বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
অরুন্ধতী রায় তাঁর ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এর জন্য বুকার পুরস্কার বিজয়ী লেখিকা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ শেখ শওকত হুসেনের সঙ্গে অরুন্ধতী রায়কে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
২০১০ সালে, অর্থাৎ চোদ্দ বছর আগে, অরুন্ধতী রায় তাঁর বক্তৃতায় যুক্তি সহ দেখিয়েছিলেন যে, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। সেই সভায় অন্যতম বক্তা ছিলেন শেখ শওকত হুসেন। কেন্দ্রীয় সরকার সেই সময়ে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচারের জন্য দু’জন বক্তাকেই নানা ধারায় অভিযুক্ত করে। ধারা প্রমাণিত হলে কারাবাসের সর্বাধিক মেয়াদ হতে পারতো তিন বছর। বিষয়টি ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয়ভাবে শাসনে ফেরে। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারার উচ্ছেদ ঘটানো ছিল দলটির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তা সম্পূর্ণ হয়েছে। তারপর কাশ্মীর রাজ্য আজ বিভাজিতও। তবু এত বছর বাদে ধারা পাল্টে বেআইনি কার্যকলাপ নিরোধ আইন বা ইউএপিএ এর অধীনে অরুন্ধতী রায় ও শওকত হুসেনকে অভিযুক্ত করে বিচার চালু করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন দিল্লীর লেফটেন্যান্ট গভর্নর জেনারেল যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। তিনি বিজেপি দলের একজন সদস্যও বটে। অর্থাৎ বিজেপি তার পুরানো যাদুদন্ড— দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী, টুকরে টুকরে গ্যাঙ, আরবান নকশাল ইত্যাদি সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচকরা যা অকেজো করে দিয়েছে, তাকেই কাজে লাগাতে চাইছে। কাজটা কী একথা বলার আগে শ্রীমতি রায় কেন শাসক বিজেপির কাছে আতঙ্কের দু’এক কথায় তা সেরে নেওয়া যাক।
বিশ্বায়ন বিরোধী তৎপরতায় অরুন্ধতী রায়ের ক্ষুরধার লেখনি ও আলোচনা শাসকদের আতঙ্কের বিষয়। তিনি নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির একজন সোচ্চার সমালোচক। তাঁর স্পষ্ট যুক্তি বৈষম্য এবং দারিদ্র্যকে চূড়ান্ত বাড়িয়ে তোলে এই আর্থিক ব্যবস্থা। তিনি দেখান যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাঙ্কের মতো সংস্থার নীতিগুলি সাধারণ মানুষের কল্যাণের চেয়ে কর্পোরেট স্বার্থকে অনেক বেশি সমর্থন করে, এমন সব নীতি প্রচারই তাদের লক্ষ্য।
অরুন্ধতী রায় ভারতের বড় বাঁধ প্রকল্পগুলির বিশিষ্ট সমালোচক। তাঁর মতে বড় বাঁধ প্রকল্প বিপুল সংখ্যায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের বাসস্থানচ্যুতি এবং পরিবেশের অবনতি ঘটায়। তার প্রবন্ধ “দ্য গ্রেটার কমন গুড” নর্মদা নদীর উপর সর্দার সরোবর বাঁধের সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে আলোচনায় সমৃদ্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে নর্মদা বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের বিশিষ্ট্য নেত্রী মেধা পাটেকারকে ২০০০ সালের মানহানির মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাদন্ড দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে বহু সমালোচনা অরুন্ধতী রায় করেছেন, বিশেষ করে ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। তিনি সামরিক হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে সরাসরি সংযোগকে স্পষ্ট করেছেন। গণতন্ত্র রক্ষা এবং স্বাধীনতা প্রসারের যুক্তির আড়ালে এই ধরনের কর্মকান্ডকে আমেরিকা প্রায়ই ন্যায্য বলে যুদ্ধের মাধ্যমে চাপিয়ে দিতে চায় পৃথিবীর দেশে-দেশে।
অরুন্ধতী রায় ভারতের আদিবাসী এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের অধিকারের জন্য এক বিশিষ্ট্য প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তিনি স্পষ্ট করেছেন কীভাবে চালু ও প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলি প্রায়ই এই সম্প্রদায়গুলিকে তাদের বসবাসের অঞ্চল থেকে অপসারণ করে এবং তাদের সমস্ত মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে৷ অরুন্ধতী রায় পরিবেশ সঙ্কটকে পুঁজিবাদসৃষ্ট বলে স্পষ্ট মতপ্রকাশে এক নির্ভিক যোদ্ধা। বক্তব্য ও লেখায় তিনি তাই বিশ্ব জলবায়ু সঙ্কটকে পুঁজিবাদী শোষণ এবং পরিবেশগত অবনতির বিস্তৃত সমস্যাগুলির সঙ্গে যুক্ত করে অক্লান্ত প্রচার করে চলেন৷ তিনি যুক্তি দেন যে বর্তমান অর্থনৈতিক মডেল আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের স্বাস্থ্যের চেয়ে অর্থনৈতিক মুনাফাকে অগ্রাধিকা দেয়। তাঁর মতে এর ফলে তৈরি পরিবেশগত অস্থিরতা মানবতার ভবিষ্যতকে চরম সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অরুন্ধতী রায়ের সাহিত্য প্রতিভা এবং সক্রিয় প্রতিবাদের সংমিশ্রণ তাঁকে সাহিত্য ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। যা অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করেএবং আরও ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই বিশ্বের সমর্থন জোগাড় করার কাজ ছড়িয়ে পড়ছে দিকে ও দিগন্তরে। আর এই ছড়িয়ে পড়ার কাজটা চলছে বহুজাতিক
সংস্থা নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধাচারণের পথে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান অস্বস্তি এখানেই। সংখ্যা গরিষ্ঠতার অভাবে স্বৈরতন্ত্রের রথের চাকা বসে গেছে। তাই এক ঢিলে বহু পাখি মারার কাজে একটা প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দশহাতকে আড়াল করতে কাশ্মীরের অজুহাত। বিরোধিতার মঞ্চে শুধু রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলগুলো আছে এমনটা তো নয়। বরং দেশের জল-জঙ্গল-জমিকে কর্পোরেটদের উপঢৌকন দেবার ক্ষেত্রে বড়ো বাধা আসছে পরিবেশ আন্দোলনের কাছ থেকে। প্রকৃতি সংলগ্ন গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের যাপনে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবিতা — তাদের আমরা আদিবাসী বলে জানি। তাদের জীবন এখনও অনেকাংশে গোষ্ঠীবদ্ধ এবং বনাচারী। প্রকৃতির নাড়ি ছিঁড়ে তাকে মাতৃহীন করার বিরুদ্ধতা তাই আদিবাসীদের মধ্যে প্রবল। চালু উন্নয়নের রাস্তায় হাঁটতে আদিবাসীদের গভীর অনাস্থার প্রকাশ ঘটছে বন-জঙ্গল লোপাটের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে। বড় উন্নয়ন আখ্যায়িত প্রকল্পগুলিতে প্রবলভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবেশ এবং অন্ত্যজ মানুষেরা। এই আন্দোলনের মুখে যারা ভাষা জোগাচ্ছেন তাদের সামনের সারিতে আছেন অরুন্ধতী রায় এবং অবশ্যই মেধা পাটেকরের মতো ব্যক্তিরা। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দল হোক বা শরিক দল সকলেই উন্নয়নের নাগিন বাঁশির সুরে ফনা নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সেই বাঁশি বাজছে। গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে দলগুলিকে নিষ্ক্রিয় রেখে পরিবেশ আন্দোলনকে নির্মূল করার চেষ্টা হচ্ছে। কাশ্মীর বা মানহানি প্রসঙ্গ অতীত খুঁড়ে সেই লক্ষ্যেই তুলে আনা হচ্ছে। বেআইনিভাবে নতুন করে যুক্ত করা হচ্ছে কঠোরতম ধারাগুলো।