্যকর হল সেবিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান অনেক নতুন বিষয়কে সামনে আনতে পারে।
বলা যায়, এই দুই হাতিয়ার কাজে লাগিয়েই লক্ষ লক্ষ কৃষককে সমাবেশিত করার কাজে সফল হয়েছে সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন।
তৃতীয়ত আন্দোলন এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পেরেছে কৃষক আন্দোলনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের বিকল্প জীবিকার সন্ধানে যেতে হয়। এটাই দীর্ঘ অবস্থান আন্দোলনকে দুর্বল করে ফেলে। কৃষকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরমক। কৃষিকাজ মরসুমি ও সামিয়ক চরিত্রের। ফলে রোয়া, নিড়ানি, ফসলকাটা বা ঝাড়ার মতো কাজগুলো শেষ করে মাঝের সময়গুলো একজন কৃষক আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবী হতে পারেন। আবার যখন পরিবারের বাকিরা চাষ ও ঘরকন্না সামলাচ্ছেন তখন বাকি এক বা একাধিক সদস্য স্থায়ীভাবে শিবিরে স্বেচ্ছাসেবক হতে পারেন। একদিকে স্থায়ী ও অন্যদিকে রোটেশনে বা পালা করে— দুই ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমের অঢেল যোগান থাকায় কৃষক আন্দোলনে কখনও ভাটা পড়েনি। এরপর আবার বহুকালের জড়তা ভেঙে মহিলারাও রাস্তার আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। সবটা মিলে তৈরি হয়েছে বিশাল এক কর্মীবাহিনি যারা অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ক্যাডারের জোগান দিয়ে গেছে।
আবার পাঞ্জাবে গুরুদ্বারের মতো ধর্মীয় সংগঠন কিংবা হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশে খাপ পঞ্চায়েতও আন্দোলনের পশ্চাদভূমির সংগঠক হিসাবে খুবই বড়সড় ভূমিকা পালন করেছেন। এই সব প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি আন্দোলনেকে বাড়তি সামাজিক শক্তি ও বৈধতা —দুই যুগিয়েছে।
যুগান্তকারী এই আন্দোলনের আরও বহু বৈশিষ্ট্য সময় থেকে সময়ান্তরে ধাপে ধাপে আলোচনা করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
কৃষক আন্দোলন ও পরবর্তী রাজনীতি
আলোচনার শেষে যে বিষয়টির দিকে আমাদের নজর ফেরাতে হবে, তাহল এই আন্দোলন উত্তর ভারতের রাজনীতিতে, বিশেষত রাজনীতির মূলস্রোত ও ভোটের রাজনীতিতে সম্ভাব্য কী প্রভাব ফেলতে পারে।
এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আগামী উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চেষ্টা করবে। কিন্তু এই সব রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় এলেই যে কৃষকদের সব দািব মেনে নেবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। কারণ তাদেরও রাজ্যপাট চালাতে হবে নয়া উদারনীতির এঁকে দেওয়া লক্ষ্মণের গণ্ডীর মধ্যেই। ফলে চাপ দিয়ে দাবি আদায় করার পথেই হাঁটতে হবে কৃষকদের। আবার এই দলগুলিও চাইবে কৃষক আন্দোলনের গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধিদের নিজেদের প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়ে ভোটে সুবিধা আদায় করতে। এভাবে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সম্পর্কের চরিত্রটি দাঁড়াবে দ্বন্দ্বমূলক। সংঘাত ও ঐক্যের মধ্যে দিয়ে পরস্পরকে প্রভাবিত করার প্রয়াস চলতেই থাকবে এবং তার জেরে নতুন নতুন উপাদান যোগ হবে রাজনীতিতে।
দ্বিতীয়ত, কৃষক আন্দোলনের মধ্যেই একাংশ আছেন যাঁরা নিজেরা দল গড়ে নির্বাচনে লড়ার কথা ভাবছেন। লড়াইয়ের ফসল তাঁরা অন্য কোনও দলের অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে নিজেরাই নিজেদের ফসল ঘরে তুলে শক্তিপরীক্ষা করতে চান। এই ধরনের কোনও প্রক্রিয়া সফল হলে তার অভিঘাত হবে ভিন্ন ধরনের।
পাঞ্জাবের রাজনৈতিক ভাষ্যকার তথা সাংবাদিক হামির সিংয়ের মতে কৃষক আন্দোলনের জয় নিঃসন্দেহে পাঞ্জাবের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। তিনি বলেছেন, ‘কৃষক নেতাদের অধীনে আমি পাঞ্জাবে বিকল্প রাজনীতির উন্মেষ দেখতে পাচ্ছি। অবাক হবো না যদি কৃষক নেতারা নিজেদের দল গড়ে তঁদের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যান। সময়ই বলবে একাজে তাঁরা কতটা সফল হবেন। মূলস্রোতের রাজনীতির দলগুলির বিরুদ্ধে একটা পরিসর তৈরি করতে পেরেছে কৃষক আন্দোলন। মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাসও এসেছে যে তাঁরা নিজেদের লড়াই নিজেরাই লড়তে পারেন’। তবে এই প্রক্রিয়ায় কৃষক আন্দোলনের ঐক্য বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই দিকটাও নিশ্চয় আন্দোলনের নেতৃত্বের নজরে থাকবে।
তাছাড়া শুধু লোকসভা বা বিধানসভাই নয়, রয়েেছ পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থাগুলি যেখানে জায়গা পেলে স্থানীয় স্তরে অংশীদারিমূলক গণতন্ত্রের নির্ভরযোগ্য শক্তি হয়ে উঠতে পারেন কৃষকেরা। গণতন্ত্রের শিকড় আরও চারিয়ে যেতে পারে খাপ পঞ্চায়েতের মতো বহুযুগযুগান্তের প্রতিষ্ঠানেও।
এসবই এখনও সম্ভাবনার স্তরে। তবে নিঃসন্দেহে একথা ঠিক যে কৃষক আন্দোলনের অভিঘাতে উত্তর ভারতের মূলস্রোতের রাজনীতিতে স্থায়ী পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।