বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
সব যুদ্ধই জেতার জন্য লড়া হয় না। না লড়ে পারা যায় না বলেও যুদ্ধে নামতে হয়। সেই তাড়নায় সম্প্রতি আদালতের দ্বারস্থ হলেন এক বাঙালি মেয়ে। মেয়েটি ব্যতিক্রমী নয়— মধ্যবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, মাঝবয়সী জননী। অমন মেয়ে অনেক আছে। ধরা যাক, তাঁর নাম অমৃতা (সত্যি নাম নয়)। যাঁর বিরুদ্ধে অমৃতার নালিশ, তেমন শ্বশুর-খুড়শ্বশুরও কম নেই। এঁরা বাঁকা কথা, চোখা মন্তব্যে বিঁধতে সিদ্ধহস্ত, বৃহৎ পরিবারে মেয়েদের ‘শাসন’ করে রাখার দায়িত্ব আগ বাড়িয়ে নেন এবং অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সঙ্গে পালন করেন।‘অকারণ ঝামেলা’ এড়াতে মেয়েরা এঁদের পাশ কাটিয়ে যায়, আড়ালে চোখের জল ফেলে, নিজেই নিজেকে প্রবোধ-সান্ত্বনার কাঁথা-কম্বল জোগায়, কষ্টগুলোকে চাপা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। তবু এক এক দিন, এক এক জীবনে, সেই সব ভনিতা ঠেলে ফেলে নিজের অবমানিত সত্তা অতৃপ্ত শবের মতো গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। আকাশ-পাতাল হাঁ করে বীভৎস চিৎকারে বিচার দাবি করে। তখন ছোটাছুটি পড়ে যায়— কোথায় পুলিশ, কোথায় আদালত, কোথায় গেল সেই লোকটা, ধরে আনো তাকে।
আদালতে অমৃতা জানিয়েছেন, তিরিশ বছর আগে বৃহৎ যৌথ পরিবারে নতুন বউ হয়ে ঢোকার পর থেকেই এই সম্পর্কিত শ্বশুর নিত্য তাঁর প্রতি কুৎসিত, যৌন-ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য করতেন। পরিবারের সব মেয়ে-বউদের প্রতিই করতেন, তবে নতুন বউটি বিশেষ লক্ষ্য হয়েছিল কারণ সে সালোয়ার-কামিজ় পরতো,এবং তার ছেলে বন্ধুরাও বাড়িতে দেখা করতে আসত। অশ্লীল শব্দ, কদর্য ইঙ্গিত, শোওয়ার ঘরের সামনে পাহারার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা, এই সব ছিল প্রৌঢ়ের হাতিয়ার। ‘রাস্তার মেয়ে’, ‘লাইনের মেয়ে,’ ‘ঘর করার মেয়ে নয়,’— এ শব্দগুলো রোজ বিদ্ধ করত অমৃতাকে। এক দশকেরও বেশি ওই বাড়িতে বাস করেছে মেয়েটি, সন্তানের জন্ম দিয়েছে,এই ’কঠোর শাসন’ (শাশুড়ির ভাষায়) কমেনি, বরং বেড়েছে।
কর্মসূত্রে অন্য রাজ্যে যাওয়া সেই পর্যায়ের যবনিকা টেনে দিয়েছিল। দীর্ঘ আঠারো বছর পরে সম্প্রতি পারিবারিক বিবাহ অনুষ্ঠানে সপরিবারে গিয়েছিলেন অমৃতা। সেখানে মুখোমুখি হওয়া মাত্র সর্বসমক্ষে সেই বৃদ্ধ ফের কুৎসিত বাক্য, কদর্য ইঙ্গিত এবং ক্রূর দৃষ্টি দিয়ে ‘অভ্যর্থনা’ করেন বধূকে। মুহূর্তে ফের বাক্যহারা হয়ে যায় মেয়েটি, যেন অসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং পর দিন সকালে স্থির করে, পুলিশে যাবেন। “আমার উপরে এবং আমার শ্বশুরবাড়ির পরিবারের বহু মহিলার উপরে হয়ে চলা এই যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মানসিক নির্যাতন ও প্রকাশ্যে চূড়ান্ত অসম্মানের প্রতিবাদ ও মূলোচ্ছেদ করার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই,” আদালতে পেশ করার জন্য নিজের বয়ানের মুসাবিদায় লিখেছেন অমৃতা। উকিলের পরামর্শ ছিল, বিচারকের কাছে বক্তব্যে করুণ, তীব্র সুর লাগাতে। অমৃতা কিন্তু স্থির করেছেন, যা ঘটেছে, তা-ই বলবেন। তাঁর আক্ষেপ, “সে দিন যদি বাড়ির বড়রা আমার পাশে দাঁড়াতেন, তা হলে আজ আমাকে এখানে দাঁড়াতে হত না।”
এ ঘটনা যত সাধারণ, ততই অ-সাধারণ। নির্যাতিত, বিতাড়িত, পরিত্যক্ত, নিঃস্ব, ক্ষতবিক্ষত, নিহত বধূদের মামলায় আদালতে যখন ফাইলের পাহাড়, তখন একটি মেয়ে এজলাশে দাঁড়িয়ে না করছে খোরপোষের দাবি, না ধরেছে প্রতিপক্ষকে জেলে পাঠানোর জেদ। কেবলই প্রতিবাদ করতে অমৃতার আদালতে আসা। মনে হতে পারে, বুড়োকে আচ্ছা করে দু’কথা শুনিয়ে দিলেই তো হয়। আঠারো বছর আগে কী হয়েছিল, তা নিয়ে আজ উকিলের পয়সা গোনার কী মানে হয়?
হয়তো দেশের কাছে এই মামলার মানে এখানেই যে, হিংসার অর্থ নিয়ে তা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ‘হিংস্র গৃহকোণ’ (দ্য ভায়োলেন্ট ডোমেস্টিক, জ়ুবান) নামে সদ্য-প্রকাশিত বইতে লেখকরা বলছেন, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮-ক ধারা ‘নারীহিংসা’ বলতে বোঝে এমন গুরুতর শারীরিক বা মানসিক আঘাত, যা জীবনের আশঙ্কাও তৈরি করতে পারে। কোনও এক দিনের ঘটনা, বিশেষত মারধরের ঘটনাই ধরা হয় আদালতে, কারণ তার ‘নৈর্ব্যক্তিক’ বা ‘বৈজ্ঞানিক’ মাপজোক চলে— ক’টা হাড় ভেঙেছে, ক’টা স্টিচ দিতে হয়েছে, কত টাকা চাওয়া হয়েছে পণে। অথচ, অধিকাংশ মেয়ের উপর দৈনন্দিন পীড়ন চলে বাক্যে, ইঙ্গিতে। যেহেতু গৃহকোণে শান্তি-সুখ বজায় রাখাই মেয়েদের কর্তব্য, তাই তা নিয়ে ‘অশান্তি’ কেউ সহ্য করে না, মেয়ের নিজের বাবা-মাও তার উপর বিরূপ হয়। পীড়ন আর নীরবতা, এ দুটো একে অপরকে ঘিরে চলে। কেবল সাহিত্যের উপকূলে বার বার ফেনা তুলে আছড়ে পড়ে কষ্টের ঢেউ। জ্যোতির্ময়ী দেবী (১৮৯৪-১৯৮৮) বালিকাবধূ হয়ে রাজস্থান থেকে এসেছিলেন হুগলিতে, বহু যন্ত্রণা সয়েছেন, পঁচিশ বছরে মুক্তি দিয়েছিল বৈধব্য। লিখছেন, “জীবনের শেষ সীমায় এসে মনে হচ্ছে, তাঁরা একটু সদয়, একটু সহৃদয় ব্যবহার করলে সেই বালিকা-বধূটি কৃতার্থ হয়ে যেত। আর দেখছি জীবনের কোনও দাগই মুছে যায় না। যে দাগ কুটিল ও অসৌজন্যের দাগ। কোনও বিশেষ অত্যাচারময় ব্যবহার নয়। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হীনম্মন্যের ব্যবহারমাত্র। যা না করলে কোনও পক্ষেরই কোনও ক্ষতি ছিল না (স্মৃতি-বিস্মৃতির তরঙ্গ)।”
সংসারে দাঁড়িয়ে এমনই মনে হয় বটে— কী ক্ষতি হতো যদি শ্বশুর কদর্য ইঙ্গিত না করতেন, শাশুড়ি কথায় কথায় খুঁত না ধরতেন? যদি ঠাঁই-নাড়া, অসহায়, ভীত একটি মেয়েকে কথায় কথায় বিনা অপরাধে শাস্তি না দিতেন? রাষ্ট্র আর সমাজের চৌরাস্তায় এসে দাঁড়ালে অবশ্য বোঝা যায়, অকারণে অমানবিক না হলে অর্ধেক মানুষকে ‘মেয়ে’ করে রাখা চলে না। হীনতার বোধ মেয়েদের মনে না ঢুকিয়ে দিলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তার উপায় হল বিষ-মেশানো তিরের মতো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে চোবানো বাক্যবাণ, যা মেয়েটির ভিতরটাকে একটু একটু করে নির্জীব করে তোলে। নারীবাদী লেখক রুক্মিণী সেন বলছেন, কষ্ট (‘সাফারিং’) মানুষের ভাষা কেড়ে নেয়, তারপর ব্যক্তিত্বের বোধকেও কেড়ে নেয়। নীরবে মেনে নাও, এ কথা বলার মানে আসলে দুটো দাবি করা— তোমার শরীর-মনের উপর আঘাত মেনে নাও, আর তা নিয়ে মুখ খোলার স্বাধীনতা যে তোমার নেই, তা-ও মেনে নাও। এর পর আর একটাই দাবি করা যায়, নীরব মৃত্যু।
অমৃতা আদালতে গিয়েছেন শুনে ননদ তাকে প্রশ্ন করেছে, ‘কী এমন বলেছে তোমায়?’ এর উত্তর হয় না, কারণ মেনে না-নেওয়ার মতো কোনও কথা থাকতে পারে, সংসার তা মানে না। সংসার নামক ইমারতটি তৈরিই হয়েছে ‘হীনম্মন্যের ব্যবহার’ দিয়ে। এই দৈনন্দিন হিংসা কেবলমাত্র কিছু নিষ্ঠুর লোকের বিকৃত আচরণ নয়, পুরুষতন্ত্রে এটা অবধারিত এবং অনিবার্য, আশি-নব্বইয়ের দশকে ভারতে নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ এ কথাই বলেছিল। তাই যৌথ পরিবার ছাড়ার আঠারো বছর পরে নিজের কষ্টকে ‘সত্য’ বলে দাবি করে, কষ্ট দেওয়াকে ‘অপরাধ’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে আদালতে দাঁড়িয়েছে যে মেয়ে, সে কেবল শরণাগত নয়। সে আইন-আদালতের পরীক্ষকও বটে।
‘মারেওনি, ধরেওনি, কেবল দুটো কথা শুনিয়েছে,’ হিংসার এই ধারণা থেকে কি বেরোতে পারবে ভারতের আদালত? হিংসার ক্ষতচিহ্নের পরিমাপ থেকে বেরিয়ে যদি হিংসার উদ্দেশ্যের বিবেচনাকে আনা যায় বিচারের কেন্দ্রে, যদি ভাবা যায়, প্রতি দিন অগণিত বাক্যের আঘাত দিয়ে আসলে কোন লক্ষ্য সাধন করতে চায় পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, তা হলেই বধূর প্রতি বর্ষিত বাক্যযন্ত্রণার প্রকৃত তাৎপর্য এবং ভয়াবহতা স্পষ্ট হবে। রামমোহন রায় দেখিয়েছিলেন, সতীদাহ প্রথার শিকড় রয়েছে বধূকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চনার কদর্য ইচ্ছায়। বাক্যযন্ত্রণার মূলও সেখানেই — নিজের প্রাপ্য সুযোগ, সম্পদ, সম্মান দাবি করার কথা একটি মেয়ে যাতে চিন্তাও না করতে পারে, সেই উদ্দেশেই প্রতি দিন বাক্যবাণে তাকে অকারণে বিদ্ধ করে তার মনোবল ভেঙে দেয় পরিবার। মেয়েদের উনমানব করে রাখার এই হিংস্র প্রচেষ্টাকে কোনও মতেই তুচ্ছ বলে দেখা চলে না।