বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২ - ১৮৮৬ সালে মেহনতী মানুষ দাবি করেছিল ৮ ঘণ্টার কাজ, প্রায় ১৪০ বছর পরে মেহনতি মানুষের কাছে প্রধান লড়াইগুলি কি? শ্রম দিবসের সকালে এই প্রশ্নটাই মাথায় আসছে। দুনিয়ার মেহনতি মানুষের প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ ভারতে, কাজেই আলোচনাটা এই দেশের জন্য সীমিত রাখা যেতে পারে।
লড়াইগুলি কি এই প্রশ্নে আসতে গেলে তার অঙ্গন সাজাতে হবে। একথা কারো অজানা নয় যে ভারতে প্রায় ৪১ কোটি মানুষ হয় কোনও কাজ করছে, নয়ত কাজ খুঁজছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষেরা আছেন কৃষিতে (গড় বয়স ৪৮), আর সবচেয়ে কমবয়সীরা আছেন উৎপাদন ক্ষেত্রে (গড় বয়স ২৪), তার একটু উপরে আছে পরিষেবা ক্ষেত্র (গড় বয়স ২৬)। এর শতকরা ৯২ ভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত বা কাজ খোঁজায় ব্যস্ত। কর্মক্ষম মানুষ আসলে প্রায় ৮০ কোটি, অর্থাৎ শ্রম শক্তির এক বিশাল অংশ কাজ আর খুঁজছেই না। যারা কাজ করছে তাদের মধ্যে ৮২ ভাগ শ্রমিকের কোন লিখিত নিয়োগপত্র নেই। যারা নিয়মিত মাসমাইনে বা মজুরিতে কর্মরত, তাদের ৬৬ ভাগ শ্রমিকের কোনও লিখিত নিয়োগপত্র নেই। মাত্র ২২ ভাগ শ্রমিকের বেতন সমেত ছুটি আছে। বেশির ভাগ রাজ্যে ভারতীয় শ্রমিকেরা (কাজুয়াল শ্রমিক বাদে) সপ্তাহে ৭ দিন এবং ৫০ থেকে ৫২ ঘণ্টা কাজ করে। আর রোজগার? ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী ক্যাজুয়াল শ্রমিকের মাসিক রোজগার ৯১০০ টাকা, স্ব-নিযুক্ত শ্রমিকের ১৫৮০০ টাকা, অস্থায়ী কিন্তু বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিকের ১১৪০০ টাকার মতো। শ্রমিককুলের যে ক্ষীণ অংশটি স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধা অর্জন করেছিল সেই অংশটির উপর একটানা আক্রমণ হয়ে চলেছে। ২০০৩ সালে উৎপাদন ক্ষেত্রে চুক্তি শ্রমিক ছিল ১৪ ভাগ, ২০১৩ সালে তা হয়েছে ৩৫ ভাগ। সংগঠিত ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা, অন্যান্য সুবিধা বিহীন কাজ এই সময়ে বেড়েছে বার্ষিক ৯% হারে, তুলনায় নিরাপদ চাকরি বেড়েছে বার্ষিক মাত্র ৩% হারে।
এই প্রাথমিক ছবিটার উপর ভিত্তি করে আমরা অঙ্গন সাজাতে পারি। কৃষিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা একটানা কমে যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও যাবে। লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় অঙ্গন স্পষ্টই উৎপাদন-পরিষেবা ক্ষেত্র; যত দিন যাবে মানুষ এই দুই ক্ষেত্রেই কাজ খুঁজবে, কৃষিতে নয়। কিন্তু উৎপাদন পরিষেবার ক্ষেত্রে চারটি বড় ঘটনা পাশাপাশি ঘটছে।
প্রথমত অটোমেশন। খনি, নির্মাণ, যানবাহন, ব্যাঙ্ক-বীমা, ইলেক্ট্রনিক্স, পোশাক-আশাক ইত্যাদি বহু কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের জায়গা নিয়েছে মেশিন। কিন্তু ভবিষ্যতের কাহিনী শুধু অটোমেশন নয়, তারও ওপারে। কৃত্রিম মেধা, রোবটিক্স, বায়নিক্স, মেশিন লার্নিং, ব্লক চেন— বহু নাম আছে তার। মুল কথাটা এই যে হাত-পা ও সাধারণ মাথা দিয়ে যে কাজ করা যায়, তা সবটাই মানুষের বদলে নানা ধরনের মেশিন করে দিতে পারবে। আমেরিকার এক হিসেব বলছে ৭০২ রকমের কাজ/পেশা যা আজ মানুষ করে, তা মেশিন করে ফেলতে পারবে। এ ধরনের হিসেব অন্য দেশেও আছে। তার মানে মেশিনের কাছে মানুষের কাজ হারানোর প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে। শুধু তাই নয়,কাজ পেতে গেলে শুধু হাত পা চালানো নয়, মেশিন চালানোর দক্ষতাও থাকতে হবে। তার মানে শ্রমিকের একটা বড় লড়াই একদিকে হবে মেশিনের বিরুদ্ধে, অন্য দিকে কাজের পূর্ব-শর্ত হবে এমন শিক্ষা দীক্ষা যা মেশিন নির্ভর কাজগুলি করতে দক্ষ হতে হবে। সেই শিক্ষার দাবি শ্রমিককেই তুলতে হবে। তার প্রাথমিক ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। মুম্বাই বাঙ্গালোরে ওয়াশিং মেশিন, ইন্ডাক্সন ওভেন, মাইক্রোওয়েভ, স্মার্ট টিভি, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালাতে জানা গৃহ-কর্মীদের চাহিদা নিরন্তর বাড়ছে। চিরুনি-কাঁচি নির্ভর নাপিতের জায়গা নিচ্ছে মেশিন চালানো হেয়ার ড্রেসার। এ ব্যাপারে একাধিক সমাজ সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠন একসঙ্গে এগিয়ে এসেছে।
দ্বিতীয় যা ঘটছে তা মারাত্মক। অসংগঠিত ক্ষেত্র এখন আর স্থানীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, সারা দেশই তার পরিসর। এই ক্ষেত্রের শ্রমিক তাই এ বছর যাচ্ছে গুজরাত তো পরের বছর যাচ্ছে তামিলনাড়ু। আজ যাচ্ছে একই রাজ্যের এক শহরে, পরের বার যাচ্ছে সেই রাজ্যেরই অন্য শহরে। এরই সঙ্গে আছে কাজের মালিক বদল, এমনকি কাজ বদল। এই ছবিটা পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না, এমনকি সাধারণ শ্রম-গবেষণাতেও আসে না। আমন শেঠি-র The Free Man উপন্যাসে এই শ্রমিককে খুঁজে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় ঝিমলি সেনগুপ্তের Karno’s daughter উপন্যাসে। প্রখ্যাত সমাজতাত্বিক ইয়ান ব্রেমেন বিশ্বের আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তুলনা করে ভারতের এই শ্রমিকের নাম দিয়েছেন শিকারি–সংগ্রহকারী (hunter gatherer)। তারা ছুটতো খাবারের পিছনে, এই শ্রমিকেরা ছুটছে কাজের পিছনে। শ্রমিকের এই ছোটার পিছনে রয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এমনকি একই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কাজের অসম বিকাশ। রাজ্যে রাজ্যে নিষ্ফলা রাজনীতির প্রভাবে এই অসমতা আরও বাড়বে। ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই দুটি স্পষ্ট কর্ম-অঞ্চল অঞ্চল তৈরি হয়েছে; উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত— যেখানে কাজ আছে; আর উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ভারত— যেখানে কাজ নেই।
এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকের লড়াই-এর একটা বড় ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে আন্ত রাজ্য শ্রমিক নেটওয়ার্ক। সাবেকি ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে একটা সর্বভারতীয় ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু সেই ব্যবস্থা দিয়ে আগামীর লড়াই লড়া যাবে না, কারণ তা ফ্যাক্টরি-অফিস শ্রমিকের ইউনিয়ন, আর এই কাজ-শিকারি শ্রমিকের অফিসও নেই, ফ্যাক্টরিও নেই। তাই নতুন লড়াইয়ের জন্য নতুন সাংগঠনিক ব্যবস্থা লাগবে এবং এই ব্যবস্থা তৈরি করতে গেলে সমাজ সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনগুলিকে একসঙ্গে আসতে হবে।
তৃতীয় ঘটনা হল শ্রমিক আর স্ব-নিযুক্ত মানুষের মধ্যে তফাত কমে যাওয়া। স্বনির্ভর দল থেকে ঋণ নিয়ে ছোট ব্যবসা করা, সাইকেল বা বাইক বাহিত মাল সাপ্লায়ার, বাইক বাহিত খাবার বা ঘরোয়া সামগ্রী সাপ্লায়ার, ভ্যান বাহিত ফল সবজি বিক্রেতা, টোটো মালিক-চালক, ভ্যান মালিক-চালক ইত্যাদির সংখ্যা একটানা বেড়ে চলেছে। এরা সবাই স্ব-নিযুক্ত শ্রমিক। ২০১২ সালেই স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল ২১ কোটি, হপ্তা বা মাস মজুরিতে মজুরিপ্রাপ্ত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১৯ কোটি। কিন্তু সমাজ এবং সরকারের রীতি ও নীতি এমনকি গিনতি তা অনেক সময় স্বীকার করে না। এদের স্বনির্ভর ব্যক্তি, আন্ত্রাপ্রেনিউর, অণু-ব্যবসায়ী ইত্যাদি নানা নামে ডাকা হয়। শ্রমিক বললে অধিকারের প্রশ্ন আসে, অন্য কিছু বললে সুযোগের কথা আসে, অধিকারের কথা নয়। এঁরাও অনেকেই নিজেদের শ্রমিক বলতে রাজি নন, অথচ সব রকম খরচা বাদ দিয়ে তাঁদের রোজগার আসলে তাঁদের শ্রমের মজুরি, তার বেশি নয়। শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে কি করে যুক্ত করা যাবে, সেটা আগামী দিনে একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ।
মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে লড়াইটা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। গৃহস্থালী, সাফাই, নির্মাণ, অতিথিসেবা, পোশাকশিল্প ও কৃষিতে মহিলা শ্রমিক পুরুষদের চেয়ে বেশি, কিন্তু মজুরি, শরীরী নিরাপত্তা, দক্ষতার বিচার – অর্থাৎ মানবিক মর্যাদার প্রতিটি বিষয়ে তাঁদের উপর শোষণ পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। মজুরিতে তফাত ২২ থেকে ৩৭%, দক্ষতার বিচারে কাজের ক্ষেত্রে তফাত প্রায় তিনগুণ, কর্মস্থলে হেনস্থার ক্ষেত্রে পুরুষ মহিলাদের মধ্যে তফাতের সঠিক তথ্য না থাকলেও বলা যায়, হেনস্থা মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। একমাত্র সামাজিক সুরক্ষার অভাবের ক্ষেত্রে খুব একটা তফাত দেখা যায় না। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এসবের উপরে আছে কাজ পাওয়ার সমস্যা। কাজ খুঁজছেন, অথচ কাজ নেই, মেয়েদের এই সংখ্যাটি বোধহয় সারা দুনিয়ায় ভারতেই সবচেয়ে বেশি, এবং কাজ করতে পারেন কিন্তু কাজ খুঁজছেনই না, এই সংখ্যাটিতেও আমরা বিশ্বগুরু। সর্বশেষ সার্ভে বলছে কর্মক্ষম মহিলাদের মধ্যে মাত্র ৯ ভাগ রোজগারি কাজে যুক্ত আছেন, কর্মক্ষম পুরুষদের মধ্যে ৬৭ভাগ। ওই একই সার্ভে থেকে আরও উঠে আসছে যে ৮১ লক্ষ মহিলা বেকার এবং কাজ খুঁজছেন, কিন্তু ৯০ লক্ষ মহিলা বেকার এবং কাজ খুঁজছেনই না।
মহিলাদের ক্ষেত্রে শুধু কাজ চাই বললে দাবিটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সন্তান পালন, কর্ম ক্ষেত্রের দূরত্ব, যাতায়াতের নিরাপত্তা ইত্যাদি সামাজিক ও পরিকাঠামোগত বাধাগুলি না কমলে কাজ থাকলেও মেয়েদের পক্ষে কাজ করা ও চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যে সব শহরে মহিলা-চালিত ট্যাক্সি বা অটো চালু হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে তাঁরা মহিলা যাত্রী নিতে পছন্দ করেন, পরিবারের কাজের জন্য সন্ধ্যার পরে পরিষেবা বন্ধ করে দেন, এবং কিছু কিছু রুটে গাড়ি নিয়ে যেতে চান না। উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতে গ্রামের মেয়েরা ঘরে থেকে কাজ করতে চান— কাঁথাস্টিচ, এম্ব্রডয়ারি, বিড়িবাধা, সেলাই, মুড়িভাজা ইত্যাদির কাজ। একমাত্র দক্ষিণ ভারতেই দেখা যায় মেয়েরা বাইরে বেরতে রাজি, তাই সারা দক্ষিণ ভারত জুড়ে মহিলা অতিথি শ্রমিকের সংখ্যা স্ব-নিযুক্তি এবং মজুরিযুক্ত কাজের ক্ষেত্রে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে মেয়েদের কাজের দাবির লড়াইয়ের সঙ্গে কাজের উপযুক্ত পরিবেশের জন্য লড়াই— দুটোই আগামীতে একই মঞ্চ থেকে লড়তে হবে, এবং এক্ষেত্রেও শ্রমিক সংগঠন ও সমাজ সংগঠনগুলিকে এক মঞ্চে আসতে হবে। শ্রমিকের মর্যাদার সঙ্গে সমাজের মর্যাদাও জড়িত তাই আগামীতে শ্রমিকের মর্যাদার লড়াই আর সমাজের বৃহত্তর মর্যাদার লড়াই এক হোক এটাই কামনা।