বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
সম্প্রতি সুইস কোর্ট ভারতীয় শিল্পপতি অজয় হিন্দুজার পরিবারের চার জনকে কারাবাসের সাজা শুনিয়েছিল। অভিযোগ, এরা জেনিভাতে নিজেদের প্রাসাদোপম বাংলোয় কাজের জন্য তিন জন কর্মীকে ভারত থেকে এনেছিলেন। সুইৎজারল্যান্ডের নিয়ম না মেনেই। কর্মীরা সেখানকার নির্ধারিত বেতন পেতেন না। দিনে আঠারো ঘণ্টা তাদের কাজ করতে হত। বসবাসের নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। বাংলোর করিডরে রাত কাটাতে হতো। সর্বোপরি তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হতো। এরা যাতে পালাতে না পারে, সে জন্য তাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়।
কর্মীরা ভাষা জানেন না। সেই সুযোগে এই কাণ্ড করত হিন্দুজা পরিবার। তাই বাবা-মা ও স্ত্রী সহ অজয় হিন্দুজাকে মানুষ পাচারের অভিযোগে কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছিল সুইৎজারল্যান্ডের কোর্ট। পরে অবশ্য ভারতে এই কর্মীদের সঙ্গে চুক্তি দেখিয়ে মানুষ পাচারের অভিযোগ থেকে তারা ছাড় পান। কিন্তু বাকি সব অভিযোগের জন্য মোটা টাকা জরিমানা দিতে হয়।
ভাল রোজগারের আশায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে বহু মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন উন্নততর দেশগুলোয়। শপিং মল ক্লিনিং, গাড়ি ধোওয়া, ক্ষেত খামারে কাজ বা বাড়িতে পরিচারকের কাজের জন্য বিদেশে শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। জোগান দিতে গজিয়ে উঠেছে বহু সংস্থা। যাদের অনেকেই নথিভুক্ত নয়। এদের হাত ধরেই ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলংঙ্কা বা আফ্রিকান দেশগুলো থেকে বহু নারী ও পুরুষ শ্রমিক বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। মোটা টাকা গচ্ছা দিয়ে। জমি-বাড়ি বন্ধক রেখে বা দেনা করে। কিন্তু বিদেশে গিয়ে বহু শ্রমিকের মোহভঙ্গ হচ্ছে।
সম্প্রতি উত্তর ইতালির একটি ফার্ম হাউজ থেকে ইতালির পুলিশ উদ্ধার করে কয়েক ডজন শ্রমিককে। দুই ভারতীয় এজেন্ট তাদের আশ্বাস দিয়েছিল ভাল কাজ ও উন্নত ভবিষ্যতের। ইতালিতে কাজের অনুমতি ও আসার খরচ বাবদ ১৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিল এই শ্রমিকরা। আসার পরই এদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। আঙ্গুরের ক্ষেতে এদের কাজ করতে হতো দিনে ১০ ঘণ্টারও বেশি। সপ্তাহে সাত দিন। কোনও ছুটি নেই। পারিশ্রমিক সামান্য। সে টাকা ইতালি আসতে যে টাকা ধার করতে হয়েছিল, তা শোধ দিতেই চলে যায়!
ইতালিতে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন আঙ্গুরের ক্ষেত ও গ্রিনহাউসে। প্রায়ই এদের কাজের কোনও চুক্তি থাকে না। কয়েক বছর আগে এক মহিলা শ্রমিক ১২ ঘণ্টা এক টানা আঙুর তোলা ও বাছাইয়ের পর মারা যান। ইতালিতে গ্যাংমাস্টার সিস্টেম (ক্যাপরোলাতো) অনেক দিন ধরে চলছে। যেখানে মিডলম্যান বেআইনি ভাবে শ্রমিকদের ভাড়া করে খুব কম বেতনে কাজ করায়। ইটালিয়ান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ইতালিতে এই পদ্ধতিতে প্রচুর শ্রমিক নিযুক্ত হয়েছে চাষের ক্ষেতগুলোতে।
যাদের উদ্ধার করা হয়েছে, প্রতিদিন সকালে তাদের ফলের ঝুড়ি, বাক্স ইত্যাদির সঙ্গে একটি গাড়িতে তুলে ক্ষেতে আনা হত। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে এদের ভাঙাচোরা স্যাঁতস্যাতে ঘরে এক সঙ্গে অনেককে রাখা হয়েছিল। উদ্ধারের পর এরা পাসপোর্ট হাতে পেয়েছে। তাদের দুই গ্যাংমাস্টারকে ধরা হয় ৪২ হাজার পাউন্ড সহ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও পরিযায়ী শ্রমিকদের চাহিদা তুঙ্গে। পাল্লা দিয়ে শ্রমিকও মিলছে। এরাও বেশির ভাগই কোনও সংস্থার মাধ্যমে আসেন দুই বছরের ভিসায়। যে পরিমাণ পারিশ্রমিক বা সুযোগসুবিধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদের আনা হয়, বেশির ভাগ সময়ই তা মেলে না। এই দুই বছর তারা দেশে যেতে পারে না। মুর্শিদাবাদ থেকে ইমদাদ আলি এসেছিলেন ছয় বছর আগে আবু ধাবিতে। ৮০০ দিরাম বেতনে (ভারতীয় মুদ্রায় ১৬,০০০ টাকা) গাড়ি ধোওয়ার কাজ করতেন একটি আবাসনে। বিকেল তিনটেয় আরও অনেক শ্রমিকের সঙ্গে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে আসতেন কর্মস্থলে। রাত ভর কাজ। ঘরে ফিরতে সকাল আটটা। দুই বছর কাজের পরও ইমদাদের বাড়ি যাওয়ার ছুটি মেলে না। অনেক বলেও ছাড়া পায় না কোম্পানি থেকে। এদিকে কোম্পানি ছাড়লে চুক্তিমতো বিমান ভাড়া মিলবে না। যা জোগার করা এই শ্রমিকদের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য। আরও বছর খানেক এ ভাবে চলার পর ছুটি যখন মিলল, তখন বিশ্ব জুড়ে করোনা থাবা বসিয়েছে। ফলে আটকে যায় ইমদাদের বাড়ি ফেরা।
দুই বছর একটানা কোম্পানির কাজ করতে না পেরে অনেকে হঠকারি করে কাজ ছেড়ে দেন। কোম্পানিও ততক্ষণাৎ তাদের ভিসা বাতিল করে। ভিসা বিহীন অবস্থায় বিদেশে কাজ মেলে না। পড়ে যান আইনি জটিলতায়। মোটা টাকা জরিমানা দিতে হয়। তবে ওমান, দুবাই বা আবু ধাবির মতো জায়গায় অনেক শ্রমিকই বছর দুয়েক কোম্পানিতে কাজের পর নিজের ভিসা নিজেই ব্যবস্থা করেন। এর পর পরিচারকের কাজ নেন। এ ভাবে কাজ মিললে তাদের এক রকম চলে যায়। দেশের ধার দেনা মিটিয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু কাজ না মিললে আতান্তরে পড়েন। সম্প্রতি ‘আদুজিভিথাম- দ্য গোট লাইভ’ নামের একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। যাতে দেখা গেছে সৌদি আরবে এক ভারতীয় শ্রমিকের দাসত্বের জীবন।
এ তো গেল বিদেশে যারা পাড়ি দিচ্ছেন সে সব পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা। কম মাইনেতে দীর্ঘ সময় কাজ করানোর ছবিটা দেশের মধ্যেও একই রকম। আসামের তেজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণী উর্মি এক সংস্থার মাধ্যমে পরিচারিকার কাজ পেয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে। চুক্তিমতো প্রতি মাসে তার ১৮০০ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু সে টাকা উর্মি চোখে দেখে না। ভোর পাঁচটায় দিন শুরু করে রাত এগারোটায় কাজ শেষ হত উর্মির। দিনভর খাটুনির পর জুটত মনিব দম্পতির মুখ ঝামটা এমনকী মারধোরও।
দু’বছর ভয়ে ভয়ে উর্মি এভাবেই কাটায়। পরে ডোমেস্টিক ওয়ার্কার রাইটস ইউনিয়নের সাহায্যে পুলিশে অভিযোগ জানায় ও একটি হোমে জায়গা পায়। উর্মিকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু আইনি জটিলতা সে বেশি দিন টানতে না পেরে কোর্টের বাইরে মনিব দম্পতির সঙ্গে একটি সমঝোতা করে নেয়।
এটা শুধু উর্মির একার গল্প নয়। শয়ে শয়ে পরিযায়ী শ্রমিক যারা পরিচারিকার কাজ করতে আসে তাদের অনেকের অবস্থা কম-বেশি একই রকম। পরিচারিকা নিয়োগকে কেন্দ্র করে চলে এক মাফিয়া চক্র। কখনও এদের কাজের জন্য এনে যৌন ব্যবসায় লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই শ্রমিকরা বেশির ভাগই আসেন উত্তর ভারত, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। এদের কোনও সামাজিক নিরাপত্তা নেই সরকার বা যারা এদের নিযুক্ত করছে তাদের থেকে।
ডোমেস্টিক ওয়ার্কার রাইটস ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক গীতা মেনন জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ পরিযায়ী শ্রমিক মূলত দলিত ও আদিবাসি সম্প্রদায়ের। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে ২৭%-এর বেশি এ ধরনের ট্রাফিকিং হয় নিচু জাতের মধ্যে।
পরিচারিকাদের কাজের সমস্যার সুরাহা করাও খানিকটা জটিল বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ গৃহ অভ্যন্তরে মনিব ও পরিচারকের সম্পর্ক অনেকটাই ব্যক্তিগত। আর বাড়ির কাজকে ঠিক কর্মক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাই সেখানে পরিচারককে কাজ করতে গিয়ে কী সমস্যার সন্মুখিন হতে হচ্ছে, তার সুরাহা করা সমস্যা। অথচ এখানে কাজ করিয়ে পারিশ্রমিক না দেওয়া, অতিরিক্ত সময় কাজ করানো ও হিংসারর সমস্যা প্রবল।
সবচেয়ে বড় সমস্যা এরা নথিভুক্ত কর্মী নয়। এদের সম্বন্ধে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাই প্রমাণও থাকে না। চুরি বা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ হলে তা প্রমাণ করা যায় না। এদের উদ্ধারের পর মূল কাজ হয়ে যায় এদের ট্রমা থেকে বের করা। সঙ্গে এদের আইনি সাহায্য দেওয়া। শ্রীমতি মেনন জানাচ্ছেন, প্লেসমেন্ট এজেন্সিগুলো লেবার ডিপার্টমেন্টে নথিভুক্ত নয়। তাই তাদের বিরুদ্ধেও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
তবে আশার আলো, ভারতের কিছু রাজ্য পরিচারকদের সুরক্ষার জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। তামিলনাড়ু পরিচারকদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি করেছে। মহারাষ্ট্র এদের কর্মী হিসিবে চিহ্নিতকরণের জন্য এদের নথিভুক্ত করণ শুরু করেছে। এখন দেখা যাক, পরিচারকদের সুরক্ষার জন্য বাকি রাজ্যগুলো কত দিনে পদক্ষেপ নেয়।