বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
বিলকিস বানোর আইনি লড়াই স্বাধীন ভারতে কোনও ব্যক্তির পক্ষে সম্ভবত দীর্ঘতম। অপরাধের পর ২২ বছর কেটে গেছে, এখনো আইনের কাছে বিলকিস বানোর বিচারের প্রত্যাশা জারি। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবার কারণ অবশ্যই প্রতিপদে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বাধা ও বার বার উচ্চ ও উচ্চতর ন্যায়ালয়ের কাছ থেকে সুবিচার পাওয়ার চেষ্টা। ঘটনা প্রবাহ সংক্ষিপ্ত হতে পারত দু’ভাবে। এক, যদি নৃশংস ঘটনাটি ২০০২ সালে ঘটার পর স্থানীয় পুলিশ বিলকিসের এফআইআর-এর উপর যথা বিহিত পদক্ষেপ করত, যা তাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে, অথবা যদি সাধারণ যে কোনও মেয়ের মত বিলকিস যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকতেন।
২০০২ এর ঘটনা। গোধরার ট্রেন কাণ্ডে ৫৯ জন করসেবকের মৃত্যুর পর গুজরাতে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে গুজরাতে তার বলি হয়েছিল কয়েক হাজার মুসলমান পরিবার।
২০-৩০ জন সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণে বিলকিস এর পরিবারের ১৪ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে ছিলেন বিলকিসের মা আর তার শিশুকন্যা। বিলকিস তখন ৫ মাসের অন্ত:সত্ত্বা। তাঁকে গণধর্ষণ করা হয়। স্থানীয় পুলিশ বিলকিসের অভিযোগ নিতে চায়নি, যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব বলে বার বার ফিরিয়েছে। শেষে নাছোড়বান্দা বিলকিসকে শাস্তির ভয় দেখিয়েছে। বিলকিস জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে গেছেন, সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্ট। ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই-কে তদন্তের ভার দেয়। ২০০৪ সালে ১৩ জন অপরাধীকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করে সিবিআই। যথার্থ ভাবেই বিলকিস এর আশংকা ছিল যে গুজরাতে তদন্তে হস্তক্ষেপ, সাক্ষীদের ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি ঘটতে পারে। তাই কেস যাতে গুজরাতের বিচার পরিসীমা থেকে বম্বে মহারাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া যায় তিনি তার জন্য আবেদন করেন। বিলকিস বানোর আবেদন মঞ্জুর হয়। শেষ পর্যন্ত, অপরাধের ৬ বছর পর, ষড়যন্ত্র, ধর্ষণ, হত্যা ও অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধের দায়ে ১১ জন অভিযুক্তর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেয় আদালত। তারপরেই অভিযুক্তরা এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যায়। আপীল কোর্টে সিবিআই কয়েক জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারির অনুরোধ জানায়, যারা সক্রিয় ভাবে অপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল। এরপর পর্দা আবার উঠেছে ২০১৬-১৭ তে। অভিযুক্তরা হাইকোর্টের কাছে শাস্তি হ্রাসের জন্য আপীল করেছে। হাইকোর্ট সে সব আপীল খুঁটিয়ে দেখার পর্বে অভিযুক্তদের আইনজীবী আরো কিছু সাক্ষীকে জেরা করতে চান। তাতে আপত্তি জানায় সিবিআই। শেষ পর্যন্ত কয়েকজনের মৃত্যু দণ্ডাদেশের জন্য সিবিআই এর আবেদন খারিজ করে বম্বে হাইকোর্ট, বহাল থাকে সবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ।
২০২২-২৩ এর ঘটনাক্রমে আসার আগে দুটি বিষয়ের উল্লেখ জরুরি। কেস এর তদন্তে সিবিআই এর নিরপেক্ষ এবং সাহসী ভূমিকা। কোনও এক সময় শীর্ষ তদন্ত সংস্থা হিসেবে সিবিআই এর কাছে এটাই প্রত্যাশিত ছিল, গত কয়েক বছরে তারা ক্রমাগত ব্যবহার হয়ে চলেছে রাজনৈতিক প্রতিশোধ স্পৃহা মেটানোর জন্য। তার ফলে সিবিআই এর দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতা দুইই প্রশ্নের মুখে। কিন্তু বিলকিস বানো মামলায় স্থানীয় পুলিশের নিস্পৃহ ও পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবের পর সুপ্রিম কোর্টের আদেশে সিবিআই যে তদন্ত ভার নিয়েছিল ২০০৩ এ, তাদের তদন্ত ও পেশাদারি মনোভাবের পরিচয় তারা টানা ১৩-১৪ বছর দিয়ে গেছে। তাদের উচ্চতম পদাধিকারীরা যে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের সাহস দিয়েছেন এবং পথনির্দেশ করে গেছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অবশ্য, ২০১৪ পর্যন্ত কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের ক্ষমতায় থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে থাকতে পারে। বিলকিস বানোর সঙ্গে যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও আইনজীবীরা এত দিন ধরে আছেন, তাঁদের সাহচর্য ও ভরসা ছাড়া এই ভাবে লড়াই করে নিরন্তর এগিয়ে যাওয়া বিলকিসের পক্ষে সম্ভব হতো না।
নিরন্তর লড়াই। তাও কেবল নিজের প্রতি, পরিবারের সঙ্গে হওয়া ক্রূরতম অপরাধের জন্য রাষ্ট্রের কাছে ন্যায় বিচার পেতে, এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি আর কি ঘটেছে কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকের ব্যক্তি জীবনে? একটি তরুণী মেয়ে যে সন্তানবতী অবস্থায় গণধর্ষিতা হয়েছিল, যার পরিবারের চোদ্দ জন ওই জনতার হাতে নিহত হয়েছিল বলে অভিযোগ, সে কিভাবে নিজের অন্তরের দাহ, বেদনা, ক্ষোভকে গুটিয়ে রেখে এই লড়াই চালিয়ে গেছে তা বোঝা আমাদের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সেই অপরাধীদের মধ্যে একজন কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষের আগে তার মুক্তির জন্য আবেদন করছিল। হাইকোর্ট তার আবেদন বিবেচনা করেনি। তাই সে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্ট এখানে একটি সিদ্ধান্ত নেয় যা পরে কেসটিকে জটিল করে তোলে। তারা রাজ্য সরকারকে ব্যাপারটি বিবেচনা করতে বলে। রাজ্য সরকার এ জন্য একটি কমিটি গঠন করে।
২০২২ সালের ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা উৎসবের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী যখন লাল কেল্লা থেকে তাঁর ভাষণে এমন সব আচরণের, কাজের নিন্দা করছেন যার ফলে মেয়েরা লাঞ্ছিত, অবদমিত হয়, তার আগেই তিনি বিলকিস বানোর কেসের অভিযুক্তদের সাজা মকুবের আদেশ দিয়ে দিয়েছেন। হতবাক বিলকিস ও তার পরিবার দেখছে, গুজরাতের গোধরা সাবজেল থেকে বন্দীরা কেবল বেরিয়ে পড়েছে তাই নয়, তাদের মালা চন্দন পরিয়ে সম্বর্ধনা দিচ্ছেন শাসক দলের কর্মকর্তাগণ। আশ্চর্য ঘটনা, কারণ শাস্তি দিয়েছে বম্বে হাইকোর্ট। তাদের অনুমতি ছাড়া এ ভাবে মেয়াদ মকুব করা আইন সঙ্গত ছিল না। বিলকিসের মনে হয়েছিল, বিচারের উপর থেকে সব আস্থা চলে যাচ্ছে তার।
এখানে বিলকিসের আইনজীবীদের কথা বলা খুব জরুরি। মুখ্য আইনজীবী শোভা গুপ্তা ২০০২ থেকে, যখন বিলকিস জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে গিয়েছিল, তখন থেকে তার সঙ্গে আছেন। গত কুড়ি বছরেরও বেশি সময় তিনি এই কেস লড়ার জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেননি। বরং সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি আর বিলকিস দু’জনেই কিভাবে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছেন। বিলকিসকে তিনি বলেছেন হিম্মৎ বা শৌর্যের প্রতিমূর্তি। অভিযুক্তরা জেল থেকে ছাড়া পেলে বিচলিত হন বহু মানুষ। তাঁদের মধ্যে সুহাসিনী আলি, অধ্যাপক রূপ রেখা বর্মা, সাংবাদিক রেবতী লাল এগিয়ে আসেন সুপ্রিম কোর্টে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করতে। তৃণমূল এমপি মহুয়া মৈত্র, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মীরা বোরবনকরের দায়ের করা আবেদনও এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। আইনজীবী কপিল সিবাল ও অপর্ণা ভাটও এই উদ্যমের আইনি সহায়তা করেন। বিলকিস নিজে কিন্তু এই মকুব আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন করেন পরে। ২০২২ এর নভেম্বর এ। শোভা গুপ্তার মনে হয়েছিল, বিলকিসের নয়, আবেদন করা উচিত অন্য বিশিষ্ট মহিলা দের, কারণ এই মকুবের ফলে যে আশঙ্কা আসন্ন বিপদে পরিণত হতে পারে, তা তো কেবল বিলকিসের একার নয়। কিন্তু যথারীতি অভিযুক্তরা এই আবেদনকে চ্যালেঞ্জ করে বলে, যাঁরা জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন, তাঁদের এই বিষয়ের সঙ্গে কোনও সম্বন্ধ নেই। কাজেই বিলকিসও আবেদন দায়ের করেন। এবছর জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখ সুপ্রীম কোর্ট এই শাস্তি মকুবের রায়কে বাতিল করে গুজরাত সরকার ও হাইকোর্টের সমালোচনা করেন। বলেন, এই বিষয়ে নির্দেশ দেবার এক্তিয়ার গুজরাত হাইকোর্টের ছিল না। এও বলেন, গুজরাত সরকার অভিযুক্তদের সাহায্য করেছে, যা নিন্দাজনক। দোষীদের জেলে ফিরে যেতে হবে অবিলম্বে, সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের পর বিলকিস বানো বলেছেন, মনে হল আবার শ্বাস নিতে পারছি। সুহাসিনী আলি বলেন, এই রায় কে কেবল মেয়েদের জন্য ভাবলে ভুল হবে। ভারতের সংবিধানের জায়গায় মনুস্মৃতিকে স্থাপন করার চেষ্টার এ এক প্রতিরোধ। ভারতের সব নাগরিকের জন্য জরুরি।
ভাবলে অবাক হতে হয়, কিভাবে একজন অভিযুক্ত ২০২২ এ নিজের মেয়াদ কমানোর আবেদন সুপ্রীম কোর্টের কাছে করার সময় একাধিক তথ্য গোপন করে। মহারাষ্ট্র হাইকোর্ট যে এ বিষয়ে সিবিআই এর মতামত চেয়েছিল, সে তথ্য গোপন করা হয়। সিবিআই আধিকারিক ও বিশেষ আদালত এই মকুবের প্রয়োজনের বিরুদ্ধে রায় দেন। এমন কি গুজরাতের দাহোদ জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ অধীক্ষক বলেছেন, এই রকম ভাবে অপরাধীদের মুক্ত করে দিলে বিলকিস ও তার পরিবারের ক্ষতি হবার আশংকা আছে। দোষীদের জেলে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেওয়ার পর ও সুপ্রীম কোর্টের ভর্ৎসনার পর তারা আত্মসমর্পণ করে। সুপ্রিম কোর্টের শাস্তির মেয়াদ কমানো সংক্রান্ত আদেশের অপব্যবহার ঘটেছে এই ভাবে। কিন্তু ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় একজনকে আবার প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গ্রামে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। কারণ, নাকি, এর আগেও প্যারোলের মেয়াদ শেষ করে সে ঠিক সময়ে ফিরে এসেছে।
২০০২ এর হিংস্রতম দাঙ্গার সময় বিরলতম অপরাধের লক্ষ্য হয়েছিল এক নারী এবং সেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। দীর্ঘ দু’দশক ধরে রাজ্যের সরকার ও বিচার ব্যবস্থার অপরাধীর স্বার্থে নিজেদের ব্যবহারের চেষ্টার কোনও শেষ নেই। তবে এই কাহিনীর উজ্জ্বল দিকটি আমাদের মনে রাখতে হবে। দীর্ঘ যাত্রায় বিলকিস একা নন। শীর্ষ আদালত, আইন, আইনজ্ঞ বন্ধুরা, তদন্তকারী সংস্থা তাঁর সঙ্গে পথ চলেছেন। অভিযুক্তদের প্রতি নির্বাচনপন্থী রাজনীতিক ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নানাবিধ সহানুভূতি ও উৎসাহ সত্ত্বেও।