সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন বিষয়ে প্রাসঙ্গিক বিতর্ক
সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন বিষয়ে প্রাসঙ্গিক বিতর্ক
সুচিক্কণ দাস
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২— সদ্য সমাপ্ত দেড় বছর ব্যাপী ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের জয়কে এখনও মেনে নিতে নারাজ নয়া উদারবাদী সংস্কারপন্থীরা। কেন ভারতীয় কৃষির বাজার নয়া উদারবাদী পুঁজির শোষণের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদি, এনিয়ে তাঁদের আফশোশের শেষ নেই। সেকারণে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনকে সুবিধাবাদী, বড় কৃষকদের আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করার কাজটা তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের আরও বক্তব্য, সাধারণ, ‘কম বোঝা’কৃষকদের রাস্তায় নামিয়ে, পিছন থেকে তাদের মদত দিয়ে, নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিল ধনী কুলাকদের লবি।
সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন কার্যত বড় চাষিদের সুবিধা আদায়ের আন্দোলন, আমাদের আপত্তি এই বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী প্রচারের বিরুদ্ধে। আমরা মনে করি, আসলে মোদির তিন কৃষি বিল প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদেরও অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান মানতে চেয়েছিল। এই আইন কার্যকর হলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হতেন। ফলে তারাই ছিলেন বিজেপি ও কর্পোরেট জোটের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। এই আন্দোলনের জয় আসলে তাঁদেরই জয়। তবে যেহেতু চলতি কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বড় চাষি ও বড় শস্য ব্যবসায়ীদের স্বার্থও, তাই ভারতীয় কৃষিতে নয়া উদারবাদ যে সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে তার বাইরে নড় বড় ও মাঝারি কৃষকেরাও। মোদির কৃষি আইন তাঁদের সঙ্কটকে যে আরও তীব্র করে তুলবে সেটা তাঁরাও বুঝতে পেরেছিলেন। সেকারণে তাঁরাও এই সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
শ্রেণীগত স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার কারণেই যে সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারি কৃষকেরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, এই বক্তব্যের সমর্থনে আমরা ধাপে ধাপে যুক্তিগুলি হাজির করব। তিনটি সূচককে ব্যবহার করে এই কাজটি করার চেষ্টা হবে। ১)সাধারণভাবে সারা ভারতের কৃষিতে এবং বিশেষ ভাবে সবুজ বিপ্লবের এবং একইসঙ্গে সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্র পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কৃষিতে সংখ্যার বিচারে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের গুরুত্ব, ২)সাধারণভাবে সারা ভারতের কৃষিতে এবং পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে মোট কৃষিজোতের বিচারে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের গুরুত্ব, এবং ৩)এবং পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে আত্মঘাতী কৃষকদের মধ্যে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সংখ্যাধিক্য।
সংখ্যার বিচারে সবুজ বিপ্লবের ৩ রাজ্যে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের গুরুত্ব
সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের মূল এলাকা হল পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র, যা আবার তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মূল কেন্দ্রও। পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে চাষ এবং প্রধানত বাজারের জন্য বা বিক্রির জন্য ফসল চাষ, এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য (যদিও এসব পুঁজিবাদী কৃষি সম্পর্কের মধ্যে এখনও সামন্ততান্ত্রিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের অর্থনীতিগত ও অর্থনীতি বহির্ভূত নানাস্তরীয় সম্পর্ক টিকে রয়েছে)। জোতের আয়তনের ভিত্তিতে এই এলাকার কৃষকদের শ্রেণীগত বিন্যাস কীরকম — আমরা প্রথমে সেই সংক্রান্ত তথ্যগুলি পেশ করব। সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তথ্যও উল্লেখ করব শুধুমাত্র পাঠকের অবগিতর জন্য।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন বর্গের কৃষকদের যে বিন্যাস দেওয়া হয়েছে সেগুলির ভিত্তি হচ্ছে জোতের আয়তন। মানে একজন কৃষক কতটা জমি চাষ করছেন সেই ভিত্তিতে তাঁকে নির্দিষ্ট বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভারত সরকারের কৃষি সেনসাসে বিষয়টি রয়েছে এইভাবে— ক)প্রান্তিক কৃষকের জমির পরিমাণ ০.৫থেকে ১ হেক্টর, খ)ক্ষুদ্র কৃষকের জমির পরিমাণ ১ থেকে ২ হেক্টর, গ)আধা মাঝারি কৃষকের জমির পরিমাণ ২ থেকে ৩ হেক্টর এবং ৩ থেকে ৪ হেক্টর, ঘ)মাঝারি কৃষকের জমির পরিমাণ ৪ থেকে ৫ হেক্টর, ৫ থেকে ৭.৫ হেক্টর এবং ৭.৫ থেকে ১০ হেক্টর এবং ঙ)বড় কৃষকের জমির পরিমাণ ১০ থেকে ২০ হেক্টর বা তার বেশি হেক্টর। সাধারণভাবে ১ হেক্টর মানে ৭.৪৭ বা সাড়ে সাত বিঘা।
সারণি ১
প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি, আধা মাঝারি, বড় চাষির শতাংশ:
রাজ্যভিত্তিক বিন্যাস- ২০১৫–১৬
রাজ্য | প্রান্তিক | ক্ষুদ্র | আধা–মাঝারি | মাঝারি | বড়
|
হরিয়ানা | ৪৯.২৯ | ১৯.২৮ | ১৭.০৭ | ১১.৮১ | ২.৫৪ |
পাঞ্জাব | ১৪.১৩ | ১৮.৯৮ | ৩৩.৬৭ | ২৭.৯৩ | ৫.২৮ |
উত্তরপ্রদেশ | ৮০.১৮ | ১২.৬৩ | ৫.৫১ | ১.৫৮ | ০.১০ |
পশ্চিমবঙ্গ | ৮২.৮১ | ১৩.৪১ | ৩.৫৩ | ০.২৪ | ০.০১ |
সারা ভারত | ৬৮.৪৫ | ১৭.৬২ | ৯.৫৫ | ৩.৮০ | ০.৫৭ |
সূত্র— এগ্রিকালচারাল সেনসাস ২০১৫–১৬, ভারত সরকারের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দপ্তর।
ওপরের সারণির তথ্যগুলি কোন ধরনের প্রবণতাকে স্পষ্ট করছে সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রাথমিক কিছু কথা।
সারা দেশের ছবি
আমরা ওপরের সারণি থেকে তিনটি বিষয় দেখতে পাচ্ছি। এক, সারা দেশের কৃষিজীবীদের বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠই প্রান্তিক কৃষক (৬৮.৪৫%)। এর সঙ্গে যদি ক্ষুদ্র কৃষকদের শতাংশ (১৭.৬২%)যোগ করা যায় তাহলে দাঁড়াবে ৮৬.০৭%। এদের সঙ্গে আধা–মাঝারি কৃষকদের (৯.৫৫%)যোগ করলে হয় ৯৫.৬২%। এর ফলে ছবিটা দাঁড়াচ্ছে তাহল এদেশের কৃষিজীবীদের ৯৫ শতাংশের বেশি কৃষকই প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারি চাষি। তার মানে, ভারতের কৃষি সমস্যা আসলে এই সব প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদেরই সমস্যা। তাদের স্বার্থ বাদ দিয়ে কোনও কৃষি আইন পাশ বা কার্যকর করা হলে তা দাঁড়ায় সম্পূর্ণ কৃষক স্বার্থবিরোধী। এখানে আরও একটা বিষয় বলে রাখা দরকার। যে জোতের ভিত্তিতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারিদের ভাগ করা হয়েছে, সেই জোতের মধ্যে থাকা সব জমির মালিক এই সব কৃষকেরা নন। এঁদের জোতের মধ্যে নিজের জমি ছাড়াও রয়েছে লিজ নেওয়া জমি। সুতরাং, আরও বিশদে গিয়ে হিসাব কষলে দেখা যাবে এঁদের মধ্যে রয়েছেন গেছেন ভূমিহীন চাষিরাও, যাঁরা শুধুমাত্র জমি লিজ নিেয় চাষ করেন। একই ভাবে এই হিসাবের বাইরে রয়েছেন কৃষিশ্রমিকেরা।
হরিয়ানা
এবার নজর দেওয়া যাক সেই তিন রাজ্যে যেগুলিকে বলা হয় এদেশে উন্নত, পুঁজিবাদী কৃষির তথা সমৃদ্ধ কৃষকদের মডেল এলাকা বলে প্রচার করা হয়। এর মধ্যে যাচ্ছে হরিয়ানায় মোট কৃষিজীবীদের ৪৯.২৯% প্রান্তিক কৃষক এবং ১৯.২৮% ক্ষুদ্র কৃষক। এদের সম্মিলিত শতাংশ হল ৬৮.৫৭। অর্থাৎ তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের অন্যতম পীঠস্থানেই, সেই ‘বিপ্লব’শুরুর ৬ দশক পরেও, বিপুল পরিমাণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন সেই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্রচাষিরাই যাদের জমির পরিমাণ ০.৫ থেকে ২ হেক্টর পর্যন্ত। মনে রাখা দরকার, এসবই নিজের মালিকানাধীন জমি নয়। এর মধ্যে ঢুকে রয়েছে লিজ নেওয়া জমিও। ফলে ৬৮.৫৭%এর মধ্যে কত শতাংশ আদতে ভূমিহীন কৃষক সেই সংখ্যাটা সামনে এলে ছবিটা আরও স্পষ্ট হবে। এর সঙ্গে যদি আমরা আধা–মাঝারি কৃষকদের (১৭.০৭ %)জুড়ে নিই তাহলে শতাংশ দাঁড়াবে ৮৫.৬৪। এভাবে দেখা যাচ্ছে, তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের পীঠস্থানের কৃষিক্ষেত্রে বিপরীত মেরুর দুই প্রান্ত হল একদিকে ৮৫.৬৪% প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষক এবং এরাই বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মেরুর অন্যপ্রান্তে রয়েছেন ১৪.৩৫% মাঝারি ও বড় চাষি, যাদের মধ্যে বড় চাষিদের সংখ্যা ২.৫৪%, দুপক্ষের মিলিত শতাংশ হল ১৪.৩৫%।
পাঞ্জাব
সবুজ বিপ্লবের আরেক কেন্দ্র পাঞ্জাবের কৃষকদের বিন্যাসে দৃশ্যত একটু অন্য ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এখানে প্রান্তিক কৃষক ১৪.১৩% এবং ক্ষুদ্র কৃষক ১৮.৯৮ %। দুই শতাংশ মেলালে দাঁড়ায় ৩৩.১১। এই রাজ্যে আধা– মাঝারি কৃষকের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি, ৩৩.৬৭ %। হরিয়ানার মতো এই রাজ্যেও যদি প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকদের সংখ্যা মিলিতভাবে হিসাব করা হয় তাহলে ওই রাজ্যের কৃষিজীবীদের মধ্যে তাদের শতাংশ দাঁড়াবে ৬৬.৭৮ বা রাজ্যের মোট কৃষিজীবীর দুই তৃতীয়াংশ। এই রাজ্যে অন্য মেরুতে রয়েছেন ৩৩.২১% মাঝারি ও বড় চাষিরা যাঁদের মধ্যে বড়চাষিরা আবার মোট কৃষিজীবীর ৫.২৮% । পাঞ্জাবে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিকদের সংখ্যা কম, আধা–মাঝারিদের সংখ্যা বেশি, এর অন্যতম কারণ হতে পারে যে ওই রাজ্যে জমির মালিক চাষির সংখ্যা তুলনায় বেশি। ভূমিহীন কিন্তু জমি লিজে নিযে চাষ করা কৃষকেরা সংখ্যা কম। আধা মাঝারিদের জমির পরিমাণ ২ থেকে ৪ হেক্টর পর্যন্ত। তবে এদের মধ্যে ২, ২.৫, ৩, ৩.৫, ৪ একর— এভাবে মালিকানার স্তরের ক্রম–বিভাজন করা গেলে কী ছবি বেরিয়ে আসবে তা এখানে স্পষ্ট নয়। এই রাজ্যে আবার মাঝারি কৃষকদের শতাংশ বেশ উল্লেখযোগ্য।
উত্তরপ্রদেশ
বিজেপির তথাকথিত সাধের উত্তম প্রদেশের চেহারাটা কী রকম? দেখাই যাচ্ছে এই রাজ্যে মোট কৃষিজীবীদের ৮০.১৮% প্রান্তিক এবং ১২.৬৩% ক্ষুদ্র কৃষক। সব মিলিয়ে এরা হলেন রাজ্যের মোট কৃষিজীবীর ৯২.৮১ শতাংশ। সবুজ বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র উত্তরপ্রদেশের কৃিষতে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের এই সুবিপুল গরিষ্ঠতাই আভাস দিচ্ছে এই রাজ্যের কৃষির পিছিয়ে পড়া চরিত্রের। ফলে বিজেপির হরিৎ ক্ষেত্র কতটা হরিৎ এনিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এর সঙ্গে আধা মাঝারিদের শতাংশ (৫.৫১)যোগ করলে হয় ৯৮.৩২% । এখানে বিপরীত মেরুতে রয়েছে ১.৬৮ শতাংশ মাঝারি ও বড় চাষি, যাদের মধ্যে বড় চাষি শতকরা মাত্র ০.১০%। মানে বড় চাষিদের সংখ্যা নগণ্যই। তবে এই রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলা, সবুজ বিপ্লবের কারণে যে জেলাগুলি তুলনায় সমৃদ্ধ হিসাবে দাবি করা হয়, সেখানকার কৃষিজীবীদের অর্থনীতিগত ও সামাজিক বিন্যাসে রাজ্যের অন্য এলাকাগুলির তুলনায় তফাৎ রয়েছে। তাতেও অবশ্য রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের সর্বত্র প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি চাষিদের গুরুত্ব কমে না।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রান্তিক (৮২.৮১% ) ও ক্ষুদ্র চাষির (১৩.৪১%) মোট শতাংশ হল ৯৬.২২%। এই রাজ্যে আধা মাঝারি মা মাঝারিররা নগণ্য হলেও আছে। কিন্তু বড় চাষি প্রায় নেইই। বাম আমলের ভূমি সংস্কার কর্মসূচি এরাজ্যের কৃষিকে অন্য চেহারা দিয়েছিল। ফলে দেশের অন্য অনেক এলাকার তুলনায় এরাজ্যের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের বিকাশ কিছুটা অন্য ধরনের। উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে স্রেফ অঙ্কের তুলনা করলেই হবে না। পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের ক্ষমতায়ন তাদের সারা ভারতের কৃষকদের থেকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।
সারণি ২
মোট জোতের কত শতাংশ ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, আধা মাঝারি, মাঝারি, বড় চাষির অধীন
রাজ্যভিত্তিক বিন্যাস— ২০১৫–১৬ (শতাংশ)
রাজ্য প্রান্তিক ক্ষুদ্র আধা–মাঝারি মাঝারি বড়
হরিয়ানা ১০.৮৫ ১২.৭৩ ২২.২৩ ৩২.৩৬ ২১.৮৩
পাঞ্জাব ২.৩৬ ৭.৩৩ ২৪.৮৮ ৪৩.৭৫ ২১.৬৮
উত্তরপ্রদেশ ৪১.৮২ ২৩.৯২ ২০.৪০ ১১.৮৯ ১.৯৭
পশ্চিমবঙ্গ ৫৩.৩৯ ২৮.৩১ ১২.৭৬ ১.৫৪ ৪.০০
সারা ভারত ২৪.০৩ ২২.৯১ ২৩.৮৪ ২০.১৬ ৯.০৭
সূত্র— এগ্রিকালচারাল সেনসাস ২০১৫–১৬, ভারত সরকারের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দপ্তর।
সারণি ২ থেকে যে বিষয়গুলি আমরা দেখতে পাচ্ছি—
হরিয়ানা
হরিয়ানার ৪৯.২৯% প্রান্তিক কৃষকের হাতে রয়েছে মাত্র রাজ্যের মোট কৃষি জোতের মাত্র ১০.৮৫%। আবার ১৯.২৮% প্রান্তিক কৃষকদের হাতে রয়েছে রাজ্যের মোট কৃষি জোতের মাত্র ১২.৭৩%। সবমিলিয়ে ৬৮.৫৭% প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা হাতে রয়েছে রাজ্যের মোট কৃষিজোতের মাত্র ২৩.৫৮% চাষের জমি। এর সঙ্গে আধা–মাঝারিদের হাতে থাকা জোতের পরিমাণের শতাংশ (২২.২৩%)যোগ করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৪৫.৮১ শতাংশ। অর্থাৎ জোতের মালিকানার বিচারে হরিয়ানার প্রান্তিক, ক্ষুদ্র চাষিরা বেশ দুর্বল। তবে তাঁদের সঙ্গে আধা মাঝারিদের সংখ্যা যোগ করলে দেখা যাবে, মোট কৃষিজীবীর ৮৫.৬৪ %, তাঁদের হাতে রয়েছে রাজ্যের মোট জোতের অর্ধেকের কিছু কম। অন্যদিকে ১১.৮১ % মাঝারিদের হাতে রয়েছে মোট জোতের ৩২.৩৬% এবং ২.৫৪ % বড় চাষির হাতে রয়েছে মোট জোতের ২১.৮৩%। মাঝারি ও বড়দের মিলিত জোতের সংখ্যা ৫৪.১৯%। তার মানে এই রাজ্যর কৃষিতে মাঝারি ও বড় চাষিদের আধিপত্য বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু কৃষিজোতের শতাংশের বিচারে দুপক্ষের মধ্যে খুব আকাশপাতাল তফাৎও নেই (৪৫.৮১% ও ৫৪. ১৯%)। এই দিক থেকে দেখলেও হরিয়ানার কৃষিতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারিদের গুরুত্বকে আদৌ খাটো করা যাচ্ছে না।
পাঞ্জাব
পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে বিষয়টা এরকম। রাজ্যের মোট কৃষি জোতের ২.৩৬% রয়েছে প্রান্তিক কৃষকদের (১৪.১৩%) হাতে। ক্ষুদ্র কৃষকদের (১৮.৯৮%)হাতে রয়েছে ৭.৩৩% জোত। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্রদের হােত সব মিলিয়ে রয়েছে মোট জোতের প্রায় ১০%। আধা মাঝারি কৃষকদের (৩৩.৬৭%)হাতে রয়েছে মোট কৃষিজোতের ২৪.৮৮%। সব মিলিয়ে পাঞ্জাবে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারি কৃষকদের হাতে মিলিতভাবে রয়েছে মোটকৃষি জোতের ৩৪.৫৭%। অন্যদিকে মাঝারি (২৭.৯৩ %)ও বড় (৫.২৮%)কৃষকদের হাতে রয়েছে যথাক্রমে রাজ্যের মোট জোতের ৪৩.৭৫% ও ২১.৬৮%। মিলিতভাবে এর পরিমাণ হল ৬৫.৪৩%। অর্থাৎ পাঞ্জাবে মোট জোতের এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারি কৃষকদের হাতে এবং বাকি দুই–তৃতীয়াংশের কিছু কম জোত রয়েছে মাঝারি ও বড় কৃষকদের হাতে। তবে মাঝারি চাষিরা সংখ্যায় এই রাজ্যের বড় চাষিদের ৫ গুণেরও বেশি। এতে থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, পাঞ্জাবের কৃষিতে আধা মাঝারি ও মাঝারি চাষিদেরই আধিপত্য রয়েছে। এটা পাঞ্জাবের কৃষি ব্যবস্থার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যদিও রাজ্যের কৃষিতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারিদের গুরুত্বও যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান।
উত্তরপ্রদেশ
উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে কৃষকদের শতাংশ ও জোতের বিন্যাস এরকম। রাজ্যের প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকদের হাতে রয়েছে মোট কৃষি জোতের যথাক্রমে ৪১.৮২%, ২৩.৯২% এবং ২০.৪০%। মিলিতভাবে ধরলে এই রাজ্যে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকদের (৯৮.৩২%)হাতে রয়েছে মোট কৃষি জোতের ৮৬.১৪%। বিপরীতে ১.৬৮% মাঝারি ও বড় কৃষকদের হাতে রয়েছে মোট জোতের ১৩.৮৬%। এর অর্থ এই রাজ্যে মাঝারি ও বড় চাষিদের গুরুত্ব খুবই কম। অন্যদিকে প্রায় গোটা কৃষিক্ষেত্র দখলে রেখেছেন প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারিরা।
পশ্চিমবঙ্গের জোতবিন্যাসের ছবিও ওপরের সারণি থেকেই স্পষ্ট। আবার সারা ভারতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকদের (৯৫.৬২%)হাতে রয়েছে ৭০.৭৮% কৃষি জোত। অন্যদিকে মাঝারি ও বড় কৃষকদের হাতে রয়েছে ২৯.২৩% কৃষিজোত।
কয়েকটি মন্তব্য
ওপরের সারণিগুলি থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, সারা ভারতে কৃষিক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকেরাই। আবার মাঝারি ও বড় চাষিদের মধ্যে প্রাধান্য মাঝারিদেরই।
হরিয়ানায় প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকেরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের অধীনস্থ জোতের পরিমাণ রাজ্যের মোট কৃষিজোতের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। আবার শতাংশের বিচারে মাঝারি ও বড় চাষিদের জোতের সংখ্যা অর্ধেকের কিছু বেশি। অর্থাৎ দু পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তির তফাৎ থাকলেও রাজ্যের কৃষিতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারিদের গুরুত্বকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
পাঞ্জাবে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারি কৃষকদের অধীনে রয়েছে মোট জোতের ৩৪.৫৭% বা এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। এদের মধ্যে আধা মাঝারিদের সংখ্যা যথেষ্ট থাকায় ছোট জমির মালিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে অনুমান করা যায়। আবার মাঝারি ও ধনী কৃষকদের হাতে রয়েছে রাজ্যের মোট জোতের দুই–তৃতীয়াংশের কিছু কম। যদিও এই দুই বর্গের মধ্যে বিশেষ করে মাঝারি চাষিদের দাপটই বেশি।
উত্তরপ্রদেশে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকেরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের অধীনে থাকা জোতও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে মাঝারি ও বড় জোতের সংখ্যা মোট কৃষিজমির এক দশমাংশের সামান্য বেশি।
এককথায়, হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ— এই তিন রাজ্যের কৃষিতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারি কৃষকদের পরিসর বা স্পেস বিপুল। আবার, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা দুই রাজ্যেই বড় চাষিদের চেয়ে মাঝারি কৃষকদের পরিসর অনেক বেশি। এই দুই রাজ্যে বড় চাষিদের হাতে রয়েছে মোট জোতের এক পঞ্চমাংশের সামান্য বেশি। দুই রাজ্যের কৃষিতে বড় ও মাঝারিদের প্রভাব ও প্রতাপ যথেষ্ট।
প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সঙ্কট ও কৃষক আত্মহত্যা
পাঞ্জাব
কৃষক আত্মহত্যার তাৎপর্য নিয়ে সবচেয়ে বিশদে কাজ হয়েছে পাঞ্জাবে। এই রাজ্যের কৃষিতে আধা মাঝারি ও মাঝারি কৃষকেরাই (৩৩.৬৭% ও ২৭.৯৩%, মিলিতভাবে ৬১.৬%)সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের জোতের পরিমাণও বেশি (২৪.৮৮% ও ৪৩.৭৫%, মিলিতভাবে ৬১.৬৩%)। সেকারণে এখানকার কৃষিক্ষেত্রের বিন্যাসটা আরও একটু খুঁটিয়ে বোঝা যেতে পারে।
পাঞ্জাবে মোট জেলা ২৩টি। এগুলি তিনটে অঞ্চলে বিভক্ত— মালওয়া, দোয়াবা ও মাঝা। ২৩টির মধ্যে ১৫টি জেলাই পড়ে মালওয়া এলাকায়। দোয়াবা ও মাঝা অঞ্চলে পড়েছে ৪টি করে জেলা। পাঞ্জাব সরকারের তথ্য অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পাঞ্জাবে আত্মঘাতী হয়েছেন ৩৩০০ জন কৃষক। এদের ৯৭% ছিলেন মালওয়া এলাকার জেলাগুলির বাসিন্দা। বাকিরা দোয়াবা ও মাঝা অঞ্চলের। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পাঞ্জাবে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ছিল ১৫০০ জন। তার মানে ২০০০ সাল থেকে শুরু হওয়া দশকের শেষ চার বছরে পাঞ্জাবে আত্মঘাতী হয়েছেন ৫০% কৃষক। এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (উগ্রহান গোষ্ঠী)। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন নিয়ে যৌথভাবে সমীক্ষা করেছেন পাতিয়ালার পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি, অমৃতসরের গুরু নানকদেব ইউনিভার্সিটি ও লুিধয়ানার পাঞ্জাব এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকেরা। সেই সমীক্ষা জানাচ্ছে, পাঞ্জাবে ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কৃষক ও কৃষিশ্রমিক মিলিয়ে আত্মঘাতীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬০৬ জন। এঁদের মধ্যে কৃষক ৯০০৭ জন। সমীক্ষা থেকে আরও জানা গেছে, সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে যে ৭০০ জন কৃষক শহিদ হয়েছেন তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই পাঞ্জাবের। আবার এঁদেরও ৮০% মালওয়া এলাকার জেলাগুলির বাসিন্দা।
মালওয়া এলাকার জেলাগুলিতে কৃষক আত্মহত্যা কেন বেশি কেন? অন্যভাবেও প্রশ্নটা করা যায়। তা হল, সবুজ বিপ্লব সমৃদ্ধ পাঞ্জাবে এত কৃষক আত্মহত্যা কেন? এবিষয়ে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, মালওয়া অঞ্চলের বেশিরভাগ কৃষকই ক্ষু্দ্র কিংবা প্রান্তিক চাষি। এবং এই অঞ্চলে কৃষিজমির ভাড়া বা লিজ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়াটাই সঙ্কটের কারণ। এঅঞ্চলে একর পিছু জমির ভাড়া (লিজ) দিতে হয় বছরে ৫০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। অথচ দোয়াব বা মাঝা অঞ্চলে এর পরিমাণ ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এক একর জমিতে একটা শস্য চাষে আয় হয় মোটামুটি ৩২ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। এভাবে একাধিক ফসল চাষ করে যে আয় হয় তার ৭৩ থেকে ৯৫% চলে যায় জমির ভাড়া মেটাতে। ফলে এখানে চাষে কার্যত কোনও লাভ নেই। মালওয়া এলাকায় বিকল্প পেশার সুযোগ নেই। তাই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ও চড়া দামে জমি লিজ নিয়ে চাষ করতে বাধ্য হন এবং কোনও কারণে ফসল মার খেলে ক্রমাগত ঋণফাঁদে জড়িয়ে পড়েন। এবং শেষ পর্যন্ত ঋণের দায়ে অনেককে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। তাছাড়া মালওয়া এলাকার বহু কৃষককে বইতে হয় ক্যানসার চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার। এই অঞ্চলে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা খুবই বেশি এবং একটা ট্রেনই আছে যাতে চেপে দলে দলে কৃষক পরিবারের সদস্য এমন ক্যানসার রোগীদের রাজস্থানে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। এই অঞ্চলে ক্যানসার ছড়ানোর অন্যতম বড় কারণ ভূগর্ভস্থ জলের দূষণ। এটাও কৃষকদের ঋণভারের অন্যতম কারণ।
মালওয়া এলাকায় যত জমি লিজে পাওয়া যায় তার চেয়ে লিজ নিতে আগ্রহী প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা সংখ্যা বেশি। অন্য পেশা সুযোগ না থাকায় চাষ করাটা তাঁদের কাছে প্রায় বাধ্যতা। জমি লিজে নিতে হলে ছোট চাষিদের যেতে হয় বড় চাষিদের কাছে যারা নিজেরা আবার সাহুকার বা সুদখোর মহাজন। অনাদায়ী ঋণের কারণে এরাই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের বহু জমি ইতিমধ্যেই আত্মস্যাত করেছে। অন্যদিকে দোয়াবা হল পাঞ্জাবের এনআরই বেল্ট। এখানে এনআরআইদের এক লপ্তে বড় জমি লিজ পাওয়া যায় যার ভাড়া, মালওয়া অঞ্চলের তুলনায়, হেক্টর পিছু ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম। মাঝা অঞ্চলে আবার কৃষক পরিবারগুলির একাধিক সদস্য হয় বিদেশে, নয়ত সরকারি চাকরিতে কিংবা সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। তাঁদের একাংশ আয় নিশ্চিত। ফলে লিজের চাপ কম থাকায় এখানে জমির লিজ বাবদ দেয় টাকার পরিমাণও কম। তাছাড়া ছোট কৃষকেরা এখানে পাশাপাশি ডেয়ারি ও অন্যান্য বিকল্প ব্যবসা চালাতে পারেন। এখানে বছরে চাষ হয় তিনটে ফসল — গম, ধান ও সবজি। সব মিলিয়ে দোয়াবা ও মাঝায় কৃষকদের পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয়।
তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা জানাচ্ছে, মালওয়া এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকেরাই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষি ( সমীক্ষকদের হিসাবে, এঁদের জোতের আয়তন ১ থেকে ৫ একর)। এই তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে আত্মঘাতী কৃষকদের জেলাওয়াড়ি বিন্যাসকে। এই রাজ্যের মালওয়া অঞ্চলের আত্মঘাতী কৃষকদের ২২.৬৩ % সাঙ্গরুর জেলার, ২১.৩০ % মানসা জেলার, ১৭ % ভাটিন্ডা জেলার, ১১.৯৫ % বারনালা জেলার, ৯.৮৯ % মোগা জেলার এবং ৫.৪৬% লুধিয়ানা জেলার। এই জেলাগুলিতেই কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা বেশি। আত্মঘাতী কৃষকদের ২.৩৬% পাতিয়ালার, ৪.৪৭% মুক্তসর সাহিবের, ২.৩৯% ফরিদকোট ও ফিরোজপুরের। এখানেই আমরা মালওয়া অঞ্চলের এমন ১১টি জেলার নাম পেয়ে যাচ্ছি যেখানে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের আত্মঘাতী হওয়ার সংখ্যা নজর কাড়ার মতো। এছাড়া মাঝা অঞ্চলের অমৃতসর, গুরুদাসপুর, পাঠানকোট এবং তারন তারন জেলা এবং দোয়াবা অঞ্চলের জালন্ধর, কাপুরথালা, হোশিয়ারপুর ও নয়ানশহর জেলায় রয়েছেন পাঞ্জাবের মোট আত্মঘাতী কৃষকদের ২.৫৫% যাদের মধ্যে ১.৮১ % কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন কৃষিঋণ মেটাতে না পেরে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেসব কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন তাঁদের ৪৩.৮৪% প্রান্তিক কৃষক, ৩০.১২% ক্ষুদ্র কৃষক, ১৮% আধা–মাঝারি কৃষক, ৭% মাঝারি কৃষক এবং ১% বড় কৃষক। অর্থাৎ আত্মঘাতী কৃষকদের ৭৩.৯৬ শতাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র। আধা মাঝারিদের যোগ করলে সংখ্যাটা হয় ৯১.৯৬ শতাংশ।
এছাড়া পাতিয়ালার পাঞ্জাবি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক লখবিন্দর সিং এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাটিন্ডার গুরু কাশী ক্যাম্পাসের সমাজ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক বলদেব সিং শেরগিল আলাদা করে তাঁদের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, যদি ভূমিহীন কৃষক এবং লিজে জমি নিয়ে চাষ করছেন এমন কৃষকদেরও ধরা যায় তাহলেও কৃষক আন্দোলন চলাকালীন এক বছরে পাঞ্জাবে যতজন কৃষক শহিদ হয়েছেন তাঁদের জোতের গড় আয়তন দাঁড়াবে ২.৯৪ একর। আন্দোলন পর্বে মৃত ৬০০ জন কৃষকের মধ্যে ৪৬০ জন কৃষকের পরিবার ভিত্তিক সমীক্ষা চালিয়ে এই পর্যবেক্ষণে পৌঁঠেছেন তাঁরা। আবার এটাও দেখিয়েছেন যে কৃষক আন্দোলনে মালওয়া অঞ্চলের কৃষকদের অংশগ্রহণই ছিল সবচেয়ে বেশি।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে সবুজ–বিপ্লব সমৃদ্ধ পাঞ্জাবের ২৩টি জেলার মধ্যে ১৮টিতেই কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, কোথাও খুবই বেশি কোথাও কম। এবং আত্মঘাতী কৃষকদের মধ্যে শুধু প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা– মাঝারিরাই নেই, রয়েছেন মাঝারি এমনকি বড় কৃষকেরাও। নিঃসন্দেহে এ এক সর্বাত্মক কৃষি সঙ্কটের প্রতিফলন।
(এই অংশে উল্লিখিত তথ্য সমূহের সূত্র— 1. Modi is Wrong: Death Data Shows Protest Not of Big Farmers by Economist Lakhwinder Singh/Ajaz Ashraf, 17 Nov 2021 News Click.
2. Explained: Why is there a high rate of farmer suicides in Punjab’s Malwa?, Indian Express, 12 December, 2021. 3. Of The Dead at Protest 'Small Farmers' make the Big Chunk, The Wire, 10 November, 2021)
সারণি ৩
কৃষক আত্মহত্যা
রাজ্য ২০১৫ ২০১৬ কত শতাংশ বেশি
পাঞ্জাব ১২৪ ২৭১ ১১৮%
হরিয়ানা ১৬২ ২৫০ ৫৪.৩২%
(উল্লিখিত দুটি বছরেই সারা দেশের মধ্যে এই দুই রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। সংসদে প্রশ্নের উত্তরে দেওয়া তথ্য।)
যদি আমরা সবুজ বিপ্লবের আরেক সফল মডেল হরিয়ানার আত্মঘাতী কৃষকদের একটা ছবি নির্মাণের চেষ্টা করি তাহলে দেখব, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ওই রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ৫৪.৩২% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে হরিয়ানায় আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ছিল ২৮। ২০১৬ সালে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ৯১। ২০১৯ সালে এই রাজ্যে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০২। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ২৮০। তবে এঁদের সকলেই ছিলেন কৃষি মজুর। মনে রাখা দরকার এই বছরটা ছিল অতিমারী শুরুর বছর যখন মোদির কাণ্ডজ্ঞানহীন লকডাউনের সিদ্ধান্তে মুখ থুবড়ে পড়ে অর্থনীতি।
হরিয়ানার মত কৃষি–সমৃদ্ধ রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলাটা সেই একই সঙ্কটের প্রতিফলন। এখানে একটা মাত্র বছরের কিছু তথ্য উল্লেখ করে আমরা প্রবণতাটা বোঝার চেষ্টা করব। হরিয়ানায় জেলার সংখ্যা ২২। একটি হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে হরিয়ানায় আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ছিল ২৪। এই সব কৃষকেরা ছিলেন আম্বালা (২), ভিওয়ানি (৪), ফতেহাবাদ (৭), কারনাল (৩), কাইথাল (৩), সোনিপত (৩) সিরসার (২) বাসিন্দা। এখানেই আমরা দেখছি রাজ্যের ২২টি জেলার মধ্যে ৭টি থেকে কৃষক আত্মহত্যার খবর এসে পৌঁছেছে। আত্মঘাতী এই ২৪ জনের মধ্যে ১০০ জনই পুরুষ। আত্মঘাতীদের মধ্যে ৭.১৪ % কৃষক তপশিলি উপজাতিভুক্ত, ২১.৪৩ % ওবিসি এবং ৭১.৪৩ % সাধারণ কৃষক মানে বর্ণ হিন্দু কৃষক। ওই বছর আত্মঘাতী কৃষকদের ১৪.৩ % ছিলেন ক্ষুদ্র কৃষক যাদের জোতের পরিমাণ ০.১ থেকে ২.৫ একর। ২৮.৬ শতাংশ ছিলেন মাঝারি কৃষক যাদের জোতের আয়তন ৫ থেকে ১০ একর পর্যন্ত এবং ৫৭.১ শতাংশ বড় কৃষক যাদের জোতের পরিমাণ ১০ একরের বেশি। এই তিনপক্ষের গড় জোতের পরিমাণ ১৭.৯১ একর। (সূত্র- Farmer Sucide in Haryana, Agricultural Economics Research Centre, University of Delhi)
হরিয়ানায় কৃষক আত্মহত্যা সংক্রান্ত ২০১৫–এর তথ্যগুলি যদি শুধু খুঁটিয়ে দেখা যায়, তাহলে হরিয়ানার কৃষি সম্পর্কে যে বিষয়গুলি স্পষ্ট হচ্ছে —
সবুজ বিপ্লবের এই প্রদেশটিও কৃষকের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতার বাইরে নয়। অন্তত একটি বছরের নিরিখে দেখা যাচ্ছে এই রাজ্যে আত্মঘাতী কৃষকদের মধ্যে বড় কৃষকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরপরেই রয়েছেন মাঝারিরা। ক্ষুদ্র কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা হরিয়ানায় ওই বছর ছিল তুলনায় কম। সবচেয়ে বড় কথা, আত্মঘাতী কৃষকদের ২১.৪৩ % ওবিসি এবং ৭১.৪৩ % বর্ণহিন্দু। মনে রাখা দরকার, এরাই মোদির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভোটব্যাঙ্ক। এথেকেই বোঝা যায় সবুজ বিপ্লবের এলাকাগুলিতে বর্তমান কৃষিসঙ্কট কোথায় গিয়ে ধাক্কা মেরেছে। সঙ্কটের ধাক্কায় যা শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় চাষিদের থেকে সেটাই ২০২০ সালে ছড়িয়ে পড়ে ওই রাজ্যের কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে। এই রাজ্যের অন্যান্য বছরের আত্মঘাতী কৃষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রোফাইল বিশ্লেষণ করলে আরও আগ্রহ উদ্রেককারী তথ্য ধরা পড়তে পারে।
উত্তরপ্রদেশ
সবুজ বিপ্লবের আরেক কেন্দ্র উত্তরপ্রদেশের কৃষক আত্মহত্যার দিকে একবার নজর দেওয়া যেতে পারে। এই রাজ্যে অঞ্চল চারটি, পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও বুন্দেলখণ্ড। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলই কৃষিতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ।
ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯১৪ সালে উত্তরপ্রদেশে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ছিল ১৯২ জন। এঁরা ছিলেন দেশের মোট আত্মঘাতী কৃষকের ১.৫৫%। এই রাজ্যে বছরওয়ারি কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা এরকম— ২০০০ সালে ৭৩৫জন, ২০০৮ সালে ৭৫০ জন, ২০০৯ সালে ৭৪৫জন, ২০১১ সালে ৬৫৬ জন, ২০১২ সালে ৬৪৫জন এবং ২০১৩ ৭৪৫জন। মাঝের বছরগুলির সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে এনসিআরবি রিপোর্টে ২০১৪ সালে এই সংখ্যাটি ছিল মাত্র ৬৩ জন।
২০১৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, ওই সালে উত্রপ্রদেশে কৃষক আত্মহত্যাপ্রবণ জেলা ৪০টি। এর মধ্যে ওই বছর সবচেয়ে বেশি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে লখিমপুর খেরি ও ফতেপুর জেলায়। ওই বছর রাজ্যে আত্মঘাতী হন ৩২৪ জন কৃষক। জেলাওয়ারি আত্মঘাতী কৃষকের শতাংশ ছিল এরকম, লখিমপুর খেরি ২১.৩০%, ফতেপুর ১১.৪২% , মাউ ৮.৩৩%, কানপুর দেহাত ৭.৪১%, বাদায়ুন ৬.১৭%, গোরখপুর ৪.০১%, ললিতপুর ৩.৭০%, ঝাঁসি ৩.৪০%, বান্ডা ও হরদোই ৩.০৯%। জেলাভিত্তিক সংখ্যাটি এরকম— কনৌজে ৫, গাজিপুরে ২, জৌনপুরে ১, মির্জাপুরে ৪, আজমগড়ে ১, বালিয়ায় ২, মাউতে ২৭, গোরক্ষপুরে ১৩, কানপুর সিটিতে ১৫, লখনউয়ে ৩, উন্নাওতে ৮, সীতাপুরে ১, হরদোইয়ে ১০, লখিমপুর খেরিতে ৬৯, ফৈজাবাদে ৪, কানপুর দেহাতে ২৪, আম্বেদকার নগরে ১, বরাবাঁকিতে ২, আমেথিতে ২, গোন্ডায় ১, বলরামপুরে ১, ফতেহপুরে ৩৭, বারআইচে ৭, ঝাঁসিতে ১১, ললিতপুরে ১২, বান্ডায় ১০, বারাণসীতে ৭ ও চান্দৌলিতে ১ জন আত্মঘাতী হয়েছেন। (সূত্র— Farmer Suicides in Uttar Pradesh by Prof. Ramendu Roy Dr. H.C. Malviya. Haseeb Ahmad, Study Sponsored by Ministry of Agriculture and Farmers Welfare, Agro-Economic Research Centre, University of Allahabad)।
২০১৫ সালের হিসাবে দেখা যাচ্ছে কৃষিতে পিছিয়ে পড়া উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডের জেলাগুলি, যেখানে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানেই কৃষক আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। তবে পূর্বাঞ্চলের লখিমপুর খেরি, ফতেপুর ও কানপুর দেহাত জেলাতেও কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে গোটা রাজ্যে এগিয়ে লখিমপুর খেরি ও ফতেপুর। লখিমপুর খেরিতে কেন কৃষক আন্দোলন তীব্র হয় এবং কেন তা ভাঙতে জিপ চাপা দিয়ে কৃষকহত্যা করতে হয়, তা বোঝা যায় এই অঞ্চলের সঙ্কটগ্রস্ত কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যাধিক্য থেকে। আবার এই রাজ্যের কৃষিসমৃদ্ধ পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার মধ্যে ১১টিতেই ঘটছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা। এগুলি হল বুলন্দসর (২), গৌতমবুদ্ধ নগর (২), হাপুর (১), মুজফফরনগর (১), মোরাদাবাদ (৩), , সম্ভল (২), বাদায়ুন (২০), শাহজাহানপুর (৭), মথুরা (১), আলিগড় (২)ও কাসগঞ্জ (২)। মোট ৪৩ জন কৃষক আত্মঘাতী এই সব জেলায়। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের পিছিয়ে পড়া বুন্দেলখণ্ড এলাকা, মাঝারি উন্নয়নের এলাকা পূর্বাঞ্চল, কিংবা অতিসমৃদ্ধ পশ্চিমাঞ্চল— সর্বত্রই কৃষি সঙ্কটের ধাক্কায় কৃষকদের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আত্মঘাতী কৃষকদের মধ্যে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই রাজ্যে আত্মঘাতী মাঝারি বা বড় চাষিদের কোনও তথ্য এখনও আমাদের হাতে আসেনি। তবে ধরে নেওয়া যায় যে পশ্চিমের সমৃদ্ধ জেলাগুলির আত্মঘাতী কৃষকদের মধ্যে এদেরও খুঁজে পাওয়া যাবে।
কৃষক আত্মহত্যা ও কৃষিশ্রমিক
সবুজ বিপ্লবের তিন রাজ্যের কৃষি শ্রমিকেরা চলমান কৃষিসঙ্কটে কতটা বিপর্যস্ত সেবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এড়ানো হয়েছে নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র পাঞ্জাবের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করব। ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পাঞ্জাবে আত্মঘাতী কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৭৩০০ জন। এঁদের ৭৯ শতাংশ বা ৫৭৬৫ জনের আত্মহত্যার কারণ বিপুল ঋণভার। পাঞ্জাবে গড়ে একজন কৃষি শ্রমিক পরিবারের ঋণের পরিমাণ ৭৬,০১৭ টাকা। সেখানে আত্মঘাতী কৃষি শ্রমিক পরিবারের গড় ঋণের বোঝা ৯৪,৫৭৯ টাকা। এদের ৯২ শতাংশই ঋণ নিয়েছিলেন বড় কৃষক ও সুদখোর মহাজনের কাছ থেকে। ফলে ঋণের বোঝা কমাতে সরকারি সুযোগ সুবিধা তাঁরা পাননি। দেখা যাচ্ছে কৃষি শ্রমিকদের সঙ্কট এতটাই তীব্র যে, ২৩৮টি কৃষি শ্রমিক পরিবারের ২জন করে আত্মঘাতী হয়েছেন। ৩ জন করে আত্মঘাতী হয়েছেন এমন কৃষি শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৩০ এবং একই পরিবারের চারজন বা তার বেশি সদস্য আত্মঘাতী হয়েছেন এমন কৃষি শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৩। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রতি লক্ষ কৃষি শ্রমিক পরিবার পিছু আত্মঘাতীর সংখ্যা এরকম — সাঙ্গরুরে (২০.৮০ জন), বারনালায় (১৯.০৫ জন), মানসা (১৮.৬২ জন) এবং লুধিয়ানায় (৫৬.৫২ জন) (সূত্র—Agrarian Crisis and Agricultural Labourer Suicides in Punjab। সমীক্ষাটি করেছেন পাঞ্জাব এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সুখপাল সিং, মনজিৎ কৌর ও এইচ এস কিংরা)। এই তথ্যগুলি থেকে পাঞ্জাবে কৃষি শ্রমিকদের সঙ্কটের তীব্রতার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।
কয়েকটি পর্যবেক্ষণ
আমরা এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাব। গোড়াতেই বলা হয়েছিল, সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনকে বড় চাষিদের সরকারি ভর্তুকির সুবিধা বজায় রাখার আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে খুবই সুপরিকল্পিত ভাবে। ভাবখানা এমন যেন, ছোট কৃষকদের জন্য সরকারের তরফে যে সব সুবিধা চালু রয়েছে তা আসলে ভোগ করছে শুধু বড় পুঁজিবাদী চাষিরা। তারাই নিজেদের চলতি সুবিধা বজায় রাখার জন্য পিছন থেকে মদত দিয়ে এই আন্দোলনকে জারি রেখেছে। এবং যদি এখনকার কৃষি ব্যবস্থাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে মোদির আনা কৃষি আইন চালু করে দেওয়া যায় তাহলে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা–মাঝারি কৃষকদের সংসারে দুধ ও মধুর স্রোত বয়ে যাবে। এবং সেই আনন্দযজ্ঞে নেতৃত্ব দেবে আদানি–আম্বানিদের মতো কর্পোরেট গোষ্ঠী।
এদেশে কৃষি সঙ্কটের উৎস কী, কেন কৃষক আন্দোলনের এই বিস্তার এবং কী তার চরিত্র—এগুলো এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। একথা এখন সর্বজনবিদিত যে, নয়া উদারবাদী অর্থনীতি ইতিমধ্যেই এদেশের চলতি কৃষি ব্যবস্থার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। এবার সরকার ও কর্পোরেটের লক্ষ্য হল ভঙ্গুর পুরোনো ব্যবস্থাকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে তার বদলে কৃষি ও কৃষককে পুরোপুরি নিঃস্বকরণের এক নয়া প্যাকেজ চালু করা। অন্যদিকে কৃষকেরা চান রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নির্ভর যে ব্যবস্থা এখনও চালু রয়েছে তাকে আরও শক্তপোক্ত করা এবং স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে এমন এক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যা রক্ষা করবে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, আধা–মাঝারি কৃষকদের। এটাই হল কৃষক আন্দোলনে দুই লাইনের লড়াই। কেন কৃষিকে টেকাতে হলে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ জরুরি, কেন ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা জাপানের মতো উন্নত দেশগুলি কৃষিতে বিপুল সরকারি ভরতুকি চালু রাখতে বাধ্য হয়েছে, সেই বিষয়টি বহু আলোচিত একটি প্রসঙ্গ। সরকারি হস্তক্ষেপ প্রত্যাহার করে কৃষিকে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে কী হতে পারে, সেনিেয়ও বহু আলোচনা হয়েছে। পুঁজি বিনিয়োগ করে কৃষি থেকে শিল্পের সমান মুনাফা যেহেতু কখনই আসবে না, তাই পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক কিংবা মিশ্র অর্থনীতির কৃষিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বলা যায় বাধ্যতামূলক। কৃষিকে ঘিরে সংঘাত চলতেই থাকবে।
আমরা সাধারণ ভাবে এদেশের কৃষিতে এবং বিশেষভাবে সুবজ বিপ্লবের পীঠস্থান যে তিন রাজ্য— পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কৃষিতে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, আধা–মাঝারি কৃষকদের গুরুত্ব ও তাদের সংকটের একটা চেহারা (সঙ্কটের উৎস নয়)তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তথ্য থেকে এটাও দেখা গেছে যে মাঝারি ও বড় কৃষকেরাও এই সংকটের বাইরে নয়। সেকারণেই সাম্প্রতিক আন্দোলনে সমগ্র কৃষক সমাজ, নীচুতলা থেকে ওপরতলা, পর্যন্ত একটা সূত্রে গ্রথিত হতে পেরেছিল। সকলকে নিয়ে সেই সুতো বাঁধার কাজটা যদি করে থাকেন কৃষক আন্দোলনের নেতারা, তবে আন্দোলনের কাঠামোয় প্রাণ সঞ্চার করেছেন হাজার হাজার ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, আধা–মাঝারি কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকেরা। দেড় বছর ব্যাপী কৃষক আন্দোলনে একটানা যে এত লোক, সমর্থক, স্বেচ্ছাসেবীদের ধারাবাহিক স্রোত দেখা গেছে এবং সব ধরনের গরিব মানুষকে এতে যুক্ত করা হয়েছে, এই কাজটা আসলে নিঃশব্দে করে গেছেন মূলত ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, আধা–মাঝারি কৃষক ও কৃষি শ্রমিকেরাই। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, প্রবল ঠাণ্ডায় মৃত্যুবরণ করেছেন এদেরই ৭০০ জন সহযোদ্ধা। তাই যাঁরা কৃষক আন্দোলনকে শুধুমাত্র বড় কৃষকদের আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করতে চাইছেন, এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও গভীরতা তাঁদের নজরেই পড়েনি।
এই নিবন্ধ রচনায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে বিশেষ সহযোগিতা করেছেন অর্থনীতির অধ্যাপক নির্মলেন্দু নাথ।