বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে কেন্দ্রের শাসক শিবিরের ধর্মীয় আস্ফালন। জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার মসজিদ— একে একে খোলা হচ্ছে আলাদীনের বন্ধ করা কলসীর মুখ। বিজেপি ভাবছে, ওই কলসী থেকে যে দৈত্য বেরিয়ে আসবে তারাই যাদুক্ষমতাবলে তাদের জিতিয়ে দেবে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন। ফলে ১০ বছরের শাসন অন্তে শুরু হবে আরও ৫ বছরের হিন্দু ফ্যাসিস্ত শাসন।
একথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, গেরুয়া শিবিরের মতো এর আগে আর কোনও শক্তিই ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার প্রয়াসে এত সংগঠিত ভাবে নামেনি। মুসলিম শাসকেরা এক প্রজন্মেই বুঝে গিয়েছিলেন, জোর করে এই দেশকে মুসলিম দেশ বানানো যাবে না। তাই প্রাজ্ঞ আকবর হাতিয়ার করেছিলেন সমন্বয়ের রাজনীতিকে। তাঁর আমলেই ঐক্যবদ্ধ ভারত পৌঁছেছিল আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক শান্তির এক নজিরবিহীন পর্যায়ে। ব্রিটিশরা এদেশে ক্ষমতা দখলের পর রাজনীতির সুবিধার্থে হিন্দু-মুসলিম বিরোধকে টিকিয়ে রেখেছিল এবং উস্কে দিয়েছিল। এরই পরিণতিতে দেশভাগ। তবে রাষ্ট্র ধর্মে তারা কখনই ধর্মকে উচ্চ আসনে বসায়নি। তারা সেখানে চালু করেছিল আধুনিক সংসদীয় রাজনীতির আইন কানুন, রীতি নীতি। আইনের শাসনের শক্তিতেই তারা আসমুদ্র হিমাচলকে এক সাম্রাজ্যপাটে বেঁধে রেখেছিল। স্বাধীন ভারত ব্যতিক্রমীভাবে গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করলেও গণতন্ত্রের ভাবাদর্শকে সমাজের গভীরে চারিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এদেশে গণতন্ত্র প্রসারিত হয়েছিল শুধুমাত্র ভোটাধিকার পর্যন্ত। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার কাজ এড়িয়ে গিয়েছিল কংগ্রেস। সেই অসমাপ্ত কর্মসূচির দুর্বলতাই রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ভিতে ফাটল ধরিয়েছে এবং সেখান থেকেই উঠে আসছে হিন্দি–হিন্দু ফ্যাসিবাদ। ধীর ধীরে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে খর্ব করে ও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিয়ে উঠে আসছে ফ্যাসিবাদী শক্তি। এর জোরের জায়গাটা হল, উত্তর ও মধ্য ভারতের জনসমাজ যার আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ অংশ হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। সেটা করা হচ্ছে একদিকে ওবিসি, দলিত, আদিবাসীকে হিন্দুত্বের মধ্যে টেনে এনে এবং অন্যদিকে নিম্নবর্ণের ওপর উচ্চবর্ণের হিংসাত্মক একাধিপত্য চাপিয়ে দিয়ে। এই ফ্যাসিবাদের দুর্বলতার জায়গাটা হল, ভারত রাষ্ট্রে যে বহু ভাষাভাষী শক্তি, আঞ্চলিক শক্তি রয়েছে, যারা মতাদর্শের দিক থেকে হিন্দু-হিন্দি ফ্যাসিবাদকে মানতে নারাজ, তাদের সঙ্গে গেরুয়া শিবিরের সংঘাত। এই দুই ধারার মধ্যে এখন এগোচ্ছে ভারতবর্ষ। হিন্দুত্ববাদীদের বাড়তি সুবিধা হল, দেশের মধ্যেকার ক্রোনি পুঁজি ও দেশের বাইরের বহুজাতিক পুঁজি বেপরোয়া লুঠের সুযোগ পেয়ে গেরুয়া শিবিরের জন্য তাদের অর্থভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছে। ফলে টাকা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিফলিত জনতার রায় বদলে দিচ্ছে তারা কিংবা সুকৌশলে কিনে নিচ্ছে ভোটদাতাদের সমর্থন। উল্টোদিকে, ভাষাবাদী ও আঞ্চলিকতাবাদী বিরোধী শিবিরের দুর্বলতা হল, ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জনজাগরণ ও রাস্তার লড়াইয়ের বদলে তারা ক্রোনি ও বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষমতায় যেতে বা টিকে থাকতে চাইছে। গেরুয়া ও গেরুয়া বিরোধী শিবিরের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে মৌলিক ফারাক না থাকায় জমনতকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ বিরোধী শিবির। বামেদের বিকল্প আর্থিক কর্মসূচি থাকলেও তা মেনে নিতে নারাজ বিরোধী দলগুলি। ফলে প্রান্তিক হয়ে পড়া বামেরাও জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পারছে না। ঠিক এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে অবাধে লুঠপাট চালিয়ে দেশের অর্থনীতকে তছনছ করে ফেলছে গেরুয়া শিবিরের শাসকেরা।
সংক্ষেপে বললে, ২০২২ সালের এপ্রিলে ভারতে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৭.৭৯ শতাংশ, যা ২০১৪ সালের মে মাসের পর সর্বোচ্চ। একাটানা ৭ মাস বেড়েই চলেছে খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি। এই বৃদ্ধি এপ্রিলে ছিল ৮.৩৮ শতাংশ, যেটা ২০২০ সালের নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ। এছাড়া ভোজ্য তেলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ১৭.২৮ শতাংশ, সব্জিতে ১৫.৪১ শতাংশ, মশলা ১০.৫৬ শতাংশ যা ইদানীংকালে সর্বোচ্চ। পরিবহণ ও যোগাযোগের খরচ বেড়েছে ১০.৯১ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৭.২১ শতাংশ, জুতো-চপ্পলে ১২.১২ শতাংশ, জামাকাপড়ে ৯.৫১ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতে, এদেশে মুদ্রাস্ফীতির সহনীয় মাত্রা ২ থেকে ৬ শতাংশ। এনিয়ে এপ্রিল পর্যন্ত টানা চার মাস সেই সীমার ওপরে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। (তথ্যসূত্র: মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন)। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে পেট্রোল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি।
বিশ্বব্যাঙ্কের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু জানিয়েছেন, বেকারি এবং কাজের অভাবই ভারতীয় অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভারতে যুবদের মধ্যে বেকারির হার প্রায় ২৪ শতাংশ যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এবছরের এপ্রিলে পাইকারি দামে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ১৫.০৮ শতাংশ যা গত ২৪ বছরে সর্বোচ্চ। গত ১৩ মাসে ধরে এই মু্দ্রাস্ফীতির হার রয়ে গেছে দুই অঙ্কে। তাঁর আশঙ্কা, ভোগ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার খুব শিগগিরই পৌঁছে যাবে ৯ শতাংশে। এটাও যাতে দুই অঙ্কে পৌঁছে না যায় সেদিকে নজর দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
ওপরের সংখ্যাতথ্যগুলোকে সাধারণের ভাষায় ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, গত কয়েক মাসে চাল, ডাল, চিনি, তেল, নুন, মশলা, শাক-সব্জি, ট্রাম, বাস, ট্রেন, অটোর ভাড়া, জুতো কিংবা চটি, মোবাইল রিচার্জ— সমস্ত কিছুর খরচ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অথচ লোকের মাইনে বাড়েনি। আর বেকারির হার? সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, ২৩ মে সারা দেশে বেকারির হার ছিল ৭.২ শতাংশ, শহরে ৮.৪ শতাংশ এবং গ্রামে ৬.৭ শতাংশ। এর ওপর ধরতে হবে কোভিড পর্বে যাঁদের চাকরি গেছে তাঁদের হিসেব। এক কথায় বললে, লোকের কাজ নেই। মজুরি কম কিংবা অনিশ্চিত অথচ জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে।
এর জন্য অর্থনীতির সাধারণ অবস্থা আদৌ দায়ী কিনা প্রশ্ন উঠছে। অধ্যাপক নির্মলেন্দু নাথ ও অধ্যাপক তরুণ কুমার মন্ডল সম্প্রতি এক নিবন্ধে দেখিয়েছেন, বর্তমান বাজারে বর্ধিত চাহিদার কোনও চিহ্ন নেই। আবার মজুরি বৃদ্ধি করার দরুণ লোকের হাতে বাড়তি টাকা গেছে— এমনও ঘটেনি। অর্থশাস্ত্র বলছে মূলত এদুটি কারণেই মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গিয়ে জিনিসের দাম বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে তাঁরা মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন অ্যাডমিনিস্টার্ড প্রাইসকে। অর্থাৎ সুপরিকল্পিত ভাবে দাম বাড়িয়ে জোর মুনাফা লুঠে নিচ্ছে একদল ধান্দা পুঁজির মালিক। এই দুই অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘কোভিড ১৯ অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রধানত তিনটি ‘রিলিফ কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। প্রথমটি হল, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩ অনুসারে দানাশস্য রেশন মারফৎ সরবরাহ করা। দ্রেজ ও সোমানচি হিসেব কষে দেখিয়েছেন ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে রেশন ব্যবস্থা মারফৎ খাদ্যশস্যের সরবরাহ দ্বিগুণ হয়। দ্বিতীয়টি হল, ১০০ দিনের কাজ মারফৎ দরিদ্র জনসাধারণের হাতে কিছু অর্থ পৌঁছে দেওয়া। এখানেও দ্রেজ হিসাব কষে দেখিয়েছেন, ২০১৯ এর তুলনায় ২০২০ সালে ১০০ দিনের কাজে দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তৃতীয়ত, ‘বার্ধক্য ভাতা’ ও ‘জনধন যোজনা’ প্রকল্প মারফৎ কিছু অর্থ দরিদ্র মানুষের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। এভাবে সরকারের হিসাবে প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা যা জিডিপির ১০ শতাংশ, ২০২০ সালের মে পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়েছে।...ধান্দা পুঁজির লক্ষ্য হচ্ছে এই অর্থ গরিব দেশবাসীর কাছ থেকে সুকৌশলে বের করে নেওয়া। এই কৌশলটি হল ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো।’ (সূত্র- আজকাল, ২১ মে, ২০২২, পৃষ্ঠা ৪)
দেখাই যাচ্ছে, গেরুয়া শিবিরের শাসকদের লক্ষ্য দুটি। জ্বালানির দামকে একেবার বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে এবং তারপর কিছুটা কমিয়ে এমন করে রাখা যাতে সরকারের ভাণ্ডার উপছে পড়ে। অন্যদিকে দাম বাড়িয়ে ধান্দা পুঁজির মালিক ও অন্যরা বিপুল মুনাফা লুঠে নিতে পারে। এইভাবে দাম বাড়িয়ে লুঠের রাস্তা যদি আপনি খুলে দেন, তাহলে অর্থনীতির ইস্যু থেকে লোকের নজর ঘোরানো দরকার হয়ে পড়ে। তখনই দরকার হয় জ্ঞানবাপী, মথুরা, তাজমহল, কুতুবমিনার কিংবা বোরখার মতো ইস্যু যা ক্রমাগত ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের পরিবেশে মদত যোগাতে পারে। এবং অর্থনৈতিক ইস্যুকে পিছনে ঠেলে দিতে পারে। আর দরকার হয় বুলডোজার যা দিয়ে ক্রমাগত আপনাকে জানমাল উচ্ছেদের ভয়ের মধ্যে রেখে দেয়া যায়। এই কৌশল খুবই পরিকল্পিতভাবে দেশজুড়ে কাজে লাগানো হচ্ছে।
লুঠ, মন্দির–মসজিদ আর বুলডোজার— এদেশে ফ্যাসিবাদের নির্দিষ্ট প্রকাশ প্রতিক্রিয়ার এই তিন ত্রিশূলে। সাধারণভাবে নির্বাচনে ভোট দিয়ে এই শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। কারণ জনমতের প্রতিফলন যাতে ঠিকমতো ঘটতে না পারে, ভোটে জিতলেও যাতে সাংসদ, বিধায়ক কিনে ক্ষমতায় থাকা যায়— এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এই শক্তির হাতে রয়েছে। এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণের, সেগুলির গণতান্ত্রিক উপাদানসমূহকে ঝেড়ে ফেলার কাজ জারি রয়েছে। এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গেলে একরোখা, দুঃসাহসী পথে মানুষকে নামাতে হবে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিকে সংহত করতে হবে। আদালত রায় দিয়ে বাঁচা যাবে এমনটা আশা করে বসে থাকলে হবে না। কারণ আদালত তখনই নড়েচড়ে বসে যখন মানুষ নড়াচড়া শুরু করে। একই সঙ্গে হিন্দি–হিন্দু মতাদর্শের সঙ্গে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবির মতো অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা এবং আঞ্চলিক মতাদর্শের সঙ্ঘাতকে আরও তীব্র করতে হবে। মতাদর্শের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী, বহুমুখী সঙ্ঘাত এবং অন্যদিকে একরোখা রাস্তার লড়াই ছাড়া শুধু ব্যালটের ওপর ভরসা করে এই শক্তিকে হঠানো যাবে না। সেজন্য আগে ধান্দা পুঁজির স্বার্থবাহী অর্থনৈতিক নীতির বিকল্প অর্থনৈতিক নীতি ঘোষণা করতে হবে।